সেন্টমার্টিন -১৯৮৫
এই লেখাটা অনেকদিন আগে থেকেই লিখবো ভেবে আসছি। সব মিলিয়ে হয়ে ওঠে নাই। আমার বুয়েটের বন্ধু সাইদ বাবুর চাহিদা আর আমার আরেক বন্ধু নিশাত জাহান রানার সম্প্রতি সেন্টমার্টিন সফরের বর্ণনা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখতে শুরু করলাম।
ভ্রমণ কাহিনি আমার ফেসবুক টাইম লাইনে আসলে আমি মুটামুটি পড়ি। বাংলাদেশের কোনো ভ্রমণ হলে আর একটু আগ্রহ বাড়ে। আর সেটা যদি সেন্ট মার্টিনের হয় তো আমি পড়বই। সেন্ট মার্টিনের লেখাগুলি পড়ি আর মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি আমার দেখা সেন্ট মার্টিনের সাথে!
আমি ১৯৮৫ এর এপ্রিলে বাংলাদেশ মেসিন টুলস্ ফ্যাক্টরিতে চাকরি শুরু করি। একটু গুছিয়ে নিয়েই দল পাকাতে শুরু করি বেড়ানোর জন্য। খুব সহজ ছিলো না বিষয়টা সে সময়। আমার সঙ্গে খুব সহজেই রাজি হয়ে যায় মাকসুদ ফজল জ্যাকি। সে আমার সঙ্গেই বুয়েট থেকে পাশ করেছে। এখন ইউ কে তে থাকে। আর ছিলো জোবায়েদুল হোসেন মিঠু এবং সাইফুল আলম চঞ্চল এরা দুইজনই রাজশাহী থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করা। মিঠু স্বর্গবাসি হয়েছে। আর চঞ্চল বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্পে কর্মে নিয়োজিত। এর বাইরে ছিলো মোজাম্মেল পাঠান। সে রাশিয়াতে লেখাপড়া করেছে। এখন টরেন্টো থাকে। সবারই আগ্রহ ছিলো কিন্তু একমতে পৌঁছাতে আরো কিছু অনুঘটক যোগ করতে হয়েছিলো।
প্রথমেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে কোথায় যাবো, চট্টগ্রাম। কেনো? যুক্তি হলো, আমাদের কাছে খবর ছিলো পতেঙ্গা সিবিচে বিয়ার বিক্রি হয় ঢাকার দামের অর্ধেক দামে। সুতরাং পতেঙ্গা যেয়ে বিয়ার পান করলেই আসা যাওয়ার খরচ উঠে যাবে! এটা ছিলো একটা বড় অনুঘটক।
যা হোক, আমরা পাঁচজন ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাই। একটা সস্তার হোটেলে তিন বেডের রুম, কমন ওয়াশরুম ভাড়া করি। আমরা শুরুতেই ভাগ করে নেই একেকদিন একেকজন সিঙ্গেল বেডে ঘুমাবে আর অন্যেরা দুজন করে এক বেডে ঘুমাবে।
চট্টগ্রাম শহর আমার আগে তন্ন তন্ন করে দেখা। খুব প্রিয় একটা শহর আমার। উঁচু নিচু পাহাড়ময়। মনটা একদম ভরিয়ে দেয়! ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে সীতাকুন্ড পাওয়ার আগেই শুরু হয় সেই অনুভুতি! মাঝে মাঝে ডানদিকে সমুদ্র দেখা যায় আর বামে পাহাড়। ভাটিয়ারি, ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, শিল্প এলাকাগুলি ছবির মত সুন্দর লাগে। সবুজ পাহাড়ের চুড়াগুলি কী অপরূপ!
আমরা চট্টগ্রাম শহরটা ঘুরে বেরাই। বাটালি হিল, পাহাড়তলী, ওয়ার সিমেট্রি এখন মনে পরছে। বিকালে যাই পতেঙ্গা সিবিচে। উদ্যেশ্য বিয়ার পান করে আমাদের আশা যাওয়ার খরচ উসুল করা। কিন্তু বিধি বাম! একজন বিক্রেতাও ওখানে নাই। আমরা ভাবলাম তাহলে বোধহয় আমাদের কাছে ভুল খবর ছিলো! কিন্তু সেটা নয়। ঐদিন চট্টগ্রামে দেলোয়ার হোসেন সাইদীর ওয়াজ ছিলো। এই সব বিক্রেতারা সবাই পালিয়েছে। অগত্যা সমুদ্র দর্শন উপোভোগ করে আমরা হোটেলে ফিরে আসি। হোটেলের ম্যানেজারের কাছে জানতে চাই কোনো বার আছে কি না! সে বলে, ভাই আজকে কারফিউ, সাইদীর ওয়াজ উপলক্ষে সব বন্ধ। তা হলে কী করা! উপায় একটাই, হোটেল আগ্রাবাদের বারে যাওয়া। তাই গেলাম। ঢাকার থেকে তিনগুন দাম। পারলে একটা বিয়ার পাঁচজন ভাগ করে খাই! বিয়ার খেয়ে লাভের ব্যবসা পরিবর্তে পুরাই লস! খরচ অনেক বেড়ে গেলো! ভাবলাম, ঠিক আছে, কক্সবাজার যেয়ে পুসিয়ে নেবো।
পরেরদিন সকালে বাসে করে কক্সবাজার যাই। এটাও আমার পুরানো যায়গা। একই রকম হোটেলে আমরা উঠি। দুপুরের খাওয়া সেরে সমুদ্রে যাই। তখন সমূদ্রের পাড়ে কী কী হোটেল ছিলো আমার মনে নাই। পর্যটনের একটা মোটেল ছিলো সবচেয়ে কাছে। খুব বেশি ভীড় ছিলো না সে সময়।
কক্সবাজারে সাইমন নামে একটা হোটেল ছিলো। আমি যতবার গেছি, ঐ হোটেলে রাত্রে একটা ডিনার নিয়েছি। সেবারও তাই করি। ওরা বড় প্লেট ভর্তি করে একটা রূপচান্দা মাছের ভাজি করতো। খুব মজা। খাওয়ার শেষে প্লেটে কিছুই থাকতো না। কাঁটাগুলিও মুড়মুড়িয়ে খাওয়া যেত। এই সব শেষ করে রাতে হোটেলে ঘুমিয়ে পরি। পরেরদিন সকাল থেকে শুরু হয় আমাদের সমুদ্রস্নান।
সমুদ্রস্নান আমার ভীষণ প্রিয়। ওর ঢেউগুলির একটা তাল আছে। শরীরে ধাক্কা দিলে একটা বাজনা সৃষ্টি করে। একটা তালে সেই বাজনার সাথে মিশে যেতে পারলে একটা নেশার সৃষ্টি হয়। অদ্ভুত সে এক নেশা! আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা উপভোগ করি সেই আনন্দ।
আমার মেশিন টুলসের বন্ধুরা ভাবতো, রিপন হালকা/পাতলা বিড়িখোড় বোধহয় দম নাই। কিন্তু ঐদিন অবাকই হয়ে যায় আমার শারীরিক সামর্থ দেখে। বেশ লম্বা সময় সমুদ্রে কাটাই।
হোটেলে ফিরে খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম সেরে আবার যাই সমুদ্রে। সুর্যাস্ত দেখতে। আর যদি বিয়ার/টিয়ার কোথাও পাওয়া যায়! আবারও সেই বিধি বাম। আমাদের পিছু নিয়ে দেলোয়ার হোসেন সাইদী ঐ দিন কক্সবাজারে, সব কারফিউ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসে চাপি টেকনাফের দিকে। আমাদের সবার জন্য নতুন দিগন্তরেখা দেখা শুরু। খুব খারাপ রাস্তা ছিলো। একদমই লক্কর ঝক্কর মার্কা। ঐটুকু রাস্তা যেতে আমাদের কতখানি সময় লেগেছিলো মনে নাই। তবে বেশ লম্বা সময়। ঐ রাস্তাটার কিছু বর্ণনা আমার আগেই জানা ছিলো। একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঁচু নিচু রাস্তা।
এমন রাস্তা রাঙামাটিতেও আছে। কিন্তু টেকনাফের এই রাস্তাটির ডানপাশে পাহাড় আর বাম পাশে নীল নাফ নদী। অপরূপা! একদম চুলের নীল ফিতার মতো পরে আছে। এই সুন্দরের বোধ হয় তুলনা হয় না। (বাংলা ব্যাকরণ অনুসারে নাফ নদ হবার কথা, কিন্তু সবাই নদী বলে, তাই আমিও নদী বললেম)।
নদীর পানি সাধারণত নীল হয় না, কিন্তু নাফ তার ব্যতিক্রম! আর এই সোন্দর্য্যটার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় নাফ নদীর ওপারে বার্মার পাহাড়গুলি।
আমার পৃথিবী ঘুরে দেখা দেশের সংখ্যা অনেক, তবুও এই লেখাটা লিখতে বসে, বিশেষ করে এই জায়গাটুকুর তুলনা আমি খুঁজে পেলাম না। পাখির চোখে দেখা নাফ নদী। আমি জানি না এখনও তেমন আছে কি না! আসলে নাফ নদীটা কোনো নদী নয়। নদী হচ্ছে একটি জলধারা, যেটা কোথাও থেকে উৎপত্তি হয়ে সাগরে কিংবা হ্রদে যেয়ে মেশে। কিন্তু নাফ নদীটা তা নয়। এটা সমুদ্রের একটা বর্ধিত অংশ। যেটা স্থলের ভিতর ঢুকে পরেছে।
টেকনাফ ব্যাস স্টান্ডে নেমে হোটেলের খোঁজ করি। কেউ বললো নতুন একটা হোটেল খুলেছে, বিল্ডিং এর। তখন টেকনাফে পাকা হোটেল খুব একটা ছিলো মনে হয় না। খুঁজে বের করলাম আমরা সেটা।
নাফ নদী থেকে একটা খালের মতো আছে যেটা বেঁকে ঢুকেছে টেকনাফ বাজারের দিকে। এই খালটা দিয়েই আসলে টেকনাফের সঙ্গে নৌ পথে যোগাযোগ। খালের উপরে একটা ব্রিজ। সেটা পার হয়ে পশ্চিম দিকে গেলেই হাতের ডান দিকে ছিলো হোটেলটা। তখন একদমই নতুন।
আমরা স্নানাহার শেষ করি। এই যে খালটা বললাম, সেটা শুধু জোয়ারের সময় পানি আসে। আর ভাটাতে প্রায় শূন্য! দিনে দুই বার জোয়ার। আর এই জোয়ারের সময়ই নৌযান গুলির চলাচল। এই খালটা থেকেই সব ধরণের জলযানগুলি বিভিন্ন জায়গায় ছেড়ে যায়। আমরা দেখতে বেড় হই। এ সময় ছিলো ভাটা। একদম অল্প পানি। কিছু নৌযান বাঁধা।
সেন্টমার্টিন যেতে হলে এখান থেকে নৌকাতে করে যেতে হবে। দেশি কাঠের তৈরী নৌকা। যাত্রি এবং মালামাল সবই পারাপার করে এরা। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় খালটার মুখের কাছে চলে যাই। ডান দিকে নাফ নদীর নীল জল। আমার এক খেয়াল চাপলো ঐ জল ছুঁয়ে দেখবার। ভাটার সময় জলটা বেশ দূরে। আর এই দূরত্বটা শুধু কাদায় ভরা। বিশ্রী রকমের কাদা। আমার সাথীরা কেউ রাজি হয় না। আমি জিন্সের প্যান্টটা হাঁটু অবধি ভাঁজ করে হাঁটা দেয়। ঠিকই ছুয়ে আসি সেই নীল জল। এখন মনে হয়, কাজটা ঠিক করি নাই! যাই হোক, ওখান থেকে হেঁটে হেঁটে বার্মিজ মার্কেটে যাই। খুব একটা মনে নাই বিশেষত্বটা কী! মুলত বার্মিজ স্যান্ডেল আর মেয়েদের সাজগোজের কিছু জিনিষ থাকবে। রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে ফিরি।
পরেরদিন সকালে উঠে আমাদের পরিকল্পনা হলো টেকনাফ দর্শন। মাথিনের কূপটা তো দেখতে হবেই। কারন সেটার সাথে “যখন পুলিশ ছিলাম” এর স্রষ্টা ধীরাজ ভট্টাচার্য্য জরিত। সেটা দেখে আমরা ঠিক করি টেকনাফের বন দেখার। শুনেছিলাম বুনো হাতী আছে, দেখতে পাওয়া যাবে। একটা বেবী ট্যাক্সি ওয়ালা রাজি হয় আমাদের বুনো হাতী দেখা অভিযানে। বেবী ট্যাক্সি করে আবার কক্সবাজারের দিকে আসতে হয়। বেশ কিছুটা পথ। সেখানে রাস্তার পাশে একটা ভাঙাচুরা রেষ্টুরেন্ট ছিলো। বেবীট্যাক্সি ওখানে রেখে চালক হলো আমাদের গাইড।
আমাদের একটা পাহাড়ী পথ দিয়ে হাঁটা শুরু। কতদূর হেঁটেছিলাম মনে নাই। ওখানে একটা টি এন্ড টির টেলিফোন টাওয়ার ছিলো, পাহাড়ের উপরে। সেটার নিচে একটা বিল্ডিং। ঐ পর্যন্ত আমরা যাই। বুনো হাতী দেখতে পাই নাই কিন্তু হাতীর হাগু পেয়েছি। ঐ পর্যন্ত যেয়েই আমরা ফিরে আসি। ভাঙাচুরা রেষ্টুরেন্টে খেয়ে নেই। এ জায়গাটুকু আসলেই অনেক সুন্দর! আন্তর্জাতিক মানের। ওখানে রাস্তার পাশে একটু উঁচু স্থানে একটা বিডিআর চৌকি ছিলো, যেখান থেকে বার্মা বাইনোকুলার দিয়ে দেখা যায়। আর সে সময়ে এক ধরনের পাস বর্ডার থেকে ইসু করতো, যেটা দিয়ে বার্মার ভিতরে যেয়ে দিনে দিনেই ফেরত আসা যেতো। আমরা যাই নাই সেটাতে। যাই হোক, ফিরে আসি হোটেলে। বিকালে বেড় হয়ে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার নৌকা ওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের যাওয়া কনফার্ম করি। যেহেতু আমরা দুই রাত সেন্ট মার্টিন থাকবো, তাই থাকা খাওয়ার কি ব্যবস্থা আছে জানার চেষ্টা করি।
এইসব শেষ করে ঘুমের আয়োজন। সমস্যা বাঁধলো পাশের রুম থেকে। ওদের কিছু কিছু কথা বার্তা আমাদের রুমে ভেসে আসে। চলাফেরা, সব শুনে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ঐ রুমে মধ্যপান চলছে। আমার সহযাত্রীদের বলতেই ওরা উড়িয়ে দেয়। আমিও জিদ করি। চল দেখাই, পাশের রুমে যেয়ে দরজা ধাক্কাই। দরজা খুলে সামনে অপরিচিত মানুষ দেখে ওরা একটু অবাক হয়। আমিও সোজা বলি, ভাই আমরা ঢাকা থেকে এসেছি, একটু গল্পগুজব করবো। হায়রে খুশি হলো মানুষগুলি! আসেন বসেন, অনেক খাতির করলো। ওরা যেগুলি পান করছিলো সেগুলি ভীষন দূর্গন্ধময় আর বিস্বাদ! মনে হয় তখনকার দিনের কোনো বদির সাপ্লাই হবে। খুব একটা এগোনো গেলো না। যা হোক ওদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতের মতো ঘুমিয়ে পরলাম পরেরদিন সেন্ট মার্টিন যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে।
আমাদের স্বপ্নের সেন্ট মার্টিন যাত্রা শুরু হলো। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা ঘাটে আসি। বেশ কিছু যাত্রী আর মালামালের ভিতরে আমাদের ঠাঁই হলো। উঠে পরলাম নৌকাতে। সেই প্রথম আমাদের সমুদ্র যাত্রা। অসম্ভব উত্তেজনা! এই জোয়ারের সময় সব নৌকাগুলি ছাড়ে টেকনাফ থেকে যাওয়ার জন্য। আবার ঠিক তেমনই যাদের টেকনাফে আসার, তারাও ফিরে আসে এই সময়টাতেই। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমাদের নৌকা ছেড়ে দিলো। খালের ভিতরে একটু এগোতেই পাশে আরেকটা নৌকা, যেটা সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরছে, সেখান থেকে রিপন ভাই বলে একটা চিৎকার।
আমি অবাক হয়ে গেলাম, এত দূরে এসেও আমার পরিচিত কেউ! তাকিয়ে দেখি তালিম। ও বুয়েটে আমার জুনিয়ার। যশোর ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করা। ওরা সেন্ট মার্টিন থেকে ফিরছে। ভীষণ ভালোলাগে বিষয়টা। সবাইকে বলি, দেখো আমার কতো পরিচিত মানুষ! খালটা ছাড়িয়ে আমরা নাফ নদীতে পরি। সেখান থেকে দক্ষিনে যাত্রা। বঙ্গপোসাগরের দিকে। ডান দিকে বাংলাদেশ আর বাম দিকে বার্মা। এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য! বাংলাদেশের গ্রামগুলির নাম জেনেছিলাম, ভুলে গেছি! আস্তে আস্তে আমরা বাংলাদেশের স্থল সীমা পেড়িয়ে বঙ্গপোসাগরে পরি। এটাই আমার প্রথম সমুদ্রে ভিতরে পরা। অসম্ভব এক শিহরণ! গাংচিলগুলি ঘিরে ফেলে নৌকাটাকে। আসলে নৌকার প্রপেলারে বারি খেয়ে যে মাছগুলি মরে, সেগুলি খাওয়া এদের উদ্দেশ্য। কারন যেটাই হোক, দৃশ্যটা তুলনা হয় না।
বাংলাদেশের স্থল ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে। সেই প্রথম আমার দূর থেকে দেখা বাংলাদেশ! আমরা গভীর সমুদ্রে এসে পরি। অনেক বড় বড় ঢেউ শুরু হয়। নৌকাটা যেন আঁছড়ে পরে! তখন লাইফ জ্যাকেটের কোনো বালাই ছিলো না। আমার মৃত্যুভয় সব সময় কম। আর কারো কী না জানিনা, কিন্তু আমাদের ভিতরে চঞ্চল খুব ভয় পেয়ে যায়। সে অনেক খেলাধুলা করে। শরীরও খুব তাগড়া জোয়ান। শুধু একটু ভিতু।
সেই সমুদ্র ডিঙিয়ে আমরা দেখতে পাই সেন্ট মার্টিন! আস্তে আস্তে পৌঁছে যাই দ্বীপটাতে। কোনো রকমের ঘাট ছিলো না, সমুদ্রতটেই নৌকাটা ভিড়লো। প্রবাল দ্বীপে আমাদের প্রথম পা। এই জমে যাওয়া মরা প্রবালের পাথরগুলি খুব ধারালো! একদম ছুরির মতো। একটু বেকায়দায় পরলেই পা কেটে যাবে। নৌকা থেকে নেমে অল্প কিছুটা পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে আমরা বালির উপর আসি।
শুরু হয় আমাদের সেন্ট মার্টিন আবিস্কার করা আর অবাক হবার পালা! আমরা জেনে এসেছি যে নৌকা থেকে নামলেই একটা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। নেমে দেখি দুই/তিনটা টং মাত্র। সিগারেট, চকলেট ধরনের কিছু বিক্রি করে। তাহলে খাবো কোথায়! আর থাকা!! কেউ একজন বললো অপেক্ষা করেন, রান্নার লোক আসবে। ঠিক আছে। আমার সেন্ট মার্টিন দেখার তর সইছে না!
ভাবলেম একটু হেঁটে আসি, কিন্তু ব্যাগ রাখবো কোথায়? জানতে চাইলে স্থানীয়রা বললো, কেনো! বালুর উপর রেখে যান, কেউ হাত দিবে না। অবাক হলেম! সত্যিই সে সময়ে সেন্ট মার্টিনে চোর/চুরি বলে কিছু ছিলো না। মনে হলো পদ্মা নদীর মাঝির ময়না দ্বীপে এসে গেছি।
দ্বিতীয় অবাক হলেম কোনো ভিক্ষুক নেই। যেখানে ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের যন্ত্রনায় আমরা দূর্বিসহ! আর একটা জিনিষ আমার চোখে পরলো, সেটা হলো কুকুর। কোনো নেড়ি কুত্তা না। খুব সুন্দর, মাঝারী সাইজের একদম অন্য একটা জাতের কুকুরগুলি। লোমস শরীর আর মোটা ফুলানো লেজ। জানলেম এটা সেন্ট মার্টিনের স্পেশাল জাত। আমার অনুমান কেউ এটা ফার্মিং করে বিশ্ব বাজারে পালিত কুকুর হিসাবে বিক্রি করতে পারতো।
কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করতেই একজন এসে বললো, সেই রেস্টুরেন্টের মালিক। যা আমরা খেতে চাই, তাই রান্না করে দেবে। আমরা বললাম দুপুরে মুরগীর মাংস আর রাতে মাছ। ব্যাস খাওয়ার সমস্যা মিটে গেলো।
কিন্তু রাতে থাকা! তখন একটাও হোটেল ছিলো না সেন্ট মার্টিনে। সব টিন অথবা বাঁশের বাড়ি। একমাত্র পাকা বিল্ডিং সরকারী, যেটা ইউনিয়ন পরিষদ এবং সরকারী কাজে ব্যবহৃত ডাক বাংলো টাইপের। আমরা থাকবো কোথায়? রেষ্টুরেন্টের মালিকই সমাধান। তার টং এর সাথেই বাঁশের মাচা করা আছে। আর নাম মাত্র বালিশ/চাদর এই সব আছে। এবং তার জন্য কোনো বাড়তি পয়সা লাগবে না। কি চমৎকার আতিথীয়তা! খুব ভালো লাগলো। আমরা ব্যাগগুলি ঐ মাচার উপর রেখে দ্বীপ দর্শনে বেড় হই।
আমার ইচ্ছা সম্পূর্ণ দ্বীপটা একদম সমুদ্রের পাড় দিয়ে চক্রাকারে হাঁটবো। সেটা আট নয় কিলোমিটারের বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না। এবং এটা আমার খুবই ইচ্ছা। ছোটোবেলায় কেয়া ফুল দেখেছি। বাবা বর্ষাকালে কেয়া ফুল এনে বাসায় রাখতেন। খুব তীব্র একটা গন্ধ। কেয়া গাছও দেখেছি। কিন্তু সেন্ট মার্টিনে সারিসারি কেয়ার বন, পিছনে সমুদ্র, কি যে সুন্দর!
আমার সাথীরা কেউ অত হাঁটতে চাইলো না। অগত্যা আমিও ওদের সঙ্গে গ্রামটার ভিতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। গ্রামের প্রায় সব মানুষই মাছ ধরার কাজ করে। গভীর সমুদ্রে যায় এরা মাছ ধরতে। কয়েকদিন পরে ফেরে। সবার অবস্থাই মুটামুটি স্বচ্ছল মনে হলো। বাড়ির আঙিনাগুলি হয় বাঁশ অথবা নারিকেল পাতা দিয়ে ঘেরা। ও হ্যা, নারিকেল গাছ সর্বত্র। সবখানেই খুব পরিস্কার। কোথাও ময়লা ফেলবার চিহ্ন নেই।
মানুষের সাথে কথা বলে খুব শান্তি লাগে আমাদের। ভীষণ আন্তরিক এবং ভালোমানুষ এরা। সেই একমাত্র পাকা সরকারী বিল্ডিংটাও দেখি আমরা। এই সব ঘুরে/টুরে আমরা ফিরে আসি আমাদের সেই টং রেষ্টুরেন্টে।
মুরগীর মাংস আর ভাত। কী ঝাল রে বাবা! একদম মাথা গরম করে দেওয়ার মতো ঝাল। তবুও পেট ভরে খেলাম। তার পরেই চঞ্চল বিগড়ে গেল! প্রথমত সে খুবই ঘড় কাতুরে। বাবা/মাকে ছাড়া কয়েকদিন থাকলেই ওর সমস্যা হয়। দ্বিতীয়ত নৌকাতে সে ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। ভেবেছিলো যে আর ওর বাবা/মার সাথে দেখা হবে না। আর শেষে এই ঝাল মুরগী! সব মিলিয়ে তার চিৎকার শুরু হলো যে সে ফিরে যাবে। পরের জোয়ারেই। দুই রাত কেন, এক রাতও থাকবে না! আমার সাথে লেগে গেলো ঝগড়া। সে এক ভীষণ অবস্থা।
অত সুন্দর একটা নির্জন দ্বীপে উচ্চকন্ঠে আমি আর চঞ্চল! যাই হোক, শেষে ঠিক হলো আমরা একরাত থেকে সকালের জোয়ারে ফিরবো। আর চঞ্চলকে বলে দিলাম, ওর সাথে জীবনেও বেড়াতে বের হবো না। (এর তেত্রিশ বছর পরে ২০১৮তে চঞ্চলের সাথে প্লান করি সিংগাপুর যাওয়ার। আবার গোল বাঁধায় চঞ্চল। শেষ মূহুর্তে যায় না। সব মিলিয়ে আমার ১২০০ ডলার ক্ষতি গেছে বুকিং ক্যানসেল বাবদ।)
দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেড় হওয়ার প্লান। এবার যাবো দ্বীপের পশ্চিম দিকটাতে। সুর্যাস্ত দেখে ফিরবো। ওরা কেউ আর হাঁটতে রাজি না। আমার একেতে চঞ্চলের উপর রাগ। মন ভালো নেই। আর একা থাকতে চাইছিলাম। দিলাম হাঁটা, একা একাই, পশ্চিম দিকে। কোনো এক কেয়ার ঝোঁপের পাশে বসে পরি। পুরা সুর্যাস্তটা সম্পূর্ণভাবে নিজের ভিতরে ধারণ করি। হয়তো কেঁদেছিলামও! খুব ছিচ কাঁদুনে ছিলাম আগে। এই সব করে সন্ধ্যার পরে আবার সেই মাচাটায় ফিরি। রাতের মাছ রান্নাতে ঝাল একটু কম ছিলো। খেয়েদেয়ে আমরা মাচাটার উপর শোবার আয়োজন করছি। এর মধ্যে এক স্থানীয় ভদ্রলোক এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন।
আলাপ করতে করতে এমন অবস্থা হলো যে তিনি আমাদের এই মাচাতে শুতে দেবেন না। ওনার বাড়িতে যেয়ে ঘুমাতে হবে। হবে মানে হবেই। একদম নাছোড়বান্দা। অগত্যা রাজি হতে হলো। বাড়ীটার উপরে টিনের চাল। পাশেরটা কিসের আমার মনে নাই। কিন্তু মেঝেটা পাকা। সেখানেই আমাদের বিছানা। পরেরদিন সকালে উনি আমাদের প্রাতরাশ করিয়ে গাছ থেকে ডাব পারিয়ে সেই পানি খাইয়ে বিদায় করলেন। এমন আতিথীয়তা! ভাবাই যায় না!
আমরা ফিরে আসতে থাকি। ভীষণ অপূর্ণতা নিয়ে। মনে হয় একটা পূর্ণিমা রাত যদি ঐ বালুতটে মুক্ত আকাশের নিচে ঘুমাতে পারতাম! কিংবা একটা সপ্তাহ যদি জেলে হয়ে ঐ সমুদ্রে মাছ ধরতে পারতাম!!
ফেরাটা খুব সহজ। ভোরের জোয়ারে টেকনাফ। সরাসরি বাসে চট্টগ্রাম। আর ট্রেনে একবারে ঢাকা।
(দোষগুলি ক্ষমা করবেন। কয়েকজন ভদ্রলোকের সন্মান রক্ষার্থে কিছু শব্দের ব্যবহার সংকুচিত করা হলো। আর কয়কেটা স্বল্প কাপড়ের ছবি প্রকাশের লোভ সামলাতে পারলাম না)
সাইফুল ইসলাম রিপন
যন্ত্রকৌশলী
ক্যালগেরী, আলবার্টা, ক্যানাডা।