• সব পোস্ট
Home Blog Page 13

আশ্রয়

ছবিটি গতবছর প্রচন্ড ঝড় বষ্টির মধ্যে তোলা। বাতাসের প্রচণ্ড গতির মধ্যেও ফোকাস করতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। কারণ পাখিটা ভয়ে এভাবেই চুপটি মেরে বসে ছিল দীর্ঘক্ষন। :( ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাত থেকে নিরাপদে থাকুক এই নিষ্পাপ পাখিগুলোও। সবাই সাবধানে থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন।

আশ্রয় …

ছবিটি গতবছর প্রচন্ড ঝড় বষ্টির মধ্যে তোলা। বাতাসের প্রচণ্ড গতির মধ্যেও ফোকাস করতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। কারণ পাখিটা ভয়ে এভাবেই চুপটি মেরে বসে ছিল দীর্ঘক্ষন।

ছবিটি গতবছর প্রচন্ড ঝড় বষ্টির মধ্যে তোলা। বাতাসের প্রচণ্ড গতির মধ্যেও ফোকাস করতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। কারণ পাখিটা ভয়ে এভাবেই চুপটি মেরে বসে ছিল দীর্ঘক্ষন। :( ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাত থেকে নিরাপদে থাকুক এই নিষ্পাপ পাখিগুলোও। সবাই সাবধানে থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন।
ছবি: রাজীব দাশ

🙁 ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাত থেকে নিরাপদে থাকুক এই নিষ্পাপ পাখিগুলোও। সবাই সাবধানে থাকবেন, নিরাপদে থাকবেন।

পাইন্দু খাল অভিযান

পাইন্দু খাল অভিযান

রোয়াংছড়ি বাজারে এসে নামলেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় বাজারঘেঁষা ছোট্ট ছাপড়া দোকানটা। সেখানটায় চা-সিঙ্গাড়া-চিড়া-মুড়ি খেয়েই সাধারণত যাত্রারম্ভ করি আমরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। নাশতা হিসেবে দোকানটায় মজুদ তেলে ভাজা-তেলে চুবানো সবরকম নাশতা চেখে দেখার পর আধঘন্টাখানেক বাজারের এদিক-সেদিক উঁকি-ঝুঁকি মেরে কাটালাম। আরো কিছুক্ষণ পর এসে আবার আসন গাড়লাম খাবার টেবিলে। নাশতা পর্ব শেষ, এবার ভাতের পর্ব শুরু। গোগ্রাসে খেলাম। আগামী ছ-সাত দিন ভাত ছাড়াই থাকতে হবে।

এইবারের অভিযানটা সম্পূর্ণ ব্যাকপ্যাকিং ধরনের হওয়ায় স্যুপ-নুডলস-কফি আর বিভিন্ন শুকনো খাবারের উপর নির্ভর করেই পরের ক’টা দিন টিকে থাকার প্ল্যান। ভরপেট সাঁটিয়ে যখন উঠলাম, তখন এই শীতের সকালেও রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে একাকার। দোকানের বাইরের টুলে দাঁড় করিয়ে রাখা আমাদের প্রকান্ড সাইজের ব্যাকপ্যাকগুলো কাঁধে নিয়ে চলতে শুরু করতেই হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমাদের একটা তাঁবু মিসিং।

পাঁচজনের একটা টিমের তিনটে তাঁবুর মধ্যে সবচেয়ে বড় তাঁবুটাই গায়েব। নিজের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোতের একটা ধারা অনুভব করলাম। এত সাধের অভিযানের শুরুতেই এত বড় একটা বিপত্তি। মনটাই দমে গেল।নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম, শেষবার কার হাতে ছিল তাঁবুটা, কে শেষ কবে কোথায় দেখেছে ইত্যাদি নিয়ে।

আলোচনাতেই বেরিয়ে এল শেষবার রাশিকের হাতেই ছিল তাঁবুখানা। বান্দরবান শহরে নেমে একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ঢুকেছিল সে, সম্ভবত সেখানেই রয়ে গেছে তাঁবুটা। বিপ্লব, ফারাবী আর আরিফকে রোয়াংছড়ি বাজারের সেই ছাপড়া দোকানটাতে বসিয়ে তৎক্ষণাৎ আমি আর রাশিক রওনা হয়ে গেলাম বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। সারাক্ষণ মুখে কথার খই ফোটা রাশিক দেখি একদম ভ্যাবদা মেরে বসে আছে সিএনজির এক কোণে।

‘আরে ধুর,কিচ্ছু হবে না’, ‘একটা না একটা উপায় তো বেরুবেই’ – ইত্যাদি বলে তাকে চাঙা রাখার চেষ্টা করলাম।বান্দরবান-রোয়াংছড়ি হালকা উঁচু-নিচু সড়কটাতে সিএনজি যেন উড়ে চলেছে। আর আমার মনে ভর করেছে অজানা আশঙ্কার কালো মেঘ।

এই অভিযানটা নিয়ে আমাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা আর শিহরণের কমতি ছিল না। বছর দুয়েক আগে রোয়াংছড়িতে একটা অভিযানে এসে প্রথম পাইন্দু খালের দেখা পাই, সেবার খালের ছোট্ট একটা কুম ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা সেই কুম আমাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল পরের বেশ কিছুদিন।

মনে মনে তখনি ঠিক করে ফেলেছিলাম,এই খালটা চষে বেড়াতে হবে। কিছুদিন পর রাশিক-বিপ্লবরাও এদিকটায় এসেছিল। এম এম আলী রোডের আড্ডায় একদিন কথাচ্ছলে বিপ্লবকে বলে ফেললাম, পাইন্দুটা একবার চষে বেড়াতে চাই। নিমেষেই সে রাজি। রাশিককে বলতেই সে জানাল-‘কোপ হবে ভাই!’

পরের ক’টা দিন গেল গুগল আর্থে বসে পুরো খালটা চষে ফেলতে। পুরো ট্রেকের দৈর্ঘ্য, ক্যাম্পসাইট, সম্ভাব্য বাধা, আশেপাশের পাড়া, একদিনে সর্বমোট কতটুকু পথ পাড়ি দিতে পারব – এসব নিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নির্ঘুম রাত কাটলো কয়েকটা।

সবচেয়ে বেশি যেসব বিষয় ভাবালো সেটা হলো ক্যাম্পসাইটের দুষ্প্রাপ্য, বড়সড় দৈর্ঘ্যের সম্ভাব্য বেশকিছু কুম, তীব্র শীতে খালের পাশে ক্যাম্পিং এবং আশেপাশে পাড়ার অনুপস্থিতি। পাড়ার অনুপস্থিতি ব্যাপারটা অবশ্য শাপে-বর হয়েই দাঁড়াল। এবার একেবারে পুরোপুরি একটা ব্যাকপ্যাকিং একটা ট্রিপ দেয়া যাবে ভেবে মনে মনে খুশিই হলাম। তবে গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ইমেজে বড় বড় বোল্ডারগুলোর ছবি উপযুক্ত ক্যাম্পসাইট খুঁজে পাওয়া নিয়ে মনের খচখচানিটাকে উসকে দিয়ে গেল।

ক্যাম্পসাইটের আকালের ভিড়ে সম্ভাব্য কিছু সাইট মার্ক করে জিপিএসে চালান দেয়ার কাজটা সারল বিপ্লব। তবে আরেকটা ব্যাপার মনের মধ্যে কাঁটার মত লেগে রইল, সেটা হলো এদিকের জঙ্গলে ভালুকের বিচরণ। পাইখ্যং পাড়ায় আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী দাদা বারবার নিষেধ করছিলেন এদিকটায় যাবার ব্যাপারে। অবশ্য আমরা শুনলে তো!

ট্রেইলের পরিকল্পনা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যেতে এবার খাবার-দাবার নিয়ে মাথা ঘামানোর পালা। প্রথমে চাল-ডাল ইত্যাদি দিয়ে খিচুড়ি রাঁধার উপকরণ নেয়ার প্ল্যান থাকলেও তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, স্লিপিং ম্যাট, দা, দড়ি ইত্যাদি নেয়ার পরে ব্যাকপ্যাকের যে ওজন দাঁড়াল, তাতে চিরন্তন স্যুপ-নুডলসেই টিকে থাকার পরিকল্পনা স্থির হল। ফুডপ্যাকে জায়গা করে নিল নুডলস, স্যুপ, খেজুর, বাদাম, বিস্কুট, পিনাট বার, ম্যাংগো বার, চকলেট ইত্যাদি। প্ল্যানের একেবারে শেষমুহুর্তে এসে যোগ দিল ফারাবী আর আরিফ।

গুগল আর্থে দেখা স্যাটেলাইট ইমেজের ছবিগুলো মানসপটে আঁকতে আঁকতেই এক শীতের সকালে বান্দরবান এসে হাজির। তারপর তো সেই তাঁবু হারানোর বিপত্তি।যথাসময়ে বান্দরবান পৌঁছে ফ্লেক্সির দোকানটার সামনে যেতেই দোকানদারের টেবিলের নিচ দিয়ে তাঁবুর প্যাকটা উঁকি দিল। তাঁবু দেখে যে পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম, ট্রিপে আসার আগেরদিন দুর্ভাগ্যক্রমে পরিচিত হওয়া এক পরমা সুন্দরীর সাথে পরিচয়েও এত খুশি হইনি। রাশিক তো পারলে দোকানদারকে রীতিমতো চুমু-টুমু খেয়ে ফেলে আর কি! তাঁবুটা নিয়েই আবার রোয়াংছড়ির দিকে ছুট।

বাজারে পৌঁছে সময়ক্ষেপণ না করে ট্রেইলে নেমে পড়লাম।ব্যাকপ্যাকের বাইরে বেঢপ সাইজের স্লিপিং ম্যাট ঝুলতে থাকায় বাজারের সবাই ঠারে ঠারে দেখছে আমাদের।প্রাথমিক গন্তব্য পাইখ্যং পাড়া।

প্রথম দিকের ৪০-৪৫ মিনিট পথ ঝিরি ধরে। বহু দিনের চেনা পথ। যাত্রাপথেই পাইখ্যং পাড়ার বেশ ক’জনের সাথে দেখা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে করতে পথ চলছি। আড়াই ঘন্টা পর পাড়ায় পৌঁছে সোজা জেমস’দার ঘরে। দাদার পাহাড়ি ঢঙের ইজি চেয়ারটায় বেশ কিছুক্ষণ আরাম করে বেরুবার তোড়জোড় করতেই দাদার বাধা। আজকে রাতটা থেকে যাবার অনুরোধ। ফেরার সময় থাকব-এই বলে দাদার কাছ থেকে রেহাই পাওয়া গেল। কোনদিকে যাব,কয়দিন থাকব-বেশ কিছুক্ষণ এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও শেষমেষ আর পারা গেল না। আমাদের ইচ্ছের কথা জানাতেই দাদা বলল, ‘বাধা দেব না। সাবধানে থেকো। ভালুক থাকতে পারে ওদিকটায়। দাদাকে আশ্বস্ত করে হাঁটা দিলাম।

পরের গন্তব্য পাইন্দু খালের একেবারে পাশঘেঁষা একটা মারমা পাড়া। জিপিএস ধরে পাড়ার ডানদিক বরাবর হাঁটা শুরু করলাম। ঘন্টাখানেক হাঁটতেই পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের শেষ রশ্মি ঠিকরে উঠে দিনশেষের বার্তা দিয়ে গেল। শেষ বিকেলের লালচে মরা আলোয় ট্রেইলের কোলঘেঁষা জুমঘরগুলোকে কেমন যেন মায়াবী দেখাচ্ছে। এক অদ্ভুত সম্মোহনে ঘরগুলোর অতিথি হতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বহুকষ্টে সে লোভ সংবরণ করে এগুচ্ছি।

বিপ্লব আমার অবদমিত মনোকামনা বুঝতে পারে বলল, ‘ভুলেও জুমঘরে থাকার টোপ আজকে দিয়েন না। যেমনে হোক, আজকে প্রথম ক্যাম্পসাইটে পৌঁছাতে চাই।’ শেষ পাহাড়টার কোলে পৌঁছাতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এল।

পরের পথটুকু একটানা উৎরাই। প্রায় ঘন্টাখানেক একনাগাড়ে নামতে হবে। হেডলাইট বের করে অধঃপতন শুরু। এই পথে দিনের বেলা নামতেই গলদঘর্ম দশা হয়।এখন রীতিমতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার উপর ফারাবী আর আরিফের হেডল্যাম্প নেই। ধীরে-সুস্থে এগুচ্ছি। এর মধ্যেই ফারাবী উল্টে পড়ে তার ব্যাকপ্যাকের শোল্ডার স্ট্র্যাপের বারোটা বাজিয়ে ফেলল। সবাই মিলে গোটা কতক আছাড় খেয়ে নিচের ঝিরিটার মুখে গিয়ে পড়লাম।

দূর থেকে পাড়ার ঘরগুলোর সোলার প্যানেলের আলো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যতই এগুচ্ছি, ততই মনে হচ্ছে পাড়া যেন দূরে সরে যাচ্ছে। পথ ভুল করেছি – একটু পরপর মনে এই ধারণা উসখুস করতে লাগল। কিন্তু জিপিএস জানাচ্ছে, সঠিক পথেই আছি আমরা।

ঘন্টাখানেকের পথ যখন দু’ঘন্টায়ও শেষ হলো না, তখন জেমস’দার ঘরের ইজি চেয়ারটার ছবিই খালি চোখের সামনে ভাসছিল। ভাবছি কীইবা হতো একটা রাত দাদার ঘরে থেকে গেলে! তখনই হঠাৎ খালের পানির কলকল শব্দে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। হাঁটু পানির খালটা পেরিয়ে সামনের সমতল জায়গাটায় তাঁবু ফেলার ইচ্ছে।

খালে পা ডুবাতেই মনে হল,কে যেন অসংখ্য সূচ ফুটিয়ে দিয়েছে পায়ে। এত ঠান্ডা। আরিফ বিপ্লবকে অফার করল, বিপ্লব যেন তাকে কোলে করে খালটা পার করিয়ে দেয়, বিনিময়ে আরিফ বিপ্লবকে শীতের রাতের অমূল্য পানীয় কফি বানিয়ে খাওয়াবে। তাতেও অবশ্য বিপ্লবের পাষাণ হৃদয় গলল না! খাল পার হয়ে হেডল্যাম্পেরর আলোয় ক্যাম্পসাইট খুঁজতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়লো সকলে।

পছন্দসই জায়গায় তাঁবু গেঁড়ে ব্যাকপ্যাকগুলো এর মধ্যে চালান করে দিয়ে রান্না চড়ালাম। ব্যাকপ্যাকের শোল্ডার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে বেকায়দায় পড়া ফারাবীর ফুডপ্যাকটাই আগে খালি করার সিদ্ধান্ত হলো। খালের একদম পাশেই ক্যাম্পসাইট। আর ক্যাম্পসাইট থেকে অল্প দুরত্বে এই হাড়কাঁপানো শীতে মাছ ধরছে পাড়ার মহিলারা। আমাদের তাঁবু ও এর আশেপাশে হেডল্যাম্পের আলোর ঝলকানিতে কিছুক্ষণের মধ্যে পাড়া থেকে পঙ্গপালের মতো বাচ্চারা ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। মিনিট কয়েক গড়াতেই বড়রাও এসে যোগ দিল। পাড়ার কারবারী দাদা বদনা হাতে পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে উনার ঘরে উঠতে বললেন। এখানে তো কেউ থাকে না, রাতে ঠান্ডায় অনেক কষ্ট পাবে-ইত্যাদি বলে আমাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। আমরা এখানেই ঠিক আছি বলে দাদাকে আশ্বস্ত করাতে বেশ বেগ পেতে হল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে পূর্ণরুপে ধরা দিল পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের থইথই করা রুপালী আলোয় অপার্থিব লাগছে খালটাকে। আর তার মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে আছে খালের হাঁটু পানিতে মাছ ধরায় ব্যস্ত পাড়ার মৎস্যকন্যাদের হি-হি-লি-লি। বেশ কয়েক কাপ কফি সাবড়ে আশ্রয় নিলাম স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায়।

পরদিন খুব ভোরে ক্যাম্পসাইট গুটিয়ে সকালের নরম রোদে হাঁটা শুরু। খালের একেবারে গা ঘেঁষে পথচলা। বেশ ক’টা বিস্তীর্ণ বাদাম ক্ষেত পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম একটা মারমা পাড়ার নিচে। যাত্রাপথে খালের পাশে এটাই শেষ পাড়া।ছোট্ট এক মাচায় বসে বিশ্রাম নিতেই মাচার মালিক দাদা বাদামভর্তি একটা পাত্র ঠেলে দিল। কিছু খেয়ে আর কিছু বাদাম পকেটে পুরে আর আধঘন্টাখানেক হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়কর কুমের পাশে। আগেও এদিকটায় আসলেও এই জায়গার আবেদন আমার কাছে কখনোই কমবে না।

বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কুমের অপর পাশে যাবার পথ ধরলাম। পাহাড়ে উঠার পথটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। খালি পিঠেই পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে কুমের অপর পাড়ে যেতে যেখানে জীবন জেরবার হয়ে যায় সেখানে এবার পিঠের উপর রীতিমতো প্রমাণ সাইজের বোঝা। হাত ফসকালেই সোজা কুমের অতলান্তে। ভয়টা বেশি সাঁতার না জানা রাশিক আর আরিফকে নিয়ে।বেশ কিছু সময় নিয়ে দুজন কুমটা নির্বিঘ্নেই পার হল।

এবার পাহাড়টার মাথায় চড়ার পালা। আগে দু’টা নড়বড়ে বাঁশ দিয়ে উঠার ব্যবস্থা ছিল। এই পাহাড়টার উপরেই মারমা পাড়ার এক দাদা জুম করাতে এবার বেশ ক’টা জংলী লতা দুমড়ে-মুচড়ে নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাঁশের চেয়ে বেশ টেকসই। সেটা বেয়ে কিছুসময় উঠতেই পাহাড়ের উপরে চড়ে বসলাম।

জংলা একটা ট্রেইল ধরে এগুচ্ছি।

জল ও জালের কাব্য – কর্ণফুলীর তীরে জেলে জীবন

কর্ণফুলীর তীরে জেলে জীবন

২৭ টা দিন সমুদ্রের অথৈই জলে। না বড় কোন জাহাজে নয় ওরা নাকি ভেসে থাকে ছোট মাছধরা ট্রলারে। জল, জাল, সমুদ্র আর মাছ এই কটা শব্দের বৃত্তের কেটে যায় ওদের নিশ্বাস দীর্ঘশ্বাসের গল্পটা।

চট্টগ্রামের অভয়মিত্র ঘাট, কর্ণফুলীর তীড়ে ওদের জমজমাট ক্যানভাস। চারদিকে মাছের আশঁটে গন্ধ এখানে।

কর্ণফুলীর তীরটা এখানে যেন এক বিশ্রামাগার। শতশত মাছ ধরা ট্রলার থেকে শুরু সাহসী ইসমাইল সবাই ক্লান্ত। তৈলাক্ত স্তর পরা শরীরগুলোর কদিনের ছুটি মিলেছে। সমুদ্রের নোনাজলের সহচর্য্যে যাওয়ার আগে এই কটা দিনই স্পর্শ মিলবে প্রিয়জনদের। সন্তানের মুখে বাবা ডাকটা কদিন পরেই হারিয়ে যাবে সমুদ্রের গর্জনে। এরই মাঝে পরিত্যত্ত জালে নতুন সুতোর প্রলেপ দিছে কেউ, সাথে চলছে ট্রলারগুলো সংষ্কার পরিচর্যা।

চলছে জাল বোনার কাজ
চলছে জাল বোনার কাজ (ছবি – রাজীব দাস)

”পদ্মা নদীর মাঝির ”- কুবের গনেশের কথা মনে আছে ?। ইসমাইলের সাথে কথা বলতে বলতে ভাছিলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা উপন্যাস শুধু নয়। শত শত কবিতা, গল্প, গান, দেয়াল চিত্র থেকে শুরু করে শিল্পীর তুলতে আঁকা ছবি কিংবা ফটোগ্রাফারদের আলোক বন্ধী ফ্রেম বাদ পড়েনি কিছুই। বার বার ওরা শিল্প হয়েছে শিল্পীর। তবু মুক্তি মেলেনি। বদলায় নি ওদের দীর্ঘশ্বাসের সেই চিরচেনা মাঝি- মহাজন দৌড়াত্ব।

চলছে জাল বোনার কাজ
চলছে জাল বোনার কাজ  (ছবি – রাজীব দাস)

ওদের বুক পকেটে সুখের প্রচুর্য্য নেই। বুকে কান পাতলে আবেক পোড়ানোর শব্দ শুনা যায়। শব্দরা গল্প হয় আর গল্পের গহীনে কবিতা জন্মে; আক্ষেপের কবিতা…

রাজপথের পরিত্যক্ত দেয়ালচিত্র ওরা,

কিংবা গল্প উপন্যাসের উপেক্ষিত রাজপুত্র।

চারুকলায় তৈল চিত্রেও দেখলাম সেদিন

কবিগুরুর পদ্যের লাইনও বাদ পড়েনি।

বারবার শুধু শিল্প হয়েছে ওরা;

তবু মুক্তি মেলেনি।

 

ওরা ক্ষুধার্ত মানুষ।

ওদের মুখে ভাষা দেননি ঈশ্বর।

ওরা রোজ স্বপ্ন বুনে বেঁচে থাকার গল্পে 

-রাজীব দাস

জুম কাব্য

জুম ঘর

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ,জুমের ফসল উৎপাদনের সুবিদার্থে এই জুমঘর খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

আমরা যারা পাহাড়ের আনাচে-কানাচেতে ট্রেকিং করতে ভালবাসি তাদের কাছে জুম ঘরের দেখা পাওয়া মানেই শান্তির এক পরশ, ক্ষুদা, ক্লান্তি ও আশ্রয় এর সম্ভাবনা! আর জুমঘরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য কম বেশী সবাইকেই আচ্ছন্ন করে দেবে ক্ষনিকের জন্য, হয়তো হয়ে উঠবেন কবি অথবা গায়ক।

পাহাড়ি জুমঘরে বসে পাহাড়ের অপূর্ব নিসর্গশোভা দেখতে দেখতে জুমিয়াদের জীবন ও জীবন ধরনের একটা ধারণা পাওয়া যায়।

বান্দরবানে পাহাড়ে বেড়াতে গেলে এমন জুমঘরের দেখা মিলবে জুমক্ষেতে হরহামেশাই। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চল গুলোতেই মূলত জুমচাষি পাহাড়িরা দের বসবাস। প্রায় প্রতিটি জুমখেতে ছোট-বড় একটি – দুইটি অস্থায়ী জুমঘর থাকে। স্থানীয় উপকরণ দিয়েই মুলত বানানো হয় এ-ই জুমঘর। এ-ই জুমঘরকে আবার অনেক নাম আছে যেমন – বমেরা জুমঘরকে টলাম, মারমারা বহ্কচাং, চাকমারা মৌনোঘর বলে থাকে।

এ-ই জুমঘরকে কেন্দ্র করে জুম চাষের ধান ও অন্যান্য ফসলের বীজ বপন, খেতের পরিচর্যা, ফসল আহরণসহ সবকিছু করা হয়।

জুমঘর পাহাড়ে জুমিয়া ও জুম সংস্কৃতির ঐতিহ্যের প্রতীক।জুম সংস্কৃতি বুজতে হলে জুমঘর কে খুব কাছে থেকে দেখতে হবে। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে জুমের ধান পাকলে জুমঘরেরও আনন্দ উল্লাস বয়ে যায়। জুমিয়ারা সবাই আনন্দ-উল্লাসে ধান কাটে। নবান্ন উৎসব পালন করে। পাড়া থেকে অনেক জুমচাষি কয়েক মাসের জন্য পরিবার নিয়ে জুমঘরে থাকেন। এবং ফসল না উঠা পর্যন্ত জুমঘরেই অস্থায়ী নিবাস স্থাপন করেন।

উঁচু নিচু পাহাড়ের ঢালে ফসল ফলানোর জন্য জুম চাষ খুবই উপযোগী পদ্ধতি। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি জনগষ্ঠী এ পদ্ধতিতে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। যদিওবা জুমচাষ নিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও জুমঘরের সৌন্দর্য নিয়ে কারোই কোনো মতভেদ নেই।

ছবিগুলো বান্দরবান থেকে নেয়া হয়েছে

কৃতজ্ঞতা: হাদী মুন

কপি রাইট: ব-দ্বীপ 

একরাত্রির গুহাবাসী!

এক রাত্রির গুহা বাসি
এক রাত্রির গুহা বাসি

একরাত্রির গুহাবাসী!

ছোট্ট একটা ফোকর। একজন কোনোরকমে হাত-পা গলিয়ে ঢুকতে পারে। সরীসৃপের মতো বুকে ভর দিয়ে এগোতে হচ্ছে। নিচের পাথুরে জমিনে হালকা শীতল পানির ছোঁয়া।কিছুদূর যেতেই গুহা হামাগুড়ি উচ্চতা থেকে একেবারে বুকসমান উচ্চতা ধারণ করলো।

হঠাৎ পায়ের নিচে কচকচ শব্দ হতেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা চিপসের খালি প্যাকেট। হায় বঙ্গসন্তান! এরকম একটা মোটামুটি দুর্গম ও বেকায়দা জায়গায় এসেও তারা তাদের উপস্থিতির ছাপটা রেখে গিয়েছে। ভাবতেই মেজাজটাই বিগড়ে গেল। তবে তখনো আরো অনেক কিছু দেখার বাকি। চিপসের প্যাকেটটা তো সবেমাত্র প্রারম্ভের বার্তা নিয়ে এসেছিল। এরপর আরো কত রকমের বস্তুর সাথে যে মোলাকাত হয়েছিল সেদিন। চকলেটের খোসা, এনার্জি ড্রিঙ্কসের খালি বোতল, মটর ভাজার মোড়ক, সিগারেটের বাঁট কোন কিছুই বাদ যায়নি।

গুহা যেখানে বেশ উঁচু সেসব জায়গা তো আছেই,গুহার দুরূহ কোণ কিংবা যেসব ছোট্ট ফোকরে হাত-পা গলানো যায় না,সেসব জায়গাও এসব অবিবেচক টুরিস্টদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মনে মনে তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম, কিছুদিনের মধ্যেই আবার গুহায় আসব।গুহা ও তার আশেপাশের এলাকায় একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাব শিগগিরই।

তবে চট্টগ্রাম ফিরে নানান ঝুট-ঝামেলায় সময় আর হয়ে উঠছিলো না। পাক্কা এক বছর পরে ফেসবুকে ইভেন্ট দিয়ে দিলাম। প্ল্যান ছিল, গুহায় একরাত কাটিয়ে পরদিন ফেরার সময় গুহা ও তার আশেপাশের জায়গাটা অপচনশীল দ্রব্য মুক্ত করব।

নির্দিষ্ট দিনে চকরিয়া হয়ে আলীকদম পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই এক হোটেলে দুপুরের খাবারটা সেরে হাঁটা ধরলাম গুহার দিকে। পানবাজার থেকে ডানে মোড় নিয়ে শেষ পাহাড়ি পাড়াটা পেরিয়ে এসে পড়লাম খালের মুখে। খাল দেখেই আমাদের গোসলসত্তা জেগে উঠলো। হাঁটুসমান পানিতে বেশ কিছুক্ষণ দাপাদাপি-ঝাপাঝাপির পর বুকডন দিয়ে গোসল সেরে খালের পাড়ে উঠে মিনিট পনের হাঁটতেই প্রথম গুহার কাছে চলে আসলাম।দিনের আলো ফুরোবার তখনো অনেক দেরি।

আমরা গুহার আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে লাগলাম।একটা মরা ঝিরি ধরে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল ৬০-৭০ ডিগ্রি খাড়া একটা পাহাড়ের। উচ্চতায় শ’দুয়েক ফুটের কাছাকাছি। সময় কাটানোর জন্য দেবুদা আর আমি গাছের শিকড়-বাকড় ধরে উঠতে শুরু করলাম। একটু পর প্রথমবারের মত পাহাড়ে আসা মারুফ ভাইও যোগ দিলেন। উনার সবকিছুতেই ব্যাপক আগ্রহ। বাকীরা নিচে থেকেই উৎসাহ যোগাতে লাগলো।

আরো বেশ কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক করে পশ্চিমাকাশে সূর্যদেব লালিমা ছড়ানো শুরু করতেই আমরা গুহার ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম। অপেক্ষাকৃত বড় ২নং গুহাতেই রাতের আবাস গাড়ব আমরা।

এক রাত্রির গুহা বাসি
এক রাত্রির গুহা বাসি

গুহায় ঢুকতেই গুহার স্থায়ী বাসিন্দা বাদুড়ের বোঁটকা গন্ধ নাকে এলো। আমরা যখন সবে ঢুকতে শুরু করেছি, তখন ব্যাটম্যানের পূর্বসুরিরা তাদের নৈশ অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের দু’একজনের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলেই। আধঘন্টাখানেকের মধ্যেই অবশ্য গুহা পুরোপুরি বাদুড়শুন্য হয়ে গিয়েছিল।

গুহা ধরে মিনিট পাঁচেক এগুতেই গুহা যেখানটায় হামাগুড়ি উচ্চতা থেকে ডিগবাজি উচ্চতা লাভ করেছে, সেখান্টায় স্থির হলাম। শুরু হলো আতি-পাতি করে তাঁবু ফেলার জন্য সমান জায়গার খোঁজ।

এদিক-সেদিক ঘুরেও বিশেষ লাভ হলো না। আলগা কিছু ছোট পাথরে গুহার পাথুরে জমিনটা ভর্তি। একটা মোটামুটিরকম জায়গা বের করে পাথর সরানোতে মনোযোগ দিলাম। কে যেন আমাদের সাথে নিয়ে আসা ছোট ছোট অনেকগুলো মোমবাতি জ্বেলে দিল। মোমবাতির লাল আলোয় গুহার ভেতরে গা ছমছমে একটা ভৌতিক পরিবেশ। পরিবেশটাকে আরেকটু উসকে দিতেই ক’টা প্রমাণ সাইজের ধাড়ি ইঁদুর এদিক-ওদিক ছুটছে। ছোট পাথর সরিয়ে মোটামুটি দুটো তাঁবু পিচ করার মতো জায়গা পরিষ্কার হতেই গুহার শেষ প্রান্তের দিকে হাঁটা ধরল সবাই।

শেষপ্রান্তের ছোট্ট ফোকরটায় বুকডন দিয়ে শরীর গলিয়ে উঠে আসলাম। গুহার মুখটা যেখানটায় শেষ, সেখানটায় বিশালাকার সাইজের এক পাথর আছে। অনায়াসে ৮-১০ জন বসতে পারে। পাথরের উপর বসেই আড্ডা শুরু হলো।

সেদিনের সেই আড্ডাটা একটা বিশেষ কারণে আমাদের সবার কাছে চিরস্মরণীয়। চট্টগ্রামে পর্বতারোহণ নামক স্পোর্টসটার চর্চা শুরু ও প্রসারের জন্য ‘ভারটিক্যাল ড্রিমারস’ নামক পর্বতারোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠার বীজ বুনে দিয়েছিল সেদিনের সেই আড্ডাটা।

খিদেটা চাগিয়ে উঠায় দীর্ঘ আড্ডার সমাপ্তি ঘটিয়ে গুহার এক কোণে রান্না চড়ালাম। চিরাচরিত সেই স্যুপ-নুডলস আর সবশেষে কফি।

খাবার-দাবার শেষে আরিফ ভাই ঝপাং ঝপাং ফ্ল্যাশ মেরে গুহার গায়ে বঙ্গসন্তানদের পাথরের গায়ে অমুক+তমুক লেখা অমর ভালোবাসার অভূতপূর্ব সব নিদর্শনের ছবি তুলতে লাগলেন।

গুহার পাথুরে দেয়ালের খাঁজে ছোট মোমবাতিগুলো গুঁজে দিয়ে ছমছমে পরিবেশ ফুটিয়ে তুললেন ফরহান ভাই আর লিটন ভাই। মোমবাতির লাল আলোতেই চলল আড্ডা। মাঝে বেশ কিছুক্ষণ টানা খচর-মচর শুনে সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। কান খাড়া করে শুনেও কোন কূলকিনারা করতে না পেরে ফের আড্ডাতেই মনোযোগ দিলাম।

পাথরের খাঁজে জ্বালানো মোমবাতিগুলোর নিভু নিভু আলো দেখে তাদের অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ঠাহর করে আমরা আবার গুহার শেষ প্রান্তের বড় পাথরটার উপর আসন পাতলাম। নানারকম বিষয় নিয়ে গ্যাঁজানোর ফাঁকে ফাঁকে আরেক দফা কফি হয়ে গেল।

রাত আরেকটু বাড়তেই এই বৈশাখ মাসের কাঠ-ফাটা গরমেও রীতিমতো কাঁপ ধরে গেল শরীরে। আড্ডা মেরেই রাতটা কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষমেষ তাঁবুর অভ্যন্তরে আশ্রয় নিতেই হলো।

নিজের তাঁবুতে ঢুকেই দেখি আমার স্লিপিং ব্যাগ গায়েব।এদিক-সেদিক তদন্ত করতেই আসামী ধরা পড়ল। অনুপ আর ইশতিয়াক আমার স্লিপিং ব্যাগটা বালিশ বানিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অগত্যা আর কি, বিনা স্লিপিং ব্যাগেই রাত কাটাতে হলো।

তাঁবুতে শুয়ে একটু ধাতস্থ হতেই তাঁবুর একেবারে ডানপাশে শোয়া লিটন ভাই বললেন, তার নিজেকে ফুটবল মনে হচ্ছে। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে বুঝলাম, তিনি তাঁবুর যেদিকটায় শুয়েছেন, সেদিকটা বেশ ঢালু। তাই একটু পরপর তিনি গড়িয়ে যাচ্ছেন। তৎক্ষণাৎ তাঁবুর বাইরে থেকে দু’টা ব্যাকপ্যাক এনে তাঁবুর শেষ প্রান্তে ঠেস দিয়ে তার পতন ঠেকানো হলো।

তাঁবুর ভেতরে শুয়ে গুহাবাসের শিহরণটা মাথা থেকে যাচ্ছিলই না। কে জানে, হয়তো আমাদেরই কোন পূর্বপুরুষ এ গুহায় রাত কাটিয়েছে। শিকার করে খেয়েছে এই গুহার আশেপাশে চরতে থাকা কোন জন্তু-জানোয়ারকে।

তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, রান্নার জন্য পেনি ষ্টোভ, জ্বালানী ইত্যাদি সুবিধাসংবলিত আমাদের গুহাবাসটাকে কোনোভাবেই সে যুগের গুহাবাসের সাথে তুলনা করা না গেলেও রোমাঞ্চটা একরত্তি কম নয়।

এসব ওথাল-পাথাল চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়ল ফরহান ভাইয়ের ডাকে। উনি হঠাৎ নাকি শ্বাস নিতে পারছেন না। বদ্ধ জায়গায় এরকম হতেই পারে বলে উনাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। তাঁবু থেকে বেরিয়ে গুহার শেষ মুখটার দিকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে কাটিয়ে ফরহান ভাই স্বাভাবিক হতেই আবার তাঁবুতে।

সকালে ক্যাম্প গুটিয়ে আমাদের মূল লক্ষ্য পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামলাম। সবাইকে যার যার ভাগের পলিব্যাগ বন্টন করে ময়লা কুড়াতে নামলাম। চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, নানান দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের বিস্কুটের মোড়ক, চকলেটের খোসা ইত্যাদি হরেক রকম আবর্জনার ভান্ডার দেখে আমরা রীতিমতো মুগ্ধ!

নিমেষেই বড় সাইজের পলিব্যাগগুলো ভরে উঠতে লাগল।আমি আবর্জনা কুড়াচ্ছিলাম প্রথম গুহাটায়। ঐসময়ই দিনের প্রথম পর্যটকের আগমন গুহাতে। বেশ-ভূষায় বেজায় ভদ্রলোক। ময়লা কুড়াতে দেখে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কারা, কেন করছি এসব ইত্যাদি। আমাদের উদ্দেশ্য জানাতেই বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললেন, ‘খুব ভালো উদ্যোগ। সবাই এরকম চিন্তা করলেই পর্যটনস্পটগুলো আর নোংরা হতো না। ‘বলেই হাতের সিগারেটের ধংসাবশেষটুকু গুহার পাথুরে জমিনে ফেলে সামনের দিকে গটগট করে হাঁটা ধরলেন। বেশ কিছুক্ষণ ঐ বিশিষ্ট ভদ্রলোকের দিকে অপলক চেয়ে থেকে ফের ময়লা কুড়ানোয় মনযোগ দিলাম আমি!

কৃতজ্ঞতা: বাবর আলী

কপিরাইট: ব-দ্বীপ

ডিম পাহাড়ে – মেঘ সবুজ আর উচ্চতার হাতছানি

ডিম পাহাড় – মেঘ সবুজ আর উচ্চতার হাতছানি

আলিকদম – থানচি রাস্তা বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু এবং ঝুঁকিপূর্ণ সড়কপথ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ২৬০০ ফিট। আলীকদম থেকে এই রাস্তা উপরের দিকে উঠেছে এবং ডিম পাহাড়ের কাছাকাছি রাস্তার উচ্চতা ছাড়িয়েছে ২৫০০ ফুটের ও বেশি। আলীকদম উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দুরের থানচি-আলীকদমে ডিম পাহাড়ের পুরোটাই পাহাড়ী পথ।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণে সময় লেগেছে ১০ বছর এবং নির্মাণকালীন বিভিন্ন দুর্ঘটনায় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ৩ জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছেন।

দেশের ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের কাছে বর্তমানে খুবই জনপ্রিয় বান্দরবানের থানচি-আলীকদমের ডিম পাহাড়। প্রকৃতির অনাবিল সৌর্ন্দয্য আর বৈচিত্র্যময়তায় পূর্ণ বান্দরবানের থানচি-আলীকদম ডিম পাহাড়। পাহাড়, আকাশ, মেঘ এবং আকাশ মিশেমিশে এখানে একাকার! ডিমপাহাড় (Dim Pahar) এর অবস্থান আলীকদম এবং থানচি থানার ঠিক মাঝখানে। এই পাহাড় দিয়েই দুই থানার সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আলীকদম থেকে থানচি পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।

ডিমপাহাড় কিভাবে যাবেন ?

প্রথম রুট –

কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থেকে জিপে( চাঁন্দের গাড়ি) করে চলে যাবেন আলীকদম উপজেলায়। এখানে আলীর গুহা, রূপমুহুরী ঝর্ণা দেখে রওনা দিতে পারবেন বাংলাদেশের ২য় উচ্চতম সড়ক পথ দিয়ে ডিমপাহাড় এর উদ্দেশ্যে। ডিম পাহাড় ঘুরে সরাসরি চলে যান থানচি বাজার। এখানে খাওয়া দাওয়া সেরে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেন অথবা থানচি বিজিবির রিসোর্টে অবস্থান করতে পারেন।

দ্বিতীয় রুট হলো –

ঢাকা > বান্দরবান > থানচি

বান্দরবান থেকে যেতে চাইলে আগে লোকাল বাসে কিংবা চান্দের গাড়িতে করে প্রথমে থানচি বাজার , সেখান এখান থেকে চান্দের গাড়ি কিংবা মোটরবাইকে করে ডিম পাহাড়।

ফটোক্রেডিট : নুসরাত নীরা

জল সবুজের বেরাইন্না লেক

জল সবুজের বেরাইন্না লেক

কাপ্তাই লেক (Kaptai Lake) বাংলাদেশে, এমন কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদুপানির হ্রদ। প্রধানত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এর সৃষ্টি হলেও, এ জলাধারে প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানির মাছ চাষ হয়। নৌবিহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি আবাদ ইত্যাদিতেও এর অবদান উল্লেখযোগ্য।

লেখক কাপ্তাই লেক এর সামনে

পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে (২২°০৯´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯২°১৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে জলাধারটি গড়ে ওঠে। মূল লেকের আয়তন প্রায় ১,৭২২ বর্গ কিমি, তবে আশপাশের আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিমি এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। মূলত রাঙ্গামাটি জেলাতেই জলাধারটি সীমিত যার অন্তর্ভুক্ত উপজেলাসমূহ হচ্ছে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি। এছাড়াও খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার কিছু অংশও লেকের অন্তর্গত ৷

ছবির মত সুন্দর কাপ্তাই লেকে বেশ কিছু পর্যটন স্পট রয়েছে , এর মধ্যে রয়েছে বেরাইন্না লেক৷

Kaptai Lake 01

কাপ্তাই বাস স্টেশন থেকে জীপতলী হয়ে গাড়িতে চড়ে পাহাড়ের উঁচু নিচু রাস্তা দিয়ে বেরাইন্যা লেক যেতে যেতে মনে হবে যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে আকাশ থেকে লেক দেখছেন। যার বিশালতা ছুঁয়ে যাবে আপনাকে। একপাশে পাহাড় আর আরেক পাশে লেক, এর মাঝখানে দিয়ে যখন এগিয়ে যেতে থাকবেন তখন যে কারো মনে শিহরণ জাগবে এটা নিশ্চিত।

সরু পাহাড়ী রাস্তায় গাড়িঘোড়া বলতে দেখা যায় সিএনজি আর কিছু ব্যক্তিগত মোটর বাইক আর গাড়ি। আর উচুঁ পাহাড়ি রাস্তা বলে প্রতিটা বাঁকে বাঁকে শিহরন জাগায় মনে৷

পাহাড়ী এলাকা বলে তেমন বেশি মানুষজনও নেই এখানে। তারপরও কিছু সংখ্যক আদিবাসীর দেখা মিলে যাবে সময়ে সময়ে পথে যেতে যেতে, যারা মূলত কৃষি কাজ করে নিজেদের পেট চালায়।

রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কিছুক্ষণ পরপর চোখে পড়বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ী বাজার। সেখানে কাঁচা আনাজী কলা, পাহাড়ী মূলা, শাক সবজী, কাঁচা পাকা পেঁপে, পেয়ারা, বড়ই সহ নানা রকম পণ্য নিয়ে বিক্রির পসরা বসিয়ে ক্রেতার অপেক্ষা করছে আদিবাসী মানুষরা৷

বেরাইন্না ব্রিজ পার হয়ে আসামবস্তি পর্যন্ত মুগ্ধতার পাশাপাশি সবাইকে ছুঁয়ে যাবে ছন্নছাড়া মেঘেদের দল। গোধূলির লালচে আলোয় দিগন্ত বিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদ যেন পরিণত হয় ঝিলমিলিয়ে ওঠা এক সোনালী নদীতে। হ্রদের পানিতে তখন শেষবেলার আলো-আধারির খুনসুটি। প্রাণভরে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য।

এই লেকের পাড়েই হিল্লোল চাকমা ও তার তিন বন্ধু মিলে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এ বেরাইন্না লেক শোর ক্যাফে চালু করেছিলেন। তখন থেকে সেবার মান ধরে রেখেই বর্তমান পর্যন্ত তারা ভালোভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পর্যটকদের ৷ হিল্লোল দাদার যোগাযোগ নাম্বার : ০১৭৩২৩৩২৮১৯ , ০১৮৫৬৯৫৭০০২

এখানে আসলেই যে কারো মন ভাল হয়ে যাবে গ্যারান্টি ৷ রয়েছে কায়াকিং করার ব্যবস্থা ৷ দুইজনের কায়াকে ঘন্টা প্রতি ৩০০ টাকা আর তিন জনের কায়াকে ঘন্টাপ্রতি ৪০০ টাকা নেয় ৷

বেরাইন্না লেক যাওয়ার উপায়:

বেরাইন্যা লেকে দু’ভাবে যাওয়া যায়। রাঙ্গামাটি দিয়ে অথবা কাপ্তাই দিয়ে ৷

রাঙ্গামাটি থেকে: ঢাকা থেকে সরাসরি বাস আছে রাঙ্গামাটির। আর চট্টগ্রাম হয়ে যদি যায় তাহলে অক্সিজেন থেকে রাঙামাটির জন্য পাহাড়িকা বাস রয়েছে, প্রতি ৩০ মিনিট পরপর। জনপ্রতি ভাড়া- ১২০ টাকা। রাঙ্গামাটি থেকে রিজার্ভ সিএনজিতে সরাসরি বেরাইন্যা লেক চলে যাওয়া যায় ভাড়া কম বেশী ৬০০-৮০০ টাকা। দরদাম করে নিতে হয়৷

কাপ্তাই থেকে: এই দিকে যেতে হলে প্রথমে চট্টগ্রামের বদ্দারহাট বাস টার্মিনাল আসতে হবে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর পর কাপ্তাইয়ের বিরতিহীন গেট লক বাস ছাড়ে। ভাড়া জনপ্রতি ৬৫ টাকা। তারপর কাপ্তাই বাস স্টেশন থেকে সিএনজিতে করে বেরাইন্যা লেক চলে আসা যায়৷ ভাড়া ৩০০ থেকে ৩২০ শুধু যাওয়া। কেউ চাইলে সিএনজি রিজার্ভ নিয়েও যেতে পারে। এতে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে নিতে হবে। তবে বেরাইন্যাতে সিএনজি থাকে। লোকাল গাড়ি পেতে তেমন কষ্ট হয় না৷ আবার কেউ চাইলে চট্টগ্রাম শহর থেকেই মাইক্রোবাস রিজার্ভ ভাড়া করে নিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারেন ৷ ভাড়া কম বেশি ৭০০০ – ৭৫০০ টাকা নিতে পারে৷

*** আমাদের সকলের পরিবেশের দিকে যত্নবান হওয়া উচিত ৷ ঘুরতে গেলে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে ৷ নিজেদের জিনিস নিজেদেরই রক্ষনাবেক্ষন করতে হবে নিজ দায়িত্বে ৷

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরীর ধান ক্ষেত
চর কুকরীর ধান ক্ষেত

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১ দিনের বেশি সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন মনপুরা, চর কুকরি মুকরি, ঢালচর, চর মনতাজ। বাংলাদেশের উপকূলের অপার সৌন্দর্য্য উপভোগের পাশাপাশি সকল ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়ে যাবে মুহূর্তেই।

আপনি বেতুয়া ঘাট থেকে মনপুরা, কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে চর কুকরী মুকরী, ঢালচর, চর মনতাজ যাওয়ার ট্রলার পাবেন।

কিভাবে যাবেন:

ঢাকা সদরঘাট থেকে বেতুয়ার লঞ্চ ছাড়ে। আবার একই সময়ে বেতুয়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে।

লঞ্চের নাম:

ফারহান ৫-৬, তাসরিফ ৩-৪, কর্ণফুলী ১২-১৩

ছাড়ার সময়:

ঢাকা থেকে: রাত ৭:৪৫, ৮:৩০ ও ৮:৪০

বেতুয়া থেকে: বিকাল ৫ টা, ৫:৩০

বেতুয়া থেকে চরফ্যাশন অটোভাড়া =৩০

আবার বেতুয়া থেকে মনপুরার ট্রলার ছাড়ে।

ভাড়া : ৮০ – ১০০ টাকা

ছাড়ার সময় দুপুর ১২ টা ও বিকাল ৩ টা…

চর কুকরী মুকরী যাওয়ার জন্য চরফ্যাশন থেকে দক্ষিণ আইচা এর বাস ছাড়ে। সেখান থেকে অটোতে কচ্ছপিয়া ঘাট যেতে হবে।

বাস ভাড়া : ৩০

অটো ভাড়া : ১০

চর কুকরী মুকরী:

ট্রলার ভাড়া : ৪০ টাকা, ছাড়ার সময়: ১২ টা ও ৪ টা,

সময় লাগে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট

ঢালচর:

ট্রলার ভাড়া : ৭০ – ৮০ টাকা, ছাড়ার সময় ২ টা, সময়: ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট

চর মনতাজ:

ট্রলার ভাড়া : ১০০ টাকা, ছাড়ার সময় ২ টা, সময়: ৩ ঘন্টা।

স্পিডবোটে গেলে আরো দ্রুত যাওয়া যায় তবে ভাড়া একটু বেশি।

আপনি সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন , দেখে আসতে পারেন – বাংলাদেশের দক্ষিণের চর কুকরী মুকরী , ঢাল চর এবং চর মনতাজের অপার সৌন্দর্য্য !

   অনুগ্রহ করে নিজের দেশের প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হবেন , ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না, প্লাস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

এদেশ আপনার ,নিজের দেশের প্রতি যত্নবান হউন।

 

ফটোগ্রাফী : Asif Soikot

জাকারিয়া পারভেজ

স্বত্ব সংরক্ষিত : ব তে ব-দ্বীপ

ডাহুক উপাখ্যান

বর্ষার সময় একটু জলা-জংলা জায়গার আশে-পাশে গম্ভীর একটা পাখির ডাক শুনতে পাবে। ঠিক যেন কোনো রাগী স্কুল টিচার, যিনি মোটেই বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন।

অনেকক্ষণ কিছু জিজ্ঞেস করার পর দায়সারা একটা জবাব দিতে চাচ্ছে। তাই ঠিক কোনো অর্থবোধক বাক্য না হয়ে ‘কোয়ক কোয়াক’ জাতীয় একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। যদি কাছে থেকে দেখেন, তবে দেখবেন পাখিটি মোটেও গম্ভীর না। বরং মনের সুখে পানির উপর তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।

আমাদের গ্রাম বাংলার মানুষেরা এলাকাভেদে ডাহুককে কেউ ডাইক, কেউবা পানপায়রা আবার কেউ ধলাবুক ডাহুক বলেও ডাকে। কারণ, ডাহুকের শরীরটা কালচে হলেও এর বুক, গলা, পেট একদম ধবধবে সাদা। তার সঙ্গে মিল রাখতে ঠোটটা হলুদ রঙের, ঠোটের উপরে লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগও আছে। সব মিলিয়ে ডাহুক খুব সুন্দর একটি পাখি।

আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ডাহুকেরা একবারে ৬-৭টি করে ডিম পারে। ডিমগুলোও দেখতে তাদের মতোই সুন্দর, ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। বাবা ডাহুক আর মা ডাহুক মিলে পালা করে ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটে যখন ছোট্ট ডাহুকগুলো বের হয় তখন পূর্ণবয়স্ক ডাহুকের রঙের মতো না হয়ে শুধু কালো হয়ে থাকে।

ডাহুক আসলে চিরবিরহী একটি পাখি । সঙ্গিহীন হলে ওরা পাগল হয়ে যায় । বাংলাদেশে অনেক প্রতন্ত অঞ্চলে এটাও প্রচলিত আছে ডাহুক কিংবা ডাহুকীদের মধ্যে কেউ একজন শিকারের পরিনত হলে কিংবা মারা গেলে , অন্যজন সেই শোকে নিজেই আত্ম হনন করে । ওরা কখনোই নতুন সঙ্ঘিনীর সাথে সংসার করে না ।

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার বা আই ইউ সি এন এই প্রজাতিটিকে বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। যদিও বাংলাদেশের বন্য আইনে এ প্রজাতিটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। তবুও পাখি শিকারিরা নির্বিচারে এ পাখিকে হত্যা করেই যাচ্ছে। এছাড়াও আমাদের জলাশয়গুলো দূষিত হয়ে যাওয়ার কারণে ডাহুকের বাসভূমিগুলো দিনে দিনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দূষিত পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকতে না পেরে একদিন হয়ত সত্যিই হারিয়ে যাবে সুন্দর এই পাখি। 

স্থানঃ- নোয়াপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম।

চড়ুই কথন

বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
“কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোধ, বৃষ্টির, ঝড়ে।”

ফেইসবুক, ইউটিউবের দাপটে সোনায় মোড়ানো সেসব কবিতায় এখন আর বাচ্চাদের শৈশব রঙ্গিন হয় না। অথচ একসময় চড়ুইয়ের প্রাচুর্য্য ও মানব-সহচার্যের কারণে বিভিন্ন লেখালেখি ও অন্যান্য মাধ্যমে এর উপস্থিতি ছিল প্রকট।

প্রতিকূল পরিবেশে খাপখাইয়ে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা থাকলেও সাধারণত জনহীন বনভূমি, তৃণভূমি ও মরুভূমিতে এরা বসবাস করে না। শহরে বা গ্রামে, মানববসতির কাছাকাছি যেকোন পরিবেশে এরা নিজেদের স্বচ্ছন্দে মানিয়ে নিতে পারে।

সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার গল্পে শহুরে ইটকাঠ আর যানজটে হয়ত আপনার চোখে মরিচা পড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত যান্ত্রিকতার অনুনাদে টিম্পেনিক মেমব্রেনটাও হয়ত বিরক্ত। ভাবতে পারেন ঠিক তখনি মিষ্টি মধুর এক স্বর্গীয় আওয়াজ আপনার কানকে প্রশান্তি দিচ্ছে। শহুরে যন্ত্রিকতায় ক্ষনিকের জন্য হলেও প্রকতির সহচার্য পাচ্ছেন আপনি। ভাবতে পারেন প্রিয় বাংলাদেশে এতটাই সৌভাগ্যবান আপনি।

তবে আর বেশীদিন থাকবেন না, বিলুপ্তির পথে আপনার প্রিয় চড়ুই, হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। চড়ুই হারিয়ে গেলে, হারিয়ে যাবে সোনায় বাধাঁনো সেইসব কবিতা, হারিয়ে যাবে আপনার সেই একমুঠো প্রশান্তিটুকুও।

ফেসবুক থেকে গৃহীত

ওদেরকে বাচঁতে দিন, পত্রিকার পাতায় চড়ুই নিধনের খবর পেলে একসাথে রুখতে হবে। তবেই না বাংলাদেশ। নদ-নদী, পাহাড়, সমুদ্রের যে ক্যানভাসকে ভালোবেসে আপনি বাংলাদেশ নামে ডাকেন। সেটাও সৌন্দর্য্য হারাবে যদি পাখি না বাঁচে। ওরা সুখে থাক আমাদের সোনার বাংলাদেশে 📷

error: Content is protected !!