• এডিটরস চয়েস
  • সব পোস্ট
অন্যান্য অভিজ্ঞতা একরাত্রির গুহাবাসী!

একরাত্রির গুহাবাসী!

-

একরাত্রির গুহাবাসী!

ছোট্ট একটা ফোকর। একজন কোনোরকমে হাত-পা গলিয়ে ঢুকতে পারে। সরীসৃপের মতো বুকে ভর দিয়ে এগোতে হচ্ছে। নিচের পাথুরে জমিনে হালকা শীতল পানির ছোঁয়া।কিছুদূর যেতেই গুহা হামাগুড়ি উচ্চতা থেকে একেবারে বুকসমান উচ্চতা ধারণ করলো।

হঠাৎ পায়ের নিচে কচকচ শব্দ হতেই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি একটা চিপসের খালি প্যাকেট। হায় বঙ্গসন্তান! এরকম একটা মোটামুটি দুর্গম ও বেকায়দা জায়গায় এসেও তারা তাদের উপস্থিতির ছাপটা রেখে গিয়েছে। ভাবতেই মেজাজটাই বিগড়ে গেল। তবে তখনো আরো অনেক কিছু দেখার বাকি। চিপসের প্যাকেটটা তো সবেমাত্র প্রারম্ভের বার্তা নিয়ে এসেছিল। এরপর আরো কত রকমের বস্তুর সাথে যে মোলাকাত হয়েছিল সেদিন। চকলেটের খোসা, এনার্জি ড্রিঙ্কসের খালি বোতল, মটর ভাজার মোড়ক, সিগারেটের বাঁট কোন কিছুই বাদ যায়নি।

গুহা যেখানে বেশ উঁচু সেসব জায়গা তো আছেই,গুহার দুরূহ কোণ কিংবা যেসব ছোট্ট ফোকরে হাত-পা গলানো যায় না,সেসব জায়গাও এসব অবিবেচক টুরিস্টদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মনে মনে তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম, কিছুদিনের মধ্যেই আবার গুহায় আসব।গুহা ও তার আশেপাশের এলাকায় একটা পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাব শিগগিরই।

তবে চট্টগ্রাম ফিরে নানান ঝুট-ঝামেলায় সময় আর হয়ে উঠছিলো না। পাক্কা এক বছর পরে ফেসবুকে ইভেন্ট দিয়ে দিলাম। প্ল্যান ছিল, গুহায় একরাত কাটিয়ে পরদিন ফেরার সময় গুহা ও তার আশেপাশের জায়গাটা অপচনশীল দ্রব্য মুক্ত করব।

নির্দিষ্ট দিনে চকরিয়া হয়ে আলীকদম পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই এক হোটেলে দুপুরের খাবারটা সেরে হাঁটা ধরলাম গুহার দিকে। পানবাজার থেকে ডানে মোড় নিয়ে শেষ পাহাড়ি পাড়াটা পেরিয়ে এসে পড়লাম খালের মুখে। খাল দেখেই আমাদের গোসলসত্তা জেগে উঠলো। হাঁটুসমান পানিতে বেশ কিছুক্ষণ দাপাদাপি-ঝাপাঝাপির পর বুকডন দিয়ে গোসল সেরে খালের পাড়ে উঠে মিনিট পনের হাঁটতেই প্রথম গুহার কাছে চলে আসলাম।দিনের আলো ফুরোবার তখনো অনেক দেরি।

আমরা গুহার আশেপাশে বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরতে লাগলাম।একটা মরা ঝিরি ধরে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল ৬০-৭০ ডিগ্রি খাড়া একটা পাহাড়ের। উচ্চতায় শ’দুয়েক ফুটের কাছাকাছি। সময় কাটানোর জন্য দেবুদা আর আমি গাছের শিকড়-বাকড় ধরে উঠতে শুরু করলাম। একটু পর প্রথমবারের মত পাহাড়ে আসা মারুফ ভাইও যোগ দিলেন। উনার সবকিছুতেই ব্যাপক আগ্রহ। বাকীরা নিচে থেকেই উৎসাহ যোগাতে লাগলো।

আরো বেশ কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক করে পশ্চিমাকাশে সূর্যদেব লালিমা ছড়ানো শুরু করতেই আমরা গুহার ভেতর সেঁধিয়ে গেলাম। অপেক্ষাকৃত বড় ২নং গুহাতেই রাতের আবাস গাড়ব আমরা।

এক রাত্রির গুহা বাসি
এক রাত্রির গুহা বাসি

গুহায় ঢুকতেই গুহার স্থায়ী বাসিন্দা বাদুড়ের বোঁটকা গন্ধ নাকে এলো। আমরা যখন সবে ঢুকতে শুরু করেছি, তখন ব্যাটম্যানের পূর্বসুরিরা তাদের নৈশ অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের দু’একজনের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলেই। আধঘন্টাখানেকের মধ্যেই অবশ্য গুহা পুরোপুরি বাদুড়শুন্য হয়ে গিয়েছিল।

গুহা ধরে মিনিট পাঁচেক এগুতেই গুহা যেখানটায় হামাগুড়ি উচ্চতা থেকে ডিগবাজি উচ্চতা লাভ করেছে, সেখান্টায় স্থির হলাম। শুরু হলো আতি-পাতি করে তাঁবু ফেলার জন্য সমান জায়গার খোঁজ।

এদিক-সেদিক ঘুরেও বিশেষ লাভ হলো না। আলগা কিছু ছোট পাথরে গুহার পাথুরে জমিনটা ভর্তি। একটা মোটামুটিরকম জায়গা বের করে পাথর সরানোতে মনোযোগ দিলাম। কে যেন আমাদের সাথে নিয়ে আসা ছোট ছোট অনেকগুলো মোমবাতি জ্বেলে দিল। মোমবাতির লাল আলোয় গুহার ভেতরে গা ছমছমে একটা ভৌতিক পরিবেশ। পরিবেশটাকে আরেকটু উসকে দিতেই ক’টা প্রমাণ সাইজের ধাড়ি ইঁদুর এদিক-ওদিক ছুটছে। ছোট পাথর সরিয়ে মোটামুটি দুটো তাঁবু পিচ করার মতো জায়গা পরিষ্কার হতেই গুহার শেষ প্রান্তের দিকে হাঁটা ধরল সবাই।

শেষপ্রান্তের ছোট্ট ফোকরটায় বুকডন দিয়ে শরীর গলিয়ে উঠে আসলাম। গুহার মুখটা যেখানটায় শেষ, সেখানটায় বিশালাকার সাইজের এক পাথর আছে। অনায়াসে ৮-১০ জন বসতে পারে। পাথরের উপর বসেই আড্ডা শুরু হলো।

সেদিনের সেই আড্ডাটা একটা বিশেষ কারণে আমাদের সবার কাছে চিরস্মরণীয়। চট্টগ্রামে পর্বতারোহণ নামক স্পোর্টসটার চর্চা শুরু ও প্রসারের জন্য ‘ভারটিক্যাল ড্রিমারস’ নামক পর্বতারোহণ ক্লাব প্রতিষ্ঠার বীজ বুনে দিয়েছিল সেদিনের সেই আড্ডাটা।

খিদেটা চাগিয়ে উঠায় দীর্ঘ আড্ডার সমাপ্তি ঘটিয়ে গুহার এক কোণে রান্না চড়ালাম। চিরাচরিত সেই স্যুপ-নুডলস আর সবশেষে কফি।

খাবার-দাবার শেষে আরিফ ভাই ঝপাং ঝপাং ফ্ল্যাশ মেরে গুহার গায়ে বঙ্গসন্তানদের পাথরের গায়ে অমুক+তমুক লেখা অমর ভালোবাসার অভূতপূর্ব সব নিদর্শনের ছবি তুলতে লাগলেন।

গুহার পাথুরে দেয়ালের খাঁজে ছোট মোমবাতিগুলো গুঁজে দিয়ে ছমছমে পরিবেশ ফুটিয়ে তুললেন ফরহান ভাই আর লিটন ভাই। মোমবাতির লাল আলোতেই চলল আড্ডা। মাঝে বেশ কিছুক্ষণ টানা খচর-মচর শুনে সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিল। কান খাড়া করে শুনেও কোন কূলকিনারা করতে না পেরে ফের আড্ডাতেই মনোযোগ দিলাম।

পাথরের খাঁজে জ্বালানো মোমবাতিগুলোর নিভু নিভু আলো দেখে তাদের অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে ঠাহর করে আমরা আবার গুহার শেষ প্রান্তের বড় পাথরটার উপর আসন পাতলাম। নানারকম বিষয় নিয়ে গ্যাঁজানোর ফাঁকে ফাঁকে আরেক দফা কফি হয়ে গেল।

রাত আরেকটু বাড়তেই এই বৈশাখ মাসের কাঠ-ফাটা গরমেও রীতিমতো কাঁপ ধরে গেল শরীরে। আড্ডা মেরেই রাতটা কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও শেষমেষ তাঁবুর অভ্যন্তরে আশ্রয় নিতেই হলো।

নিজের তাঁবুতে ঢুকেই দেখি আমার স্লিপিং ব্যাগ গায়েব।এদিক-সেদিক তদন্ত করতেই আসামী ধরা পড়ল। অনুপ আর ইশতিয়াক আমার স্লিপিং ব্যাগটা বালিশ বানিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অগত্যা আর কি, বিনা স্লিপিং ব্যাগেই রাত কাটাতে হলো।

তাঁবুতে শুয়ে একটু ধাতস্থ হতেই তাঁবুর একেবারে ডানপাশে শোয়া লিটন ভাই বললেন, তার নিজেকে ফুটবল মনে হচ্ছে। প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে বুঝলাম, তিনি তাঁবুর যেদিকটায় শুয়েছেন, সেদিকটা বেশ ঢালু। তাই একটু পরপর তিনি গড়িয়ে যাচ্ছেন। তৎক্ষণাৎ তাঁবুর বাইরে থেকে দু’টা ব্যাকপ্যাক এনে তাঁবুর শেষ প্রান্তে ঠেস দিয়ে তার পতন ঠেকানো হলো।

তাঁবুর ভেতরে শুয়ে গুহাবাসের শিহরণটা মাথা থেকে যাচ্ছিলই না। কে জানে, হয়তো আমাদেরই কোন পূর্বপুরুষ এ গুহায় রাত কাটিয়েছে। শিকার করে খেয়েছে এই গুহার আশেপাশে চরতে থাকা কোন জন্তু-জানোয়ারকে।

তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, রান্নার জন্য পেনি ষ্টোভ, জ্বালানী ইত্যাদি সুবিধাসংবলিত আমাদের গুহাবাসটাকে কোনোভাবেই সে যুগের গুহাবাসের সাথে তুলনা করা না গেলেও রোমাঞ্চটা একরত্তি কম নয়।

এসব ওথাল-পাথাল চিন্তাভাবনায় ছেদ পড়ল ফরহান ভাইয়ের ডাকে। উনি হঠাৎ নাকি শ্বাস নিতে পারছেন না। বদ্ধ জায়গায় এরকম হতেই পারে বলে উনাকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। তাঁবু থেকে বেরিয়ে গুহার শেষ মুখটার দিকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে কাটিয়ে ফরহান ভাই স্বাভাবিক হতেই আবার তাঁবুতে।

সকালে ক্যাম্প গুটিয়ে আমাদের মূল লক্ষ্য পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামলাম। সবাইকে যার যার ভাগের পলিব্যাগ বন্টন করে ময়লা কুড়াতে নামলাম। চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, নানান দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের বিস্কুটের মোড়ক, চকলেটের খোসা ইত্যাদি হরেক রকম আবর্জনার ভান্ডার দেখে আমরা রীতিমতো মুগ্ধ!

নিমেষেই বড় সাইজের পলিব্যাগগুলো ভরে উঠতে লাগল।আমি আবর্জনা কুড়াচ্ছিলাম প্রথম গুহাটায়। ঐসময়ই দিনের প্রথম পর্যটকের আগমন গুহাতে। বেশ-ভূষায় বেজায় ভদ্রলোক। ময়লা কুড়াতে দেখে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কারা, কেন করছি এসব ইত্যাদি। আমাদের উদ্দেশ্য জানাতেই বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বললেন, ‘খুব ভালো উদ্যোগ। সবাই এরকম চিন্তা করলেই পর্যটনস্পটগুলো আর নোংরা হতো না। ‘বলেই হাতের সিগারেটের ধংসাবশেষটুকু গুহার পাথুরে জমিনে ফেলে সামনের দিকে গটগট করে হাঁটা ধরলেন। বেশ কিছুক্ষণ ঐ বিশিষ্ট ভদ্রলোকের দিকে অপলক চেয়ে থেকে ফের ময়লা কুড়ানোয় মনযোগ দিলাম আমি!

কৃতজ্ঞতা: বাবর আলী

কপিরাইট: ব-দ্বীপ

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!