ম্যাজিকাল মারায়ং তং :
আলীকদম পার্বত্য বান্দরবানের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজেলা ৷ এর আয়তন প্রায় ৮৮৫.৭৮ বর্গ কিলোমিটার ( ২,১৮৮৮০ একর ) ৷ আলোহক্যডং থেকে আলীকদম নামের উৎপত্তি। বোমাং সার্কেল চীফের নথি পত্র ও ১৯৬৩ সালের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আঁকা মানচিত্রে আলোহক্যডং নামের সত্যতা পাওয়া যায়।
আলীকদমের বেশ কিছু পাহাড়ের মধ্যে কির্সতং, রুংরাং এবং মারায়ং তং অন্যতম ৷ কির্সতং ও রুংরাং যেতে কষ্টকর ও সময় সাপেক্ষ হলেও যোগোযোগের সুবিধার জন্য মারায়ং তং যাওয়া কিছুটা সহজ ও কম সময় সাপেক্ষ ৷
মারায়ং তং এর অবস্থান আলীকদমের মিরিঞ্জা রেঞ্জে ৷ অনেকে এই পাহাড়কে মারায়ন ডং ( Marayan Dong ) বলেও ডেকে থাকে। আবার মেরাই থং নামটাও শুনতে পাওয়া যায় ৷ মারায়ং তং এর উচ্চতা প্রায় ১৬৪০ ফুট।
এই পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় রয়েছে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয়। চারদিকে খোলা ও ওপরের দিকে টিনের চালা দেয়া স্থাপনার মাঝখানে বিশাল এক বৌদ্ধ মূর্তি রাখা আছে ৷ প্রতিবছর মাঘ মাসে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা মেলা পরিচালিত হয় মারায়ং তং জাদীতে। এই জাদীই এই পাহাড়ের মূল সামিট পয়েন্ট ৷
১৬৪০ ফুট উঁচু মারায়ং তং এর পুরোটা রাস্তাই চড়াই পথ। অর্ধেক আবার আধপাকা রাস্তা। মানে ইট বাঁধানো রাস্তা। মূলত স্থানীয় আদিবাসীদের উপড়ের জাদীতে যাবার সুবিধার জন্যই এই রাস্তা বানানো।
মারায়ং তং পাহাড়ের ওপরের অংশটুকু অনেকাংশেই সমতল। তাঁবু করে ক্যাম্পিং করার জন্য আদর্শ জায়গা ৷ এর চূড়া থেকে যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড় চোখে পড়ে ৷ সেসব পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দেখা যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ী জনবসতি।
পাহাড়ের নীচে সাপের মতো এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে মাতামুহুরী নদী। তার দুই কূলে দেখা যায় অসংখ্য ফসলের ক্ষেত ৷ পাহাড়ীরাই মূলত এসব ক্ষেতে ফসল ফলায় ৷ যা দিয়ে স্থানীয় চাহিদা পুরণ হয় অনেকাংশে ৷
মারায়ং তং পাহাড়ে রয়েছে বিভিন্ন আদিবাসীর বসবাস। এদের মধ্যে ত্রিপুরা, মারমা ও মুরং অন্যতম। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে মুরংদের তৈরি ছোট ছোট পাড়া।
মুরংরা পাহাড়ের ঢালে তাদের ঘর বানিয়ে বসবাস করে। মাটি থেকে সামান্য উপরে কাঠ দিয়ে মাচার মত উঁচু করে ঘর বানায় মুরংরা ৷
উপড়ের দিকে নিজেরা থাকে পরিবার পরিজন নিয়ে আর নিচের দিকে রাখে বিভিন্ন গবাদি পশু যেমন-গরু, ছাগল, শূকর, মুরগি ইত্যাদি ৷ গবাদি পশুর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় লাকড়ি ও তারা স্তূপ করে জমিয়ে রাখে নীচে ৷ এগুলো তারা জ্বালানী কাঠ হিসাবে ব্যবহার করে ৷
পাহাড়ের নীচের দিকে থাকে মারমারা ৷ পাহাড়ীদের পাশাপাশি পাহাড়ের নীচের দিকে সমতলে বাঙালীরাও থাকে ৷
মারায়ং তং এ রাতের আকাশ দেখার মত সুন্দর । একবার তাকালে সহজে দৃষ্টি ফেরানো কঠিন ৷ এতো সুন্দর, অপার্থিব রাতের আকাশ দেশের আর কোন জায়গা থেকে দেখা যায় বলে মনে হয় না ৷
পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়ানো আকাশগঙ্গা বা মিল্কিওয়ে তথা আমাদের গ্যালাক্সী যেন তার সৌন্দর্য্যের সবটুকুর পসরা সাজিয়ে বসে থাকে এখানে আমাদের চোখের ক্ষুধা নিবারনের জন্য ৷ চিৎ হয়ে শুয়ে একবার তা দেখা শুরু করলে আর উঠতেই মন চাইবে না কারো ৷
কিছুক্ষন পরপর মাথার উপড় দিয়ে উড়ে যায় হাওয়াই জাহাজ৷ একটু খেয়াল করে ভালকরে তাকালেই বুঝা যায় ৷ রাতে মারায়ং তং এর চূড়ায় প্রচন্ড বাতাস থাকে ৷
যাবার উপায় :
মারায়ং তং যেতে হলে দেশের যে কোন জায়গা থেকে প্রথমে পৌঁছাতে হবে চকোরিয়া। চকোরিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে আলিকদম যাবার সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে ৷ সেইসাথে রয়েছে পাহাড়ের বিশ্বস্ত বন্ধু নামে পরিচিত চান্দের গাড়ি জীপ সার্ভিস ৷
চান্দের গাড়ী কিংবা বাসে করে আলিকদম যাবার পথে রেফার ফাঁড়ি বাজার নেমে যেতে হবে মারায়ং তং যাবার জন্য ৷
চকরিয়া থেকে রিজার্ভ চান্দের গাড়ি ১০০০/১২০০ টাকার মতন নেয় , একটু দরদাম করে নিতে হয় ৷ চাইলে লোকাল জীপেও যাওয়া যায় , নির্দিষ্ট সময় পর পর জীপ সার্ভিস আছে৷ ৭০-৮০ টাকার মত পড়বে ভাড়া জনপ্রতি ৷
বাসে করে গেলে এই রুটে মাতামুহুরী নামে বাস সার্ভিস আছে । বাসের ভাড়া ৬৫ টাকা জন প্রতি। রেফার ফাঁড়ি বাজারে নেমে ডানদিক বরাবর যে রাস্তা চলে গেছে সে রাস্তা ধরে আবাসিক বিদ্যালয় পাড় হয়ে গ্রামের পাড়ার সামনে পর্যন্ত যেতে হবে৷
তারপর সেখান থেকে শুরু হবে মূল ট্রেকিং পর্ব ৷ প্রায় ২ ঘন্টার ট্রেকিং মোটামুটি কষ্টের , পুরোটা পথই আপ ট্রেইল৷
মারায়ং তং এর চূড়ায় পানীয় জলের কোন উৎস নেই, যাবার সময় তাই সাথে করে অবশ্যই পানকরার জন্য ও রান্নার জন্য পর্যাপ্ত পানি নিজেদের বহন করে নিয়ে যেতে হবে, যদি চূড়ায় ক্যাম্পিং করে থাকার প্লান থাকে!
রেফার ফাঁড়ি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই রয়েছে ৷ ট্রেকিং শুরু করার পূর্বে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই এখান থেকেই কিনে নিতে পারবেন ৷ এমন কি এখান থেকে ক্যাম্পিংয়ের জন্য পাহাড়ী লাকড়িও কিনতে পারবেন।
আমার মতে যাবার সময় সাথে লাকড়ি কিনে নিয়ে যাওয়াই ভালো, কারন উপরে রান্নার করার জন্য তেমন লাকড়ি পাওয়া যায় না। বাজারে ২-৩ টা মাঝারি মানের খাবার হোটেল আছে ৷
চাইলে হালকা নাস্তা অথবা যেতে যেতে যদি দুপুর হয়ে যায় তাহলে এই হোটেল গুলোতে দুপুরের খাবার টা খেয়ে ট্রেকিং শুরু করতে পারবেন । খাবারের মান মোটামুটি ভাল ৷
থাকার জায়গা :
মূলত মারায়ং তং যারা ভ্রমণ করতে যায় তারা ক্যাম্পিং করে সেখানে থাকার জন্যে ভ্রমণে যায়। ক্যাম্পিং করে পরের দিন ফিরে আসে ৷
তবে যদি কারো নিতান্তই এক্সট্রা কিছুদিন সেখানে থাকার প্রয়োজন হয় তাহলে আলীকদম উপজেলা রোডের “দ্যা দামতুয়া ইন” হোটেলে অথবা জেলা পরিষদের ডাক বাংলোতে থাকতে পারবেন। এছাড়াও পান বাজারে সাধারণ মানের একটা বোর্ডিং আছে।
প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হউন । ট্রেইল পথে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না , বাংলাদেশকে ভালবাসুন , উপভোগ করুন এর অপার সৌন্দর্য ।
লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু