বাঁশখালী ভ্রমণ চিত্র
২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২১, শুক্রবার।
হাঁড়ি-পাতিল আর এক বস্তা বাজার নিয়ে আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে প্রচুর বকছি Abdullah Al Noman কে। লেইট মফিজ, সবসময় লেইট করে।
ওহ, গন্তব্য হচ্ছে বাঁশখালি সমুদ্র সৈকত। গ্রুপ মেম্বার ১৬জন।
রওনা করলাম ৭:৩০ এর চিটাগংমূখী ট্রেনে করে। বন্ধুরা মিলে ট্রেন ভ্রমণের মজাটা অনেকেই হয়ত অনুভব করতে পারছেন।
৯:৪৫টা, আমরা চিটাগং ট্রেন স্টেশনে পৌছালাম। তারপর, বড় একটা চিএনজি নিয়ে সোজা বাঁশখালি সৈকতে।
আহা! এই যায়গা ছেড়ে আগামীকাল কিভাবে বাসায় ফিরবো?? প্রেমে পড়ে গেলাম যে!
চারিদিকে খোলা বালি কঠোর রোদে চিক চিক করছে। এদিকে সবার পেট থেকে হাহাকারের চিত্র ফুটে উঠেছে চেহারায়। প্রচুর ক্ষুধা, উফ! কোনোমতে ক্ষুধা মিটানোর জন্যে যেই একটা হোটেলে ঢুকলাম হতাশা নিয়ে বেরোতে হলো। তাদের হোটেলে অগ্রিম অর্ডার ছাড়া ভারি খাবার(ভাত,মাছ, মাংস) পাবো না। আছেই একটা মাত্র হোটেল। কি করি এখন?? অর্ডার করার পর কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগলো খাবার আসতে। এই সময়ে আমরা ফ্রেশ হয়ে নামাজ সেরে নিলাম। আহা! খাবার টা যেমন-ই হোক, ক্ষুধার্ত পেট আমার ভীষণ তৃপ্ত।
মূলত আমরা দু’দিনব্যাপি বনভোজনে এসেছি। থাকতে হবে ক্যাম্প করে। পরিকল্পনা মোতাবেক ৫টা তাবু আর দুদিনের খাবারের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সরঞ্জাম সাথে এনেছি।
সূর্য ধীরে-ধীরে তার রাতের গন্তব্যে ফিরছিল। আহা! সে কি মনোরম দৃশ্য। আসলে খাবার শেষ করে সবাই নিজ নিজ ভাবনা থেকে অঞ্চলটার সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।
বিকাল ৫:৪০ টা বেজে গেলো। লাকড়ি দরকার সারারাত জ্বালানোর জন্যে। ভাগ্যিস ক্যাম্পের পাশেই একটা শুকনো গাছ পেয়ে গেলাম। বডিবিল্ডার বন্ধু Naimul Islam Ifan এই গাছ মাটিতে শোয়াবে। গাছ কাটার জন্যে রামদা দিলো ক্যাম্পের পাশের এক দোকানী। লোকটা ভীষণ উপকারী এবং ভালো মানুষ বটে।
রাতের খাবার ছিল কাবাব+পরটা(৪টা)। কাবাবের মুরগী কিনতে গিয়েছে টীম লিডার Anamul Hoque সাথে Mahmud Saleh
এদিকে ত্রি ইডিয়ট ( M R Rony, noman, MD Jahirul Islam ঘুরছে সে এলাকার ঢাকাইয়া বরই চুরি খাওয়ার ধান্দায়। চলে গেলো অন্ধকার পথ ধরে নির্দিষ্ট গাছের তলায়। বরই চুরি শেষে বীচ ধরে ক্যাম্পে ফেরার সময়টা ছিল সবচেয়ে মজার।
হাঁটার পথে পায়ের সাথে লাল কাঁকড়া দেখে ভয়ই পেয়েছিলাম প্রথমে। দুষ্টের দলতো এই কাঁকড়া ছাড়বে না।
ওমা! সামনে দেখি শত-সহস্র কাঁকড়া। ধরতে ধরতে প্রায় ১০০ পিস ধরে ফেললাম। এবার চিন্তা পড়ে গেলাম এগুলো কি খাওয়া যাবে কিনা আসলে?? পরে সিওর হয়ে নিলাম যে খাওয়া যাবে।
রাত ১০:৩০ টা।
কেন্ডল জ্বালানো ক্যাম্পটা দেখতে কি যে দারুণ লাগছিল আহা! চা বানিয়ে খাওয়ালাম সবাইকে।
ক্যাম্পের সামনে কাবাবের আয়োজন চলছে।
৩:৩০টা।
মাঝরাতে খুব ঘুম পাচ্ছে। তাবুতে ঢুকে কি আর মশার জ্বালায় ঘুমানো যায়?? তাও রেস্টের জন্যে শুয়ে থাকলাম।
দ্বিতীয় দিনঃ
চোখ মেলে দেখি সকাল ১০:০০ টা বাজে। চা বন দিয়ে নাস্তা সারলাম। ওয়েদারটা মারাত্মক সুন্দর। ফুটবল তো খেলা-ই যায় বীচ ধারে।
এই, দুপুরের খাবার রেডি করবি না??
টীম লিডারকে মনে করিয়ে দিলাম। দুপুর ১২:৩০ টায়। তখনও বাজার হয়নি। তাড়াহুড়ো করে বাজারে গেলাম। এসে গোসল করলাম সেই গ্রামের একটা পুকুরে। এভাবেই “বিরিয়ানি” প্লেটে উঠতে উঠতে সময় সময় গড়ালো ৪:৫০ টা।
বড্ড দ্বিধায় পড়ে গেলাম,ধুর!
এই যায়গা ছেড়ে যাবো কি যাবো না? নাহ! যাবো না। থেকেই যাই।
তিনজন সিওর হলাম আর সবাই চলে গেলেও আমরা থেকে যাবো। গ্রুপের কয়েকজন জনের জরুরী কাজ থাকায় আর কয়জন অসুস্থ অনুভব করায় তারা থাকতে পারছে না। চলে যাবে তারা। আরো দু-চারজন দ্বিধায় আছে।
পরে আমরা মোট ৭ জন কনফার্ম হলাম আমরা থাকছি।
গ্রুপের বাকি ৯ জন রওনা করছে। আমরা বিদায় দিয়ে দিলাম তাদেরকে। আর মনে মনে ভাবছিলাম আজকের রাতটাই হবে সবচেয়ে মজার।
আমাদের স্টকে খাবার শেষ। দুটো হাফ বোতল কোক ছাড়া কিচ্ছু নেই আর। ভাবলাম রাতটা মুড়ি চানাচুর খেয়ে কাটিয়ে দিবো। কিনে আনা হলো মুড়ি চানাচুর।
রাত ৯:০০টা- ১২:০০টা।
সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছি। মনে হচ্ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে এই বীচটা আমার। আবার ভাবছিলাম এটা আমার পৃথিবী। হ্যাঁ, আমার একান্ত।
আমরা ৭ জন তাবু ছেড়ে বীচ পাড়ে বসে আছি। চারিদিক অনেক শান্ত, স্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই।
আরে, কে ওখানে?
তাবুর পেছনে হঠাৎ দু-চারজন লোক ছোটাছুটি করছে। থমথমে এই পরিবেশে আচমকা মনের ভেতর এক উত্তাল, ভয়। কেমন যেন উদ্ভট আচরণ করছে কিছু ছেলেপেলে।
দৌড়ে তাবুর কাছে গেলে তাদের একজন সামনে এগিয়ে আসে।
-ডাব হাইবানে?
-হ্যাঁ, খাবো তো! এনে দিতে পারবেন?
-হাইজ্জুম, তোঁয়ারা থাক, ফারি আনির। আঁরা আর তিনজন আছেদে।
তারা উপস্থিত তিনজন আমাদেরকে ডাব অফার করলো। আবার বলে গেলো পেছনে তাদের আরো তিনজন লোক আছে।
এরা এত রাতে এখানে এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছে? ছিনতাইয়ের চেষ্টা করছে নাতো?
আবার ডাবের কথা শুনে না বলতেও পারলাম না।
যাইহোক,সন্দেহের জের ধরে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। যেহেতু আমরা বনভোজনে এসেছি সেহেতু রান্নাবান্না-র কাজে কিছু হাতিয়ার(দা, ছুরি ইত্যাদি)নিয়ে এসেছিলাম। সেসব নিয়েই প্রস্তুতি।
দু একজনের হাতে লাঠি।
মাহমুদের প্ল্যানঃ- তাবুর দক্ষিণ পাশে সে উত্তরে আমি আর তপু গাছের পেছনে থাকবো।
যদি তারা এটাক করে তাহলে আমরা তিনদিক থেকে গর্জন করে এটাক করে তাদেরকেই তাক লাগিয়ে দিবো।
(অবস্থান এবং অবস্থা অনুযায়ী আমাদের এই ধরনের চিন্তা করা এবং প্রস্তুতি নেওয়া সময় সাপেক্ষ এবং যৌক্তিক ছিল।)
দূর থেকে তাদের উদ্ভট আচরণগুলো পর্যবেক্ষণ করছিলাম। যদিও অনেক দূর থেকে ভালো করে তেমন কিছু বোঝা যাচ্ছিল না।
১:৪৫ টা। ঘন অন্ধকারে বন দিয়ে তারা দৌড়ে আসছে। আমরাও প্রস্তুত। মাহমুদের নির্দেশনা অনুযায়ী “থেরাপি” বলে হাঁক ডেকে এগোবো।
আস্তে আস্তে আমরা গোলাচ্ছি। ওরাও একদম কাছে। আসছে…
ওরে! ওরাতো সত্যিই ডাব নিয়ে এলো! কিন্তু তাদেরকে ভালো মানুষ ভাবা ভুল। তারা এই ডাব চুরি করে এনেছে।
যাইহোক, আমরা প্রতি পিস ডাব৩০ টাকা করে কিনে নিলাম। রাতে এই ডাব আর মুড়ি চানাচুর ই আমাদের খাবার ছিল।
তৃতীয় দিন। ভোর ৬:৫০ টা।
সকালে গ্রামটা ঘুরে দেখার প্ল্যান ছিল। রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। ফিরে এসে দেখি আমাদের তাবুর দিকে মুখ করে একদল মহিলা উরাধুরা গালি দিচ্ছে।
পরে বুঝলাম, সেই মহিলার গাছ থেকেই ডাব চুরি হয়েছে।
এখন পুরো দোষ আমাদের। হয়তো চোর ধরে দিতে হবে নয়তো জরিমানা গুনতে হবে।
আমরা অবশ্য চালাকি করে গত রাতে চোরদের সাথে একটা সেল্ফি তুলে রেখেছিলাম।
পরে আর কি করার, সেই সেল্ফিটা দেখিয়ে বাঁচলাম।
বাঁচলাম বললেই কি আর বাঁচা যায়? চোরেদের কানে খবর পৌছেছে যে, তাদের কথা ফাঁস হয়ে গেছে।
তারা ওতপেতে বসে আছে আমাদের জন্যে।
গ্রামের কিছু লোক ইনফর্ম করেন যে, আপনাদের জন্যে ফন্দি এঁটে আছে তারা। আপনারা এদিক দিয়ে যাবেন না।
পরে তাদের পরামর্শে আমরা উলটো পথ ধরে চলে এলাম।
আসার পথে সেই গ্রামের অনেক মানুষই খোজ নিলো, কোনো সমস্যা হলো কিনা? তারা অনেকেই অনেক সাহায্য করেছিল। মানুষগুলো দারুণ অতিথি পরায়ণ।
৩ দিন ২ রাতের সফরে এলাকাটি, সমুদ্র পাড় আর ওখানকার মানুষগুলো অনেক আপন হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল আরো কটাদিন থাকি।
যাকগে, প্রথমে মোশালি(মোশারফ আলি) বাজার হয়ে গুনাগরি বাজার, তারপর সেখান থেকে বাসে চট্রগ্রাম ট্রেন স্টেশন। বিকাল ৫:০০ টার ট্রেন ধরলাম।
চলন্ত ট্রেনের ঝনঝন শব্দ মনে লাগছিল। ইশ! যদি ট্রেনটি না থামতো!
ট্রেন থেমে গেলো ফেনী স্টেশনে। হঠাৎ বুকে খুব ব্যাথা অনুভব হলো। এই ভ্রমণের ইতি ঘটা খুব জরুরি ছিল!?
[বিঃদ্রঃ ১. ভ্রমণে গিয়ে ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে নির্দিষ্ট যায়গায় ফেলুন।
২. এমন নির্জন সমুদ্র সৈকত কিংবা পাহাড়ে ঘুরতে গেলে রাতে কোনো মানুষের সাথে দেখা হলে সতর্কতার সাথে হেন্ডেল করার চেষ্টা করুন। তাদের যে কোনো অফার ফিরিয়ে দিন।
৩. নির্জন যায়গায় ক্যাম্পিং করতে গেলে অবশ্যই সেইফটি গিয়ার সঙ্গে রাখবেন।]
ধন্যবাদ। আসসালামু আলাইকুম। — feeling fantastic at Banskhali Sea Beach.