• ঐতিহাসিক স্থান
  • পরিচিতি
  • সব পোস্ট
ঐতিহাসিক স্থান পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির...

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

-

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে গাজীখালির চরে বসে জমিদারী করতে গেলো কেন? অবশ্য জমিদারীর যখন শুরু, তখন আর চর ছিলো না। আর শুধু তখন কেন, এর চার পুরুষ আগেও মোকাম ছিলো, বালিয়াটি না হোক, অন্তত সাটুরিয়াতে।

এর অনেক আগেই নদীর বালি জমে জমে চর হয়ে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ন ভূমি। আর এই ভূমির মাটি কেটে কেটে ভিটে করে বসতি করেছে লোকজন। এজন্যই নাম ‘বালিয়াটি’ আর এতো এতো পুকুর বালিয়াটিতে। এটাও অনেকটা বালিয়াটি নিয়ে লেখা লেখকের অনুমান।

মোকাম ছিলো বলছি কেন? বাড়িতে কর্মচারী রাখতে পারেন যে ব্যবসায়ী, তাও পানের ব্যবসা, ব্যবসা বড়ই ছিলো বলতে হবে। আর বড় ব্যবসা থাকতো মোকামেই।

বালিয়াটির কপালেই লেখা ছিলো এত্তো এত্তো দালান কোঠা ( শুধু পুকুর পাড়ের চারটি নয়, অনেকগুলো আছে), এতো আগে ছোট্ট এতোটুকুন এই জনপদে ইস্কুল, ডিসপেনসারি, মন্দির, মসজিদ।

আর এটা লেখা হয়ে যায় ভাগ্যান্বেষণে বালিয়াটিতে আসা কিশোরটি যেদিন পা রাখে বালিয়াটিতে। মাণিকগঞ্জের ঘিওরের বিনোদপুর থেকে আসা কিশোরটি চাকুরী নেয় পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে। সেদিনই উপরওয়ালা বালিয়াটির বুকে লিখে রেখে দেন বালিয়াটির বুকে ‘জমিদারী’ নামে ছোটখাটো এক ‘সাম্রাজ্যের’ নাম।

বালিয়াটির জমিদার বাড়ি
বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

এই কিশোরটির নাম মহেশরাম, মহেশরাম সাহা। এখানে তাঁর আগমন হয়তো ১৭০০ খৃষ্টাব্দের এদিক ওদিক, কারণ এই জমিদার বাড়ির গোড়া পত্তন হয় ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে। চার পুরুষের মাথায় এই গোড়াপত্তন করেন পানের ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরে নেয়া এই ঘনশ্যামের চার প্রপৌত্র *১।

এটাও এক ভালো লাগার ব্যাপার যে পশ্চিমে কান্যকুব্জ অযোধ্যা বা বাঁকুড়া পর্যন্ত যেতে হয় নি এই বাড়ির শেকড়ের খোঁজে। পারস্য আফগানিস্তান তো আরো পশ্চিমে।

প্রায়শই দেখা যায় জমিদার বা রাজাদের আদিপুরুষ এসেছেন পশ্চিম থেকে। বৃহত্তর সিলেটের আমার জানা তিনটে বাড়ির কথাই বলি।

বানিয়াচং এর রাজবাড়ির আদিপুরুষ কেশব মিশ্র এসেছিলেন কান্যকুব্জ হতে। হাসন রাজার আদিপুরুষ বিজয় সিংহ দেব অযোধ্যা থেকে আর আমদের বাড়ির পাশের সুনামগঞ্জের বেহেলীর করুণা সিন্ধু রায়ের পূর্বপুরুষ এসেছিলেন বাঁকুড়া থেকে।

মৌলভীবাজারের পৃত্থিমপাশার জমিদারদের পারসিয়ান শেকড়তো সর্বজনবিদিত।

এই বাড়ির পূর্বপুরুষ এসেছিলেন মানিকগঞ্জেরই ঘিওর থেকে। একেবারেই মাটির কাছাকাছির লোক, উচ্চাশা থেকে নয়, পেটের দায়ে বাড়ি ছেড়ে চাকুরী নিয়েছিলেন এক পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে।

পেশা হিসাবে পান ব্যবসা করে অহংকার করার কিছু নেই। তাই নিজ কন্যাটিতে এই পান ব্যবসায়ী পাত্রস্থ করেন নিজ বাড়ির এই কর্মচারীর কাছে। এর পর শ্বশুরের সাথে ব্যবসায় হাত লাগান গোবিন্দপুর থেকে আসা ঘনশ্যাম।

পানের ব্যবসা থেকেই ঘনশয়াম উন্নীত হন প্রথম শ্রেণীর ব্যবসায়ীতে।

ব্যবসা সাধারণত দুই পুরুষের বেশী টিকে থাকে কমই। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো এই পরিবারটির প্রতি। পর পর চার প্রজন্ম – ছেলে, নাতি, ‘পুতি’, শনৈ শনৈ উন্নতি করতে থাকে ব্যবসায় – পান থেকে লবণ, সুপারী, চাল, নানান সব দ্রব্যে।

এই পরিবারের ভাইয়েদের ব্যবসা কেন্দ্র বিস্তৃত হয় সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠি।

ঘনেশরামের তৃতীয় প্রজন্মের চার পৌত্র ( Grandson) আনন্দরাম, দধিরাম, পন্ডিতরাম ও গোলাপরাম প্রথমে ব্যবসা শুরু করেন একত্রে, পরে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। পরে এই চারজনের হাতেই পত্তন হয় গোলাবাড়ি, পূর্ব বাড়ি, পশ্চিম বাড়ি, মধ্যবাড়ি ও উত্তর বাড়ি নামে পাঁচটি জমিদার বাড়ির।

শুরু করেছিলাম, গাজীখালী নদীর চরের মাঝের পল্লীতে জমিদারীর পত্তন করতে গেলো কেন।

বালিয়াটির দক্ষিণ পূর্ব পাশে চর পাড়া, পশ্চিম উত্তর পাশে চর ভাটারা, উত্তর পূর্ব পাশে জোয়ার আমতা, চর আর নদীর জোয়ার ভাটা সংশ্লিষ্ট সব নাম। বালিয়াটিও যে গাজীখালীর বুকে জেগে উঠা বালিতে ভরা চর, তাতে আর সন্দেহ কি।

বালিয়াটিতে স্থায়ী যা কিছু, সবইতো জমিদারদের কারো না কারো নয়তো তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় করা।

বালিয়াটি পুরান বাজারের কালীমন্দিরটি ভেবেছিলাম আগেকার। কিতু এটিও দেখছি জমিদার পরিবারের পশ্চিম বাড়ির হীরালাল রায়ের দত্তক পুত্র চুণীলাল রায়ের দেয়া। এটির প্রতিষ্ঠা কাল ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ৮ ই ফাল্গুন।

বালিয়াটির প্রথম মসজিদটিও (১৯৬৬ সালে) বালিয়াটির জমিদারদের দেয়া ঈশ্বর চন্দ্র স্কুলের জায়গায়। তাহলে আগে ছিলো কি?

হীরালাল রায় ছিলেন জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ যাঁর নামে, সেই জগন্নাথ রায় চৌধুরীর পৌত্র, জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা কিশোরী লাল চৌধুরীর ভাতুষ্পুত্র।

বলতে গেলে অতি সাধারণ কিছু কৃষক জেলে কামার কুমার-দের বসতি নিয়ে ক্ষুদ্র এক পল্লী, হয়তো বাজার বা মোকাম ছিলো একটা। আর ‘জমিদারী’ নামে ছোটখাটো এক ‘সাম্রাজ্যের’’ যে কথা বললাম?

জমিদারির শুরুর পর প্রসার, বিভাজন হয়ে জমিদারি হয় গোটা চার পাঁচটি। এই বাড়ির জমিদারীর বিস্তৃতি ছিলো ঢাকা, ময়মনসিংহ , বরিশাল, ফরিদপুর ও তৎকালীন ত্রিপুরা জেলায়।

তবে এঁদের ব্যবসাপাতির যে নেটওয়ার্ক, অনুমান হয় জমিদারি শুরুর পরও এদের আয়-ইনকামের উৎস ছিলো মূলত ব্যবসা। শুধু নিজেদের জন্য প্রাসাদ, একাধিক বিদ্যালয় ও মন্দিরই নয়, দুর্ভিক্ষকালে আর্তের সহায়তার রেকর্ডও আছে এই বাড়ির।

*১ মহেশরামের ছেলে ঘনেশরাম, ঘনেশরামের চার ছেলের বড় ছেলে গোবিন্দরাম, গোবিন্দরামের চার ছেলে আনন্দরাম, দধিরাম, পন্ডিতরাম ও গোলাপরাম।

তথ্যসূত্রঃ বালিয়াটির যত কথা, প্রকাশক রনি সাহা, প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০১০ সাল ( Save the Heritage Of Bangladesh গ্রুপ ও পেজের এডমিন অধ্যাপক জনাব সাজ্জাদুর রশিদ বইটির অনেকগুলো পৃষ্ঠার ছবি সরবরাহ করায় লেখাটি গুছানো সম্ভব হলো)

লিখা: তপন রায়

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!