জলে ও জঙ্গলে এ্যাডভেঞ্চার
পর্ব – ১
(সমুদ্র পথে- হরিনা ঘাটা, লালদিয়ার বন, বিহঙ্গ দ্বীপ , সুন্দরবন এর কচিখালী, শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, টেংরাগিরি ফরেস্ট, আশার চর, চর বিজয় – Victory Island, গঙ্গামতির চর, কুয়াকাটা হয়ে আবার বরগুনায় ফিরে আসা, প্রায় ২০০ + কিমি এর মতো সমুদ্র ভ্রমন)
গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারী আমরা শুরু করেছিলাম আমাদের এই এ্যাডভেঞ্চার ট্রিপ টি । বেশ কিছুদিন আগেই গ্রুপ ইভেন্ট ক্রিয়েট করা হয়েছিলো । যেহেতু মিড লেভেল এ্যাডভেঞ্চার ট্রিপ ছিলো তাই গ্রুপ সাইজ ছোট ছিলো ।
সাকুল্যে ২৫ জন এর মতো আমরা রেজিঃস্ট্রেশন নিয়েছিলাম। বলা বাহুল্য আমাদের ইভেন্ট গুলোতে ইভেন্ট ঘোষণা করতে দেরী হয় , কিন্তু সিট ফিলাপ প্রায় সাথে সাথেই হয়ে যায় । কারন বছরে আমরা ২ থেকে ৩ টি ট্রিপ করি। আর আমাদের প্রায় প্রতিটি ট্রিপ ই হয় অনেকটা অচেনা ও ভিন্ন পথে । উপকূলীয় আন এক্সপ্লোর বিউটি গুলো আমরা উপভোগ করতে চেস্টা করি সব সময় । এই ট্রিপ গুলোতে যেহেতু রিমোর্ট এরিয়ায় বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশ থাকে তাই সিট সংখ্যা লিমিটেড রাখতে হয়।
যাই হোক রাস্তায় জ্যাম জনিত জটিলতায় ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতায় শেষ মুহূর্তে আমাদের এই ট্রিপে ১৫/১৭ জন এর মতো ছিলাম বোধহয় । সেদিন ছিলো ৩ দিন এর বন্ধ শুরু। তাই আমি আগে ভাগেই অফিস থেকে বের হয়ে উবার এর বাইকে রওনা দিলাম সদরঘাট এর পথে । সন্ধ্যায় ৬ টায় আমাদের লঞ্চ ছাড়বে এম ভি পূবালী ১ । সদরঘাট পৌছেই দেখি মোটামুটি অনেকেই চলে এসেছে । এর মধ্যে আমাদের ট্রিপ এর ব্যানার আনা হলো , টি শার্ট দেয়া হলো সবাইকে (যারা এসে পৌছেছে আর কি) । এরপর পরিচয় পর্ব ও ফটোসেশন শেষ এ লঞ্চ ছাড়ার সময় হয়ে গেলো । আর আমাদের লঞ্চ ও ছেড়ে দিলো ।
বাই দ্যা ওয়ে এর মধ্যে আমাদের রমজান ভাই চলে আসলেও, তার বন্ধু আবিদ ভাই এখনো এসে পৌছে নি । তাই সে রয়ে গেলো , বরিশাল হয়ে আসবে বলে। ওয়েদার টা সেদিন বেশ ভালোই ছিলো । ঘাট ছেড়ে বের হয়েই পূবালী ১ তার স্বভাব সুলভ গতিতে ছুটে চললো ।
লঞ্চ ছেড়ে দেয়ার পরই নিচে চলে গেলাম চা খেয়ে উঠে গেলাম ছাদে । এক ধাপ আড্ডা চললো বেশ খানিক ক্ষন । চাঁদপুর এর কাছাকাছি আসার পর নিচে চলে এলাম । এরই মাঝে রমজান ভাই ফোন করে জানালো তারা দুই জন এম ভি পারাবত ১২ তে উঠেছে । আমরা ছিলাম ডেক শ্রেনীর যাত্রী , লঞ্চ এর ২য় তলার সামনের ডেক এ আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। তো এর পর খাওয়া দাওয়ার পালা। লঞ্চ এর ডেক এর রেস্টুরেন্ট এ প্রি সেট মেনু তে খাওয়া দাওয়া সম্পন্ন করে যারা ঘুমুবে তারা ঘুমুতে গেলো । আর আমরা আবার গেলাম ছাদ এ ।
চললো রাত ভর আড্ডা, আকাশে চাঁদ মোটামুটি বড় ছিলো। পূর্ণিমার আশে পাশে কোন এক তারিখ ছিলো সম্ভবত । আশে পাশে কোন নৌযান নেই, মেঘনার জলে চাঁদের আলোর রিফ্লেক্ট এর সাথে সাথে হালের পানি কাটার শব্দ , বেশ ভালোই লাগছিলো।
আমরা মাঝের চর পার হয়ে হিজলার কাছাকাছি , তখন দক্ষিন অঞ্চল থেকে ফিরতি লঞ্চ গুলোর লাইন ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছুটে চলা বহর শুরু হলো। কিছু ক্ষন লঞ্চ ফ্যানিং চললো, এরপর লঞ্চ ঢুকে গেলো মিয়ার চর হয়ে কালাবদর নদীতে। দেখতে দেখতে চলে এলাম চরমোনাই এবং রাত আনুমানিক ২ টার দিকে বরিশাল এ ঘাট করলো লঞ্চ । এ সময় ভোলা থেকে আগত আজাদ ভাই ও স্বরূপকাঠি থেকে রিয়াদ ও রিয়াদের এক বন্ধু এই মধ্য রাতে আমাদের সাথে যোগ দিলো ।
তাদের রিসিভ করে আমাদের জায়গায় এনে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করে দেয়া হলো । এরপর আমাদের শুরু হলো ঘাট গোনার পালা। অর্থাৎ স্বভাব সুলভ বরগুনার লঞ্চ এক টি একটি করে ঘাট প্লেস করা শুরু করলো, আমরাও লঞ্চ থেকে যাত্রী উঠা নামা ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখতে লাগলাম ।
নদীতে বেশ কুয়াশা ছিলো , তাই বেশ ধীর গতিতেই চলছিলো লঞ্চ । ভোর হওয়ার কিছু আগে পেছন থেকে লোকাল ট্রিপ এ ছেড়ে আসা এম ভি যুবরাজ ৪ লঞ্চ এর আগ্রাসন লক্ষ করা গেলো । কিছুক্ষন পাশাপাশি চালিয়ে পূবালী ১ ঘাট ধরার জন্য ডানে চেপে গেলেও, রাডার ও জিপিএস বিহীন যুবরাজ ৪ ঘাট খুজে পাচ্ছিলো না । সে ডানে বায়ে করতে করতেই পুবালীর সার্চ লাইট ধরে এগিয়ে এসে ঘাট করলো, আমরাও ঘাট ছেড়ে বেরিয়ে এগিয়ে চললাম ।
এভাবে সকাল ৭ টার কিছু আগে আমরা আমাদের গন্তব্য কাকচিড়া ঘাটে এসে পৌছুলাম। সবাই আগেই রেডী ছিলাম। তাই ঘাট ধরা মাত্রই আমরা সবাই লঞ্চ থেকে নেমে গেলাম। লঞ্চ থেকে নেমে সবাই এক জায়গায় দাঁড়ালো। আমি ২ টি মাহেন্দ্র (অটো) কথা বলে ঠিক করলাম আমাদের পরবর্তী ডেস্টিনেশন এর জন্য । কাকচিড়া থেকে আমাদের সাথে বেলাল ভাই সম্ভবত যোগ হয়েছিলেন ।
আমাদের অটো বা মাহেন্দ্র ছুটে চললো পাথরঘাটা এর উদ্দেশ্যে। পাথরঘাটা বাজারে আমরা নাস্তা করলাম । চা খেলাম । এরপর আমরা ছুটে চললাম হরিনা ঘাটা এর পানে। বলে রাখি হরিনাঘাটা একটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল এরিয়া।
এখানে ওয়াচ টাওয়ার,ঘন বন, ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে প্রায় ২ কিমি লম্বা কাঠের ট্রেইল আছে । যা বিষখালী নদী ও বঙ্গোপসাগর এর বুকে গিয়ে শেষ হয়েছে ।
এখান থেকে নেমে কিছু দূর হাটলেই লালদিয়ার চর ও লালদিয়ার বন । এখান থেকেই সাগর শুরু । লালদিয়ার শেষ মাথার সৌন্দর্য আসলে না দেখে বিশ্বাস করানো যাবে না।
আমরা হরিনাঘাটা চলে আসলাম । এখানে ফরেস্ট অফিসে আরিফ ভাই কথা বলে রেখেছিলো , তাই আমরা সরাসরি ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমাদের রিজার্ভ করা ট্রলার টি এখানেই অপেক্ষা করতেছিলো । আমাদের ব্যাগ /ব্যাগেজ সব ট্রলার এ রেখে , আমরা চলে গেলাম ওয়াচ টাওয়ার এর দিকে।
ওয়াচ টাওয়ার এ কিছুক্ষন থেকে আবার নেমে এলাম। এবার জাকারিয়া ভাই কে টিম এর দায়িত্ব দিয়ে , আমি আর টিটু ভাই চলে আসলাম পাথরঘাটা বাজারে । উদ্দেশ্য আমাদের ৩ দিন এর বাজার সদাই করতে ও ঢাকা থেকে আগত রমজান ভাই ও আবিদ ভাই কে রিসিভ করতে।
এদিকে জাকারিয়া ভাই তাদের নিয়ে লালদিয়ার বন সহ আশেপাশে এক্সপ্লোর করতে করতে , আমি, টিটু ভাই ও আমাদের একজন হেল্পিং হ্যান্ড ইব্রাহিম ভাই মিলে বাজার করলাম ৩ দিন এর । চাল, ডাল, মশলা, হাস, মুরগি, ডিম সবই কেনা হলো। এরই মধ্যে বহু পথ বাই রোডে পারি দিয়ে , অনেক কস্ট সহ্য করে রমজান ভাই ও আবিদ ভাই চলে আসলো পাথর ঘাটায়। আমরা ৫ জন বাই রোডে রওনা হলাম পাথরঘাটার অদূরে ইব্রাহিম ভাই এর বাড়িতে। সেখানে আমাদের দুপুরের খাবার রান্না হবে। আমরা সেই বাড়িতে পৌছুলাম এবং হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হলাম । রান্না শেষ হলো ।
এরই মাঝে জাকারিয়া ভাই কে ফোন দিচ্ছিলাম । যদিও ফোন এর নেটওয়ার্ক ছিলো না ওদের । তারপর একবার কানেকশন পেয়েই বলে দিলাম , সবাইকে সহ ট্রলার নিয়ে , ইব্রাহিম ভাই এর বাড়ির পেছনের ঘাটে আসতে । এর মধ্যে আমাদের বরগুনার সবার পরিচিত সাংবাদিক প্রিয় আরিফ ভাই কে বার বার ফোন দিচ্ছিলাম আমাদের সাথে জয়েন করার কথা উনার । কিন্তু কোন এক ঝামেলায় উনার দেরী হচ্ছিলো ।
আমাদের টিম এর মধ্যে আরো ২ টি নাম না জানা সুন্দর সৈকত ও ম্যানগ্রোভ বন এ নেমে, ট্রলার এ করে আমাদের কাছে চলে আসলো । আমরাও আর দেরী না করে রান্না খাবার দাবার, বাজার পত্র সহ দৌড়ে উঠে গেলাম ট্রলার এ ।
ট্রলার ছুটে চললো বলেশ্বর নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা ধরে সুন্দরবন এর কচিখালী এর উদ্দেশ্যে । আমাদের প্রায় ২০০ কিমি এর মতো মাছ ধরার নৌকায় সমুদ্র অভিযান ও শুরু হয়ে গেলো ।।
চলবে…
লিখা ও ছবি: জাহিদ ইবনে জাহান