‘জলির পাড়‘ গ্রামের সোনালী অতীত
পঞ্চাশ বছর আগেও এদেশের অনেক গ্রাম ‘ঝুমঝুমি’ করতো উৎসবে, পালা, পার্বনে। আর কিছু না হোক, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, পৌষ মাঘে যাত্রাপালা – এসব তো নিজের চোখে দেখা।
এখনো হয়, হাজার গ্রামের এক গ্রামে হয়তো ধরে রেখেছে। অবশ্য নুতন অনেক বিনোদনের যা আগে ছিলো না।
এমনই এক গ্রামের ‘ঝুমঝুমি’ পর্বের সন্ধান পাওয়া গেলো একজনের চমৎকার এক মন্তব্য থেকে। গ্রামটির নাম জলিরপাড়। মাদারীপুরের রাজৈরের প্রান্তসীমায়, গোপালগঞ্জে।
এখন এই নামে আছে কিনা কে জানে। থাকলেও নিতান্তই অচেনা অজানা যদিও পাকা সড়ক আর বিদ্যুৎ হয়তো চলে গেছে আরদাশটা গ্রামের মতো। কিন্তু কুড়ি বছর আগেওতো এমন সড়ক বা বিদ্যুৎ যায়নি এমন প্রত্যন্ত গ্রামে।
কিন্তু অর্ধ শতাব্দী আগে অপারেশন হতো সেই গ্রামের এক হাসপাতালে। মিশনারী হাসপাতাল। সাহেব ডাক্তার ছিলেন এইহাসপাতালে।
জানার নাঝে চন্দ্রঘোনাতেও ছিলো এমন একটি খ্যাতনামা মিশনারী হাসপাতাল।
মন্তব্যকারী গৌতম সাহা নিজেও একজন চিকিৎসক । এখন বসবাস পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে। জন্ম হয়েছিলো এদেশেরমাদারীপুরের রাজৈর গ্রামের সাহাপাড়ায়।
তাঁর তিন ভাইয়ের অপারেশন হয়েছিলো জলিরপাড়ের এই মিশনারী হাসপাতালে। অনুমান করি স্বাধীনতার আগে পরে কোনএক সময়। কারণ গৌতম সাহার জন্ম ১৯৬২ সালে।
হাসপাতালে সাহেব চিকিৎসক ছিলেন। তবে এই অপারেশন করেছিলেন ডাঃ লক্ষীকান্ত কীর্তনীয়া।
হোসেনপুরের ‘হাজি বাড়ি’ (আগের ‘ভুঁইয়া বাড়ি’) নিয়ে তিনদিন আহে করা আমার পোস্টে তাঁর মন্তব্য থেকে পাওয়া যায় চমকপ্রদআরো সব তথ্য। পুরো মন্তব্যটি তুলে ধরছি পাঠ করার জন্য –
“মাদারীপুর এখন বাংলাদেশের একটি জেলা। আর রাজৈর মনে হয় থানা।
আজ থেকে ষাট বছর আগে আমি যখন জন্মেছি তখন রাজৈর থানা থাকলেও মাদারীপুর ছিল মহকুমা। এর অধীনে অনেকগুলিথানা ছিল। রাজৈর তার মধ্যে একটি। এই গ্রামেই আমার জন্মভিটে। এখনও আছে। সাহাপাড়ায়। প্রায় সত্তর ঘর সাহা একসঙ্গেবাস করত।
বলতে গেলে সকলেই ব্যবসায়ী। বৈশ্য। কারও কাপড়ের আবার কারও মিষ্টির। আমার ঠাকুরদা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। বাবাপ্রথম দিকে পাঠশালার শিক্ষক ছিলেন। নিজেরই পাঠশালা। পরে গ্রামীন চিকিৎসক হন। ওঁর কাছে হোসেনপুরের নাম শুনেছি। যেমন শুনেছি, কালকিনি, বরমগঞ্জ, ঘাঘর, কুলপদ্দি এই সব জনপদের কথা।
জলিরপাড় নামে একটি জায়গা আছে। সেখানে আছে একটি মিশনারি হসপিটাল। আড়িয়াল খাঁ নদের পাড়ে। একটা বড় বাঁধতার পাশেই এই বিখ্যাত হাসপাতালটি। সাহেব ডাক্তার ছিলেন। ছিলেন ডাঃ লক্ষ্মীকান্ত কীর্তনীয়া। উনি আমাদের তিন ভাইয়েরঅপারেশন করেছিলেন।
জলিরপাড়ে দুর্গাপুজোর দশমীতে বিশাল নৌকাবাইচ হতো। একবার দেখতেও গিয়েছিলাম।
আড়িয়াল খাঁ–র শাখা নদ কুমারের পারেই ছিল আমাদের গ্রাম রাজৈর। ”
এখানেই শেষ নয়, নিজ মাতৃভূমি নিয়ে নিজের টাইমলাইনে করা গৌতম সাহার অনবদ্য একটি পোস্টও দেয়া হলো নীচে।
“বলি
****
গৌতম সাহা
সকাল হলেই একটা উদ্দাত্ত কন্ঠের আওয়াজ কানে ভেসে আসত, মা, আনন্দময়ী মা।
ধরণী সা–র এই ধ্বনিতে সাহাপাড়া জেগে উঠত।
রাজৈর গ্রামে সাহাপাড়ায় প্রায় সত্তর ঘর সাহা সম্প্রদায়। বৈশ্য সাহা। পেশা—- ব্যবসা। কেউ কাপড়ের, কেউ মিষ্টির।
আমাদের ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ঠাকুরদা করতেন। পরে বাবা প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করলেও পরে ডাক্তারীকে পেশা করে নেন।
প্রায় সকলের বাড়ি টিনের–কাঠের। দু –তিনটে দালান–কোঠা ছিল। তার মধ্যে একটা ধরণী সা–র আর একটা গোকুল সা–র।
ধরণী সাহার উত্তরে ভিটে দালান। পূব ভিটেতে বিশাল মন্ডপ। দুর্গাপুজো, কালিপুজো হতো।
দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন পাঁঠা বলি হত ধুমধাম করে। বলি দেখতে যেতাম।
একটা অবোলা জীবকে চান করিয়ে, তেল সিঁদুর মাখিয়ে, কাঠগড়ায় গলা ঢুকিয়ে খিল আটকে দিয়ে বন্দি করা হত। তারপরএকজন প্রাণিটির পেছনের পা দুটো টেনে ধরত এবং আর একজন খাঁড়া হাতে
” জয় মা ” বলে এক কোপে ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দিত। ভয়ে–ভক্তিতে দেখতাম বটে, তবে মোটেই ভাল লাগত না।
************
উনিশশো একাত্তর সাল। পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের ডাকে পূর্ব বঙ্গ স্বাধীনতার জন্য উত্তাল। মুক্তিযুদ্ধে মুসলিম হিন্দু সব ধর্মের যুবক, কৃষক, মজুর, ছাত্র–ছাত্রী, বুদ্ধিজীবী প্রায় সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সেই সংগ্রামে।
শুধু কিছু স্বার্থান্বেষী ধান্দাবাজ পাকিস্তানপন্থী পাক সেনার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
পাক শাসকদের চোখে তখন সব হিন্দু, আওয়ামী লিগপন্থী, স্বাধীনতাকামী মুসলিমরা দেশদ্রোহী। এদেরকে হত্যা করতে হবে। শুরুহল শতাব্দীর এক ঘৃণ্য জেনোসাইড। গণহত্যা।
এপ্রিল–মে নাগাদ গ্রামে মিলিটারি ঢুকল। তল্লাশি চলছে। যুবক–যুবতী, বয়স্ক পুরুষ পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছেপাকসেনা–রাজাকারেরা। তাদের পরিণাম হয় মৃত্যু না–হয় ধর্ষণ। অনেক নারী ধর্ষিতা হয়ে পরে আত্মহত্যা বা মিলিটারি, রাজাকার, আলবদর দ্বারা নিহত হয়েছেন।
সাহাপাড়ার প্রায় সব মানুষই দূরের গ্রামে, বিল অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে ভারতে পাড়ি দিয়েছে।
সেদিন সকালেই ধরণী ও তাঁর একমাত্র যুবা ছেলে বছর আঠারোর পরিমল একবার বাড়িতে গিয়েছিলেন।
মিলিটারি পাড়ায় ঢুকেছে এই খবর তাঁরা পাননি। তল্লাশিতে ধরা পড়ে গেলেন পাকসেনার হাতে। ধরণীর স্ত্রী কতোকাকুতি–মিনতি করলেন ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ওরা ছাড়ল না। পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গেল। পরিণতি সহজেই অনুমেয়।
দেশ স্বাধীন হল। বাংলাদেশ পেল পূর্ব বাংলার বাঙালীরা। একে–একে অনেকেই দেশে ফিরতে লাগল দেশত্যাগী শরণার্থীরা।নিজেদের ভিটেমাটি ফিরে পেল। বাড়িঘর লুটপাট হয়ে গেছে। তা হোক। আবার ঘরদোর বানাল তারা।
সবাই ফিরছে। ধরণীর স্ত্রী বিমলা স্বামী–সন্তানের জন্য পথ চেয়ে বসে আছেন। ওঁরা ফিরবেন। ক্ষীণ হলেও একটু আশা বুকেনিয়ে বসে আছেন বিমলা।
শাঁখা–সিঁদুর সবই পরছেন।
কিন্তু ওঁরা আর ফেরেন না।
নতুন দেশ জাগছে। কাচারী ঘর পরিমলের স্মৃতিতে ক্লাব ঘরে পরিণত হল।” শহীদ পরিমল যুব সংঘ “। বিমলা আপত্তি করলেননা।
পাড়ার সকলে যখন দুর্গাপুজো করবে বলে বিমলার কাছে অনুমতি নিতে এল তখন তিনি অনুমতি দিলেন বারোয়ারী পুজোর।
একজন জিজ্ঞেস করল, মাসিমা, অষ্টমীতে বলি হবে তো?
বিমলা একটু নীরব থেকে বললেন, না, আর রক্তপাত নয়। ”
তিনদিন আগে করা সেই পোস্টে ছিলো এই রাজৈরের ভুঁইয়া বাড়িতে সর্বশেষ নির্মান করা বাড়ির ছবি। সম্ভবত হাত বদল হয়ে‘ভুঁইয়া বাড়ি’ হতে ‘হাজী বাড়ি’ হওয়ার পর। এই ভুঁইয়া বাড়ির ‘১৩২৬ সাল, ২৯ বৈশাখ’ এর নির্মান করা অপর একটি দালানেরছবি দেওয়া হলো এই পোস্টে।
লিখাঃ তপন রায়