Home Blog Page 4

হিম সোমেশ্বরী আর দুই দুঃসাহসী

হিম সোমেশ্বরী আর দুই দুঃসাহসী

(আগের পর্ব)

… দৌড়াতে দৌড়াতে ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে মাত্র এক মিনিটের জন্য জারিয়াগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস আমরা মিস করলাম। রিকশাভাড়া মিটিয়ে আমরাও স্টেশনে ঢুকেছি আর মহানন্দা এক্সপ্রেস ছেড়ে দিল।

আমার আর ইয়াশ এর মন খুব খারাপ হয়ে গেল কারণ আমাদের এই টাইপের টু-ডু লিস্ট এ সবার উপরে ছিল এই ট্রেনে ভ্রমণ করা। তাছাড়া মাত্র 20 টাকা ভাড়া দিয়ে ময়মনসিংহ থেকে জারিয়া যাওয়ার সুযোগ টাও ছাড়ার ইচ্ছা ছিল না কারণ আমরা তো বেরিয়েছি বাজেট ট্রাভেলিং এ।

যাই হোক ট্রেন মিস করে দুজনেই বেশ মন খারাপ করে প্লাটফর্মে হাটাহাটি করছি এ সময় এক পুলিশ সদস্য আমাদের পরামর্শ দিল ময়মনসিংহ নতুন ব্রিজের ঐখান থেকে সিএনজি নিয়ে শ্যামগঞ্জ স্টেশনে চলে যেতে, এতে আমরা নাকি মহানন্দা এক্সপ্রেস এর আগেই ওখানে পৌঁছে যাব। ওখান থেকে মহানন্দা এক্সপ্রেস ধরতে পারবো।

সাথে সাথে আমি আর ইয়াশ ছুট লাগালাম। একটা রিক্শা করে আমরা নতুন ব্রিজ এ চলে আসলাম। এখান থেকে সিএনজিতে উঠে ছুটলাম শ্যামগঞ্জের দিকে। শ্যামগঞ্জ এর কাছাকাছি এসে রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমাদের চোখে মুখে তখন ট্রেন মিস করার শঙ্কা।

আমরা সিএনজি ছেড়ে দিয়ে হেঁটেই শ্যামগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছালাম। আর তখনই মহানন্দা এক্সপ্রেস সবেমাত্র স্টেশনে ঢুকেছে। আমরা বেশ আনন্দচিত্তে ট্রেনে উঠে গেলাম। ট্রেন এখানে জারিয়া থেকে ঢাকাগামী বলাকা কমিউটার ট্রেনকে সাইড দেওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে, কাজেই সময় আছে। সে সময় আমরা শ্যামগঞ্জ স্টেশন, স্টেশনের মানুষ, মানুষের জীবনযাত্রা এসব দেখে কাটালাম। বেশ কিছু ছবি তুললাম। 15 মিনিট পরে ট্রেন ছেড়ে দিল।

আমি আর ইয়াশ ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেশের অন্যতম একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রকৃতি, ঘরবাড়ি ও মানুষের জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ট্রেন স্টেশন জারিয়া ঝাঞ্জাইল এর দিকে।

মোটামুটি তিনটার দিকে আমরা জারিয়া পৌছালাম। জারিয়া পৌঁছে সবার আগেই স্টেশনের সাইনবোর্ডের সাথে নিজের একটা ছবি তুলে নিলাম। আমার ভ্রমণ জীবনের বাকেট লিস্ট এ যে কয়টা স্থান ভ্রমণের তালিকায় ছিল তার ভেতরে জারিয়া স্টেশন অন্যতম।

আমি জানি এই বাক্যটি পড়ে অনেকেই হয়তো ভাবছেন মানুষের বাকেট লিস্ট এ ভ্রমণের অনেক কিছুই তো থাকে আমার বাকেট লিস্ট এ জারিয়া কেন? কারো আছে আইফেল টাওয়ার, কারো তাজমহল, কেউ চায় নিউজিল্যান্ড বেড়াতে, কেউ চায় নরওয় বেড়াতে, কারো স্বপ্ন থাকে আমেরিকা ঘুরতে যাওয়ার। এসব স্বপ্ন আমারও আছে।

বেশ কয়েকটা জায়গায় যাওয়াও হয়েছে। তদুপরি ছোটবেলায় ওই যে সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের পড়া দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ট্রেন স্টেশন জারিয়া ঝাঞ্জাইল। এজন্য ছোটবেলা থেকেই এটা আমার বাকেট লিস্ট এর উপরের দিকে। যাই হোক ছবি তুলে আমি আর ইয়াশ স্টেশন থেকে বের হতেই আমাদেরকে পাকড়াও করল স্থানীয় একজন যুবক।

আসলে সে আমাদের সাথে ট্রেনে একই বগিতে ভ্রমণ করেছিল সেখান থেকেই আমাদেরকে ফলো করছিল। স্টেশন থেকে বের হওয়া মাত্র আমাদেরকে নিজের পরিচয় দিল যে, সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদেরকে দেখে তার পর্যটক মনে হয়েছে বিধায় যেকোনো রকম হেল্প লাগলে সেটা করতে চায়।

আমরা খুব খুশি মনে তার কাছে জারিয়া থেকে বিরিশিরি সুসং দুর্গাপুর যাওয়ার, ক্যাম্পিং করার নানান রকম তথ্য জেনে নিলাম। তার ফোন নাম্বারটি রেখে দিলাম। এই ভদ্রলোক আমাদেরকে আতিথেয়তা না করিয়ে ছাড়লেন না।

পাশের একটা বিখ্যাত চায়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। চা খেলাম, লুচি সন্দেশ খেলাম। এরপর ভদ্রলোক নিজেই আমাদের দুর্গাপুর গামী একটা অটোরিকশায় তুলে দিলেন। আমরা প্রায় ত্রিশ মিনিটের জার্নি করে দুর্গাপুর এসে পৌছালাম এখানে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি।

এদিন দুর্গাপুর পৌরসভা নির্বাচন চলছিল। চারিদিকে কড়া নিরাপত্তা। হোটেল রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ। নির্বাচন উপলক্ষে চারিদিকে একটা বেশ সাজ সাজ অবস্থা।

আমরা সোজা চলে গেলাম দূর্গাপুর থানায়। দূর্গাপুর থানায় নিয়ে আমরা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে আমাদের উদ্দেশ্য খুলে বললাম। তারা বেশ আনন্দেই আমাদের অনুমতি দিলো এবং যেকোন প্রকার সমস্যায় ওই অঞ্চলের চেয়ারম্যান এর নাম্বার আমাদেরকে দিয়ে দিল।

নেত্রকোনার এই এলাকাটি আসলে দুই ভাগে বিভক্ত। জারিয়া এবং ঝাঞ্জাইল। জারিয়া এলাকার ভিতরে পড়েছে সুসং দুর্গাপুর। দুর্গাপুর হলো এখানকার থানার নাম। বিরিশিরি সুসং ইউনিয়নে অবস্থিত।

থানা থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসে থানার মোড়ে একটা যেমন-তেমন রেস্টুরেন্ট পেলাম। খাবার মেনু ডিমের তরকারি অথবা মুরগির তরকারি। ইয়াশ ডিম দিয়ে খেলো আর আমি মুরগি দিয়ে খেলাম।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোমেশ্বরী নদী পায়ে হেঁটে পার হলাম। শীতের সময়ে নদীতে এমনি পানি কমে যায় তার উপর কাঠের ব্রিজ করা হয়েছে। ব্রিজ পার হয়ে ওপারে গিয়ে আমরা একটা অটো নিলাম। অটোতে করে আমরা সোজা চলে গেলাম রানীখং চার্চে।

আমাদের ইচ্ছা ছিল চার্চের টিলার উপরে সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে ক্যাম্পিং করার। কিন্তু করোনা জনিত কারণে চার্চ এ প্রবেশ নিষেধ। চেয়ারম্যান এর অনুমতি নিয়ে আমরা সোমেশ্বরীর একেবারেই পাড়ে ক্যাম্পিং করলাম, তাবু থেকে কয়েকহাত দূরেই নদীর হিম জল।

বিকালে তাবু ঠিক করে আমি একটা নৌকায় বসে সোমেশ্বরীর হিম শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে বসলাম। ওদিকে ইয়াশ শুরু করলো ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি। পেট যথেষ্ট ভরা থাকায় মাথা থেকে রান্নার চিন্তা উবে গেল। আমরা বেশ বিন্দাস মুডে বসে থাকলাম।

সোমেশ্বরীর এখানে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের ব্যাপারটি বেশ আদিম। আমাদের সামনে দিয়ে দুইজন নারী বিশুদ্ধ পানি নদী থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম আপনারা এই পানি কিভাবে সংগ্রহ করলেন? তারা আমাকে পদ্ধতি টা দেখাল, তারা নদীর পাড়েই কয়েকটা গর্ত করে রেখেছে পানি থেকে একটু দূরে। সেই গর্তের ভেতরে বিশুদ্ধ পানি ফিল্টার হয়ে জমা হচ্ছে, সেই পানি তারা পাত্রে করে নিয়ে যাচ্ছে।

পানি সংগ্রহের ব্যাপারটি আমার কাছে বেশ মজা লাগলো এবং আমি আশ্বস্ত হলাম যে বিশুদ্ধ পানির জন্য আমাদেরকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। আমি এমনিতেও নিশ্চিন্ত ছিলাম কারণ সাধারণত অপরিচিত জায়গায় গেলে আমরা পানি ফুটিয়ে খাই এবং আমাদের সাথে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও থাকে। ব্যাপারটি বলার পর ইয়াশ নিজেও ব্যাপারটা ঘুরে ঘুরে দেখল ব্যাপারটা আমাদের দুজনের কাছেই বেশ মজা লাগলো।

আমরা যেখানে ক্যাম্প করেছি এর আশেপাশে প্রচুর কয়লার স্তুপ। নদী থেকে সংগ্রহ করা কয়লা এখানে স্তুপ করা হচ্ছে। একটা যেমন তেমন ভাবে বানানো তাবুও দেখলাম একজনের। বুঝলাম এখানে একজন রাতে পাহারায় থাকে।

একটু পর সন্ধ্যা নামলে আমি আর ইয়াশ একটু চা এর আয়োজন করছি, চুলা বানিয়ে কেটলিতে পানি চড়িয়েছি এমন সময় দুজন লোক এসে হাজির হলো। একজনের পরনে বিজিবির পোশাক সাথে হাতিয়ার, অন্যজন সিভিল পোশাকে। তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলো আমি তাদেরকে পরিচয় দিলাম।

সিভিল পোশাকের লোকটির আচরণ বেশ খারাপ মনে হলো। লোকটি আমাদেরকে বেশ রুক্ষভাবে জিজ্ঞাসা করলো আপনারা এখানে ক্যাম্প করার জন্য কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন? আমি বললাম আমরা থানায় জানিয়ে এসেছি এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান এর সাথে কথাবার্তা বলেই আমরা এখানে ক্যাম্প করেছি।

তখন তারা জানতে চাইল এখানে একটা বিজিবি ক্যাম্প আছে। ক্যাম্পিং করতে হলে বিজিবি ক্যাম্পের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে, এটা কি আপনারা জানেন? আমি তাদেরকে জবাব দিলাম দেখুন আমি বাংলাদেশের নাগরিক, বিজিবির কাজ সীমান্ত পাহারা দেয়া দেশের ভিতরে কোন নাগরিক কোথায় কি করছে এটা দেখা বিজিবি দায়িত্ব নয়, এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর এবং স্থানীয় প্রশাসনের।

আমি দুইটা জায়গায় জানিয়ে এসেছি এরপরেও যদি আপনাদের কোন কিছু জানার থাকে আপনাদের কোনো সিনিয়র অফিসার বা কমান্ডিং অফিসার লেভেলের কাউকে আসতে বলুন আমি তার সাথে কথা বলে বিষয়টি বুঝে নেব। এ কথা বলার পর সিভিল ড্রেসের লোকটি চেয়ারম্যান কে ফোন দিলেন এবং নিশ্চিত হলেন যে আমাদের ক্যাম্প করার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন জানে। তারপর তারা চলে গেল এবং আমরা রাতের রান্নার আয়োজন করলাম।

আজ রাতে আমাদের রান্না ছিল এগ নুডুলস। ওখানকার স্থানীয় কয়লা পাহারাদার বলল যে ভাই আপনারা তো রাতে থাকবেন তাহলে আমি আজ একটু বাসায় থাকি, বাসায় গিয়ে ঘুমাই মানে সোজা কথায় আমরা আজ কয়লা পাহারাদার।

আমরা রাজি হলাম কারন আমরা একটু প্রাইভেসি চাচ্ছিলাম। আমরা চাচ্ছিলাম নিরিবিলি নির্জনে ক্যাম্পিং করতে, সেখানে একজন তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে আমাদেরও একটু দ্বিধা কাজ করতো। কাজেই আমরা বেশ খুশী মনে রাজী হলাম। উনি চলে গেলেন এবং আমরা দুজনে নুডুলস রান্না করে ফেললাম।

সেদিন ছিল পূর্ণিমার ২য় রাত। সোমেশ্বরীর ওপাশে মেঘালয়ের পাহাড়ে চাঁদ উঠেছে আজ। পূর্ণিমা রাতের চাঁদ আর হালকা কুয়াশা। বেশ দূরে কয়লা সংগ্রহকারী এবং কয়লা পাহারাদারদের টুকটাক কথাবার্তা ভেসে আসছিল। নুডুলস রান্না করে প্লেটে নিয়ে আমি আর ইয়াশ একটা নৌকায় গিয়ে বসলাম। নৌকায় বসে হাতে খাবারের প্লেট, মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সোমেশ্বরী, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

একটু ভেবে দেখুন তো চারপাশ নিরবতার মাঝে একটা নৌকায় দুইজন মানুষ চুপচাপ বসে বসে খাচ্ছেন আর পূর্ণিমা দেখছেন। নৌকাটা ও কিনা নদীতে ভাসছে। এভাবে প্রায় 15 মিনিট ধরে আমরা খাওয়া শেষ করলাম। নদীর উপরে হালকা কুয়াশা, ওপারে পাহাড়ের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ এই অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাকে আজকে স্তব্ধ করে দিলো।

আমরা প্রায় আধাঘণ্টা একেবারেই চুপচাপ বসে থাকলাম, পূর্ণিমা উপভোগ করলাম। তারপর আগুনের পাড়ে বসে চা বানালাম। চা বানিয়ে আবার আমরা ফিরে আসলাম নৌকায়। হাতে গরম চা এর মগ, চারপাশে পূর্ণিমা নদীতে চিকচিক করছে পূর্ণিমার চাঁদের আলো। মনে হল পৃথিবীর সবকিছু থেকে হারিয়ে গিয়েছি কিছুক্ষণের জন্য।

ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়াশ বলল ভাই জীবন খুব সুন্দর, খুব সুখের, একে উপভোগ করতে হলে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়না। খুব বেশি ব্যয় করতে হয় না, খুব সামান্য ব্যয়ে যেকোনো জায়গায় গিয়ে আমরা জীবনকে উপভোগ করতে পারি।

আমি একমত হলাম কারন সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি। জীবন এত সুন্দর হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরেছি, মানুষের স্বপ্ন থাকে এমন অনেক জায়গায় গিয়েছি, অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু খেয়েছি, অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, অনেক মানুষের সাথে সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছি কিন্তু সোমেশ্বরীর তীরে ওই হিমশীতল রাতটা আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল জীবন সুন্দর।

জীবনের সৌন্দর্য কে কখন কিভাবে উপভোগ করবে এটা আসলে কেউই জানেনা। এভাবে আমি আর ইয়াশ নৌকায় বসে বসে পূর্ণিমা উপভোগ করতে করতে রাত দুইটা বাজিয়ে দিলাম। এসময় ঠান্ডা বেড়ে গেল হঠাৎ করে, হিম শীতল বাতাস বইতে শুরু করল। ঐদিন নেত্রকোনার তাপমাত্রা ছিল 10 ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সোমেশ্বরীর পাশে ছিল হাড় কাঁপানো শীত। কাঁপতে কাঁপতে আমি আর ইয়াশ তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমরা স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে শুয়ে পড়লাম। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকেই আমরা চারপাশের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছিলাম। এভাবে কখন যে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি।

আমাদের ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। যথারীতি তাঁবুর ফ্লাপ খুলে সূর্যোদয় দেখার জন্য আমি আর ইয়াশ স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকেই চোখ খুলে শুয়ে থাকলাম। আমার হঠাৎ ইচ্ছা হল আজকের সূর্যোদয় টি তাঁবুর ভেতরে শুয়ে না দেখে সোমেশ্বরীর নৌকায় বসে পানিতে পা ডুবিয়ে দেখব। আমি উঠে বের হয়ে একটা নৌকায় বসে পানিতে পা ডুবিয়ে থাকলাম।

ওদিকে ইয়াশ ঘুম থেকে উঠে একটা গাছের গুঁড়ির উপরে বসলো। খুব আরাম করে আমরা সূর্যোদয় দেখলাম। সূর্যোদয় দেখে চা কফি বানিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা করেই আমরা তাবু গুছিয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসলাম।

আমাদের এবারের গন্তব্য দুর্গাপুরের বিখ্যাত টংক আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন এবং চিনামাটির পাহাড়। একটা রিক্সা নিয়ে আমরা বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড় এসে হাজির হলাম। আসার পথেই আমরা টংক আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন দেখে এসেছি। এখানে এসে চিনামাটির পাহাড় এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন দেখে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম কেননা আমাদের একটু তাড়া ছিল। পরের বার এসে আমরা সুসং দুর্গাপুর আবার ভালভাবে ঘুরে দেখব বলে নিজেদের মনকে প্রবোধ দিলাম। একই পথে জারিয়া ঝাঞ্জাইল ফিরে এসে বলাকা কমিউটার টিকেট করে আমরা ঢাকার পথ ধরলাম।

উত্তরের এই জনপদ নেত্রকোনা, বাংলাদেশের অন্যতম সহজ সরল মানুষদের দেশ। এখানকার মানুষ গুলো অসাধারণ এবন খুবই অতিথি পরায়ন। একটা সময় ছিল যখন বিরিশিরি পর্যটন স্পট হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিল কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বিরিশিরিতে ঢাকা বা অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটকদের আনাগোনা একটু কমেছে। তবুও বিরিশিরির সৌন্দর্য একটু অম্লান হয়নি বরং বিরিশিরি দিনে দিনে আরো সুন্দর হয়েছে।

আমি আর ইয়াশ ট্রেনে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের আরও একবার সুসং-দুর্গাপুরে আসতে হবে। নিজেদের মনকে আমরা প্রবোধ দিলাম যে, আমরা আবার আসব। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। ছোট্ট একটা দেশ।

হয়তো আমাদের একটা তাজমহল নেই, হয়তো আমাদের একটা আইফেল টাওয়ার নেই, হয়তো আমাদের একটা ইন্টারলেকেনের মতন গ্রাম নেই, হয়তো আমাদের স্ট্যাচু অব লিবার্টি নেই, হয়তো আমাদের নায়াগ্রা ফলস নেই, হয়তো আমাদের কিলিমাঞ্জারো নেই। কিন্তু আমাদের আছে নেত্রকোনা সুসং দুর্গাপুর, বিরিশিরি, বান্দরবান সেন্টমারটিন, সুন্দরবন এমন হাজারো জায়গা।

পুরো পৃথিবীতে ফেলার স্বপ্ন তো আমাদের সবারই আছে কিন্তু তার আগে নিজের দোষটা কেন আমরা একটু চষে দেখব না? আসুন না আগে নিজের দেশটা দেখি। এখানেই শেষ হচ্ছে আজকে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা দুইটা ক্যাম্পিং এর গল্প পরবর্তীতে আবার কোন এক গল্পে লেখা হবে অন্যকোন ভ্রমণের ইতিকথা।

নেত্রকোনা ভ্রমণ সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রয়োজন হলে নিচের কমেন্ট এ প্রশ্ন করতে পারেন। ভ্রমণ করুন বিশেষ করে একাকী নির্জনে ঘুরে নিজের দেশকে নিজের মত জানুন। দেশটা আপনার, প্রকৃতি আপনার, পৃথিবী আপনার। আপনার দেশ আপনার সম্পদ। আপনার সম্পদ কে নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে রেখে দিন।

সৌজন্যে: Najmus Sakib

পূর্ণ চন্দ্রিমায় ট্রাভেলার্স ক্যাম্পিং

পূর্ণ চন্দ্রিমায় ট্রাভেলার্স ক্যাম্পিং

কেমন হয় যদি একটা চন্দ্রিমা রাতে আপনি অনেকগুলো বিখ্যাত ট্রাভেলারের সাথে ক্যাম্প করেছেন কোন একটা নদীর পাড়ে, একপাশে ক্যাম্প আরেক পাশে ক্যাম্পফায়ার করে গোল হয়ে বসে আপনারা ভ্রমণের গল্প করতেছেন, খাচ্ছেন, আড্ডা দিচ্ছেন। জীবনে গল্প বলার মত এমন ড্রিম ট্রাভেল করার সুযোগ খুব কমই আসে, আমার জীবনে একবারই এসেছিল। সুযোগটা আমি মিস করিনি।

জানুয়ারীর হাড় কাপানো শীতের সপ্তাহে আমার পরিকল্পনা ছিল নেত্রকোনা যাব ক্যাম্পিং করতে। পরিকল্পনা মোতাবেক আমি আমার বহুদিনের বিশ্বস্ত এবং পুরানো ট্রাভেলার ভাই ইয়াশ এর সাথে যোগাযোগ করলাম। নেত্রকোনা যাচ্ছি তাও চিপ বাজেটে ক্যাম্পিং করতে এটা শুনে ইয়াস লাফিয়ে পড়লো। কোন চিন্তাভাবনা না করে হ্যা বলে দিল। আমি ম্যাসেঞ্জারে জানিয়ে দিলাম কি কি নিতে হবে।

দুপুর হওয়ার আগেই ইয়াস বারবার তাগাদা দিচ্ছিল। ভাই আমি রেডি কখন বের হবেন আমি রেডি এসব বলে পাগল করে দিচ্ছিল বেচারা। অফিস করে ধীরেসুস্থে সন্ধ্যাবেলা বাসায় আসলাম। ব্যাকপ্যাক গোছালাম, ইয়াশকে বলা ছিল আমরা রাত এগারোটার সময় মিরপুর 10 নাম্বারে দেখা করব, ওখান থেকে আমাদের ভ্রমণ শুরু যথাসময়ে ইয়াশ মিরপুর 10 নাম্বারে পৌঁছে গেছে এবং আমাকে বারবার ফোন দিচ্ছে। আমি আমার শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে হেলেদুলে বের হলাম ১১ টায়।

আমাদের টার্গেট ছিল এই ভ্রমনটা সবচেয়ে কম ব্যায়ে করার। সেজন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম বলাকা কমিউটার। ঢাকা থেকে বলাকা কমিউটার প্রতিদিন রাত চারটার সময় ময়মনসিংহ হয়ে নেত্রকোনা জারিয়া ঝাঞ্জাইল স্টেশন পর্যন্ত যায়। ভাড়া নেয় দূরত্বভেদে 20 টাকা থেকে 75 টাকা। আমাদের যেহেতু জারিয়া পর্যন্ত যাওয়ার প্ল্যান ছিল সেজন্য 75 টাকা করে দুইটি টিকিট কেটে নিলাম। রাত ১২ টার ভেতরেই স্টেশনে চলে এসেছি, এখন আমাদের রাত পার করতে হবে বিধায় আমি আর ইয়াশ ষ্টেশনে চা খেতে খেতে সময় কাটাতে লাগলাম।

রাতটা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে কাটতে লাগলো। একটা সময় প্লাটফর্মে আমি আর ইয়াশ পাশাপাশি হেলান দিয়ে বসে ঘুমিয়ে গেলাম। ঠিক 4 টার সময় ট্রেন কমলাপুর থেকে আসলো আর আমরা ট্রেনে চড়ে বসলাম।

ঢাকা শহর ছাড়তে ছাড়তে ততক্ষনে ভোর হয়ে গেছে। ট্রেন যখন গাজীপুরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল সে সময় ভোরের আলো ফুটেছে চারিদিকে। ঘুম পেলেও কিসের ঘুম? আমি আর ইয়াশ দুজন ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে কিছু ছবি তুললাম। ইয়াশ কিছু ভিডিও শুট করে নিল।

ভোরের আলোয় অনিন্দ্যসুন্দর গাজীপুরকে দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে আমরা গাজীপুর পার হচ্ছিলাম। ট্রেন মোটামুটি যখন ময়মনসিংহের কাছে চলে এসেছে তখন চ্যাটিং শুরু হয়েছিল ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ (টিওবি) এর এডমিন জুয়েল রানা ভাইয়ের সাথে। উনি ময়মনসিংহের জামাই, শশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। উনারা ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে একটা ক্যাম্পিং করবেন। জুয়েল রানা ভাই আমাদেরকে চ্যাটেই দাওয়াত দিলেন আমরা যেন ময়মনসিংহে নেমে যাই এবং উনাদের সাথে একরাত ক্যাম্পিং করি। কথাটা ইয়াশকে খুলে বললাম, ইয়াশ খুব আনন্দের সাথেই রাজি হয়ে গেল, কারন আমরা দুই বোহেমিয়ান ইচ্ছামত ঘুরতে বের হয়েছি। যেখানে রাত সেখানে কাত এভাবে ট্রাভেল করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য।

ময়মনসিংহ স্টেশনে ট্রেন আসামাত্র আমরা নেমে গেলাম। তখনো প্রচন্ড শীত ময়মনসিংহে, সূর্য তার মুখ দেখায়নি। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। এর ভেতরে আমি আর ইয়াশ স্টেশন থেকে নেমে একটা অটো রিকশা নিয়ে চলে গেলাম ময়মনসিংহ জয়নুল আবেদিন পার্কে। পার্কে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে নিলাম। এরপর আমি আর ইয়াশ কুয়াশাচ্ছন্ন পার্কে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। এর মধ্যে কয়েকবার জুয়েল রানা ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা হয়েছে। উনি জানালেন উনারা পুরা টিম কয়েকভাগে ভাগ হয়ে আসবেন। আমি আর ইয়াশ সকালের নাস্তা করে নিলাম। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি পরে ইয়াশ বলল ভাই চলেন ওপারে যাই ক্যাম্প করে ফেলি।

এপারে এসে জুয়েল রানা ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলে উনারা যে লোকটিকে ঠিক করে রেখেছিল তাকে খুঁজে বের করলাম। তাকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলে ক্যাম্প সাইট ঠিক করে একটা নৌকার পাশে তাবু ফিট করলাম। কারন ততক্ষনে দুপুর হয়ে যাচ্ছিল। আমাদেরকে লাঞ্চ করতে হবে, রান্না করতে হবে। আমরা ক্যাম্পসাইটস ঠিক করে বসা মাত্র এসে হাজির হলেন জুয়েল ভাই। একটু পর উনার সাথে গল্প করতে করতে আমি আর ইয়াশ রান্নাবান্নায় হাত লাগালাম। আমাদের প্ল্যান ছিল দুজনের জন্য ডিম খিচুড়ি রান্না করবো, কিন্তু যেহেতু জুয়েল রানা ভাই চলে এসেছেন স্বাভাবিকভাবেই উনি আমাদের মেহমান হয়ে গেলেন। আমি আর ইয়াশ কাজ ভাগ করে নিলাম।

প্রথমেই ইয়াশ চুলা বানাতে বসলো, আমি পানি নিয়ে আসলাম এবং সমস্ত কাটাকাটি করে চালডাল সব ধুয়ে রেডি করে দিলাম। চুলা বানাতে ইয়াসের একটু সময় লাগছিল তাই আমি ব্যাগ থেকে আমার ম্যাশেটি বের করে কাঠের সন্ধানে বের হলাম। এদিকে বিকেলবেলা ঘোরাঘুরি করার জন্য উত্তম তাই প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসে, পিকনিক করে তাই এদিকে শুকনা কাঠ ডালপালা এসবের অভাব বেশ প্রকট। একটা শুকনা গাছ পেলাম যেটা মরে গিয়ে লাকড়ি হয়ে গেছে, আমি ওখান থেকে বেশ কষ্ট করে কিছু কাঠ কেটে নিয়ে আসলাম। ইয়াশ বলল এতেই হয়ে যাবে। আসলে রান্নাবান্নার সেগমেন্টে আমি সবসময় ইয়াশ এর উপরে নির্ভরশীল কারণ ও রান্না-বান্না আমার চেয়ে ভালো করে এবং বেশ গুছিয়ে করে। তো জুয়েল রানা ভাই ও একটু হেল্প করতে লাগলো, আমরা রান্না চড়িয়ে দিলাম। তিনজন মিলে টুকটুক করে গল্প, আড্ডা ও নিজেদের ভ্রমণকাহিনী শেয়ার এসব করতে করতে আমাদের রান্না করে ফেললাম।

রান্না শেষ করেই আমরা খেতে বসলাম। জুয়েল রানা ভাইয়ের সাথে ক্যাম্পিঙের রান্নাবান্নার চুলা, পাতিল এগুলো ছিল সেখান থেকে উনি প্লেট বের করে খাওয়া-দাওয়া শুরু করলেন। আমরা ৩ টা প্লাস্টিকের চেয়ার জোগাড় করলাম এবং গল্প করতে করতে মজা করে দুপুরে লাঞ্চ শেষ করলাম। আমরা লাঞ্চ শেষ করে সবে মাত্র বিশ্রাম নিচ্ছি এমন সময় হাজির হলেন রাজন ভাই। অদ্ভুত একজন ফটোগ্রাফার এবং এডিটর।

পূর্ণ চন্দ্রিমায় ট্রাভেলার্স ক্যাম্পিং

রাজন ভাই আসার পর পরিচিত হয়ে আমি লুঙ্গি পড়ে নেমে গেলাম হাড় কাঁপানো শীতে ব্রহ্মপুত্র নদীতে গোসল করতে। পাশেই নদী আর আমি একটু দাপাদাপি করব না আমি এটা হয় না। ইয়াশ বারণ করল ঠাণ্ডা পানিতে গোসল না করার জন্য, কিন্তু আমি নেমে গেলাম। গোসল করে রান্নার সরঞ্জাম গুলো ধুয়ে মুছে উঠে আমি,ইয়াশ, রাজন ভাই আর জুয়েল ভাই আড্ডা দিচ্ছিলাম। সে সময় সপরিবারে দেখা করতে আসলেন আমাদের কেওকারাডাং ভ্রমণের মিল্টন ভাই।

মিল্টন ভাইয়ের সাথে সেই কেউকারাডং ভ্রমণের পর এই প্রথম দেখা হল। মিল্টন ভাই অনেক মজার মানুষ, আমাদের কেউকারাডং ট্রিপে অনেক মজা করেছে। তিনি আমাদের সাথে ভাবির পরিচয় করিয়ে দিলেন, বেশ হ্যাপি কাপল উনারা। ভাইয়ের দুইটা ছোট কিউট মেয়ে আছে তাদের সাথে পরিচয় হলাম। আমরা একসাথে একটু হাঁটাহাঁটি করতে বের হলাম। একসাথে চা খেলাম, একটু ঘোরাফেরা করে রাতে আসার কথা দিয়ে মিল্টন ভাই সপরিবারে বিদায় নিলেন।

ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, নদীর এপার থেকে ওপারে ময়মনসিংহ শহরে বাতি গুলো এক এক করে জ্বলতে দেখছি। মনে হচ্ছে আমরা সমুদ্রের মাঝে নাবিক, জাহাজে বসে সমুদ্রতীরবর্তী কোন নগরীর দৃশ্য দেখছি। কিছুক্ষণ পর একটা বাইকার দল আসলো।

বাইকার দলে ছিল টিওবির এডমিন সবুজ ভাই, রিয়াদ ভাই, ভাবি সহ একগাদা সিনিয়র ফেলো ট্রাভেলার্স। সবার সাথে পরিচয় হলাম। উনারা ক্যাম্প সাইটে তাবু ফিট করলেন, ক্যাম্প ফায়ার করার জন্য লাকড়ি নিয়ে আসা হল কিন্তু ঠিক করা হলো ক্যাম্প ফায়ার করা হবে রাতের ডিনার এর পর।

রাতের ডিনার বানানোর দায়িত্ব পড়ল আমার আর রাজন ভাইয়ের উপরে। রাতের মেনুতে ছিল স্যুপ নুডুলস আর চা। ক্যাম্পিং এ আসলে হালকা এসব খাবার খেয়েই কাটানো হয়। আমি নুডুলস বানানোর জন্য আমাদের লোকাল গাইড এর বাসায় গেলাম, সেখানে গিয়ে রাজন ভাই আর আমি গল্প করতে করতে এক পাতিল স্যুপ নুডুলস রান্না করলাম। রান্না করে নিয়ে আসতে আসতে দেখি আমাদের কেওকারাডাং ট্রিপের ময়মনসিংহের প্রায় সবাই হাজির, শুধুমাত্র বকুল ভাই নাই। গত বছরের শুরুতে বকুল ভাই বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে পরলোকে চলে গিয়েছেন।

অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা হওয়া মাত্রই আমরা কেন যেন সবাই একটু শোকাচ্ছন্ন হয়ে গেলাম বকুল ভাইয়ের জন্য। বকুল ভাই খুব মজার মানুষ ছিলেন। আমি, মিল্টন ভাই, শাওন ভাই আর বকুল ভাই লালা বম এর কটেজে সারারাত আড্ডা দিয়েছিলাম কেওকারাডং এ। বকুল ভাইয়ের জন্য আমাদের কষ্ট হচ্ছিল। সে সময় মনে হচ্ছিল কিছু একটা নাই, একটা খালি খালি ভাব তবু আমরা অনেকক্ষণ গল্প করলাম। গল্প করতে করতেই পরিদর্শক টিম এবং আমরা ক্যাম্পাররা মিলে একসাথে ডিনার করলাম।

সেদিন আবার ছিল পূর্ণিমা রাত, চাঁদ উঠেছিল আকাশে। চাঁদের আলোয় অনেকক্ষণ গল্প করলাম। এরপর ময়মনসিংহ টিম বিদায় নিল। আমরা ক্যাম্প ফায়ার জ্বালালাম। ক্যাম্প ফায়ার করে তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আমরা মেতে উঠলাম ভ্রমণ আড্ডায়। অনেকক্ষণ ধরে আমরা সকলেই আমাদের বিভিন্ন রকম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। আমি আর ইয়াশ বললামই কম, শুনলাম বেশি কারণ প্রায় সকলেই ছিল আমাদের চেয়ে অভিজ্ঞ এবং সিনিয়র ভ্রমণকারী। তাদের কাছ থেকে শোনার এবং শেখার অনেক কিছু ছিল, সেগুলো আমি আর ইয়াশ শুনতে লাগলাম। এভাবে আড্ডা দিতে দিতে কখন যে রাত 2 টা বেজে গেছে আমরা টের পাইনি। ততক্ষণে দু-একজন ঘুমাতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল বিধায় আড্ডার হাট ভেঙে গেল। আমরা উঠে সকলেই যে যার যার তাবুতে চলে গেলাম। টুকটাক গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।

সকালবেলা উঠে তাবুর ফ্লাপ খুলে সূর্যোদয় দেখা আমার অন্যতম একটা নেশা। পরদিন সকালবেলা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে সূর্য উঠলো উজ্জ্বল রূপে। তাবুর ফ্লাপ খুলে শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে সেই সূর্যোদয় দেখলাম। তাঁবুর ভেতর থেকে প্রতিটি সূর্যোদয় দেখতে আমার ভালো লাগে, প্রতিটি সূর্যোদয় অন্যরকম নেশা ধরায়। স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে পা ডুবিয়ে সূর্য দেখছি, পাশে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ইয়াশ।

ওকে ডেকে তুললাম। ও ফোন নিয়ে বের হল এবং সুন্দর সুন্দর বেশ কিছু ছবি তুললো, কিছু ভিডিও শুট করল। এরপর আমরা আড়ামোড়া ভেঙে সবাই উঠে পড়লাম। জুয়েল রানা ভাইয়ের স্টোভ আর আমার কেটলিতে চা বসালাম। সবারই ব্যাকপ্যাক ঝাড়া দিয়ে কিছু বিস্কিট, কিছু, চিপস এসব বের হলো। এসব দিয়ে আমরা চা নাস্তা করলাম। এরপর পাশেই একটা ইসকন মন্দির ছিল সেখানে গিয়ে আমরা সবাই ফ্রেশ হলাম। ক্যাম্প সাইট গুছিয়ে ফেললাম।

পূর্ণ চন্দ্রিমায় ট্রাভেলার্স ক্যাম্পিং
পূর্ণ চন্দ্রিমায় ট্রাভেলার্স ক্যাম্পিং

সবাই একটু আড্ডা দিয়ে আমাদের গ্রুপ ফটোগ্রাফি করে যে যার মত বিদায় হওয়ার জন্য রেডি হলাম। আমাদের একটু তাড়া ছিল কারণ আমরা ময়মনসিংহ থেকে জারিয়াগামী বিখ্যাত মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ধরবো। ওই ট্রেন ধরার জন্য আমাদেরকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে। যদিও আমরা ঠিকই বিখ্যাত সেই ট্রেন মিস করেছিলাম। তা সত্বেও ময়মনসিংহ থেকে সিএনজি দাবড়িয়ে শ্যামগঞ্জ থেকে ঠিকই মহানন্দায় চড়েছিলাম। বিখ্যাত এই সুপার স্লো ট্রেন ধরার সেই গল্প আরেকদিন লিখবো। আপাতত আজ এখানেই ফেলো ট্রাভেলারদের সাথে আমাদের ময়মনসিংহের পূর্ণিমা রাতে গল্পটি শেষ হলো।

পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। এর প্রতিটি কোনায় দেখার জন্য, শেখার জন্য, জীবনের আনন্দ নেওয়ার জন্য লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। পৃথিবীর প্রতিটা কোনায় পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সৌন্দর্য, গল্প আর অভিজ্ঞতা।

যদিও গত কয়েক শতাব্দীতে মানুষের অত্যাচারে পৃথিবীর সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে, পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে তবুও এখনো সুযোগ আছে পৃথিবী কে সুস্থ করে বাঁচিয়ে রাখার, বাঁচিয়ে তোলার। কয়েক শতাব্দী আগের সেই সুন্দর পৃথিবী আবার নতুন করে গড়ে তোলার জন্য আমাদেরকে সবার আগে পরিবেশের প্রতি নজর দিতে হবে। প্লাস্টিক বর্জন করতে হবে। আমাদের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে এবং সর্বোপরি আমাদের চারপাশের সবাইকে এই পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।

ময়মনসিংহ ভ্রমণ সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রয়োজন হলে নিচের কমেন্ট এ প্রশ্ন করতে পারেন। ভ্রমণ করুন বিশেষ করে একাকী নির্জনে ঘুরে নিজের দেশকে নিজের মত জানুন। দেশটা আপনার, প্রকৃতি আপনার, পৃথিবী আপনার। আপনার দেশ আপনার সম্পদ। আপনার সম্পদ কে নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে রেখে দিন।

আগামী পর্ব- হিম সোমেশ্বরী আর দুই দুঃসাহসী

সৌজন্যে: Najmus Sakib

চন্দ্রাবতীর পালা

চন্দ্রাবতীর পালা

চন্দ্রাবতী এক কিংবদন্তির নাম। প্রায় ৫০০ বছর আগে এই বঙ্গীয় উপদ্বীপে জন্ম নেয়া চন্দ্রাবতী নিছক একজন পালাকারই ছিলেন না! ছিলেন সুন্দরী, বিদুষী এবং সর্বোপরি চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর এক দ্রাবিড় রমণী ।

মধ্যযুগে বাংলার প্রথম সার্থক মহিলা কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন বাবার মতো ভাসান কবি, গীতিকার আর রামায়ণের রচয়িতা। মৈমনসিংহ গীতিকার পরতে পরতে মিশে আছে কবি চন্দ্রাবতীর অমর কাব্য, প্রেম আর বিরহের উপাখ্যান।কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাতুয়াইর গ্রাম।

চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বাল্যসখা জয়ানন্দের বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয়। । দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা।

বাল্যপ্রেমকে পদ-দলিত করে চঞ্চলমতি জয়ানন্দ ত্রিভুজ প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে। যে সন্ধ্যায় চন্দ্রাবতী বিবাহবেশে অপেক্ষমাণ সে সন্ধ্যায় খবর আসে, আসমানি নামের এক মুসলমান মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে কাপুরুষ জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে তাকেই করেছে বিয়ে! এ নিদারুণ সংবাদে লগ্নভ্রষ্টা-চন্দ্রাবতীর হৃদয় ভেঙে যায়, স্তম্ভিত চন্দ্রাবতী নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন।

এক সময় নির্জন আর বন-জঙ্গলে ঘেরা অনেকটা দুর্গম পাতুয়াইর গ্রাম ছিল ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। পরাহত প্রেম আর চরম অপমানের জ্বালা ভুলবার জন্য চন্দ্রাবতী পিতার উপদেশ শিরোধার্য করে তাঁর কাছে দুটি প্রার্থনা করেন।

প্রথমটি, ফুলেশ্বরী নদী-তীরে একটি শিব-মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবার অনুরোধ। দ্বিতীয়টি, চিরকুমারি থেকে বাকি জীবন শিবের-সাধনায় নিয়োজিত থাকার অনুমতি।

কিছুকাল পরে মোহ কেটে গেলে অনুতপ্ত জয়ানন্দ পুনরায় ফিরে আসে চন্দ্রাবতীর কাছে। তখন চরাচরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে চন্দ্রাবতী সন্ধ্যারতি এবং শিবের পূজায় মগ্ন।

রুদ্ধদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে জয়ানন্দ বারবার চন্দ্রাবতীকে নাম ধরে ডেকেও কোন সাড়া পায়না। এই নীরবতাকে চন্দ্রাবতীর প্রত্যাখ্যানের ভাষা মনে করে ব্যর্থ-মনোরথ জয়ানন্দ, লাল রঙের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দরোজায় ৪ ছত্রের একটি পদ লিখে সে স্থান ত্যাগ করে-

“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী
পাপিষ্ঠ জানিয়ো মোরে না হইল সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো”

পূজা শেষে মন্দিরের দরোজা খুলে চন্দ্রাবতী লেখাটি দেখতে পান। মন্দির অপবিত্র হয়েছে ভেবে মন্দির গাত্রে উৎকীর্ণ সে লেখা মুছে ফেলার জন্য তিনি নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন নদীর জলে ভাসছে জয়ানন্দের মৃতদেহ। মুহূর্তে তাঁর জীবনের সব আলো নিভে যায়।

জয়ানন্দের মৃত্যু থামিয়ে দেয় চন্দ্রাবতীর জীবন। প্রাণের আবেগ সম্বরণ করতে না পেরে প্রন্মত্তা-ফুলেশ্বরীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়ানন্দের শেষযাত্রায় তিনিও সঙ্গী হন। এভাবেই চন্দ্রাবতী তাঁর প্রেমকে অমর করে রেখে গেছেন, সেটা ১৬০০খৃস্টাব্দের কথা।

চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি-
* মলুয়া
* দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ)
* রামায়ণ(অসমাপ্ত)

চন্দ্রাবতী এক কিংবদন্তির নাম। প্রায় ৫০০ বছর আগে এই বঙ্গীয় উপদ্বীপে জন্ম নেয়া চন্দ্রাবতী নিছক একজন পালাকারই ছিলেন না! ছিলেন সুন্দরী, বিদুষী এবং সর্বোপরি চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর এক দ্রাবিড় রমণী ।

কিন্তু দীর্ঘদিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহাসিক স্মৃতি। পাশেই রয়েছে আরো একটি মন্দির ও ভগ্নপ্রায় একটি দ্বিতল ভবন।

বাড়িটি চন্দ্রাবতীর পূর্বপুরুষ জমিদার নীলকণ্ঠ রায়ের বলাহয় । জমিদার নীলকন্ঠ রায়ের নামে এলাকার নাম হয় নীলগন্জঁ। হুমায়ূন আহমেদ এর ‘সুখী নীলগঞ্জ’ নাটকের দৃশ্যায়ন হয় নীলগঞ্জে।

দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন চন্দ্রাবতীর বাড়ী দ্খতে। কিন্তু মন্দিরের দৈন্যদশা দেখে হতাশ হন অনেকে। — জালালপুর নীলগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ.

বাঁশখালী ভ্রমণ চিত্র

বাঁশখালী ভ্রমণ চিত্র
২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১, শুক্রবার।

হাঁড়ি-পাতিল আর এক বস্তা বাজার নিয়ে আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে প্রচুর বকছি Abdullah Al Noman কে। লেইট মফিজ, সবসময় লেইট করে।

ওহ, গন্তব্য হচ্ছে বাঁশখালি সমুদ্র সৈকত। গ্রুপ মেম্বার ১৬জন।
রওনা করলাম ৭:৩০ এর চিটাগংমূখী ট্রেনে করে। বন্ধুরা মিলে ট্রেন ভ্রমণের মজাটা অনেকেই হয়ত অনুভব করতে পারছেন।

৯:৪৫টা, আমরা চিটাগং ট্রেন স্টেশনে পৌছালাম। তারপর, বড় একটা চিএনজি নিয়ে সোজা বাঁশখালি সৈকতে।

আহা! এই যায়গা ছেড়ে আগামীকাল কিভাবে বাসায় ফিরবো?? প্রেমে পড়ে গেলাম যে!

চারিদিকে খোলা বালি কঠোর রোদে চিক চিক করছে। এদিকে সবার পেট থেকে হাহাকারের চিত্র ফুটে উঠেছে চেহারায়। প্রচুর ক্ষুধা, উফ! কোনোমতে ক্ষুধা মিটানোর জন্যে যেই একটা হোটেলে ঢুকলাম হতাশা নিয়ে বেরোতে হলো। তাদের হোটেলে অগ্রিম অর্ডার ছাড়া ভারি খাবার(ভাত,মাছ, মাংস) পাবো না। আছেই একটা মাত্র হোটেল। কি করি এখন?? অর্ডার করার পর কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগলো খাবার আসতে। এই সময়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নামাজ সেরে নিলাম। আহা! খাবার টা যেমন-ই হোক, ক্ষুধার্ত পেট আমার ভীষণ তৃপ্ত।

মূলত আমরা দু’দিনব্যাপি বনভোজনে এসেছি। থাকতে হবে ক্যাম্প করে। পরিকল্পনা মোতাবেক ৫টা তাবু আর দুদিনের খাবারের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সরঞ্জাম সাথে এনেছি।

সূর্য ধীরে-ধীরে তার রাতের গন্তব্যে ফিরছিল। আহা! সে কি মনোরম দৃশ্য। আসলে খাবার শেষ করে সবাই নিজ নিজ ভাবনা থেকে অঞ্চলটার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।

বিকাল ৫:৪০ টা বেজে গেলো। লাকড়ি দরকার সারারাত জ্বালানোর জন্যে। ভাগ্যিস ক্যাম্পের পাশেই একটা শুকনো গাছ পেয়ে গেলাম। বডিবিল্ডার বন্ধু Naimul Islam Ifan এই গাছ মাটিতে শোয়াবে। গাছ কাটার জন্যে রামদা দিলো ক্যাম্পের পাশের এক দোকানী। লোকটা ভীষণ উপকারী এবং ভালো মানুষ বটে।

রাতের খাবার ছিল কাবাব+পরটা(৪টা)। কাবাবের মুরগী কিনতে গিয়েছে টীম লিডার Anamul Hoque সাথে Mahmud Saleh

এদিকে ত্রি ইডিয়ট ( M R Rony, noman, MD Jahirul Islam ঘুরছে সে এলাকার ঢাকাইয়া বরই চুরি খাওয়ার ধান্দায়। চলে গেলো অন্ধকার পথ ধরে নির্দিষ্ট গাছের তলায়। বরই চুরি শেষে বীচ ধরে ক্যাম্পে ফেরার সময়টা ছিল সবচেয়ে মজার।

হাঁটার পথে পায়ের সাথে লাল কাঁকড়া দেখে ভয়ই পেয়েছিলাম প্রথমে। দুষ্টের দলতো এই কাঁকড়া ছাড়বে না।
ওমা! সামনে দেখি শত-সহস্র কাঁকড়া। ধরতে ধরতে প্রায় ১০০ পিস ধরে ফেললাম। এবার চিন্তা পড়ে গেলাম এগুলো কি খাওয়া যাবে কিনা আসলে?? পরে সিওর হয়ে নিলাম যে খাওয়া যাবে।

রাত ১০:৩০ টা।
কেন্ডল জ্বালানো ক্যাম্পটা দেখতে কি যে দারুণ লাগছিল আহা! চা বানিয়ে খাওয়ালাম সবাইকে।
ক্যাম্পের সামনে কাবাবের আয়োজন চলছে।

৩:৩০টা।
মাঝরাতে খুব ঘুম পাচ্ছে। তাবুতে ঢুকে কি আর মশার জ্বালায় ঘুমানো যায়?? তাও রেস্টের জন্যে শুয়ে থাকলাম।

দ্বিতীয় দিনঃ

চোখ মেলে দেখি সকাল ১০:০০ টা বাজে। চা বন দিয়ে নাস্তা সারলাম। ওয়েদারটা মারাত্মক সুন্দর। ফুটবল তো খেলা-ই যায় বীচ ধারে।

এই, দুপুরের খাবার রেডি করবি না??
টীম লিডারকে মনে করিয়ে দিলাম। দুপুর ১২:৩০ টায়। তখনও বাজার হয়নি। তাড়াহুড়ো করে বাজারে গেলাম। এসে গোসল করলাম সেই গ্রামের একটা পুকুরে। এভাবেই “বিরিয়ানি” প্লেটে উঠতে উঠতে সময় সময় গড়ালো ৪:৫০ টা।

বড্ড দ্বিধায় পড়ে গেলাম,ধুর!
এই যায়গা ছেড়ে যাবো কি যাবো না? নাহ! যাবো না। থেকেই যাই।

তিনজন সিওর হলাম আর সবাই চলে গেলেও আমরা থেকে যাবো। গ্রুপের কয়েকজন জনের জরুরী কাজ থাকায় আর কয়জন অসুস্থ অনুভব করায় তারা থাকতে পারছে না। চলে যাবে তারা। আরো দু-চারজন দ্বিধায় আছে।
পরে আমরা মোট ৭ জন কনফার্ম হলাম আমরা থাকছি।

গ্রুপের বাকি ৯ জন রওনা করছে। আমরা বিদায় দিয়ে দিলাম তাদেরকে। আর মনে মনে ভাবছিলাম আজকের রাতটাই হবে সবচেয়ে মজার।

আমাদের স্টকে খাবার শেষ। দুটো হাফ বোতল কোক ছাড়া কিচ্ছু নেই আর। ভাবলাম রাতটা মুড়ি চানাচুর খেয়ে কাটিয়ে দিবো। কিনে আনা হলো মুড়ি চানাচুর।

রাত ৯:০০টা- ১২:০০টা।
সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছি। মনে হচ্ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে এই বীচটা আমার। আবার ভাবছিলাম এটা আমার পৃথিবী। হ্যাঁ, আমার একান্ত।
আমরা ৭ জন তাবু ছেড়ে বীচ পাড়ে বসে আছি। চারিদিক অনেক শান্ত, স্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই।

আরে, কে ওখানে?
তাবুর পেছনে হঠাৎ দু-চারজন লোক ছোটাছুটি করছে। থমথমে এই পরিবেশে আচমকা মনের ভেতর এক উত্তাল, ভয়। কেমন যেন উদ্ভট আচরণ করছে কিছু ছেলেপেলে।
দৌড়ে তাবুর কাছে গেলে তাদের একজন সামনে এগিয়ে আসে।
-ডাব হাইবানে?
-হ্যাঁ, খাবো তো! এনে দিতে পারবেন?
-হাইজ্জুম, তোঁয়ারা থাক, ফারি আনির। আঁরা আর তিনজন আছেদে।

তারা উপস্থিত তিনজন আমাদেরকে ডাব অফার করলো। আবার বলে গেলো পেছনে তাদের আরো তিনজন লোক আছে।
এরা এত রাতে এখানে এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছে? ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছে নাতো?
আবার ডাবের কথা শুনে না বলতেও পারলাম না।

যাইহোক,সন্দেহের জের ধরে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। যেহেতু আমরা বনভোজনে এসেছি সেহেতু রান্নাবান্না-র কাজে কিছু হাতিয়ার(দা, ছুরি ইত্যাদি)নিয়ে এসেছিলাম। সেসব নিয়েই প্রস্তুতি।
দু একজনের হাতে লাঠি।
মাহমুদের প্ল্যানঃ- তাবুর দক্ষিণ পাশে সে উত্তরে আমি আর তপু গাছের পেছনে থাকবো।
যদি তারা এটাক করে তাহলে আমরা তিনদিক থেকে গর্জন করে এটাক করে তাদেরকেই তাক লাগিয়ে দিবো।
(অবস্থান এবং অবস্থা অনুযায়ী আমাদের এই ধরনের চিন্তা করা এবং প্রস্তুতি নেওয়া সময় সাপেক্ষ এবং যৌক্তিক ছিল।)

দূর থেকে তাদের উদ্ভট আচরণগুলো পর্যবেক্ষণ করছিলাম। যদিও অনেক দূর থেকে ভালো করে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।

১:৪৫ টা। ঘন অন্ধকারে বন দিয়ে তারা দৌড়ে আসছে। আমরাও প্রস্তুত। মাহমুদের নির্দেশনা অনুযায়ী “থেরাপি” বলে হাঁক ডেকে এগোবো।
আস্তে আস্তে আমরা গোলাচ্ছি। ওরাও একদম কাছে। আসছে…

ওরে! ওরাতো সত্যিই ডাব নিয়ে এলো! কিন্তু তাদেরকে ভালো মানুষ ভাবা ভুল। তারা এই ডাব চুরি করে এনেছে।
যাইহোক, আমরা প্রতি পিস ডাব৩০ টাকা করে কিনে নিলাম। রাতে এই ডাব আর মুড়ি চানাচুর ই আমাদের খাবার ছিল।

তৃতীয় দিন। ভোর ৬:৫০ টা।

সকালে গ্রামটা ঘুরে দেখার প্ল্যান ছিল। রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। ফিরে এসে দেখি আমাদের তাবুর দিকে মুখ করে একদল মহিলা উরাধুরা গালি দিচ্ছে।
পরে বুঝলাম, সেই মহিলার গাছ থেকেই ডাব চুরি হয়েছে।

এখন পুরো দোষ আমাদের। হয়তো চোর ধরে দিতে হবে নয়তো জরিমানা গুনতে হবে।
আমরা অবশ্য চালাকি করে গত রাতে চোরদের সাথে একটা সেল্ফি তুলে রেখেছিলাম।
পরে আর কি করার, সেই সেল্ফিটা দেখিয়ে বাঁচলাম।

বাঁচলাম বললেই কি আর বাঁচা যায়? চোরেদের কানে খবর পৌছেছে যে, তাদের কথা ফাঁস হয়ে গেছে।
তারা ওতপেতে বসে আছে আমাদের জন্যে।

গ্রামের কিছু লোক ইনফর্ম করেন যে, আপনাদের জন্যে ফন্দি এঁটে আছে তারা। আপনারা এদিক দিয়ে যাবেন না।
পরে তাদের পরামর্শে আমরা উলটো পথ ধরে চলে এলাম।

আসার পথে সেই গ্রামের অনেক মানুষই খোজ নিলো, কোনো সমস্যা হলো কিনা? তারা অনেকেই অনেক সাহায্য করেছিল। মানুষগুলো দারুণ অতিথি পরায়ণ।
৩ দিন ২ রাতের সফরে এলাকাটি, সমুদ্র পাড় আর ওখানকার মানুষগুলো অনেক আপন হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল আরো কটাদিন থাকি।

যাকগে, প্রথমে মোশালি(মোশারফ আলি) বাজার হয়ে গুনাগরি বাজার, তারপর সেখান থেকে বাসে চট্রগ্রাম ট্রেন স্টেশন। বিকাল ৫:০০ টার ট্রেন ধরলাম।
চলন্ত ট্রেনের ঝনঝন শব্দ মনে লাগছিল। ইশ! যদি ট্রেনটি না থামতো!
ট্রেন থেমে গেলো ফেনী স্টেশনে। হঠাৎ বুকে খুব ব্যাথা অনুভব হলো। এই ভ্রমণের ইতি ঘটা খুব জরুরি ছিল!?

[বিঃদ্রঃ ১. ভ্রমণে গিয়ে ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট যায়গায় ফেলুন।
২. এমন নির্জন সমুদ্র সৈকত কিংবা পাহাড়ে ঘুরতে গেলে রাতে কোনো মানুষের সাথে দেখা হলে সতর্কতার সাথে হেন্ডেল করার চেষ্টা করুন। তাদের যে কোনো অফার ফিরিয়ে দিন।
৩. নির্জন যায়গায় ক্যাম্পিং করতে গেলে অবশ্যই সেইফটি গিয়ার সঙ্গে রাখবেন।]

ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম। — feeling fantastic at Banskhali Sea Beach.

হরিনছড়া গলফ মাঠ

শ্রীমঙ্গলের যারা বেড়াতে আসেন সময় করে যেতে পারেন হরিনছড়া গলফ মাঠে। অত্যন্ত সুন্দর এই মাঠের একপাশে রয়েছে রাবার বাগান আর অন্যপাশে চা বাগান।

হরিনছড়া গলফ মাঠ
হরিনছড়া গলফ মাঠ

শ্রীমঙ্গল শহর থেকে হরিনছড়ার দূরত্ব প্রায় ১৮ কি:মি:। যেতে হবে সিএনজি অথবা ছোট গাড়ি রিজার্ভ করে।

দয়াকরে পরিচ্ছন্ন মাঠটি আবর্জনা ফেলে নষ্ট করবেন না।

Credit: Escapist Antu

কালা পাহাড়

শ্রেণী : লংলা~হাড়ারগজ পর্বতশ্রেণী
উচ্চতা : 1,098 feet (GPS accuracy +/-3 m)
স্থানাঙ্ক : 24°24.586’N | 92°04.792’E

কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার
কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার

পরিচিতিঃ

পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় একটি স্থান হলো কালা পাহাড়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই নামে একাধিক পাহাড় থাকলেও দেশের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত স্বল্প উচ্চতার এই কালা পাহাড় ভৌগলিকভাবে যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে। কারণ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে হাড়ারগজ পাহাড়সারির সর্বোচ্চ চূড়া বা বিন্দু কালা পাহাড় হচ্ছে বৃহত্তর সিলেট তথা বাংলাদেশের উত্তরাংশের সর্ববৃহৎ পর্বতশৃঙ্গ।

ইতিহাসঃ

২০১৫ সালের দিকে একদল ভ্রমণপিয়াসী অভিযাত্রী ‘BD Explorer’ লংলার বনজঙ্গলে হাইকিং করতে গিয়ে সর্বপ্রথম কালা পাহাড় নামক এই অনিন্দ্যসুন্দর শীর্ষস্থানের খোঁজ পায়। এবং গারমিন চালিত জিপিএস দিয়ে শিখরের সর্বোচ্চ সীমা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১১০০ ফুট পরিমাপ করে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই স্থানটি দেশবাসীর কাছে তখনও সম্পূর্ণ অজানা ছিলো। মূলত সঠিক প্রচারণার অভাবে রহস্যে ঘেরা এই জায়গাটা একদম লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়।

তারপর কুলাউড়া উপজেলা প্রশাসনের পরামর্শে ‘Kulaura Problem & Prospect – কুলাউড়া সমস্যা ও সম্ভাবনা’ সাইবার কমিউনিটি পাহাড়টির চূড়া জয় করে, রোমাঞ্চকর তথ্যগুলো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় লেখালেখি করে অনলাইন প্রমোটিং দ্বারা এই ট্যুরিস্ট স্পট ব্রান্ডিং শুরু করে দেয়। ফলস্বরূপ কালা পাহাড়ের সৌন্দর্য এখন সমগ্র দেশব্যাপী প্রসারিত হয়ে তা বর্তমানে পর্যটকদের লাইমলাইটে চলে এসেছে।

অবস্থানঃ

এই পাহাড়টির এক পাশে বাংলাদেশের কুলাউড়া-জুড়ী সীমান্ত, অন্য পাশে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত। উল্লেখিত সংরক্ষিত বন এলাকাকে লোকমুখের ভাষায় ‘লংলা পাহাড়শ্রেণী’ নামে ডাকা হয়। কালা পাহাড় হচ্ছে এখানকার সর্বোচ্চ চূড়ার স্থানীয় প্রচলিত নাম। বাংলাদেশ জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, এই পাহাড়টি ‘হাড়ারগজ রিজার্ভ ফরেস্ট’ নামেও পরিচিত। দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় অবস্থান করা এই পাহাড়ের প্রায় ৬০% বাংলাদেশ সীমান্তের ভিতরে অবস্থিত এবং বাকি অংশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্গত। উত্তর ত্রিপুরায় এই পাহাড়টি রঘুনন্দন পাহাড় নামে বহুল পরিচিত।

ঐতিহাসিক নিদর্শনঃ

পাথরে খোদাইকৃত উপমহাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ধর্মীয় স্থান ঊনকোটি এই পাহাড়ের পাদদেশে ভারতীয় অংশে অবস্থিত। এছাড়া পাহাড়টির উপরিভাগের কাছাকাছি বাংলাদেশ অংশে ছাতাচূড়া নামের একটি বিখ্যাত মাজার আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কালা পাহাড়ের অগ্রভাগে একটি বিমান ভূপাতিত হয়েছিলো।

প্রাকৃতিক আকর্ষণঃ

কালা পাহাড়ের সবচেয়ে উচু স্থান থেকে অসাধারণ সব দৃশ্য চোখে পড়বে। দেখা যাবে দূরে অবস্থান করা বেশ কয়েকটি জনপদ। পাহাড় থেকে উত্তর-পূর্বাংশ কোণে তাকালে দেখা মিলবে দেশের সীমান্তের ভেতরে অবস্থিত জুড়ী উপজেলার অন্তর্গত রাজকি চা বাগান ও ফুলতলা বাজার। হালকা পূর্ব-দক্ষিনে তাকালে দেখা যাবে সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর জেলার প্রধান শহর ধর্মনগরের একাংশ। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, শরৎকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে কালা পাহাড়ের চূড়া থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির স্বচ্ছ নীলাভ জলরাশি স্পষ্টভাবে অবলোকন করা যায়।

হাকালুকির স্বচ্ছ জলরাশি, কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার

এমনকি ভারতের মেঘালয়ের দেয়াল সদৃশ পাহাড়সারিও সবসময় দৃশ্যমান থাকে। বর্ষাকালে পাহাড়টির চূড়া থেকে আকাশে মেঘের খেলা একদম কাছাকাছি উপভোগ করা যায়। বৃষ্টির দিনে যাত্রাকালে ঝিরিপথ দিয়ে হাটার সময় বেশ কয়েকটি ছোট ঝর্ণা পাওয়া যায়।

কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার
কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার

এছাড়া আন্ডর বা কুম তৈরী করার জন্য আধিবাসীরা ছড়ার মধ্যে অস্থায়ী বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখে সপ্তাহে একদিন ফ্ল্যাশ ফ্লাডে বাশের আটি সমতলের বাজারে নিয়া আসার জন্য, ভাগ্য ভালো থাকলে আপনিও ভেলায় চড়ে লোকালয়ে আসতে পারেন। পাহাড়ি মেঠোপথে ছোটো ছোটো খালের উপর গাছের গুড়ির সাঁকো পার হওয়া খুবই আনন্দদায়ক। শীতকালে পাহাড়টি আরও সুন্দরভাবে ফুটে উঠে। কালা পাহাড় একেক ঋতুতে একেক ধরনের রূপ ধারণ করে। ঘন বনে উচু গাছের আড়ালে যখন সূর্য চোখে দেখতে পারবেন না তখন মনে হবে ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলে আছি। কালা পাহাড়ের জঙ্গলে রয়েছে হরিণ, বানর, মেছোবাঘ, ভাল্লুক ও সাপ সহ নানান প্রজাতির জীবজন্তু। পাহাড়ে যাত্রাপথে বিভিন্ন ফলজ গাছ থেকে ফলমূল হালকা নাস্তা হিসেবে খেতে পারবেন।

স্থানীয় সংস্কৃতিঃ

উত্তর থেকে দক্ষিন বরাবর দাড়িয়ে থাকা এই পাহাড়সারির আশপাশ মূলত খাসিয়া ও গারো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। জনসংখ্যায় খাসিয়ারা বেশি হলেও গারো বসবাসকারীদের সংখ্যা খুবই কম। উল্লেখযোগ্য পাড়াগুলোর মধ্যে বেগুনছড়া পুঞ্জি, লবণছড়া পুঞ্জি, পুটিছড়া পুঞ্জি ও ফানাইছড়া পুঞ্জি অন্যতম।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার
পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, কালা পাহাড়, মৌলভীবাজার

কালা পাহাড়ে যেতে সবচেয়ে কাছের ও সহজতম পথ আজগরাবাদ চা বাগান দিয়ে ঢুকে এই বেগুনছড়া পুঞ্জি হয়েই। পাড়াটি খুবই সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম। এখানে বসবাসকারী প্রায় পাঁচশত পরিবারের মানুষ বেশিরভাগই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। স্থানীয় আধিবাসীদের প্রধান পেশা হলো পান চাষী। দেশব্যাপী নামকরা খাসিয়া পান-ই হল এখানকার প্রধান অর্থকারী ফসল।

রোডম্যাপঃ

কালা পাহাড় যেতে হলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ট্রেন অথবা বাসে করে প্রথমে কুলাউড়ায় আসতে হবে খুব ভোরে। কুলাউড়া পৌর শহর থেকে কালা পাহাড়ের দূরত্ব আনুমানিক ৩০ কি.মি।

শুরুতে কুলাউড়া থেকে গাড়িযোগে পৃথিমপাশার রবিরবাজার হয়ে কর্মধার আজগরাবাদ চা বাগান গেইটে সকাল ৮টার আগে পৌঁছাতে হবে। তারপর এখানে গাড়ি রেখে বাগানের রাস্তা দিয়ে সোজা বরাবর ৪৫ মিনিট পায়ে হেটে বেগুনছড়া পুঞ্জিতে যেতে হয়।

এরপর বেগুনছড়া পুঞ্জির দায়িত্বশীল মন্ত্রীর কাছ থেকে স্থানীয় অভিজ্ঞ গাইড নিয়ে টানা ২ ঘন্টা পাহাড় আরোহণ করা লাগবে। গাইড রেডি রাখার ব্যাপারে ট্রিপের আগেরদিন বেগুনছড়া পুঞ্জির দায়িত্বে থাকা বর্তমান হেডম্যান বা মন্ত্রী লেম্বু দাদার সাথে টেলিফোনে(০১৯৫১৬৪৯৮৮১) যোগাযোগ করে গেলে ভালো হবে। ট্যুরের পূর্বদিন শুধুমাত্র গাইড ম্যানেজ ব্যাতিত জরুরী প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কিছুর ব্যাপারে তথ্য জানার জন্য উনাকে বারবার কল দিয়ে বিরক্ত না করার অনুরোধ রইলো। উনি কোনো ট্যুর অপারেটর না, আমাদের মতে উনার রিকমেন্ডেড গাইড সবচেয়ে বেশি সিকিউরড। একজন গাইডকে ৪-৫০০ টাকা বা আপনারা খুশি হয়ে যা দিবেন তা সাদরে সে গ্রহণ করবে।

কালা পাহাড়ের একদম শীর্ষস্থান যেখানে ট্যুরিস্টরা কলম দিয়ে কাগজে আরোহীদের নাম সহ স্মৃতিচারণ নোট লিখে তা বোতলবন্দী করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে, সেই বিখ্যাত সামিট পয়েন্টে গেলেই আপনি মনে করবেন আপনার অসাধ্য সাধন হয়ে গেছে। তখন আশেপাশের স্বর্গীয় ভিউ দেখে এক নিমিষেই পিছনের সব কষ্ট ভুলে যাবেন।

কালা পাহাড়ের উপরে উঠার রাস্তা একটা (পাহাড়ি পথ) কিন্তু একই রাস্তা দিয়ে নামার ক্ষেত্রে ঝিরি পথ ও পাহাড়ি পথ দুইটা। বিকাল ৪টা নাগাদ রবিরবাজার এসে দুপুরের লাঞ্চ করতে পারবেন। এখানকার বিখ্যাত মসজিদে নামাজ পড়ার সুযোগ মিস করবেন না। আর হাতে সময় থাকলে বোনাস হিসেবে পৃথিমপাশার ঐতিহ্যবাহী নবাববাড়ি ঘুরে যেতে পারেন।

এছাড়া কালা পাহাড়ের চূড়া থেকে আসার সময় অন্য আরেকটি সময়সাপেক্ষ, জুড়ী উপজেলার ফুলতলা বাজারের কাছে অবস্থিত রাজকি চা বাগান হয়েও লোকালয়ে ফিরা যায়। তবে এই রুট অনেক সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

সতর্কতাঃ

নব্বই দশকের আগে একসময় এই গহীন কালা পাহাড়ে পার্শ্ববর্তী ভারতের বিদ্রোহী উগ্রপন্থি দল উলফা(এলএলটিটিএফ) এর সদস্যরা আত্মগোপন করে এখানে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং করতো। তখন বাংলাদেশি অনেকেই এই পাহাড়ে বিচরণ করতে ভয় পেতেন।

কিন্তু বর্তমানে সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র মাধ্যমে এসব নিষিদ্ধ সংগঠন আমাদের দেশ থেকে একেবারে নির্মূল হওয়ায় পাহাড়টি সম্পূর্ণ শতভাগ নিরাপদ ট্যুরিজম জোনে পরিণত হয়েছে। ফলে পর্যটকরা এখন নিয়মিত স্বাচ্ছন্দ্যে পাহাড়ের পুরো এলাকায় ভ্রমণ করতে পারছেন। পাশাপাশি স্থানীয় আদিবাসীরাও জীবিকার তাগিদে পাহাড় এলাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন কাজকর্ম করে থাকেন।

তাছাড়া এই পাহাড়ে অবস্থান করা বুনো হাতিগুলো খুবই শান্তশিষ্ট প্রকৃতির হওয়ায় স্থানীয় ও বহিরাগত কেউ এসব তেমন একটা ভয় পায়না বললেই চলে। মানুষের শব্দ পেলেই ওরা বনের ভিতরে ঢুকে যায়। মাঝেমধ্যে তাদের শুধু দূর থেকেই দেখা যায়। যাত্রাপথে যেসব গোবরের স্তুপ লক্ষ্য করা যায় এগুলো সাধারণত পোষা হাতির বিষ্ঠা। পোষ্য হাতিকে অবশ্য কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়।

আশার কথা হলো, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এখনও পর্যন্ত কালা পাহাড় এলাকায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা হয়নি।

পরামর্শঃ

একাএকা না গিয়ে কমপক্ষে ৫ জনের টিম বানিয়ে গেলে বেশি মজা পাবেন। কালা পাহাড় আরোহী প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাকপ্যাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার যেমন কেক, ব্রেড, কলা ও জনপ্রতি কমপক্ষে ২ লিটার পানীয় জল সাথে নিতে হবে।

কাপড় হিসেবে ফুল হাতা শার্ট, পাঞ্জাবি, ভারী ড্রেস, শাড়ি, টাইট জিন্স প্যান্ট না পড়ে নরমাল গেঞ্জি ও লোজ ট্রাউজার পড়বেন আর পায়ের জন্য পিছন দিকে ফিতাওয়ালা মজবুত জুতা অথবা যেসব কেডস-শূ ভিজলেও সমস্যা হবেনা; অর্থাৎ এমন জিনিস পরিধান করে যাবেন যাতে পাহাড় এবং খাল দিয়ে সহজে চলাফেরা করা যায়।

চূড়ার উপর পর্বত বিজয়ের সুন্দর ছবি তোলার জন্য দলের যেকোনো একজনের সাথে একটি দেশের পতাকা রাখতে পারেন। আর যারা শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির আপনাদের এই কঠিন চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে আমরা নিরুৎসাহিত করছি।

তবে পুরুষের পাশাপাশি এখন অনেক অদম্য নারীরা এই অসম্ভবকে নিয়মিত সম্ভব করতেছেন। আসলে আপনার যদি প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকে তাহলে মন থেকে চাইলে যেকোনো বাধা টপকানো অবশ্যই সম্ভব।

নির্দেশনাঃ

প্রকৃতিতে কোনো অপচনশীল আবর্জনা ফেলে পরিবেশ নষ্ট করে আসবেন না। উচ্ছিষ্ট ময়লা ব্যাগের সাথে নিয়ে এসে লোকালয়ের নির্দিষ্ট স্থানে ফেলবেন। আর দয়া করে পুঞ্জি এলাকায় এমন কোনো আচরণ করবেন না যা স্থানীয় আধিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতিতে আঘাত হেনে তাদের মনে পীড়া দেয়।

আমন্ত্রণপত্রঃ

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন ট্যুরিস্টরা মূলত এক্সট্রিম হিল ট্রেকিং ও এডভেঞ্চারাস ট্রেইলের ট্রিপ এক্সপিডিশন করার জন্য নিয়মিত কালা পাহাড়ে ঘুরতে আসেন। আপনার যদি ঢাকার ফ্যান্টাসি কিংডম কিংবা সিলেটের ড্রীমল্যান্ড পার্ক জাতীয় স্থানগুলো যদি পছন্দ হয় তবে কালা পাহাড় আপনার জন্য আদর্শ না।

আপনি যদি পর্বতমালা ভালোবাসেন এবং শহুরে যান্ত্রিকতা ছেড়ে মায়াবী প্রকৃতির নিসর্গ সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে কিছুটা সময়ের জন্য হারিয়ে সৃষ্টিকর্তার অপরূপ পৃথিবী প্রাণভরে উপভোগ করতে চান, তাহলে জীবনে একবার হলেও সুউচ্চ কালা পাহাড় আরোহন করে কল্পনার রাজ্যে নেপালের হিমালয় এভারেস্ট বিজয় স্বাদের সামান্য অনুভূতি এখান থেকে নিতে পারেন।

যেকোনো সহযোগিতার জন্য কুলাউড়া সমস্যা ও সম্ভাবনা পেইজের ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন অথবা Kulaura Problem & Prospect গ্রুপে পোস্ট করে বিনামূল্যে কাঙ্ক্ষিত ভ্রমণ সেবা নিতে পারেন। আপনাদের উষ্ণ আতিথেয়তা দেওয়ার জন্য কুলাউড়াবাসী সবসময় মুখিয়ে আছে। আমাদের পক্ষ থেকে আপনার কালা পাহাড় জয়ের ব্যাপারে অগ্রীম অভিনন্দন ও শুভকামনা রইলো…

©Mahfuj Hamid

WIKIPEDIA- https://en.m.wikipedia.org/wiki/Kala_Pahar

GPX- https://www.wikiloc.com/hiking-trails/kala-pahar-the-highest-peak-of-greater-sylhet-and-northern-bangladesh-11491114

#BeautifulKulaura💚

আহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিল (Ahsan Manzil, Ahsan Monjil) পুরান ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। দোতলা এ ভবনের বারান্দা ও মেঝে তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে। আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি কক্ষ অষ্টকোণ বিশিষ্ট এবং এই ভবনের ছাদ কাঠের তৈরি। প্রাসাদের ভেতরে রয়েছে খাবার ঘর, লাইব্রেরি, জলসাঘর, দরবার হল এবং বিলিয়ার্ড খেলার জায়গা। আর প্রাসাদের দোতলায় রয়েছে অথিতিদের থাকার কক্ষ, বৈঠকখানা, নাচঘর, গ্রন্থাগার এবং আরো কিছু বসবাসের কক্ষ। প্রসাদের ঠিক সামনে রয়েছে চমৎকার ফুলের বাগান ও সবুজ মাঠ। আহসান মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলা থেকে একটি বড় সিড়ি সবুজ মাঠে নেমে এসেছে।

আহসান মঞ্জিল
আহসান মঞ্জিল

আহসান মঞ্জিলকে ঢাকা শহরের প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য নিদর্শন হিসাবে মনে করা হয়। আর তৎকালীন নবাবদের হাতে এই ভবনেই প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠে। আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্যশৈলী পশ্চিমাদেরও সমানভাবে আকর্ষণ করে, লর্ড কার্জন ঢাকায় আসলে এই ভবনেই থাকতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে আহসান মঞ্জিল বাংলাদেশ সরকারের জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত আছে। ১৯৯২ সালে এই জাদুঘর জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আহসান মঞ্জিলের রংমহলের ২৩ টি কক্ষে ৪ হাজার ৭৭ নিদর্শন রয়েছে।

ইতিহাস

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ রংমহল প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর ছেলে শেখ মতিউল্লাহ ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ১৮৩৫ সালে নবাব আবদুল গনির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এই প্রাসাদটি কিনে বসবাস শুরু করেন। নবাব আবদুল গনি ১৮৭২ সালে নতুন করে এটি নির্মাণ করে তার ছেলের নামানুসারে প্রাসাদটির নাম রাখেন আহসান মঞ্জিল।

টিকেট মূল্য

সাধারণ দর্শনার্থীদের আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন করতে জনপ্রতি ২০ টাকা দিয়ে প্রবেশ টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। ১২ বছরের নিচে অপ্রাপ্ত শিশুরা জনপ্রতি ১০ টাকায় প্রবেশ করতে পারে। বিদেশীদের আহসান মঞ্জিলে প্রবেশ করতে জনপ্রতি ১০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিবন্ধী দর্শনার্থীদের জন্য আহসান মঞ্জিলে কোন টিকিটের প্রয়োজন হয় না। আর আগে থেকে আবেদন করলে ছাত্র-ছাত্রীরাও বিনামূল্যে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর দেখতে পারে।

পরিদর্শনের সময়

শনিবার থেকে বুধবার এই পাঁচ দিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আহসান মঞ্জিল দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। আর প্রতি শুক্রবার বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন করা যায়। প্রতি বৃহস্পতিবার এবং অন্যান্য সরকারী ছুটির দিনে আহসান মঞ্জিল জাদুঘর সম্পূর্ন বন্ধ থাকে।

আহসান মঞ্জিল কিভাবে যাবেন

ঢাকার যেকোন জায়গা থেকে গুলিস্তান এসে রিক্সা বা সিএনজি তে করে আহসান মঞ্জিল দেখতে যেতে পারেন। গুলিস্থানের নর্থ সাউথ রোড ধরে নয়াবাজার মোড় হয়ে বাবুবাজার ব্রিজ দিয়ে এগুলে ইসলামপুর পৌঁছে যাবেন। আর ইসলামপুর আসলে আহসান মঞ্জিল যাওয়ার রাস্তা যে কাউকে জিজ্ঞাস করলেই জানতে পারবেন। অথবা সরাসরি পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকায় এসে পায়ে হেঁটে কিংবা অল্প টাকা রিকশা ভাড়ায় আহসান মঞ্জিল যেতে পারবেন।

লিখা ও ছবি: Sayed Ahmed

সেন্টমার্টিন – ১৯৮৫

সেন্টমার্টিন -১৯৮৫

এই লেখাটা অনেকদিন আগে থেকেই লিখবো ভেবে আসছি। সব মিলিয়ে হয়ে ওঠে নাই। আমার বুয়েটের বন্ধু সাইদ বাবুর চাহিদা আর আমার আরেক বন্ধু নিশাত জাহান রানার সম্প্রতি সেন্টমার্টিন সফরের বর্ণনা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখতে শুরু করলাম।

ভ্রমণ কাহিনি আমার ফেসবুক টাইম লাইনে আসলে আমি মুটামুটি পড়ি। বাংলাদেশের কোনো ভ্রমণ হলে আর একটু আগ্রহ বাড়ে। আর সেটা যদি সেন্ট মার্টিনের হয় তো আমি পড়বই। সেন্ট মার্টিনের লেখাগুলি পড়ি আর মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি আমার দেখা সেন্ট মার্টিনের সাথে!

আমি ১৯৮৫ এর এপ্রিলে বাংলাদেশ মেসিন টুলস্ ফ্যাক্টরিতে চাকরি শুরু করি। একটু গুছিয়ে নিয়েই দল পাকাতে শুরু করি বেড়ানোর জন্য। খুব সহজ ছিলো না বিষয়টা সে সময়। আমার সঙ্গে খুব সহজেই রাজি হয়ে যায় মাকসুদ ফজল জ্যাকি। সে আমার সঙ্গেই বুয়েট থেকে পাশ করেছে। এখন ইউ কে তে থাকে। আর ছিলো জোবায়েদুল হোসেন মিঠু এবং সাইফুল আলম চঞ্চল এরা দুইজনই রাজশাহী থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করা। মিঠু স্বর্গবাসি হয়েছে। আর চঞ্চল বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পে কর্মে নিয়োজিত। এর বাইরে ছিলো মোজাম্মেল পাঠান। সে রাশিয়াতে লেখাপড়া করেছে। এখন টরেন্টো থাকে। সবারই আগ্রহ ছিলো কিন্তু একমতে পৌঁছাতে আরো কিছু অনুঘটক যোগ করতে হয়েছিলো।

প্রথমেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে কোথায় যাবো, চট্টগ্রাম। কেনো? যুক্তি হলো, আমাদের কাছে খবর ছিলো পতেঙ্গা সিবিচে বিয়ার বিক্রি হয় ঢাকার দামের অর্ধেক দামে। সুতরাং পতেঙ্গা যেয়ে বিয়ার পান করলেই আসা যাওয়ার খরচ উঠে যাবে! এটা ছিলো একটা বড় অনুঘটক।

যা হোক, আমরা পাঁচজন ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাই। একটা সস্তার হোটেলে তিন বেডের রুম, কমন ওয়াশরুম ভাড়া করি। আমরা শুরুতেই ভাগ করে নেই একেকদিন একেকজন সিঙ্গেল বেডে ঘুমাবে আর অন্যেরা দুজন করে এক বেডে ঘুমাবে।

চট্টগ্রাম শহর আমার আগে তন্ন তন্ন করে দেখা। খুব প্রিয় একটা শহর আমার। উঁচু নিচু পাহাড়ময়। মনটা একদম ভরিয়ে দেয়! ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে সীতাকুন্ড পাওয়ার আগেই শুরু হয় সেই অনুভুতি! মাঝে মাঝে ডানদিকে সমুদ্র দেখা যায় আর বামে পাহাড়। ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, শিল্প এলাকাগুলি ছবির মত সুন্দর লাগে। সবুজ পাহাড়ের চুড়াগুলি কী অপরূপ!

আমরা চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরে বেরাই। বাটালি হিল, পাহাড়তলী, ওয়ার সিমেট্রি এখন মনে পরছে। বিকালে যাই পতেঙ্গা সিবিচে। উদ্যেশ্য বিয়ার পান করে আমাদের আশা যাওয়ার খরচ উসুল করা। কিন্তু বিধি বাম! একজন বিক্রেতাও ওখানে নাই। আমরা ভাবলাম তাহলে বোধহয় আমাদের কাছে ভুল খবর ছিলো! কিন্তু সেটা নয়। ঐদিন চট্টগ্রামে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর ওয়াজ ছিলো। এই সব বিক্রেতারা সবাই পালিয়েছে। অগত্যা সমুদ্র দর্শন উপোভোগ করে আমরা হোটেলে ফিরে আসি। হোটেলের ম্যানেজারের কাছে জানতে চাই কোনো বার আছে কি না! সে বলে, ভাই আজকে কারফিউ, সাইদীর ওয়াজ উপলক্ষে সব বন্ধ। তা হলে কী করা! উপায় একটাই, হোটেল আগ্রাবাদের বারে যাওয়া। তাই গেলাম। ঢাকার থেকে তিনগুন দাম। পারলে একটা বিয়ার পাঁচজন ভাগ করে খাই! বিয়ার খেয়ে লাভের ব্যবসা পরিবর্তে পুরাই লস! খরচ অনেক বেড়ে গেলো! ভাবলাম, ঠিক আছে, কক্সবাজার যেয়ে পুসিয়ে নেবো।

পরেরদিন সকালে বাসে করে কক্সবাজার যাই। এটাও আমার পুরানো যায়গা। একই রকম হোটেলে আমরা উঠি। দুপুরের খাওয়া সেরে সমুদ্রে যাই। তখন সমূদ্রের পাড়ে কী কী হোটেল ছিলো আমার মনে নাই। পর্যটনের একটা মোটেল ছিলো সবচেয়ে কাছে। খুব বেশি ভীড় ছিলো না সে সময়।

কক্সবাজারে সাইমন নামে একটা হোটেল ছিলো। আমি যতবার গেছি, ঐ হোটেলে রাত্রে একটা ডিনার নিয়েছি। সেবারও তাই করি। ওরা বড় প্লেট ভর্তি করে একটা রূপচান্দা মাছের ভাজি করতো। খুব মজা। খাওয়ার শেষে প্লেটে কিছুই থাকতো না। কাঁটাগুলিও মুড়মুড়িয়ে খাওয়া যেত। এই সব শেষ করে রাতে হোটেলে ঘুমিয়ে পরি। পরেরদিন সকাল থেকে শুরু হয় আমাদের সমুদ্রস্নান।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।

সমুদ্রস্নান আমার ভীষণ প্রিয়। ওর ঢেউগুলির একটা তাল আছে। শরীরে ধাক্কা দিলে একটা বাজনা সৃষ্টি করে। একটা তালে সেই বাজনার সাথে মিশে যেতে পারলে একটা নেশার সৃষ্টি হয়। অদ্ভুত সে এক নেশা! আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা উপভোগ করি সেই আনন্দ।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।

আমার মেশিন টুলসের বন্ধুরা ভাবতো, রিপন হালকা/পাতলা বিড়িখোড় বোধহয় দম নাই। কিন্তু ঐদিন অবাকই হয়ে যায় আমার শারীরিক সামর্থ দেখে। বেশ লম্বা সময় সমুদ্রে কাটাই।

হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম সেরে আবার যাই সমুদ্রে। সুর্যাস্ত দেখতে। আর যদি বিয়ার/টিয়ার কোথাও পাওয়া যায়! আবারও সেই বিধি বাম। আমাদের পিছু নিয়ে দেলোয়ার হোসেন সাইদী ঐ দিন কক্সবাজারে, সব কারফিউ।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসে চাপি টেকনাফের দিকে। আমাদের সবার জন্য নতুন দিগন্তরেখা দেখা শুরু। খুব খারাপ রাস্তা ছিলো। একদমই লক্কর ঝক্কর মার্কা। ঐটুকু রাস্তা যেতে আমাদের কতখানি সময় লেগেছিলো মনে নাই। তবে বেশ লম্বা সময়। ঐ রাস্তাটার কিছু বর্ণনা আমার আগেই জানা ছিলো। একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁচু নিচু রাস্তা।

এমন রাস্তা রাঙামাটিতেও আছে। কিন্তু টেকনাফের এই রাস্তাটির ডানপাশে পাহাড় আর বাম পাশে নীল নাফ নদী। অপরূপা! একদম চুলের নীল ফিতার মতো পরে আছে। এই সুন্দরের বোধ হয় তুলনা হয় না। (বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে নাফ নদ হবার কথা, কিন্তু সবাই নদী বলে, তাই আমিও নদী বললেম)।

নদীর পানি সাধারণত নীল হয় না, কিন্তু নাফ তার ব্যতিক্রম! আর এই সোন্দর্য্যটার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় নাফ নদীর ওপারে বার্মার পাহাড়গুলি।

আমার পৃথিবী ঘুরে দেখা দেশের সংখ্যা অনেক, তবুও এই লেখাটা লিখতে বসে, বিশেষ করে এই জায়গাটুকুর তুলনা আমি খুঁজে পেলাম না। পাখির চোখে দেখা নাফ নদী। আমি জানি না এখনও তেমন আছে কি না! আসলে নাফ নদীটা কোনো নদী নয়। নদী হচ্ছে একটি জলধারা, যেটা কোথাও থেকে উৎপত্তি হয়ে সাগরে কিংবা হ্রদে যেয়ে মেশে। কিন্তু নাফ নদীটা তা নয়। এটা সমুদ্রের একটা বর্ধিত অংশ। যেটা স্থলের ভিতর ঢুকে পরেছে।

টেকনাফ ব্যাস স্টান্ডে নেমে হোটেলের খোঁজ করি। কেউ বললো নতুন একটা হোটেল খুলেছে, বিল্ডিং এর। তখন টেকনাফে পাকা হোটেল খুব একটা ছিলো মনে হয় না। খুঁজে বের করলাম আমরা সেটা।

নাফ নদী থেকে একটা খালের মতো আছে যেটা বেঁকে ঢুকেছে টেকনাফ বাজারের দিকে। এই খালটা দিয়েই আসলে টেকনাফের সঙ্গে নৌ পথে যোগাযোগ। খালের উপরে একটা ব্রিজ। সেটা পার হয়ে পশ্চিম দিকে গেলেই হাতের ডান দিকে ছিলো হোটেলটা। তখন একদমই নতুন।

আমরা স্নানাহার শেষ করি। এই যে খালটা বললাম, সেটা শুধু জোয়ারের সময় পানি আসে। আর ভাটাতে প্রায় শূন্য! দিনে দুই বার জোয়ার। আর এই জোয়ারের সময়ই নৌযান গুলির চলাচল। এই খালটা থেকেই সব ধরণের জলযানগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছেড়ে যায়। আমরা দেখতে বেড় হই। এ সময় ছিলো ভাটা। একদম অল্প পানি। কিছু নৌযান বাঁধা।

সেন্টমার্টিন যেতে হলে এখান থেকে নৌকাতে করে যেতে হবে। দেশি কাঠের তৈরী নৌকা। যাত্রি এবং মালামাল সবই পারাপার করে এরা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় খালটার মুখের কাছে চলে যাই। ডান দিকে নাফ নদীর নীল জল। আমার এক খেয়াল চাপলো ঐ জল ছুঁয়ে দেখবার। ভাটার সময় জলটা বেশ দূরে। আর এই দূরত্বটা শুধু কাদায় ভরা। বিশ্রী রকমের কাদা। আমার সাথীরা কেউ রাজি হয় না। আমি জিন্সের প্যান্টটা হাঁটু অবধি ভাঁজ করে হাঁটা দেয়। ঠিকই ছুয়ে আসি সেই নীল জল। এখন মনে হয়, কাজটা ঠিক করি নাই! যাই হোক, ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে বার্মিজ মার্কেটে যাই। খুব একটা মনে নাই বিশেষত্বটা কী! মুলত বার্মিজ স্যান্ডেল আর মেয়েদের সাজগোজের কিছু জিনিষ থাকবে। রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরি।

পরেরদিন সকালে উঠে আমাদের পরিকল্পনা হলো টেকনাফ দর্শন। মাথিনের কূপটা তো দেখতে হবেই। কারন সেটার সাথে “যখন পুলিশ ছিলাম” এর স্রষ্টা ধীরাজ ভট্টাচার্য্য জরিত। সেটা দেখে আমরা ঠিক করি টেকনাফের বন দেখার। শুনেছিলাম বুনো হাতী আছে, দেখতে পাওয়া যাবে। একটা বেবী ট্যাক্সি ওয়ালা রাজি হয় আমাদের বুনো হাতী দেখা অভিযানে। বেবী ট্যাক্সি করে আবার কক্সবাজারের দিকে আসতে হয়। বেশ কিছুটা পথ। সেখানে রাস্তার পাশে একটা ভাঙাচুরা রেষ্টুরেন্ট ছিলো। বেবীট্যাক্সি ওখানে রেখে চালক হলো আমাদের গাইড।

আমাদের একটা পাহাড়ী পথ দিয়ে হাঁটা শুরু। কতদূর হেঁটেছিলাম মনে নাই। ওখানে একটা টি এন্ড টির টেলিফোন টাওয়ার ছিলো, পাহাড়ের উপরে। সেটার নিচে একটা বিল্ডিং। ঐ পর্যন্ত আমরা যাই। বুনো হাতী দেখতে পাই নাই কিন্তু হাতীর হাগু পেয়েছি। ঐ পর্যন্ত যেয়েই আমরা ফিরে আসি। ভাঙাচুরা রেষ্টুরেন্টে খেয়ে নেই। এ জায়গাটুকু আসলেই অনেক সুন্দর! আন্তর্জাতিক মানের। ওখানে রাস্তার পাশে একটু উঁচু স্থানে একটা বিডিআর চৌকি ছিলো, যেখান থেকে বার্মা বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যায়। আর সে সময়ে এক ধরনের পাস বর্ডার থেকে ইসু করতো, যেটা দিয়ে বার্মার ভিতরে যেয়ে দিনে দিনেই ফেরত আসা যেতো। আমরা যাই নাই সেটাতে। যাই হোক, ফিরে আসি হোটেলে। বিকালে বেড় হয়ে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার নৌকা ওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের যাওয়া কনফার্ম করি। যেহেতু আমরা দুই রাত সেন্ট মার্টিন থাকবো, তাই থাকা খাওয়ার কি ব্যবস্থা আছে জানার চেষ্টা করি।

টেকনাফ
টেকনাফ

এইসব শেষ করে ঘুমের আয়োজন। সমস্যা বাঁধলো পাশের রুম থেকে। ওদের কিছু কিছু কথা বার্তা আমাদের রুমে ভেসে আসে। চলাফেরা, সব শুনে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ঐ রুমে মধ্যপান চলছে। আমার সহযাত্রীদের বলতেই ওরা উড়িয়ে দেয়। আমিও জিদ করি। চল দেখাই, পাশের রুমে যেয়ে দরজা ধাক্কাই। দরজা খুলে সামনে অপরিচিত মানুষ দেখে ওরা একটু অবাক হয়। আমিও সোজা বলি, ভাই আমরা ঢাকা থেকে এসেছি, একটু গল্পগুজব করবো। হায়রে খুশি হলো মানুষগুলি! আসেন বসেন, অনেক খাতির করলো। ওরা যেগুলি পান করছিলো সেগুলি ভীষন দূর্গন্ধময় আর বিস্বাদ! মনে হয় তখনকার দিনের কোনো বদির সাপ্লাই হবে। খুব একটা এগোনো গেলো না। যা হোক ওদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতের মতো ঘুমিয়ে পরলাম পরেরদিন সেন্ট মার্টিন যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে।

আমাদের স্বপ্নের সেন্ট মার্টিন যাত্রা শুরু হলো। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা ঘাটে আসি। বেশ কিছু যাত্রী আর মালামালের ভিতরে আমাদের ঠাঁই হলো। উঠে পরলাম নৌকাতে। সেই প্রথম আমাদের সমুদ্র যাত্রা। অসম্ভব উত্তেজনা! এই জোয়ারের সময় সব নৌকাগুলি ছাড়ে টেকনাফ থেকে যাওয়ার জন্য। আবার ঠিক তেমনই যাদের টেকনাফে আসার, তারাও ফিরে আসে এই সময়টাতেই। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমাদের নৌকা ছেড়ে দিলো। খালের ভিতরে একটু এগোতেই পাশে আরেকটা নৌকা, যেটা সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরছে, সেখান থেকে রিপন ভাই বলে একটা চিৎকার।

আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত দূরে এসেও আমার পরিচিত কেউ! তাকিয়ে দেখি তালিম। ও বুয়েটে আমার জুনিয়ার। যশোর ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করা। ওরা সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরছে। ভীষণ ভালোলাগে বিষয়টা। সবাইকে বলি, দেখো আমার কতো পরিচিত মানুষ! খালটা ছাড়িয়ে আমরা নাফ নদীতে পরি। সেখান থেকে দক্ষিনে যাত্রা। বঙ্গপোসাগরের দিকে। ডান দিকে বাংলাদেশ আর বাম দিকে বার্মা। এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! বাংলাদেশের গ্রামগুলির নাম জেনেছিলাম, ভুলে গেছি! আস্তে আস্তে আমরা বাংলাদেশের স্থল সীমা পেড়িয়ে বঙ্গপোসাগরে পরি। এটাই আমার প্রথম সমুদ্রে ভিতরে পরা। অসম্ভব এক শিহরণ! গাংচিলগুলি ঘিরে ফেলে নৌকাটাকে। আসলে নৌকার প্রপেলারে বারি খেয়ে যে মাছগুলি মরে, সেগুলি খাওয়া এদের উদ্দেশ্য। কারন যেটাই হোক, দৃশ্যটা তুলনা হয় না।

বাংলাদেশের স্থল ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। সেই প্রথম আমার দূর থেকে দেখা বাংলাদেশ! আমরা গভীর সমুদ্রে এসে পরি। অনেক বড় বড় ঢেউ শুরু হয়। নৌকাটা যেন আঁছড়ে পরে! তখন লাইফ জ্যাকেটের কোনো বালাই ছিলো না। আমার মৃত্যুভয় সব সময় কম। আর কারো কী না জানিনা, কিন্তু আমাদের ভিতরে চঞ্চল খুব ভয় পেয়ে যায়। সে অনেক খেলাধুলা করে। শরীরও খুব তাগড়া জোয়ান। শুধু একটু ভিতু।

সেন্ট মার্টিন, দূর থেকে।
সেন্ট মার্টিন, দূর থেকে।

সেই সমুদ্র ডিঙিয়ে আমরা দেখতে পাই সেন্ট মার্টিন! আস্তে আস্তে পৌঁছে যাই দ্বীপটাতে। কোনো রকমের ঘাট ছিলো না, সমুদ্রতটেই নৌকাটা ভিড়লো। প্রবাল দ্বীপে আমাদের প্রথম পা। এই জমে যাওয়া মরা প্রবালের পাথরগুলি খুব ধারালো! একদম ছুরির মতো। একটু বেকায়দায় পরলেই পা কেটে যাবে। নৌকা থেকে নেমে অল্প কিছুটা পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে আমরা বালির উপর আসি।

শুরু হয় আমাদের সেন্ট মার্টিন আবিস্কার করা আর অবাক হবার পালা! আমরা জেনে এসেছি যে নৌকা থেকে নামলেই একটা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। নেমে দেখি দুই/তিনটা টং মাত্র। সিগারেট, চকলেট ধরনের কিছু বিক্রি করে। তাহলে খাবো কোথায়! আর থাকা!! কেউ একজন বললো অপেক্ষা করেন, রান্নার লোক আসবে। ঠিক আছে। আমার সেন্ট মার্টিন দেখার তর সইছে না!

ভাবলেম একটু হেঁটে আসি, কিন্তু ব্যাগ রাখবো কোথায়? জানতে চাইলে স্থানীয়রা বললো, কেনো! বালুর উপর রেখে যান, কেউ হাত দিবে না। অবাক হলেম! সত্যিই সে সময়ে সেন্ট মার্টিনে চোর/চুরি বলে কিছু ছিলো না। মনে হলো পদ্মা নদীর মাঝির ময়না দ্বীপে এসে গেছি।

দ্বিতীয় অবাক হলেম কোনো ভিক্ষুক নেই। যেখানে ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের যন্ত্রনায় আমরা দূর্বিসহ! আর একটা জিনিষ আমার চোখে পরলো, সেটা হলো কুকুর। কোনো নেড়ি কুত্তা না। খুব সুন্দর, মাঝারী সাইজের একদম অন্য একটা জাতের কুকুরগুলি। লোমস শরীর আর মোটা ফুলানো লেজ। জানলেম এটা সেন্ট মার্টিনের স্পেশাল জাত। আমার অনুমান কেউ এটা ফার্মিং করে বিশ্ব বাজারে পালিত কুকুর হিসাবে বিক্রি করতে পারতো।

কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করতেই একজন এসে বললো, সেই রেস্টুরেন্টের মালিক। যা আমরা খেতে চাই, তাই রান্না করে দেবে। আমরা বললাম দুপুরে মুরগীর মাংস আর রাতে মাছ। ব্যাস খাওয়ার সমস্যা মিটে গেলো।

কিন্তু রাতে থাকা! তখন একটাও হোটেল ছিলো না সেন্ট মার্টিনে। সব টিন অথবা বাঁশের বাড়ি। একমাত্র পাকা বিল্ডিং সরকারী, যেটা ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরকারী কাজে ব্যবহৃত ডাক বাংলো টাইপের। আমরা থাকবো কোথায়? রেষ্টুরেন্টের মালিকই সমাধান। তার টং এর সাথেই বাঁশের মাচা করা আছে। আর নাম মাত্র বালিশ/চাদর এই সব আছে। এবং তার জন্য কোনো বাড়তি পয়সা লাগবে না। কি চমৎকার আতিথীয়তা! খুব ভালো লাগলো। আমরা ব্যাগগুলি ঐ মাচার উপর রেখে দ্বীপ দর্শনে বেড় হই।

সেন্ট মার্টিন, টং রেষ্টুরেন্ট। পেছনে মাচার উপর শোয়ার ব্যবস্থা।
সেন্ট মার্টিন, টং রেষ্টুরেন্ট। পেছনে মাচার উপর শোয়ার ব্যবস্থা।

আমার ইচ্ছা সম্পূর্ণ দ্বীপটা একদম সমুদ্রের পাড় দিয়ে চক্রাকারে হাঁটবো। সেটা আট নয় কিলোমিটারের বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না। এবং এটা আমার খুবই ইচ্ছা। ছোটোবেলায় কেয়া ফুল দেখেছি। বাবা বর্ষাকালে কেয়া ফুল এনে বাসায় রাখতেন। খুব তীব্র একটা গন্ধ। কেয়া গাছও দেখেছি। কিন্তু সেন্ট মার্টিনে সারিসারি কেয়ার বন, পিছনে সমুদ্র, কি যে সুন্দর!

সেন্ট মার্টিন।
সেন্ট মার্টিন।

আমার সাথীরা কেউ অত হাঁটতে চাইলো না। অগত্যা আমিও ওদের সঙ্গে গ্রামটার ভিতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গ্রামের প্রায় সব মানুষই মাছ ধরার কাজ করে। গভীর সমুদ্রে যায় এরা মাছ ধরতে। কয়েকদিন পরে ফেরে। সবার অবস্থাই মুটামুটি স্বচ্ছল মনে হলো। বাড়ির আঙিনাগুলি হয় বাঁশ অথবা নারিকেল পাতা দিয়ে ঘেরা। ও হ্যা, নারিকেল গাছ সর্বত্র। সবখানেই খুব পরিস্কার। কোথাও ময়লা ফেলবার চিহ্ন নেই।

মানুষের সাথে কথা বলে খুব শান্তি লাগে আমাদের। ভীষণ আন্তরিক এবং ভালোমানুষ এরা। সেই একমাত্র পাকা সরকারী বিল্ডিংটাও দেখি আমরা। এই সব ঘুরে/টুরে আমরা ফিরে আসি আমাদের সেই টং রেষ্টুরেন্টে।

মুরগীর মাংস আর ভাত। কী ঝাল রে বাবা! একদম মাথা গরম করে দেওয়ার মতো ঝাল। তবুও পেট ভরে খেলাম। তার পরেই চঞ্চল বিগড়ে গেল! প্রথমত সে খুবই ঘড় কাতুরে। বাবা/মাকে ছাড়া কয়েকদিন থাকলেই ওর সমস্যা হয়। দ্বিতীয়ত নৌকাতে সে ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। ভেবেছিলো যে আর ওর বাবা/মার সাথে দেখা হবে না। আর শেষে এই ঝাল মুরগী! সব মিলিয়ে তার চিৎকার শুরু হলো যে সে ফিরে যাবে। পরের জোয়ারেই। দুই রাত কেন, এক রাতও থাকবে না! আমার সাথে লেগে গেলো ঝগড়া। সে এক ভীষণ অবস্থা।

অত সুন্দর একটা নির্জন দ্বীপে উচ্চকন্ঠে আমি আর চঞ্চল! যাই হোক, শেষে ঠিক হলো আমরা একরাত থেকে সকালের জোয়ারে ফিরবো। আর চঞ্চলকে বলে দিলাম, ওর সাথে জীবনেও বেড়াতে বের হবো না। (এর তেত্রিশ বছর পরে ২০১৮তে চঞ্চলের সাথে প্লান করি সিংগাপুর যাওয়ার। আবার গোল বাঁধায় চঞ্চল। শেষ মূহুর্তে যায় না। সব মিলিয়ে আমার ১২০০ ডলার ক্ষতি গেছে বুকিং ক্যানসেল বাবদ।)

দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেড় হওয়ার প্লান। এবার যাবো দ্বীপের পশ্চিম দিকটাতে। সুর্যাস্ত দেখে ফিরবো। ওরা কেউ আর হাঁটতে রাজি না। আমার একেতে চঞ্চলের উপর রাগ। মন ভালো নেই। আর একা থাকতে চাইছিলাম। দিলাম হাঁটা, একা একাই, পশ্চিম দিকে। কোনো এক কেয়ার ঝোঁপের পাশে বসে পরি। পুরা সুর্যাস্তটা সম্পূর্ণভাবে নিজের ভিতরে ধারণ করি। হয়তো কেঁদেছিলামও! খুব ছিচ কাঁদুনে ছিলাম আগে। এই সব করে সন্ধ্যার পরে আবার সেই মাচাটায় ফিরি। রাতের মাছ রান্নাতে ঝাল একটু কম ছিলো। খেয়েদেয়ে আমরা মাচাটার উপর শোবার আয়োজন করছি। এর মধ্যে এক স্থানীয় ভদ্রলোক এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন।

আলাপ করতে করতে এমন অবস্থা হলো যে তিনি আমাদের এই মাচাতে শুতে দেবেন না। ওনার বাড়িতে যেয়ে ঘুমাতে হবে। হবে মানে হবেই। একদম নাছোড়বান্দা। অগত্যা রাজি হতে হলো। বাড়ীটার উপরে টিনের চাল। পাশেরটা কিসের আমার মনে নাই। কিন্তু মেঝেটা পাকা। সেখানেই আমাদের বিছানা। পরেরদিন সকালে উনি আমাদের প্রাতরাশ করিয়ে গাছ থেকে ডাব পারিয়ে সেই পানি খাইয়ে বিদায় করলেন। এমন আতিথীয়তা! ভাবাই যায় না!

সেন্ট মার্টিন।
সেন্ট মার্টিন।

আমরা ফিরে আসতে থাকি। ভীষণ অপূর্ণতা নিয়ে। মনে হয় একটা পূর্ণিমা রাত যদি ঐ বালুতটে মুক্ত আকাশের নিচে ঘুমাতে পারতাম! কিংবা একটা সপ্তাহ যদি জেলে হয়ে ঐ সমুদ্রে মাছ ধরতে পারতাম!!

ফেরাটা খুব সহজ। ভোরের জোয়ারে টেকনাফ। সরাসরি বাসে চট্টগ্রাম। আর ট্রেনে একবারে ঢাকা।

(দোষগুলি ক্ষমা করবেন। কয়েকজন ভদ্রলোকের সন্মান রক্ষার্থে কিছু শব্দের ব্যবহার সংকুচিত করা হলো। আর কয়কেটা স্বল্প কাপড়ের ছবি প্রকাশের লোভ সামলাতে পারলাম না)

সাইফুল ইসলাম রিপন
যন্ত্রকৌশলী
ক্যালগেরী, আলবার্টা, ক্যানাডা।

বাগেরহাট-পিরোজপুর ভ্রমণ

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাবুর ফ্লাপ খুলে বসে বসে ভোর দেখা আমার অন্যতম নেশা। ক্যাম্পিংয়ের প্রতিটি ভোরে আমি এই কাজ করে থাকি, যত রাতেই ঘুমাই না কেন ভোর দেখতে উঠব এটা মাস্ট।

আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। পিরোজপুরের সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের মাঠে গত রাতে অনেক ঝামেলা সামলে ক্যাম্প সাইট ফিট করে, রাতে নুডলস দিয়ে ডিনার করে ঘুমিয়েছিলাম।

আজ খুব ভোরে উঠে পড়লাম। হালকা শীতে এখনো চারপাশে কুয়াশাচ্ছন্ন। ভোরের শিশিরে চারপাশের বাহারি ফুলগুলো অসাধারণ লাগছিল। ইয়াশ তখনো ঘুমিয়ে। আমি একা একা কলেজের ভেতরে হেটে বেড়াতে লাগলাম। সাধারণত ক্যাম্প সাইট এর আশেপাশে আমি কমপক্ষে দুইবার হাটি। ১. রাতে নিরাপত্তা কেমন সেটা দেখার জন্য, ২. ভোরে প্রকৃতি দেখার জন্য। আজও হাটতে বেরিয়েছি।

কলেজের মাঠ, হল, বিভিন্ন একাডেমিক ভবনগুলোর চারপাশে হেটে বেড়াতে লাগলাম। স্নিগ্ধ সকালে চারপাশ অসাধারন লাগছিলো। এত ভোরেও বেশ কিছু ছেলেমেয়ে কলেজে এসেছে বিএনসিসি প্যারেড করতে। তাদের সাথেও কথা হল। ২/৪ জন প্রাতভ্রমণকারী এসেছে, তাদের সাথে আলাপ হল। ৩০ মিনিট মত ঘোরাঘুরি করে কেটলিতে চা এর পানি গরম দিয়ে আমি ইয়াশকে ডেকে তুললাম। চা হতে হতেই ইয়াশ আড়ামোড়া ভেঙ্গে উঠে পড়ল। দুইজনে ফ্রেশ হয়ে চা খেয়ে ক্যাম্প সাইট গুছাতে বসে গেলাম। রবিদা ততক্ষনে মুখ দেখিয়ে দিয়েছেন।

ক্যাম্প গুছিয়ে প্যাক করতে করতে কলেজের অধ্যাক্ষ স্যার কলেজে চলে এসেছেন। সময়ানুবর্তী বলে এই শিক্ষক ভদ্রলোকের সুনাম গতকাল রাতেই শুনেছি। উনার সাথে সকালে আমাদের নাস্তার দাওয়াত আছে। ব্যাকপ্যাক নিয়েই উনার সাথে গল্প করতে করতে আমরা উনার অফিসে গেলাম। উনার অফিসে গল্প করতে করতে নাস্তা করলাম। এই সকালেও অল্প সময়েই উনি বেশ নাস্তার আয়োজন করেছেন। উনি ভ্রমণ নিয়ে আমাদের সাথে অনেক গল্প করলেন। চা খেতে খেতে আমাদের ভ্রমণ গল্প শুনলেন। ১০ টার দিকে আমরা উনার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। আমাদের একটু তাড়া ছিল, ৩ টার লঞ্চ ধরে হুলারহাট থেকে আমাদের ঢাকায় ফেরার প্লান।

কলেজ থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম দুলাল মিষ্টান্ন ভান্ডারে। এখানকার রসগোল্লা বিখ্যাত, না চেখে দেখলেই নয়। আমরাও রসগোল্লা চেখে দেখলাম। রসগোল্লা খাইতে গিয়ে মুজতবা আলীর “রসগোল্লা” গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। এই যেন সেই রসগোল্লাই। ব্যাটা খাইবি না মানে, তুই খাবি তোর ১৪ গোষ্টী খাবে। যাইহোক রসগোল্লা খেয়ে আমরা রিকসা নিয়ে গেলাম রায়েরকাঠি জমিদার বাড়িতে।

 

শতাব্দী প্রাচীন জমিদার বাড়ীর অধিকাংশ ভবন ধংশ প্রায়। মোটামুটি টিকে আছে এমন একটা ভবনে জমিদারদের কিছু আত্নীয় বসবাস করে। জমিদারদের শশ্নান, পুকুর এসবও আমরা ঘুরে দেখলাম। পুকুর সংলগ্ন বাগানটি যেন ভুতুড়ে বাগান। গল্পে আমরা ছোটবেলায় যেমন গা হিম করা ছমছমে রহস্যময় বাগানের গল্প পড়েছি এটাও তেমনই। ইয়াশ এখানে ফটোগ্রাফি করতে লাগল। আমি একা একা বাগানের এদিক সেদিক হেটে বেড়াতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে জমিদার বাড়ি, বাগান পুকুর এসব দেখে আমরা পাশের শতাব্দী প্রাচীন মঠে উপস্থিত হলাম।

এখানে ইয়াশের পূর্ব পরিচিত এক বন্ধু এসে যোগ দিল। ৩ জনে অনেকক্ষন মঠে ঘুরে ফিরে আবার পিরোজপুর শহরে ফিরে আসলাম। এখানে ইয়াশের বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে একটা রিকশা নিয়ে আমরা হুলারহাট লঞ্চ টার্মিনালে এসে বিআইডব্লিউটিসির এমভি মধুমতি লঞ্চে চড়লাম। এভাবেই শেষ হয়ে যায় আমাদের বাগেরহাট – পিরোজপুর ক্যাম্পিং ট্রিপ। শেষ বিকালের আলোয় হ্যামকে দোল খেতে খেতে লঞ্চেই সুর্যাস্ত দেখে রাতে লঞ্চের ডেকেই খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে তাবু লাগায়া ঘুম দিলাম। পরদিন ঘুম ভাঙ্গল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে।

কিভাবে যাবেনঃ

ঢাকা থেকে পিরোজপুর লঞ্চ চলাচল আছে। ঢাকা থেকে প্যাডেল স্টিমার সহ ঝালকাঠির লঞ্চগুলো হুলারহাট হয়ে চলাচল করে। এছাড়া ঢাকা থেকে বাসও চলাচল করে। বাগেরহাট থেকে পিরোজপুর ৩০ কিলোমিটার মত। বাসে যাইতে সময় লাগে ৪০/৫০ মিনিট।

কি কি দেখবেনঃ রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি ও পার্শ্ববর্তী মঠ।

মাস্ট খাবেন দুলালের রসগোল্লা।

পিরোজপুর ভ্রমণ সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রয়োজন হলে নিচের কমেন্ট এ প্রশ্ন করতে পারেন। ভ্রমণ করুন বিশেষ করে একাকী নির্জনে ঘুরে নিজের দেশকে নিজের মত জানুন। দেশটা আপনার, প্রকৃতি আপনার, পৃথিবী আপনার। আপনার দেশ আপনার সম্পদ। আপনার সম্পদ কে নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে রেখে দিন।

লিখা ও ছবি: নাজমুস সাকিব

শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়িয়ে রক্তবর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘা

শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়িয়ে রক্তবর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘা

#আসা_যাওয়া, #সময়_সুযোগ বিস্তারিত

গতকালের আপডেট জেনে মাত্র কয়েকঘন্টায় প্ল্যান করেই ছুটে যাই পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার উদ্দেশ্যে। ব্যাগভর্তি এক্সেসরিজ। নাহ্, কোনো DSLR ক্যামেরা setup না। সাথে ছিল আমার 50mm টেলিস্কোপ, 10x বাইনোকুলার আর ফোন শুধুমাত্র। এ নিয়েই লক্ষ্য ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াকে ক্যামেরাবন্দি করার।

রাতের মধ্যেই ফোন এডাপ্টার বানিয়ে ফেললাম। ফজরের নামাজ সেরে একটা ভালো ছবির ক্লিকের জন্য দোয়া করে বের হলাম ভোর ৬ টার আগেই। তিন বন্ধুও ভোরের কনকনে ঠাণ্ডায় কাবু। Firoz Al Sabah ভাইয়ের পরামর্শে মহানন্দার তীরে বসে পড়ি setup নিয়ে। সূর্য উঠে নি, এরপরেও কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট। সূর্য উঠার সাথে সমানুপাতিক হারে এটি রক্তবর্ণ রূপ নিচ্ছে। ক্লিকের পর ক্লিক। ঠিক ৬:৪০ মিনিটে এই রূপে তাকে ধরে ফেলি।

কাঞ্চনজঙ্ঘা
কাঞ্চনজঙ্ঘা

কার্শিয়াং, পাংখাবাড়ি শহর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার পিছনেই হালকা কুয়াশা নিয়ে দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে রক্তবর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘা যার দূরত্ব মাত্র ১৫০ কিমি। ভয়ংকর গিরিখাদ, শ্বেতশুভ্র বরফ আর পাথুরে দেয়াল নিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে একটুও দেরি করে নি পৃথিবীর এই ৩য় উচ্চতম শৃঙ্গ, কাঞ্চনজঙ্ঘা।

ছবিটি তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো থেকে উত্তরে মহানন্দার তীর থেকে তোলা।

| 30.10.2020 | 06:40 AM |

#আসবো_কিভাবে?

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় সরাসরি ট্রেনে। একতা/দ্রুতযান/পঞ্চগড় এক্সপ্রেস। অথবা পঞ্চগড়/তেঁতুলিয়াগামী বাস অনেক। একটু খোঁজ নিলেই পাবেন।

#কখন_দেখা_বেস্ট?

সূর্য উঠার সময় থেকে দুপুর ১১-১২ টা পর্যন্ত। ভোরে লালচে রং, একটু পর ধবধবে সাদা। বর্তমানে আকাশ অনেক পরিষ্কার, পলুশন কম। ৭ দিন পরে পাবার সুযোগ অনেক কম। তাই দ্রুত চলে আসুন।

#থাকবো_কই?

তেঁতুলিয়াতে হোটেল আছে। অথবা পঞ্চগড় সদরেও আছে। থাকা খাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই। এদিকে খরচ অনেক রিজনেবল। একটা মাইক্রো ২৫০০-৩৫০০ টাকায় ভাড়া করে ১দিনে A to Z পুরো পঞ্চগড় দেখে ফেলতে পারবেন।

এই ছবির মত ক্লোজ ভিউ পেতে হলে আপনাকে বাইনোকুলার লাগবে। ক্যামেরার জুম লেন্স দিয়ে অসাধারণ ফটো তুলতে পারবেন। দানব আকারের এই পর্বত খালি চোখে দেখতে পাবেন খুব খুব খুব খুব পরিষ্কার ভাবে, অনেক অনেক অনেক বড় আকারেই। সত্যি ভাই, একদম সত্যি।

দেরি না করে দ্রুত চলে আসুন #হিমালয়_কন্যা_পঞ্চগড়।

আর হ্যাঁ, হালকা শীতের কাপড় নিতে ভুলবেন না। এদিক কিন্তু ভালই ঠান্ডা।

বিঃদ্রঃ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে গিয়ে অনেকেই মহানন্দা নদীতে প্লাস্টিকের প্যাকেট ফেলে। এধরনের কাজ থেকে নিজেদের বিরত রাখি, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখি।

©ফাহিম ফয়সাল শুভ

error: Content is protected !!