জীবনের প্রথম বান্দরবান অভিযান ও একজন নাঈম ভাই তথা সিনিয়রের সাথে পথচলা
ক্ষুদ্র এই ট্রাভেলিং জীবনে অবদান আছে বহু মানুষের কখনো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি ৷ আজ সবাইকে বলতে চাই আমার পাহাড়ের প্রতি ভালবাসার জন্য হাদী মুন ভাইয়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ ৷ ভাই না হলে মনে হয় আমি কখনো পাহাড় ভালবাসতে পারতাম না ৷ ভাইয়ের তোলো বান্দরবানের অসাধারন ছবিগুলো আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষন করত ৷ সেই ভালবাসার ভাইটার সাথে জীবনে আমার দেখাও হয় নি সরাসরি একবারও 🙁 যখন যা জানতে চেয়েছি নিঃস্বার্থভাবে তার ক্ষুধা তিনি মিটিয়েছেন ৷ কখনও কখনও গভীর রাতে বিরক্ত করতাম জানার জন্য , ভাই কখনো বলেনি যে পরে নক দাও এখন ব্যস্ত ৷ আপনার প্রতি ভালবাসা হাদী ভাই ♥
২০১৮ সালের জুলাই মাসে রোজার ঈদের পরদিনই প্রচন্ড গরমে গিয়েছিলাম জীবনে প্রথমবার পাহাড়ের স্বাদ নিতে৷ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম তৌফিক ভাই, হিমেল , নাঈম ভাই ( সিনিয়র ) আর আমি যাব একসাথে ৷ সমস্য হল আমরা একেকজন একেক জায়গার , তমাল ভাই কুমিল্লার, হিমেল ঢাকার, সিনিয়র ভোলার আর আমি চট্টগ্রামের ৷ সবাই একসাথে হওয়াটাই একটা চ্যালেঞ্জ ৷ সিনিয়রের বড় ভাই ফয়েস লেকে থাকত তাই তিনি একদিন আগে চট্টগ্রাম চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ৷ কথা ছিল আমি আর সিনিয়র একসাথে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবান যাব ৷ তমাল ভাই হিমেল একসাথে রওনা দিবে , বান্দরবান গিয়ে সবাই একসাথে মিলিত হব৷
যাত্রার দিন দুপুরে আমি সিনিয়রকে পিক করি মুরাদপুর থেকে৷ তারপর সিনিয়র আর আমি বহদ্দার হাট টার্মিনাল থেকে বান্দরবানের বাসে চেপে বসি ৷ লম্বা প্লান ছিল তাই দুইজনের ব্যাকপ্যাকই ছিল রসদে ভরা ৷ ব্যাগের ওজন ও তাই বেশি ছিল , আমার ব্যাগের ওজন ছিল সবচাইতে বেশি ২১ কেজি যেটা আমি যাবার আগে ওজন করে নিয়েছিলাম ৷ অন্যদের গুলাও কম বেশি এমনই হবে হয়ত জানিনা৷
সিনিয়রের সাথে প্রথম পরিচয় ৷ দুজনই গল্প করতে করতে সন্ধার একটু আগে বান্দরবান পৌঁছালাম ৷ গাড়ি থেকে নেমে দুইজনই আগে সেই রকম চা খেলাম নদীর তীরে ছোট একটা টং দোকানে ৷ সিনিয়র বহুবার বান্দরবান এসেছে , সব তার চেনা , এটা আমাকে বেশ স্বস্তি দিয়েছিল ৷ এরপর দুইজন মিলে চলে গেলাম স্বর্ণ মন্দিরে , সেখানে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধা হয়ে গেল৷
নাঈম ভাই এবার চেষ্টা করতে লাগল ওখানে আশেপাশে কোথাও তাবু ফেলে থাকা যায় কিনা ৷ মন্দীরের কেউ রাজি হয় নি , পরে আমরা টমটম নিয়ে রাত ৮টার দিকে আবার সদরে ফিরে আসি ৷ সিদ্ধান্ত নিলাম হোটেলে থাকব না , আমরা ট্রাভেলার হোটেল আমাদের জন্য না ৷ যেকোন উপযুক্ত জায়গা পেলেই তাবু লাগিয়ে দিব ৷ সিদ্ধান্ত ফাইনাল , এবার খেতে যাব , পাহাড়ী একটা রামিয়ন (মংডু) বেশ সুস্বাদু বললেন সিনিয়র ৷ সিনিয়র আমাকে বংড তে নিয়ে গেলেন তা খাওয়ানোর জন্য ৷ সেই স্বাদটা এখনো মুখে লেগে আছে আমার , ৩ বাটি খেয়েছিলাম 😉 ৷ খাবার খেয়ে বের হয়ে তাবু লাগানোর জন্য জায়গা খুজতে লাগলাম ৷ খালি মাঠও পেয়ে গেলাম , অনেকেই নাকি আগে সেখানে গ্রুপ করে তাবু লাগিয়ে থেকেছিল অতীতে ৷ কিন্ত সমস্যা হল আমরা মাত্র দুইজন আর তাবু একটা তাই নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে ৷
আরেকটু সামনে গিয়ে দেখি বান্দরবান সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের গেট খোলা ৷ কোন কথা না বলে গেটের ভিতরে ঢুকে গেলাম সিনিয়রকে সাথে নিয়ে ৷ সিনিয়র একটু ভয়ে ছিল ৷ রাতে প্রহরী যদি এসে কিছু বলে বা তাড়িয়ে দেয় ৷ বললাম কিস্সু হবে না ৷ তারপরও আসেপাশে অনেক খুজলাম কাউকে পেলাম না অনুমতি নেবার জন্য ৷ নাঈম ভাইকে বললাম সিনিয়র তাবু বাইর করেন , যা হবার পরে দেকমুয়ানে 😛 ঈদের বন্ধ থাকায় স্কুল বন্ধ সকালে কেউ চেচামেচি ও করবে না ৷ সিনিয়র কথামত জায়গা খুজে তাবু লাগানো শুরু করে দিছে আর আমি চারপাশে নজরদারি করতেছিলাম ৷ তাবু খাটানো হলে দুইজনের সব জিনিসপত্র তাবুর ভিতরে রেখে স্কুলের চারপাশ টা চক্কর দিতে শুরু করলাম ৷ একদম নিস্তব্দ চারপাশ৷
রাত ১০ টার পর তমাল ভাই ফোন দিল যে তারা রওনা দিয়েছে , সকালের মধ্যে পৌঁছে যাবে ৷ সিনিয়র আর আমি নিজেদের গল্পে মসগুল হয়ে গেলাম ৷ সকালে ভোরে ফজরের আজান দিতেই আমরা সব গুছানো শুরু করলাম ৷ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম তমাল ভাইদের ৷
তমাল ভাই হিমেল এসে পৌঁছালে তাদের সাথে নিয়ে নাস্তা করে থানচির দিকে যাত্রা করলাম ৷ পথে বিভিন্ন জায়গায় আর্মির চেক পোস্টে নাম লিখিয়ে আমরা দুপুরের একটু আগে থানচি গিয়ে পৌঁছালাম ৷ দুপুরের খাবার খেয়ে কুত্তা মারা গরমে জীবনের প্রথম ট্রেকিং শুরু করলাম আমি তমাল ভাই আর সিনিয়রের হাত ধরে ৷ গরম কি জিনিস সেটা আমরা হারে হারে টের পেয়েছিলাম সেদিন 🙁
পথে অনেক মজা করলাম , একটার চেয়ে একটা সেরা কমেডিয়ান একসাথে হলে যা হয় আরকি 😉 বিভিন্ন জায়গায় বিরতি দিয়ে দিয়ে সন্ধার একটু আগে বোডিং পাড়া ওয়াই জংশনে এসে আমার পায়ের মাসল ক্রাম্প করল ৷ পিঠের ভারী ব্যাগটাও বেশ প্যাড়া দিচ্ছিল ৷ তমাল ভাই হিমেলকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল ৷ সিনিয়র আমার সাথে সাথে আস্তে আস্তে চলতে লাগলেন ৷ বহু কষ্টে ঠিক সন্ধায় বোডিং পাড়া গিয়ে পৌঁছালাম ৷ হাফ ছেড়ে বাঁচলাম আজ আর হাঁটতে হবে না , সকালে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিব ৷ তমাল ভাই আমার ব্যাগ থেকে খিচুরীর প্যাকেট বের করে রান্না করা শুরু করে দিলেন ৷ কারবারির বাড়িতে সেদিন আমরা রাত্রিযাপন করেছিলাম ৷ রাতে খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীরে একটু ঘুমালাম ৷ সকালে আমার পায়ের ব্যথা আরো বেড়ে গেল ৷ আমি কুইট করার সিদ্ধান্ত নিলাম , কিন্তু চেয়েছিলাম অন্যরা যাক ৷ আমি একজন লোকাল গাইড নিয়ে একা ফিরে আসার চিন্তা করছিলাম থানচির দিকে ৷ তমাল ভাই সিনিয়রের সাথে কথা বলে তাকে আমার সাথে ফিরে যাবার কথা বললেন ৷ সিনিয়র প্রথমে যেতে চাননি ৷ আমিও চাইনি তিনি ফিরে আসুক মিশন কমপ্লিট না করে ৷ কিন্তু তমাল ভাইয়ের ধারনা ছিল সিনিয়র অনেক ক্লান্ত হয়ত সামনে গিয়ে আর আর পারবেন না তিনি ৷ তাই তাকেও আমার সাথে ফিরে আসার কথা বললেন ৷ পরে সিনিয়র আমার সাথেই ফিরে আসার জন্য তৈরি হয়ে গেলেন ৷ সিনিয়রের জন্য সেদিন মনটা অনেক খারাপ ছিল আমার ৷ বোডিং পাড়া থেকে একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে আমি সেদিন সিনিয়র সহ থানচি ফিরে এসেছিলাম ৷ আসার সময় সিনিয়রের সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে উপভোগ করা সময়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ৷ অনেক মজা করেছি সেদিন আমি সিনিয়র আর ইয়ং৷
সিনিয়র তোমার জন্য অনেক অনেক ভালবাসা ৷ সেই সাথে কৃতজ্ঞতা জানাই মন থেকে তোমার প্রতি ৷ বেঁচে থাকলে কোন একদিন আবার একসাথে ট্রিপ দিব ইনশাআল্লাহ , আর সেদিন আমরা ব্যর্থ হবনা ৷
লিখা: রবি চন্দ্রবিন্দু