চন্দ্রাবতীর পালা
চন্দ্রাবতী এক কিংবদন্তির নাম। প্রায় ৫০০ বছর আগে এই বঙ্গীয় উপদ্বীপে জন্ম নেয়া চন্দ্রাবতী নিছক একজন পালাকারই ছিলেন না! ছিলেন সুন্দরী, বিদুষী এবং সর্বোপরি চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর এক দ্রাবিড় রমণী ।
মধ্যযুগে বাংলার প্রথম সার্থক মহিলা কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন বাবার মতো ভাসান কবি, গীতিকার আর রামায়ণের রচয়িতা। মৈমনসিংহ গীতিকার পরতে পরতে মিশে আছে কবি চন্দ্রাবতীর অমর কাব্য, প্রেম আর বিরহের উপাখ্যান।কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে পাতুয়াইর গ্রাম।
চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বাল্যসখা জয়ানন্দের বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয়। । দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে যায় এক নাটকীয় ঘটনা।
বাল্যপ্রেমকে পদ-দলিত করে চঞ্চলমতি জয়ানন্দ ত্রিভুজ প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে। যে সন্ধ্যায় চন্দ্রাবতী বিবাহবেশে অপেক্ষমাণ সে সন্ধ্যায় খবর আসে, আসমানি নামের এক মুসলমান মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে কাপুরুষ জয়ানন্দ ধর্মান্তরিত হয়ে তাকেই করেছে বিয়ে! এ নিদারুণ সংবাদে লগ্নভ্রষ্টা-চন্দ্রাবতীর হৃদয় ভেঙে যায়, স্তম্ভিত চন্দ্রাবতী নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করেন।
এক সময় নির্জন আর বন-জঙ্গলে ঘেরা অনেকটা দুর্গম পাতুয়াইর গ্রাম ছিল ফুলেশ্বরী নদীর তীরে। পরাহত প্রেম আর চরম অপমানের জ্বালা ভুলবার জন্য চন্দ্রাবতী পিতার উপদেশ শিরোধার্য করে তাঁর কাছে দুটি প্রার্থনা করেন।
প্রথমটি, ফুলেশ্বরী নদী-তীরে একটি শিব-মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবার অনুরোধ। দ্বিতীয়টি, চিরকুমারি থেকে বাকি জীবন শিবের-সাধনায় নিয়োজিত থাকার অনুমতি।
কিছুকাল পরে মোহ কেটে গেলে অনুতপ্ত জয়ানন্দ পুনরায় ফিরে আসে চন্দ্রাবতীর কাছে। তখন চরাচরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করে চন্দ্রাবতী সন্ধ্যারতি এবং শিবের পূজায় মগ্ন।
রুদ্ধদ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে জয়ানন্দ বারবার চন্দ্রাবতীকে নাম ধরে ডেকেও কোন সাড়া পায়না। এই নীরবতাকে চন্দ্রাবতীর প্রত্যাখ্যানের ভাষা মনে করে ব্যর্থ-মনোরথ জয়ানন্দ, লাল রঙের সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দরোজায় ৪ ছত্রের একটি পদ লিখে সে স্থান ত্যাগ করে-
“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী
পাপিষ্ঠ জানিয়ো মোরে না হইল সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মতো”।
পূজা শেষে মন্দিরের দরোজা খুলে চন্দ্রাবতী লেখাটি দেখতে পান। মন্দির অপবিত্র হয়েছে ভেবে মন্দির গাত্রে উৎকীর্ণ সে লেখা মুছে ফেলার জন্য তিনি নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন নদীর জলে ভাসছে জয়ানন্দের মৃতদেহ। মুহূর্তে তাঁর জীবনের সব আলো নিভে যায়।
জয়ানন্দের মৃত্যু থামিয়ে দেয় চন্দ্রাবতীর জীবন। প্রাণের আবেগ সম্বরণ করতে না পেরে প্রন্মত্তা-ফুলেশ্বরীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জয়ানন্দের শেষযাত্রায় তিনিও সঙ্গী হন। এভাবেই চন্দ্রাবতী তাঁর প্রেমকে অমর করে রেখে গেছেন, সেটা ১৬০০খৃস্টাব্দের কথা।
চন্দ্রাবতীর রচিত কাব্যগুলি-
* মলুয়া
* দস্যু কেনারামের পালা (মনসার ভাসান, রচনাকাল: ১৫৭৫ শকাব্দ)
* রামায়ণ(অসমাপ্ত)
কিন্তু দীর্ঘদিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ ঐতিহাসিক স্মৃতি। পাশেই রয়েছে আরো একটি মন্দির ও ভগ্নপ্রায় একটি দ্বিতল ভবন।
বাড়িটি চন্দ্রাবতীর পূর্বপুরুষ জমিদার নীলকণ্ঠ রায়ের বলাহয় । জমিদার নীলকন্ঠ রায়ের নামে এলাকার নাম হয় নীলগন্জঁ। হুমায়ূন আহমেদ এর ‘সুখী নীলগঞ্জ’ নাটকের দৃশ্যায়ন হয় নীলগঞ্জে।
দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন চন্দ্রাবতীর বাড়ী দ্খতে। কিন্তু মন্দিরের দৈন্যদশা দেখে হতাশ হন অনেকে। — জালালপুর নীলগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ.