পাইন্দু খাল অভিযান
রোয়াংছড়ি বাজারে এসে নামলেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় বাজারঘেঁষা ছোট্ট ছাপড়া দোকানটা। সেখানটায় চা-সিঙ্গাড়া-চিড়া-মুড়ি খেয়েই সাধারণত যাত্রারম্ভ করি আমরা। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। নাশতা হিসেবে দোকানটায় মজুদ তেলে ভাজা-তেলে চুবানো সবরকম নাশতা চেখে দেখার পর আধঘন্টাখানেক বাজারের এদিক-সেদিক উঁকি-ঝুঁকি মেরে কাটালাম। আরো কিছুক্ষণ পর এসে আবার আসন গাড়লাম খাবার টেবিলে। নাশতা পর্ব শেষ, এবার ভাতের পর্ব শুরু। গোগ্রাসে খেলাম। আগামী ছ-সাত দিন ভাত ছাড়াই থাকতে হবে।
এইবারের অভিযানটা সম্পূর্ণ ব্যাকপ্যাকিং ধরনের হওয়ায় স্যুপ-নুডলস-কফি আর বিভিন্ন শুকনো খাবারের উপর নির্ভর করেই পরের ক’টা দিন টিকে থাকার প্ল্যান। ভরপেট সাঁটিয়ে যখন উঠলাম, তখন এই শীতের সকালেও রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে একাকার। দোকানের বাইরের টুলে দাঁড় করিয়ে রাখা আমাদের প্রকান্ড সাইজের ব্যাকপ্যাকগুলো কাঁধে নিয়ে চলতে শুরু করতেই হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমাদের একটা তাঁবু মিসিং।
পাঁচজনের একটা টিমের তিনটে তাঁবুর মধ্যে সবচেয়ে বড় তাঁবুটাই গায়েব। নিজের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোতের একটা ধারা অনুভব করলাম। এত সাধের অভিযানের শুরুতেই এত বড় একটা বিপত্তি। মনটাই দমে গেল।নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম, শেষবার কার হাতে ছিল তাঁবুটা, কে শেষ কবে কোথায় দেখেছে ইত্যাদি নিয়ে।
আলোচনাতেই বেরিয়ে এল শেষবার রাশিকের হাতেই ছিল তাঁবুখানা। বান্দরবান শহরে নেমে একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকানে ঢুকেছিল সে, সম্ভবত সেখানেই রয়ে গেছে তাঁবুটা। বিপ্লব, ফারাবী আর আরিফকে রোয়াংছড়ি বাজারের সেই ছাপড়া দোকানটাতে বসিয়ে তৎক্ষণাৎ আমি আর রাশিক রওনা হয়ে গেলাম বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। সারাক্ষণ মুখে কথার খই ফোটা রাশিক দেখি একদম ভ্যাবদা মেরে বসে আছে সিএনজির এক কোণে।
‘আরে ধুর,কিচ্ছু হবে না’, ‘একটা না একটা উপায় তো বেরুবেই’ – ইত্যাদি বলে তাকে চাঙা রাখার চেষ্টা করলাম।বান্দরবান-রোয়াংছড়ি হালকা উঁচু-নিচু সড়কটাতে সিএনজি যেন উড়ে চলেছে। আর আমার মনে ভর করেছে অজানা আশঙ্কার কালো মেঘ।
এই অভিযানটা নিয়ে আমাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা আর শিহরণের কমতি ছিল না। বছর দুয়েক আগে রোয়াংছড়িতে একটা অভিযানে এসে প্রথম পাইন্দু খালের দেখা পাই, সেবার খালের ছোট্ট একটা কুম ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছিল। পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা সেই কুম আমাকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল পরের বেশ কিছুদিন।
মনে মনে তখনি ঠিক করে ফেলেছিলাম,এই খালটা চষে বেড়াতে হবে। কিছুদিন পর রাশিক-বিপ্লবরাও এদিকটায় এসেছিল। এম এম আলী রোডের আড্ডায় একদিন কথাচ্ছলে বিপ্লবকে বলে ফেললাম, পাইন্দুটা একবার চষে বেড়াতে চাই। নিমেষেই সে রাজি। রাশিককে বলতেই সে জানাল-‘কোপ হবে ভাই!’
পরের ক’টা দিন গেল গুগল আর্থে বসে পুরো খালটা চষে ফেলতে। পুরো ট্রেকের দৈর্ঘ্য, ক্যাম্পসাইট, সম্ভাব্য বাধা, আশেপাশের পাড়া, একদিনে সর্বমোট কতটুকু পথ পাড়ি দিতে পারব – এসব নিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নির্ঘুম রাত কাটলো কয়েকটা।
সবচেয়ে বেশি যেসব বিষয় ভাবালো সেটা হলো ক্যাম্পসাইটের দুষ্প্রাপ্য, বড়সড় দৈর্ঘ্যের সম্ভাব্য বেশকিছু কুম, তীব্র শীতে খালের পাশে ক্যাম্পিং এবং আশেপাশে পাড়ার অনুপস্থিতি। পাড়ার অনুপস্থিতি ব্যাপারটা অবশ্য শাপে-বর হয়েই দাঁড়াল। এবার একেবারে পুরোপুরি একটা ব্যাকপ্যাকিং একটা ট্রিপ দেয়া যাবে ভেবে মনে মনে খুশিই হলাম। তবে গুগল আর্থের স্যাটেলাইট ইমেজে বড় বড় বোল্ডারগুলোর ছবি উপযুক্ত ক্যাম্পসাইট খুঁজে পাওয়া নিয়ে মনের খচখচানিটাকে উসকে দিয়ে গেল।
ক্যাম্পসাইটের আকালের ভিড়ে সম্ভাব্য কিছু সাইট মার্ক করে জিপিএসে চালান দেয়ার কাজটা সারল বিপ্লব। তবে আরেকটা ব্যাপার মনের মধ্যে কাঁটার মত লেগে রইল, সেটা হলো এদিকের জঙ্গলে ভালুকের বিচরণ। পাইখ্যং পাড়ায় আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী দাদা বারবার নিষেধ করছিলেন এদিকটায় যাবার ব্যাপারে। অবশ্য আমরা শুনলে তো!
ট্রেইলের পরিকল্পনা মোটামুটি দাঁড়িয়ে যেতে এবার খাবার-দাবার নিয়ে মাথা ঘামানোর পালা। প্রথমে চাল-ডাল ইত্যাদি দিয়ে খিচুড়ি রাঁধার উপকরণ নেয়ার প্ল্যান থাকলেও তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, স্লিপিং ম্যাট, দা, দড়ি ইত্যাদি নেয়ার পরে ব্যাকপ্যাকের যে ওজন দাঁড়াল, তাতে চিরন্তন স্যুপ-নুডলসেই টিকে থাকার পরিকল্পনা স্থির হল। ফুডপ্যাকে জায়গা করে নিল নুডলস, স্যুপ, খেজুর, বাদাম, বিস্কুট, পিনাট বার, ম্যাংগো বার, চকলেট ইত্যাদি। প্ল্যানের একেবারে শেষমুহুর্তে এসে যোগ দিল ফারাবী আর আরিফ।
গুগল আর্থে দেখা স্যাটেলাইট ইমেজের ছবিগুলো মানসপটে আঁকতে আঁকতেই এক শীতের সকালে বান্দরবান এসে হাজির। তারপর তো সেই তাঁবু হারানোর বিপত্তি।যথাসময়ে বান্দরবান পৌঁছে ফ্লেক্সির দোকানটার সামনে যেতেই দোকানদারের টেবিলের নিচ দিয়ে তাঁবুর প্যাকটা উঁকি দিল। তাঁবু দেখে যে পরিমাণ খুশি হয়েছিলাম, ট্রিপে আসার আগেরদিন দুর্ভাগ্যক্রমে পরিচিত হওয়া এক পরমা সুন্দরীর সাথে পরিচয়েও এত খুশি হইনি। রাশিক তো পারলে দোকানদারকে রীতিমতো চুমু-টুমু খেয়ে ফেলে আর কি! তাঁবুটা নিয়েই আবার রোয়াংছড়ির দিকে ছুট।
বাজারে পৌঁছে সময়ক্ষেপণ না করে ট্রেইলে নেমে পড়লাম।ব্যাকপ্যাকের বাইরে বেঢপ সাইজের স্লিপিং ম্যাট ঝুলতে থাকায় বাজারের সবাই ঠারে ঠারে দেখছে আমাদের।প্রাথমিক গন্তব্য পাইখ্যং পাড়া।
প্রথম দিকের ৪০-৪৫ মিনিট পথ ঝিরি ধরে। বহু দিনের চেনা পথ। যাত্রাপথেই পাইখ্যং পাড়ার বেশ ক’জনের সাথে দেখা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে করতে পথ চলছি। আড়াই ঘন্টা পর পাড়ায় পৌঁছে সোজা জেমস’দার ঘরে। দাদার পাহাড়ি ঢঙের ইজি চেয়ারটায় বেশ কিছুক্ষণ আরাম করে বেরুবার তোড়জোড় করতেই দাদার বাধা। আজকে রাতটা থেকে যাবার অনুরোধ। ফেরার সময় থাকব-এই বলে দাদার কাছ থেকে রেহাই পাওয়া গেল। কোনদিকে যাব,কয়দিন থাকব-বেশ কিছুক্ষণ এসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও শেষমেষ আর পারা গেল না। আমাদের ইচ্ছের কথা জানাতেই দাদা বলল, ‘বাধা দেব না। সাবধানে থেকো। ভালুক থাকতে পারে ওদিকটায়। দাদাকে আশ্বস্ত করে হাঁটা দিলাম।
পরের গন্তব্য পাইন্দু খালের একেবারে পাশঘেঁষা একটা মারমা পাড়া। জিপিএস ধরে পাড়ার ডানদিক বরাবর হাঁটা শুরু করলাম। ঘন্টাখানেক হাঁটতেই পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের শেষ রশ্মি ঠিকরে উঠে দিনশেষের বার্তা দিয়ে গেল। শেষ বিকেলের লালচে মরা আলোয় ট্রেইলের কোলঘেঁষা জুমঘরগুলোকে কেমন যেন মায়াবী দেখাচ্ছে। এক অদ্ভুত সম্মোহনে ঘরগুলোর অতিথি হতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বহুকষ্টে সে লোভ সংবরণ করে এগুচ্ছি।
বিপ্লব আমার অবদমিত মনোকামনা বুঝতে পারে বলল, ‘ভুলেও জুমঘরে থাকার টোপ আজকে দিয়েন না। যেমনে হোক, আজকে প্রথম ক্যাম্পসাইটে পৌঁছাতে চাই।’ শেষ পাহাড়টার কোলে পৌঁছাতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এল।
পরের পথটুকু একটানা উৎরাই। প্রায় ঘন্টাখানেক একনাগাড়ে নামতে হবে। হেডলাইট বের করে অধঃপতন শুরু। এই পথে দিনের বেলা নামতেই গলদঘর্ম দশা হয়।এখন রীতিমতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার উপর ফারাবী আর আরিফের হেডল্যাম্প নেই। ধীরে-সুস্থে এগুচ্ছি। এর মধ্যেই ফারাবী উল্টে পড়ে তার ব্যাকপ্যাকের শোল্ডার স্ট্র্যাপের বারোটা বাজিয়ে ফেলল। সবাই মিলে গোটা কতক আছাড় খেয়ে নিচের ঝিরিটার মুখে গিয়ে পড়লাম।
দূর থেকে পাড়ার ঘরগুলোর সোলার প্যানেলের আলো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যতই এগুচ্ছি, ততই মনে হচ্ছে পাড়া যেন দূরে সরে যাচ্ছে। পথ ভুল করেছি – একটু পরপর মনে এই ধারণা উসখুস করতে লাগল। কিন্তু জিপিএস জানাচ্ছে, সঠিক পথেই আছি আমরা।
ঘন্টাখানেকের পথ যখন দু’ঘন্টায়ও শেষ হলো না, তখন জেমস’দার ঘরের ইজি চেয়ারটার ছবিই খালি চোখের সামনে ভাসছিল। ভাবছি কীইবা হতো একটা রাত দাদার ঘরে থেকে গেলে! তখনই হঠাৎ খালের পানির কলকল শব্দে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। হাঁটু পানির খালটা পেরিয়ে সামনের সমতল জায়গাটায় তাঁবু ফেলার ইচ্ছে।
খালে পা ডুবাতেই মনে হল,কে যেন অসংখ্য সূচ ফুটিয়ে দিয়েছে পায়ে। এত ঠান্ডা। আরিফ বিপ্লবকে অফার করল, বিপ্লব যেন তাকে কোলে করে খালটা পার করিয়ে দেয়, বিনিময়ে আরিফ বিপ্লবকে শীতের রাতের অমূল্য পানীয় কফি বানিয়ে খাওয়াবে। তাতেও অবশ্য বিপ্লবের পাষাণ হৃদয় গলল না! খাল পার হয়ে হেডল্যাম্পেরর আলোয় ক্যাম্পসাইট খুঁজতে ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়লো সকলে।
পছন্দসই জায়গায় তাঁবু গেঁড়ে ব্যাকপ্যাকগুলো এর মধ্যে চালান করে দিয়ে রান্না চড়ালাম। ব্যাকপ্যাকের শোল্ডার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে বেকায়দায় পড়া ফারাবীর ফুডপ্যাকটাই আগে খালি করার সিদ্ধান্ত হলো। খালের একদম পাশেই ক্যাম্পসাইট। আর ক্যাম্পসাইট থেকে অল্প দুরত্বে এই হাড়কাঁপানো শীতে মাছ ধরছে পাড়ার মহিলারা। আমাদের তাঁবু ও এর আশেপাশে হেডল্যাম্পের আলোর ঝলকানিতে কিছুক্ষণের মধ্যে পাড়া থেকে পঙ্গপালের মতো বাচ্চারা ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। মিনিট কয়েক গড়াতেই বড়রাও এসে যোগ দিল। পাড়ার কারবারী দাদা বদনা হাতে পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে উনার ঘরে উঠতে বললেন। এখানে তো কেউ থাকে না, রাতে ঠান্ডায় অনেক কষ্ট পাবে-ইত্যাদি বলে আমাদের নিরস্ত করার চেষ্টা করলেন। আমরা এখানেই ঠিক আছি বলে দাদাকে আশ্বস্ত করাতে বেশ বেগ পেতে হল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে পূর্ণরুপে ধরা দিল পূর্ণিমার চাঁদ। চাঁদের থইথই করা রুপালী আলোয় অপার্থিব লাগছে খালটাকে। আর তার মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে আছে খালের হাঁটু পানিতে মাছ ধরায় ব্যস্ত পাড়ার মৎস্যকন্যাদের হি-হি-লি-লি। বেশ কয়েক কাপ কফি সাবড়ে আশ্রয় নিলাম স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায়।
পরদিন খুব ভোরে ক্যাম্পসাইট গুটিয়ে সকালের নরম রোদে হাঁটা শুরু। খালের একেবারে গা ঘেঁষে পথচলা। বেশ ক’টা বিস্তীর্ণ বাদাম ক্ষেত পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম একটা মারমা পাড়ার নিচে। যাত্রাপথে খালের পাশে এটাই শেষ পাড়া।ছোট্ট এক মাচায় বসে বিশ্রাম নিতেই মাচার মালিক দাদা বাদামভর্তি একটা পাত্র ঠেলে দিল। কিছু খেয়ে আর কিছু বাদাম পকেটে পুরে আর আধঘন্টাখানেক হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়কর কুমের পাশে। আগেও এদিকটায় আসলেও এই জায়গার আবেদন আমার কাছে কখনোই কমবে না।
বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে কুমের অপর পাশে যাবার পথ ধরলাম। পাহাড়ে উঠার পথটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। খালি পিঠেই পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে কুমের অপর পাড়ে যেতে যেখানে জীবন জেরবার হয়ে যায় সেখানে এবার পিঠের উপর রীতিমতো প্রমাণ সাইজের বোঝা। হাত ফসকালেই সোজা কুমের অতলান্তে। ভয়টা বেশি সাঁতার না জানা রাশিক আর আরিফকে নিয়ে।বেশ কিছু সময় নিয়ে দুজন কুমটা নির্বিঘ্নেই পার হল।
এবার পাহাড়টার মাথায় চড়ার পালা। আগে দু’টা নড়বড়ে বাঁশ দিয়ে উঠার ব্যবস্থা ছিল। এই পাহাড়টার উপরেই মারমা পাড়ার এক দাদা জুম করাতে এবার বেশ ক’টা জংলী লতা দুমড়ে-মুচড়ে নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাঁশের চেয়ে বেশ টেকসই। সেটা বেয়ে কিছুসময় উঠতেই পাহাড়ের উপরে চড়ে বসলাম।
জংলা একটা ট্রেইল ধরে এগুচ্ছি।
দুরের আকাশে ‘চাম পি’ নামক পাহাড়টি তার টেবিলের মত শেপের চূড়া নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। পাহাড় থেকে নেমে এবার কিছু পথ পাইন্দু খালের শাখা একটা ঝিরি ধরে এগুলাম।ঝিরির তলাটা পুরোটাই নিরেট পাথরে তৈরি। ঝিরিটা খালে গিয়ে মিশেছে যেখানটায় সেখান থেকে সোজা মিনিট বিশেক এগুলেই দেখা মেলে ‘জাদি মুরং’ নামে ছোট্ট একটা পাহাড়ের। দেখতে অবিকল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জাদির মত।পার্থক্য একটাই, এর পুরোটা কালো ঝুরঝুরে মাটিতে তৈরি।আশেপাশের সবগুলো পাহাড়-টিলা যেখানে সাদা ও লালচে মাটির সেখাটায় কালো আবলুস কাঠের মত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই পাহাড়টি নজরকাড়া। আশেপাশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাড়ার লোকেরা এই পাহাড়কে বেশ শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
এর পাশ ঘেঁষে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল এক দাদার।নিবিষ্ট মনে মাছ ধরছে। দাদার কাছ থেকে কিছু বাদাম চেয়ে নেয়া হল। তখনো আমরা জানতাম না, এই দাদাই আগামী চার-পাঁচ দিনে আমাদের পাঁচজনের দেখা শেষ মানবসন্তান হতে যাচ্ছে। তখনো জানতাম না, পরের ক’টা দিন আমরা নিজেরা একে অন্যের চেহারা দেখতে দেখতেই বিরক্ত হয়ে যাব।
টানা হেঁটে দুপুরের কিছু পরে একটা উঁচু পাথুরে চাতালের মত জায়গায় পৌঁছানো হল। পেটে কিছু চালান দিয়ে খালের বেশ কয়েকটা দৃষ্টিনন্দন বাঁক পেরুলাম আমরা। খাল থেকে অল্প দূরে জলবিয়োগ করতে গিয়ে একটা গুহার সন্ধান পেয়ে গেল রাশিক। জলবিয়োগ করতে গিয়ে আবিষ্কার করা গুহাসমগ্রের ইতিহাসে তোর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে-ইত্যাদি বলে রাশিককে খেপানো অব্যাহত থাকল। গুহার ভেতর সেঁধিয়ে অল্প কিছুদূর যেতেই মন খারাপ হয়ে গেল।মাটি ধসে আর সামনে এগুনোর পথ নেই। আবার খালে নামলাম।
খাল এদিকটায় বেশ প্রশস্ত। পানির প্রবাহও বেশ ভালো।এতক্ষণ হাঁটু ভিজিয়ে পার পাওয়া গেলেও এবার দু’এক জায়গায় কোমর অবধি ডুবাতে হল। ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘর পেরুতেই সুবিধাজনক ক্যাম্পসাইটের খোঁজে তীক্ষ্ণ নজর রাখছি। শেষ বিকেলে পথ আটকাল বেশ বড়সড় একটা কুম। কুমের এপাশ থেকে ঠিক এর দৈর্ঘ্য ঠাহর করা যাচ্ছিল না।
পরদিন কুম পার হব-এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কুম থেকে অল্প দূরত্বে তাঁবু পিচ করলাম। খালের পাশের বোল্ডারের রাজ্যের ভিড়ে এক চিলতে মাটি পাওয়া গেল। তবে একপাশটা বেশ নিচু।ব্যাকপ্যাকের সাইড পকেটে বয়ে আনা দা’টা এবার কাজে লাগানোর পালা।
পাশের ঝোপ থেকে বেশ কিছু আগাছা কেটে এনে অন্যপাশটা সমান করে সেখানেই তাঁবু ফেলা হল। অন্ধকার নামতেই আমাদের ‘ফায়ার সার্ভিস’ নামে খ্যাত আরিফ (সে অবশ্য আগুন নেভায় না,জ্বালায়!) তার কারিশমা দেখিয়ে বেশ জাঁকালো একটা আগুন ধরিয়ে ফেলল। অন্ধকার আরেকটু ঘনাতেই তাপমাত্রা ধুপ করে নেমে গেল। এবার কাউকেই আর আগুনের কাছ থেকে সরানো যায় না। শীত তাড়াতে একের পর এক কফির মগ চড়তে লাগল পেনি ষ্টোভে।
পরেরদিন সকালে সকলের নিয়ত ছিল, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কুমটা পার হওয়া। ইতি-উতি খুঁজতেই কুমের পাশে শতছিন্ন একটা ভেলা পাওয়া গেল। খুব সম্ভবত গত বর্ষায় পাহাড়ি কোন দাদা এই কুমে মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করেছিল। প্রায় ডুবুডুবু ভেলাতেই পাইলট বিপ্লবের নেতৃত্বে একমাত্র যাত্রী হল ফারাবী। আর আমরা পাহাড়ের গা ঘেঁষে কুমটা পার হওয়ার কোন ট্রেইল আছে কিনা সেটা খুঁজতেই গরু খোঁজা শুরু করলাম।
কুমের বাঁ পাশ ঘেঁষে একটা রাস্তাও পেয়ে গেলাম।আমি, রাশিক আর আরিফকে নিয়ে শ’তিনেক মিটার দীর্ঘ কুমটা সেদিকেই পার হলাম। অপর পাশে গিয়ে কুমের সৌন্দর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে লোভ সামলাতে না পেরে বিপ্লবের ভেলায় চড়ে কুমটা ঘুরে এলাম।
কুমের অপর পাশের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ আলাদা। বোল্ডারগুলো আকারে দ্বিগুণ প্রায় এদিকটায়। কয়েকটা বোল্ডার দেখে অতিকায় হাতির পিঠ বলে ভ্রম হল। কুমটা পেরিয়ে আর মাত্র মিনিট পনের এগুতেই আরো একটা কুম। তবে আফসোসের বিষয় হল, এই কুমের পাশে কোন ভেলা নেই।
নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম,কুমের দু’পাশের পাহাড় দিয়ে অপর পাশে যাওয়ার কোন পথ আছে কিনা সেটা খুঁজে দেখব।
দু’টো টিমে ভাগ হয়ে কুমের দুপাশে রেকি শুরু হলো। আমার সাথে দা আছে বিধায় আমি আর বিপ্লব পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত জঙ্গুলে পাশটা বেছে নিলাম। খাড়া পাহাড়ের শিকড় ধরে ঝুলে জঙ্গল কাটা যে কি পরিমাণ প্রাণান্তকর একটা কাজ, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে।
পালাক্রমে বিপ্লব আর আমি আগাছার জঙ্গল আর শুকনো বাঁশ কেটে ছোটখাট একটা ট্রেইল বানাতে বানাতে এগুচ্ছি (বাঁশ বেশ দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় এবং পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় বলে আমরা শুধুমাত্র বাঁশের জঙ্গলই কেটেছি, সেটাও অনেকটা নিরুপায় হয়ে। অন্য কোন গাছের কোনরকম অনিষ্ট আমরা করিনি)।
টানা গতর খাটিয়ে ক্লান্ত হয়ে একসময় বুঝতে পারলাম,এদিকে এগুনো সম্ভব নয়। শিকড়-বাকড় ধরে ঝুলে নিচে নেমে নেমে রাশিকদের ফেরার জন্য অপেক্ষা এবার।ওরাও নেতিবাচক উত্তর নিয়ে ফেরত এল।
আমাদের আশংকাকে সত্যি করে দিয়ে শেষ পথটাই বেছে নিতে হলো। আগের কুম থেকে ভেলাটা ভেঙ্গে বাঁশগুলো নিয়ে এসে আবার নতুন করে ভেলা বাঁধতে হবে এবং সেটাও আগের চেয়ে বেশ শক্ত-পোক্ত করে। কারণ আগের নড়বড়ে ভেলাটায় শুধু নিজেরা পার হলেও এই ভেলাটায় আমাদের ব্যাকপ্যাকগুলোও না ভিজিয়ে পার করতে হবে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা হল, আগের কুমটা থেকে এই কুমে বাঁশ নিয়ে আসার কাজটা পুরোটাই করতে হবে স্রোতের বিপরীতে। আর আগুনে ঘৃতাহুতির মতো ব্যাপার হলো এই দু’কুমের মাঝে আছে ছোট কিন্তু তীব্র পানির বেগ বিশিষ্ট দুটো ক্যাসকেড।
স্যুপ-নুডলস খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ভেলা বাঁধানোর তোড়জোড় শুরু করলাম। ফারাবীকে দা দিয়ে পাশের পাহাড়টায় পাঠিয়ে দিলাম ভেলা বাঁধার জন্য শক্তপোক্ত লতার খোঁজে। সাঁতার জানা বিপ্লব আর আমি বাঁশ নিয়ে কুমের গভীর অংশটুকু পার করে দিচ্ছি। আর অগভীর বড় অংশটুকু পার করে পরের কুমে বাঁশ বয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুদায়িত্বটুকু পালন করছে রাশিক আর আরিফ।
পরের সময়টুকু প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন নগণ্য মানবসন্তানের সংগ্রামের গল্প।
গল্পের শেষ অংকে যখন শেষ বাঁশটাকেও ভেলার ঠাস বুননে বেঁধে ফেলা হলো, ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে মুখ লুকিয়েছে সূর্যদেব। ভেলাটাকে কুমের একপাশে রেখে অন্যপাশে তাঁবু ফেলা হল। এই শীতের মৌসুমে প্রায় সারাদিন পানিতে থেকে আমাদের রীতিমতো কাঁপাকাঁপি অবস্থা। আরিফ এবার একদিকে আগুন না জ্বালিয়ে বৃত্তের মতো করে আগুন জ্বালাল। আমরা সবাই বৃত্তের ভেতর সেঁধিয়ে শরীরের চারপাশে উত্তাপ লাগানোতেই জীবনের পরমানন্দ খুঁজে পেলাম।
পাশের পাহাড় থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা খচরমচর শব্দে বেশ কয়েকবার ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল শরীরে।হেডল্যাম্পের আলোয় পাহাড়ের এখানে সেখানে আলো ফেলেও শব্দের উৎস সম্পর্কে কোন সুরাহা করতে না পারলেও মনের উৎকণ্ঠিত ভাবটা গেল না। মনের কাঁটা হোক কিংবা ভয়ের কাঁটা দূর করতে খালের দিকটা ব্যতীত তাঁবুকে ঘিরে অন্য তিনপাশে আগুন জ্বালিয়ে রেখে সেদিনের মতো স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় হারালাম।
সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার টেন্টম্যাট বিপ্লব বলল, সে গত রাতে সে স্বপ্নে বান্দরবান শহরের আর্মি পরিচালিত কাবাব হাউজটার বানানো চিকেন টিক্কা আর বসনিয়ান রুটি দেখেছে! আমি সোলেমানী খোয়াবনামা মতে তার দেখা স্বপ্নের কয়েকটা আগড়ুম-বাগড়ুম ব্যাখ্যা দিলেও সেসব তার মনঃপূত হলো না।
পেনি স্টোভে কফি বসাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমাদের একটা পেনি স্টোভ গায়েব।আর অন্য স্টোভটার গায়ে নখরের গভীর আঁচড়ের দাগ। চারটা একই সাইজের পাথরের ভেতর থেকে (পাথরগুলো চুলার স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল) পেনি স্টোভ হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নাতীত কোন ব্যাখ্যা আমরা আজও খুঁজে পাইনি। সকাল সকাল আগেরদিনের বানিয়ে রাখা ভেলায় চড়ে কুমটা পার হয়ে আরো কিছুদূর যেতেই দেখলাম দু’পাহাড়ের মাঝের ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা। আরো একটা কুম!
কুম দেখতে দেখতে ত্যক্ত-বিরক্ত। আবার স্রোতের বিরুদ্ধে ভেলা চালিয়ে নেয়ার মতো তেল শরীরে অবশিষ্ট নেই।পাহাড়ের উপর দিয়ে পথের হদিস পাবার আশায় আবার পাশের পাহাড়ের পানে পা বাড়াতে হলো। ঘন্টাদুয়েক তন্ন তন্ন করে খুঁজে দড়ি লাগিয়ে নামার মতো একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল। দড়ি ফেলে দেখা গেল নিচের পাথুরে বোল্ডারের রাজত্ব শুরু হওয়ার ফুট বিশেক আগেই দড়ি থেমে গেছে। তার মানে, শেষের ফুট বিশেক লাফ দিয়ে নামতে হবে। নিচে চোখা সব বোল্ডার না থাকলে হয়তো সেদিকে নামার সুযোগটা নিতাম। তবে পিঠের উপর জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসা ব্যাকপ্যাক নিয়ে পাথুরে বোল্ডারে লাফ দেয়ার ঝুঁকি না নিয়ে আবার নিচে নেমে গিয়ে ভেলা বাঁধা-ভেলা খোলা কর্মসূচিতে আত্মনিয়োগ করা ছাড়া কোন উপায় থাকলো না।
আরো এক বেলা খাটাখাটুনি করে ভেলা বেঁধে যখন ব্যাকপ্যাকসমেত কুমটা পার হচ্ছি, তখন আচমকা মনে হল, এই কুমে ভেলা চালাতে না পারলে একটা আফসোস থেকেই যেত জীবনে। ব্যাকপ্যাক পার করার ছুতোয় তিনবার ভেলা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে বিপ্লবকে বৈঠা হস্তান্তর করেই ক্ষান্তি দিয়েছিলাম সেদিন। সবাই কুম হবার পর আবার শুরু হলো পথচলা। খালের পাশ ঘেঁষে কিছুদূর যেতেই দেখা মিলল আরো একটা কুমের। সেটা পার হতেই আরেকটা। একের পর এক। এ যেন কুমের রাজ্য। তবে আশার বিষয় হল, এ কুমগুলোর ওপরদিকে হাচড়ে-পাচড়ে পার হয়ে যাবার মতো পথ আছে। ভেলা বানানোর মতো হাড়-ভাঙা খাটুনি করতে হচ্ছে না এসব কুমে। কুমের রাজ্য পার হয়ে খালের সমতলে নামতেই আবার বোল্ডারের রাজ্যে। পাইন্দু খাল ঘেঁষে গত কদিনের পথ-পরিক্রমায় যেসব বোল্ডার দেখেছি সেসবকে এ বোল্ডারগুলোর তুলনায় রীতিমতো নস্যি বলেই মনে হচ্ছে। বোল্ডারিং করতে করতে এগুচ্ছি।
শেষ বিকেলের নরম আলোয় যখন কয়েকশ মিটার লম্বা শেষ কুমটার সামনে এসে দাঁড়ালাম, তখন আমরা বুঝে গিয়েছি এই কুম পার হবার জন্য নতুন করে ভেলা বানানোর মতো তেল আমাদের শরীরে আর অবশিষ্ট নেই। বেশ কিছুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থেকে ফেরার পথ ধরা ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিল না। এরপর টানা দু’দিন হেঁটে যখন বান্দরবানের এক উপজেলা সদরে নদীর পাশে চাঁদের আলোয় তাঁবুতে বসে নদীর একটানা বয়ে যাওয়ার শব্দ নিবিষ্ট মনে শুনছি, তখনো মানসপটে উঁকি দিচ্ছে গত ক’দিনে আমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে যাওয়া পাইন্দু খালের ছবি।
কৃতজ্ঞতা: বাবর আলী
কপি রাইট: ব – দ্বীপ