• ফিচারড
  • সব পোস্ট
অন্যান্য অভিজ্ঞতা হিম সোমেশ্বরী আর দুই দুঃসাহসী

হিম সোমেশ্বরী আর দুই দুঃসাহসী

-

হিম সোমেশ্বরী আর দুই দুঃসাহসী

(আগের পর্ব)

… দৌড়াতে দৌড়াতে ময়মনসিংহ স্টেশনে এসে মাত্র এক মিনিটের জন্য জারিয়াগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস আমরা মিস করলাম। রিকশাভাড়া মিটিয়ে আমরাও স্টেশনে ঢুকেছি আর মহানন্দা এক্সপ্রেস ছেড়ে দিল।

আমার আর ইয়াশ এর মন খুব খারাপ হয়ে গেল কারণ আমাদের এই টাইপের টু-ডু লিস্ট এ সবার উপরে ছিল এই ট্রেনে ভ্রমণ করা। তাছাড়া মাত্র 20 টাকা ভাড়া দিয়ে ময়মনসিংহ থেকে জারিয়া যাওয়ার সুযোগ টাও ছাড়ার ইচ্ছা ছিল না কারণ আমরা তো বেরিয়েছি বাজেট ট্রাভেলিং এ।

যাই হোক ট্রেন মিস করে দুজনেই বেশ মন খারাপ করে প্লাটফর্মে হাটাহাটি করছি এ সময় এক পুলিশ সদস্য আমাদের পরামর্শ দিল ময়মনসিংহ নতুন ব্রিজের ঐখান থেকে সিএনজি নিয়ে শ্যামগঞ্জ স্টেশনে চলে যেতে, এতে আমরা নাকি মহানন্দা এক্সপ্রেস এর আগেই ওখানে পৌঁছে যাব। ওখান থেকে মহানন্দা এক্সপ্রেস ধরতে পারবো।

সাথে সাথে আমি আর ইয়াশ ছুট লাগালাম। একটা রিক্শা করে আমরা নতুন ব্রিজ এ চলে আসলাম। এখান থেকে সিএনজিতে উঠে ছুটলাম শ্যামগঞ্জের দিকে। শ্যামগঞ্জ এর কাছাকাছি এসে রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমাদের চোখে মুখে তখন ট্রেন মিস করার শঙ্কা।

আমরা সিএনজি ছেড়ে দিয়ে হেঁটেই শ্যামগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছালাম। আর তখনই মহানন্দা এক্সপ্রেস সবেমাত্র স্টেশনে ঢুকেছে। আমরা বেশ আনন্দচিত্তে ট্রেনে উঠে গেলাম। ট্রেন এখানে জারিয়া থেকে ঢাকাগামী বলাকা কমিউটার ট্রেনকে সাইড দেওয়ার জন্য বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবে, কাজেই সময় আছে। সে সময় আমরা শ্যামগঞ্জ স্টেশন, স্টেশনের মানুষ, মানুষের জীবনযাত্রা এসব দেখে কাটালাম। বেশ কিছু ছবি তুললাম। 15 মিনিট পরে ট্রেন ছেড়ে দিল।

আমি আর ইয়াশ ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেশের অন্যতম একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রকৃতি, ঘরবাড়ি ও মানুষের জীবনযাত্রা দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ট্রেন স্টেশন জারিয়া ঝাঞ্জাইল এর দিকে।

মোটামুটি তিনটার দিকে আমরা জারিয়া পৌছালাম। জারিয়া পৌঁছে সবার আগেই স্টেশনের সাইনবোর্ডের সাথে নিজের একটা ছবি তুলে নিলাম। আমার ভ্রমণ জীবনের বাকেট লিস্ট এ যে কয়টা স্থান ভ্রমণের তালিকায় ছিল তার ভেতরে জারিয়া স্টেশন অন্যতম।

আমি জানি এই বাক্যটি পড়ে অনেকেই হয়তো ভাবছেন মানুষের বাকেট লিস্ট এ ভ্রমণের অনেক কিছুই তো থাকে আমার বাকেট লিস্ট এ জারিয়া কেন? কারো আছে আইফেল টাওয়ার, কারো তাজমহল, কেউ চায় নিউজিল্যান্ড বেড়াতে, কেউ চায় নরওয় বেড়াতে, কারো স্বপ্ন থাকে আমেরিকা ঘুরতে যাওয়ার। এসব স্বপ্ন আমারও আছে।

বেশ কয়েকটা জায়গায় যাওয়াও হয়েছে। তদুপরি ছোটবেলায় ওই যে সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের পড়া দেশের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ট্রেন স্টেশন জারিয়া ঝাঞ্জাইল। এজন্য ছোটবেলা থেকেই এটা আমার বাকেট লিস্ট এর উপরের দিকে। যাই হোক ছবি তুলে আমি আর ইয়াশ স্টেশন থেকে বের হতেই আমাদেরকে পাকড়াও করল স্থানীয় একজন যুবক।

আসলে সে আমাদের সাথে ট্রেনে একই বগিতে ভ্রমণ করেছিল সেখান থেকেই আমাদেরকে ফলো করছিল। স্টেশন থেকে বের হওয়া মাত্র আমাদেরকে নিজের পরিচয় দিল যে, সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদেরকে দেখে তার পর্যটক মনে হয়েছে বিধায় যেকোনো রকম হেল্প লাগলে সেটা করতে চায়।

আমরা খুব খুশি মনে তার কাছে জারিয়া থেকে বিরিশিরি সুসং দুর্গাপুর যাওয়ার, ক্যাম্পিং করার নানান রকম তথ্য জেনে নিলাম। তার ফোন নাম্বারটি রেখে দিলাম। এই ভদ্রলোক আমাদেরকে আতিথেয়তা না করিয়ে ছাড়লেন না।

পাশের একটা বিখ্যাত চায়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। চা খেলাম, লুচি সন্দেশ খেলাম। এরপর ভদ্রলোক নিজেই আমাদের দুর্গাপুর গামী একটা অটোরিকশায় তুলে দিলেন। আমরা প্রায় ত্রিশ মিনিটের জার্নি করে দুর্গাপুর এসে পৌছালাম এখানে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি।

এদিন দুর্গাপুর পৌরসভা নির্বাচন চলছিল। চারিদিকে কড়া নিরাপত্তা। হোটেল রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ। নির্বাচন উপলক্ষে চারিদিকে একটা বেশ সাজ সাজ অবস্থা।

আমরা সোজা চলে গেলাম দূর্গাপুর থানায়। দূর্গাপুর থানায় নিয়ে আমরা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে আমাদের উদ্দেশ্য খুলে বললাম। তারা বেশ আনন্দেই আমাদের অনুমতি দিলো এবং যেকোন প্রকার সমস্যায় ওই অঞ্চলের চেয়ারম্যান এর নাম্বার আমাদেরকে দিয়ে দিল।

নেত্রকোনার এই এলাকাটি আসলে দুই ভাগে বিভক্ত। জারিয়া এবং ঝাঞ্জাইল। জারিয়া এলাকার ভিতরে পড়েছে সুসং দুর্গাপুর। দুর্গাপুর হলো এখানকার থানার নাম। বিরিশিরি সুসং ইউনিয়নে অবস্থিত।

থানা থেকে অনুমতি নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসে থানার মোড়ে একটা যেমন-তেমন রেস্টুরেন্ট পেলাম। খাবার মেনু ডিমের তরকারি অথবা মুরগির তরকারি। ইয়াশ ডিম দিয়ে খেলো আর আমি মুরগি দিয়ে খেলাম।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সোমেশ্বরী নদী পায়ে হেঁটে পার হলাম। শীতের সময়ে নদীতে এমনি পানি কমে যায় তার উপর কাঠের ব্রিজ করা হয়েছে। ব্রিজ পার হয়ে ওপারে গিয়ে আমরা একটা অটো নিলাম। অটোতে করে আমরা সোজা চলে গেলাম রানীখং চার্চে।

আমাদের ইচ্ছা ছিল চার্চের টিলার উপরে সোমেশ্বরী নদীর পাড়ে ক্যাম্পিং করার। কিন্তু করোনা জনিত কারণে চার্চ এ প্রবেশ নিষেধ। চেয়ারম্যান এর অনুমতি নিয়ে আমরা সোমেশ্বরীর একেবারেই পাড়ে ক্যাম্পিং করলাম, তাবু থেকে কয়েকহাত দূরেই নদীর হিম জল।

বিকালে তাবু ঠিক করে আমি একটা নৌকায় বসে সোমেশ্বরীর হিম শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে বসলাম। ওদিকে ইয়াশ শুরু করলো ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি। পেট যথেষ্ট ভরা থাকায় মাথা থেকে রান্নার চিন্তা উবে গেল। আমরা বেশ বিন্দাস মুডে বসে থাকলাম।

সোমেশ্বরীর এখানে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের ব্যাপারটি বেশ আদিম। আমাদের সামনে দিয়ে দুইজন নারী বিশুদ্ধ পানি নদী থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাদের কাছে জানতে চাইলাম আপনারা এই পানি কিভাবে সংগ্রহ করলেন? তারা আমাকে পদ্ধতি টা দেখাল, তারা নদীর পাড়েই কয়েকটা গর্ত করে রেখেছে পানি থেকে একটু দূরে। সেই গর্তের ভেতরে বিশুদ্ধ পানি ফিল্টার হয়ে জমা হচ্ছে, সেই পানি তারা পাত্রে করে নিয়ে যাচ্ছে।

পানি সংগ্রহের ব্যাপারটি আমার কাছে বেশ মজা লাগলো এবং আমি আশ্বস্ত হলাম যে বিশুদ্ধ পানির জন্য আমাদেরকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। আমি এমনিতেও নিশ্চিন্ত ছিলাম কারণ সাধারণত অপরিচিত জায়গায় গেলে আমরা পানি ফুটিয়ে খাই এবং আমাদের সাথে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও থাকে। ব্যাপারটি বলার পর ইয়াশ নিজেও ব্যাপারটা ঘুরে ঘুরে দেখল ব্যাপারটা আমাদের দুজনের কাছেই বেশ মজা লাগলো।

আমরা যেখানে ক্যাম্প করেছি এর আশেপাশে প্রচুর কয়লার স্তুপ। নদী থেকে সংগ্রহ করা কয়লা এখানে স্তুপ করা হচ্ছে। একটা যেমন তেমন ভাবে বানানো তাবুও দেখলাম একজনের। বুঝলাম এখানে একজন রাতে পাহারায় থাকে।

একটু পর সন্ধ্যা নামলে আমি আর ইয়াশ একটু চা এর আয়োজন করছি, চুলা বানিয়ে কেটলিতে পানি চড়িয়েছি এমন সময় দুজন লোক এসে হাজির হলো। একজনের পরনে বিজিবির পোশাক সাথে হাতিয়ার, অন্যজন সিভিল পোশাকে। তারা আমাদের পরিচয় জানতে চাইলো আমি তাদেরকে পরিচয় দিলাম।

সিভিল পোশাকের লোকটির আচরণ বেশ খারাপ মনে হলো। লোকটি আমাদেরকে বেশ রুক্ষভাবে জিজ্ঞাসা করলো আপনারা এখানে ক্যাম্প করার জন্য কার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন? আমি বললাম আমরা থানায় জানিয়ে এসেছি এবং স্থানীয় চেয়ারম্যান এর সাথে কথাবার্তা বলেই আমরা এখানে ক্যাম্প করেছি।

তখন তারা জানতে চাইল এখানে একটা বিজিবি ক্যাম্প আছে। ক্যাম্পিং করতে হলে বিজিবি ক্যাম্পের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে, এটা কি আপনারা জানেন? আমি তাদেরকে জবাব দিলাম দেখুন আমি বাংলাদেশের নাগরিক, বিজিবির কাজ সীমান্ত পাহারা দেয়া দেশের ভিতরে কোন নাগরিক কোথায় কি করছে এটা দেখা বিজিবি দায়িত্ব নয়, এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর এবং স্থানীয় প্রশাসনের।

আমি দুইটা জায়গায় জানিয়ে এসেছি এরপরেও যদি আপনাদের কোন কিছু জানার থাকে আপনাদের কোনো সিনিয়র অফিসার বা কমান্ডিং অফিসার লেভেলের কাউকে আসতে বলুন আমি তার সাথে কথা বলে বিষয়টি বুঝে নেব। এ কথা বলার পর সিভিল ড্রেসের লোকটি চেয়ারম্যান কে ফোন দিলেন এবং নিশ্চিত হলেন যে আমাদের ক্যাম্প করার বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন জানে। তারপর তারা চলে গেল এবং আমরা রাতের রান্নার আয়োজন করলাম।

আজ রাতে আমাদের রান্না ছিল এগ নুডুলস। ওখানকার স্থানীয় কয়লা পাহারাদার বলল যে ভাই আপনারা তো রাতে থাকবেন তাহলে আমি আজ একটু বাসায় থাকি, বাসায় গিয়ে ঘুমাই মানে সোজা কথায় আমরা আজ কয়লা পাহারাদার।

আমরা রাজি হলাম কারন আমরা একটু প্রাইভেসি চাচ্ছিলাম। আমরা চাচ্ছিলাম নিরিবিলি নির্জনে ক্যাম্পিং করতে, সেখানে একজন তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে আমাদেরও একটু দ্বিধা কাজ করতো। কাজেই আমরা বেশ খুশী মনে রাজী হলাম। উনি চলে গেলেন এবং আমরা দুজনে নুডুলস রান্না করে ফেললাম।

সেদিন ছিল পূর্ণিমার ২য় রাত। সোমেশ্বরীর ওপাশে মেঘালয়ের পাহাড়ে চাঁদ উঠেছে আজ। পূর্ণিমা রাতের চাঁদ আর হালকা কুয়াশা। বেশ দূরে কয়লা সংগ্রহকারী এবং কয়লা পাহারাদারদের টুকটাক কথাবার্তা ভেসে আসছিল। নুডুলস রান্না করে প্লেটে নিয়ে আমি আর ইয়াশ একটা নৌকায় গিয়ে বসলাম। নৌকায় বসে হাতে খাবারের প্লেট, মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে সোমেশ্বরী, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

একটু ভেবে দেখুন তো চারপাশ নিরবতার মাঝে একটা নৌকায় দুইজন মানুষ চুপচাপ বসে বসে খাচ্ছেন আর পূর্ণিমা দেখছেন। নৌকাটা ও কিনা নদীতে ভাসছে। এভাবে প্রায় 15 মিনিট ধরে আমরা খাওয়া শেষ করলাম। নদীর উপরে হালকা কুয়াশা, ওপারে পাহাড়ের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ এই অভূতপূর্ব দৃশ্য আমাকে আজকে স্তব্ধ করে দিলো।

আমরা প্রায় আধাঘণ্টা একেবারেই চুপচাপ বসে থাকলাম, পূর্ণিমা উপভোগ করলাম। তারপর আগুনের পাড়ে বসে চা বানালাম। চা বানিয়ে আবার আমরা ফিরে আসলাম নৌকায়। হাতে গরম চা এর মগ, চারপাশে পূর্ণিমা নদীতে চিকচিক করছে পূর্ণিমার চাঁদের আলো। মনে হল পৃথিবীর সবকিছু থেকে হারিয়ে গিয়েছি কিছুক্ষণের জন্য।

ঠিক সেই মুহূর্তে ইয়াশ বলল ভাই জীবন খুব সুন্দর, খুব সুখের, একে উপভোগ করতে হলে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়না। খুব বেশি ব্যয় করতে হয় না, খুব সামান্য ব্যয়ে যেকোনো জায়গায় গিয়ে আমরা জীবনকে উপভোগ করতে পারি।

আমি একমত হলাম কারন সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি। জীবন এত সুন্দর হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরেছি, মানুষের স্বপ্ন থাকে এমন অনেক জায়গায় গিয়েছি, অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু খেয়েছি, অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, অনেক মানুষের সাথে সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছি কিন্তু সোমেশ্বরীর তীরে ওই হিমশীতল রাতটা আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল জীবন সুন্দর।

জীবনের সৌন্দর্য কে কখন কিভাবে উপভোগ করবে এটা আসলে কেউই জানেনা। এভাবে আমি আর ইয়াশ নৌকায় বসে বসে পূর্ণিমা উপভোগ করতে করতে রাত দুইটা বাজিয়ে দিলাম। এসময় ঠান্ডা বেড়ে গেল হঠাৎ করে, হিম শীতল বাতাস বইতে শুরু করল। ঐদিন নেত্রকোনার তাপমাত্রা ছিল 10 ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সোমেশ্বরীর পাশে ছিল হাড় কাঁপানো শীত। কাঁপতে কাঁপতে আমি আর ইয়াশ তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলাম। আমরা স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে শুয়ে পড়লাম। স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকেই আমরা চারপাশের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছিলাম। এভাবে কখন যে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি।

আমাদের ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। যথারীতি তাঁবুর ফ্লাপ খুলে সূর্যোদয় দেখার জন্য আমি আর ইয়াশ স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকেই চোখ খুলে শুয়ে থাকলাম। আমার হঠাৎ ইচ্ছা হল আজকের সূর্যোদয় টি তাঁবুর ভেতরে শুয়ে না দেখে সোমেশ্বরীর নৌকায় বসে পানিতে পা ডুবিয়ে দেখব। আমি উঠে বের হয়ে একটা নৌকায় বসে পানিতে পা ডুবিয়ে থাকলাম।

ওদিকে ইয়াশ ঘুম থেকে উঠে একটা গাছের গুঁড়ির উপরে বসলো। খুব আরাম করে আমরা সূর্যোদয় দেখলাম। সূর্যোদয় দেখে চা কফি বানিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা করেই আমরা তাবু গুছিয়ে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসলাম।

আমাদের এবারের গন্তব্য দুর্গাপুরের বিখ্যাত টংক আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন এবং চিনামাটির পাহাড়। একটা রিক্সা নিয়ে আমরা বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড় এসে হাজির হলাম। আসার পথেই আমরা টংক আন্দোলনের স্মৃতিচিহ্ন দেখে এসেছি। এখানে এসে চিনামাটির পাহাড় এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন দেখে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম কেননা আমাদের একটু তাড়া ছিল। পরের বার এসে আমরা সুসং দুর্গাপুর আবার ভালভাবে ঘুরে দেখব বলে নিজেদের মনকে প্রবোধ দিলাম। একই পথে জারিয়া ঝাঞ্জাইল ফিরে এসে বলাকা কমিউটার টিকেট করে আমরা ঢাকার পথ ধরলাম।

উত্তরের এই জনপদ নেত্রকোনা, বাংলাদেশের অন্যতম সহজ সরল মানুষদের দেশ। এখানকার মানুষ গুলো অসাধারণ এবন খুবই অতিথি পরায়ন। একটা সময় ছিল যখন বিরিশিরি পর্যটন স্পট হিসেবে খুব জনপ্রিয় ছিল কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বিরিশিরিতে ঢাকা বা অন্যান্য অঞ্চলের পর্যটকদের আনাগোনা একটু কমেছে। তবুও বিরিশিরির সৌন্দর্য একটু অম্লান হয়নি বরং বিরিশিরি দিনে দিনে আরো সুন্দর হয়েছে।

আমি আর ইয়াশ ট্রেনে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের আরও একবার সুসং-দুর্গাপুরে আসতে হবে। নিজেদের মনকে আমরা প্রবোধ দিলাম যে, আমরা আবার আসব। আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। ছোট্ট একটা দেশ।

হয়তো আমাদের একটা তাজমহল নেই, হয়তো আমাদের একটা আইফেল টাওয়ার নেই, হয়তো আমাদের একটা ইন্টারলেকেনের মতন গ্রাম নেই, হয়তো আমাদের স্ট্যাচু অব লিবার্টি নেই, হয়তো আমাদের নায়াগ্রা ফলস নেই, হয়তো আমাদের কিলিমাঞ্জারো নেই। কিন্তু আমাদের আছে নেত্রকোনা সুসং দুর্গাপুর, বিরিশিরি, বান্দরবান সেন্টমারটিন, সুন্দরবন এমন হাজারো জায়গা।

পুরো পৃথিবীতে ফেলার স্বপ্ন তো আমাদের সবারই আছে কিন্তু তার আগে নিজের দোষটা কেন আমরা একটু চষে দেখব না? আসুন না আগে নিজের দেশটা দেখি। এখানেই শেষ হচ্ছে আজকে ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা দুইটা ক্যাম্পিং এর গল্প পরবর্তীতে আবার কোন এক গল্পে লেখা হবে অন্যকোন ভ্রমণের ইতিকথা।

নেত্রকোনা ভ্রমণ সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রয়োজন হলে নিচের কমেন্ট এ প্রশ্ন করতে পারেন। ভ্রমণ করুন বিশেষ করে একাকী নির্জনে ঘুরে নিজের দেশকে নিজের মত জানুন। দেশটা আপনার, প্রকৃতি আপনার, পৃথিবী আপনার। আপনার দেশ আপনার সম্পদ। আপনার সম্পদ কে নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর করে রেখে দিন।

সৌজন্যে: Najmus Sakib

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

1 COMMENT

  1. প্রথমত ময়মনসিংহ অঞ্চলে মহানন্দা এক্সপ্রেস নামে কোন ট্রেন নাই।আপনারা যেটাতে গিয়েছেন সেটার নাম জারিয়া লোকাল। আর জারিয়া পড়েছে পুর্বধলা থানায় আর ঝাঞ্জাইল পড়েছে দুর্গাপুর থানায়।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!