মারায়ন তং এ ক্যাম্পিং, আলীরগুহা, দামাতুয়া ঝর্ণা, ডিম পাহাড় ভ্রমন
পর্ব: ০২
১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বাস স্টেন্ডে নেমে আমরা সবাই সেখানের একটা খাবার হোটেলে ঢুকলাম। সবার ব্যাগ গুলো একটা টেবিলের উপর রেখে সবাই নাস্তা করতে বসলাম। সেখানকার হোটেল গুলোতে পরোটা বা রুটির চেয়ে লুচির চাহিদা বেশি। তাই পরোটা না বানিয়ে তারা শুধু লুচিই বানায়। আবার ভাতও রান্না হয়েছে। আমি ভাত খেলাম। আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে। বাকিরা লুচি, ডিম ও ডাল ভাজি দিয়ে নাস্তা করলো। নাস্তা শেষে আমরা দু’টো অটো নিয়ে চলে গেলাম আলীকদম ব্রীজের গোড়ায়।
আমাদের প্রথম দিনের প্ল্যান ছিলো মাতামুহুরি নদী, পোয়ামুহুরী ঝর্ণা এবং রূপমূহুরী ঝর্ণাতে যাওয়ার। আর সেখানে যেতে হলে আর্মি চেকপোষ্টের অনুমতি নিতে হয়। এজন্য সবার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সহ নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার এন্ট্রি করে রাখলো। সেখানেরই এক আর্মি ভাইয়ের সাথে আমাদের বেশ খাতির হয়ে যায়, উনার নাম আমির ভাই। কামরুলদের এলাকার লোক উনি।
সবাই তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতে বলতে আমি বিশাল সেই ব্রীজের উপরে এসে দাঁড়ালাম। ব্রীজের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল মাতামুহুরি নদী।
নদীর পিছনেই দেখা যাচ্ছে বড় বড় পাহাড়ের সারি। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় দূরের পাহাড় গুলোকে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছিলো!
সবাই মিলে নৌকা ঠিক করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেলো যে, সেখানে শুধু একটি ঝর্ণায় যাওয়ার অনুমতি মিলেছে আর নৌকা ভাড়াও অনেক বেশি। আমির ভাই অনেক চেষ্টাও করেছিলেন অনুমতি নেয়ার জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো না। পরে আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো।
সবাই আমরা আলীরগুহায় যাবো তাই অটো ঠিক করলাম। ব্যাগ গুলো সেখানেইর একটি দোকানে রেখে গিয়েছিলাম। সকাল প্রায় সাড়ে ১০ টার দিকে আলীরগুহার দিকে রওনা হলাম।
আলীকদম উপজেলা সদর থেকে মাত্র ০৩ কিলোমিটার দূরেই মাতামুহুরি নদী ও তৈন খাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দু’পাহাড়ের চূঁড়ায় প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট “আলীরগুহা বা আলীর সুড়ঙ্গ”। আমরা আনুমানিক আধাঘন্টা পরে তৈন খালের মাথায় এসে পৌঁছালাম।
খালের পাড়ে ছোট্ট একটি টং দোকান আছে। খাল পার হয়ে আমাদের ওপাড়ে গিয়ে ট্রেকিং শুরু করতে হবে। আমি ড্রেস চেন্জ্ঞ করার মতো কোনো সুবিধাজনক জায়গা না পেয়ে পরনের ভারী কাজের জামাতেই এগুলাম।
আমরা ছোট্ট একটা নৌকা দিয়ে খাল পার হলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো ঝিরি, ঝিরিটা বেশ সরু।
এর আগে আমি এমন ঝিরি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি অবাক হলাম ঝিরিতে মোটামুটি বেশ পানি ছিলো। সবাই নিচে না নেমে ঝিরির গাঁ ঘেঁষে থাকা শক্ত পাথরের মতো পাহাড়ের দেয়াল ধরে ধরে সামনে এগুতে লাগলো।
আমি ট্রেকিং সেন্ডেলের পরিবর্তে ট্রেকিং শু নিয়েছিলাম। তাই ঝিরিতে নামলে শু এর ভিতর অনেক পানি ঢুকে যাবে ভেবে সবাই আমাকে ঝিরি পার হতে সাহায্য করেছিলো।
কিন্তু, এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে নেমেই ঝিরি পার হতে হবে। অগত্যা আমাকে জুতা খুলে ফেলতে হলো। ঝিরি থেকে প্রায় ১৫০ ফিট উপরে সেই গুহা। প্রায় ০১ ঘন্টার মতো হাঁটার পর আমরা গুহার কাছে এলাম। আরও একটা গ্রুপও ছিলো আমাদের সাথে।
ঝিরি থেকে গুহায় উঠা খুবই কষ্টকর। একটা মোটা গাছের সাথে ছোট ছোট ডাল দিয়ে সিঁড়ি করে দিয়েছিলো কেউ। গাছের সাথে একটা মোটা রশিও ঝুলানো ছিলো। বৃষ্টি আর কাঁদায় সিঁড়িটা খুবই পিচ্ছিল হয়ে আছে।
এক এক করে সবাই উপরে উঠলো। উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম কিছু বাদুড় উড়ে গেলো। অনেকটা অন্ধকার ঝিরি। হালকা ভয়ও লাগছিলো আমার। হাতের ডানপাশেই পাহাড়ের গা ঘেঁষা গুহার ছোট্ট মুখ। গুহার ভেতর অনেক অন্ধকার থাকে বলে আলো জ্বালিয়ে ঢুকতে হয়।
প্রথম ২/৩ জন গুহায় ঢুকার পর আমি ঢুকলাম। গুহার মুখ এতটা ছোট ছিলো আর ভিতরে যেতেই দেখলাম অনেক বড় চওড়া জায়গা। এই গুহা লম্বায় প্রায় ১০০ ফিট। প্রথমবার গুহায় ঢুকার অনুভূতি অসম্ভব ভালো লেগেছিলো আমার। গুহার ভিতরে সবাই ছবি তুলেছিলো। তারপর কিছুক্ষণ থেকে আমরা আবার ফিরার প্রস্তুতি নিলাম।
একে একে সবাই গুহা থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে রশি ধরে নিচে নেমে আসলো। ঠিক সেই সময়ের জন্য নিজেকে আমার ভিন্ন জগতের মনে হয়েছে। কি যে অদ্ভূত সুন্দর অভিজ্ঞতা।
ফিরার পথে অর্ধেক এসে বিপরীত দিকে আরেকটি রাস্তা চলে গেছে। শুনেছি এই পাহাড়ে নাকি একাধিক গুহা রয়েছে। তবে ‘আলীরগুহা’ সবচেয়ে পরিচিত গুহা।
আমরা বিপরীত পাশের সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো একটি লোহার সিঁড়ি।
সবাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চাইলাম। কিন্তু, শাহিন ভাই বললো আমাদের এখানে আর বেশি দেরি করা যাবে না। কারণ, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মারায়ন তং পাহাড়ে ক্যাম্পিং।
প্রায় ১২ টার মধ্যে আমরা ঝিরি শেষ করে খালের পাড়ে চলে এলাম। সবাই খাল পার হয়ে অটো দিয়ে আলীকদম ব্রীজের সাথের সেই আর্মি ক্যাম্পের কাছে ফিরে এলাম যেখান থেকে আমরা গিয়েছিলাম।
আর্মি ক্যাম্পের সেই আমির ভাই আমাদের দেখেই একগাল হেসে সামনে এগিয়ে এলেন, হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। সবাইকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করালেন তিনি এবং বললেন যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় আমরা যেনো ওনাকে জানাই। অতঃপর আমির ভাই সহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে যার যার ব্যাগ নিয়ে আমরা সেখান থেকে চলে এলাম আবাসিক এ।
এখান থেকে মূলত মারায়ন তং-এর যাত্রা শুরু করতে হয়। কয়েকটা ছোটখাটো দোকান ও খাবার হোটেল আছে এখানে। ততক্ষণে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। বেলা প্রায় ০১ টা বাজে তখন।
আমরা সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম, মুরগীর মাংস, আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে। খাবার মোটামুটি ভালোই ছিলো। খাবার শেষ করে শাহিন ভাই সেদিন রাতের জন্য খাবারের অর্ডার করলেন সেই হোটেলেই। রাতের জন্য মুরগীর বিরিয়ানি অর্ডার করা হলো।
মূলত মারায়ন তং যাওয়ার আগে এটাই সর্বশেষ বাজার যেখান থেকে আপনি খাবার অর্ডার করতে পারবেন। তারপর প্রয়োজনীয় খাবার পানি এবং কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আমরা রওনা হলাম। তখন প্রায় দুপুর ০২ টার কিছু বেশি বাজে।
সবাই যার যার ব্যাগ, তাবু, খাবার পানি নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। আবাসিকের ডান পাশ দিয়ে চলে গেছে সোজা একটি রাস্তা, এই রাস্তা দিয়াই সবাই মারায়ন তং পাহাড়ের যাত্রা শুরু করে।
মারায়ন তং-এর উচ্চতা প্রায় ১৬৪০ ফিট। এখানে অনেক আদিবাসীদের বসবাস। হাঁটতে হাঁটতে সমতল পথ পার হতে হতে কিছু আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘর চোখে পড়লো।
তখন আমের মৌসুম ছিলো। আশেপাশের ছোট ছোট গাছ গুলোতে প্রচুর আমি দেখতে পেলাম। যেনো হাত দিয়েই পাড়া যাবে। তবে অনুমতি ছাড়া পাহাড়ীদের গাছের কোনো ফল ছিঁড়া উচিত নয়। যতই সামনে এগুতে লাগলাম পাহাড়ের উচ্চতা টের পাচ্ছিলাম।
সেই পাহাড়ের প্রায় পুরো রাস্তাটাই ছিলো ইট বসানো এবং ভীষণ খাঁড়া রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে জঙ্গলের মতো অসংখ্য গাছ আছে। যাত্রার শুরু থেকেই আমাদের সঙ্গী হয়েছিল একটি পাহাড়ী কুকুর।
চলবে…
লিখা ও ছবি: ছায়েরা আখতার সুমি