গতকাল রাত থেকেই মাথায় শুধু এই নামটাই ঘুরছে। ঘুরবেনাই বা কেনো ? এমন চাঁদ রাতেই ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম এই নামের এক পাহাড়ের খোঁজে।
তারিখটা সঠিক মনে নেই
সাল ২০২১ ৷ নাইট শিফট থাকায় রাতেই ব্যাগ নিয়ে অফিসে চলে যাই ৷
সে এক মহা বিপদ ৷৷ আমার এত বড় ব্যাগ দেখে গেইট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে সব সিকিউরিটি গার্ড বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। স্ক্যানিং মেশিনে ব্যাগ দিলাম কিন্তু ব্যাগ ঢুকে না ৷ আমার ব্যাগের তুলনায় কোম্পানির স্ক্যানিং মেশিন ছোট ৷
কোম্পানি মেশিন ক্রয় করার সময় হয়তো ভাবেইনি আমার মতো কেও কোনদিন এখানে জয়েন করতে পারে ৷
মহা বিপদ, ব্যাগের সাইজ আর ওজন দেখে তারা রীতিমত ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে আমার দিকে ৷ ব্যাগ যেহেতু স্ক্যানিং মেশিনে ঢুকছে না তাই সব খুলেই চেক করা লাগবে ৷ আমিও এখন টেনশনে পড়লাম, এই ব্যাগ প্যাক করতে আমার ২ দিন লাগছে ৷
ব্যাগ আমি খুলে দিলাম ৷ একটা একটা করে জিনিস দেখছে,
আমি পাশে বসে তাদের রিয়েকশন দেখছি ৷ বেশ কিছু জিনিস বুঝতে অসমর্থ রয়েছিল তারা, আমার কাছে জিজ্ঞেস করে নিলেন।
ইতি মধ্যে সিকিউরিটি গার্ড অফিসার এসে হাজির ৷ বুঝলাম ভয়ে ব্যাপার টা তারা কোথায় অব্দি পৌঁছাইছে । উনি এসেই বলে দিলো আমি ব্যাগ নিয়ে ভিতরে যেতে পারবো না ৷ জমা দিয়ে ভিতরে যেতে হবে ৷ আমি রাজি না, আমি ব্যাগ রেখে যাব এটা হয়না ।
ফোন দিলাম আমার ডিপার্টমেন্টের ডিজিএম স্যারকে ।উনি ব্যাপারটা শুনেই এক গাল হাসি দিয়ে আমার কল কেটে সিকিউরিটি ম্যানেজারকে কল দেন ৷ পরে ম্যানেজার সিকিউরিটি অফিসারকে কল দিতেই বেচারার চোখ মুখ দেখার মতো অবস্থা ছিলো ৷
অবশেষে আমি আমার ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়লাম ৷
ভোর সকালে বের হওয়ার সময় ভেবেছিলাম আবার প্যারা খাইতে হবে, ব্যাগ খুলে চেকিং এর ৷
কিন্তু না, আমি এসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাচ্ছি এমন সময় সিকিউরিটি অফিসার পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন দাদা ব্যাগ খোলা লাগবে না, আপনি যান ৷ আর রাতের জন্যে দুঃখিত ।
আমিও মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলাম।
গাড়ি ধরে সোজা জি ই সি নামলাম ৷ রাস্তা পুরাই ফাঁকা, বিমান চালাইছে নাকি বুঝলাম না । এদিকে আমি ২নম্বর গেইট এসে বসে আছি , আর আমার শহরের ট্যুর পার্টনাররা তখনো বিছানায় শোয়া ৷
নয়নকে কল দিয়ে বাকিদের খোঁজ নিলাম ৷ প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর সবাই একত্রিত হলাম।
ঈদের নামাজ চলছে তখন, আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম ৷ অক্সিজেন পৌঁছে হালকা নাস্তা করে বাসে করে চলে গেলাম রাঙামাটি ৷ তখন দুপুর ১২টা।
রাঙামাটি পৌঁছেই বাজার থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী কিনে নিলাম ৷ সাথে একটা লিজেন্ডারি মুরগি ৷ লিজেন্ড কেনো বললাম পুরো গল্পটা পড়লে বুঝতে পারবেন ৷
বাজার করে বোট ঠিক করলাম, গন্তব্য জুরাইছড়ি । আকাশ হঠাৎ মেঘলা হয়ে গেছে , একদম কালো মেঘে ঢেকে গেছে ৷ সামনে যে খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে প্রকৃতি তার আগাম বার্তা জানাচ্ছে আমাদের। কিন্তু আমরা ঐসব এত না ভেবে বোটে উঠে পড়লাম।
১০মিনিট পরেই শুরু হলো মুষল ধারায় বৃষ্টি ৷ কর্ণফুলী নদীকে তখন বঙ্গোপসাগরের রূপে দেখছি ৷ ভয়ঙ্কর সুন্দর, ভয়ঙ্কর অ্যাডভেঞ্চার । কিছুদূর গিয়ে আর সামনে আগানো সম্ভব হচ্ছিলো না, তাই মাঝি ভাই বোটটা কোন একটা পাড়ের কিনারায় লাগিয়ে দিলেন ৷ বাতাস আর বৃষ্টি একটু কমার অপেক্ষা করছি আমরা ।
বৃষ্টি থামার পড় আবার যাত্রা শুরু হলো আবার ৷ শুভলং ঝর্নার ঐ জায়গা গিয়ে বোটের মাঝি আর্মিদের আমাদের দেখায়, কিন্তু আর্মি ভালো ভাবে খেয়াল না করে আমাদের পাহাড়ী ভেবে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দেন ৷ মূলত বাঙালি এই ক্যাম্পের পরে আর যেতে পারেনা, বাঙালি যাওয়া নিষিদ্ধ। আমাদের গায়ের উপর একটা সাদা তিরপল দেয়া থাকায় আমাদের হয়ত ভালো ভাবে খেয়াল করেনি। তার পরে আরো একটি ক্যাম্প আসে ৷ বৃষ্টির কারণে তারাও ভালো ভাবে চেক না করে অনুমতি দেন যাওয়ার ৷ তারপর জুরাইছড়ি ক্যাম্প আসে, ওটাও পাড় করে যাই আমরা।
জুরাইছড়ি বাজারে নামার পর ঐখানের মানুষগুলো আমাদের দিকে কেমন করে যেনো দেখছিলো বার বার ৷ আমরা আমাদের গন্তব্যে হাঁটা শুরু করলাম। ৩ ঘণ্টা ট্রেক করে বিকেল ৫ টার দিকে আমরা পাংখু পাড়া পৌঁছাই। পাড়ায় ঢুকতে একটা বিশাল বড় আম গাছ, দারুন সুন্দর দেখতে । স্কুল আছে একটা ৷ সুন্দর গোছানো পাড়া ।
পাড়ার লোকগুলো আমাদের দিকে দেখছে, ছোট ছোট বাচ্চারা ঘিরে ধরেছে ৷ আমরা জানতে চাইলাম এই পাড়ার কারবারি কে?
বাচ্চাগুলো আমাদের কারবারির বাসায় নিয়ে গেলো। আমরা জানালাম আমরা কোথা থেকে এসেছি, আর কেনো এসেছি।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া হয়নি আমাদের, বেশ ক্ষুধার্ত ছিলাম আমরা সবাই ৷ কারবারি কে বলায় উনি আমাদের অর্ধেক কাঁঠাল দিলেন খাওয়ার জন্য, যা আমরা ৪ জনে খেয়েও আরো বেচেঁ গেছে ৷ এমনিতে কাঁঠাল তেমন খাইনা আমি, কিন্তু ঐদিন কাঁঠাল যেন সবচেয়ে প্রিয় ফল আমার সেভাবে খাচ্ছিলাম।
কারবারি দাদাকে বললাম আমরা কোন ঘরে থাকব না, কোনো একটা জুম ঘরে থাকতে চাই আমরা ৷ আমরা সাথে করে তাবু নিয়ে গেছিলাম।
উনি আমাদের প্রথমে বললেন স্কুলের পাশে আম গাছের নিচে ক্যাম্প করার জন্য, বৃষ্টি আসলে স্কুলে ঢুকে যেতে পারবো ৷ কিন্তু পাড়ার মানুষদের হাব ভাব দেখে পাড়ায় থাকার ইচ্ছে হয়নি৷ আমাদের পাড়া থেকে একটু দূরে একটা জুম ঘর দেখা যাচ্ছিলো ৷ আমরা ওটাতে থাকার ইচ্ছা পোষণ করলে, অনুমতি দেন কারবারি দাদা ৷
পাড়া থেকে আরো ৩০মিনিট ট্রেক করে আমরা জুম ঘরে পৌঁছাই ৷ কিন্তু সমস্যা এখানে অন্য কিছু, জুম ঘরের একটু উপরে, মানে আমরা যে পাহাড়ের খোঁজে এসেছি, হুগীমন পাহাড়, ঠিক সেই পাহাড়ের উপরেই পাংখু পাড়া আর্মি ক্যাম্প ৷ যেহেতু আমরা এতটুক এসেছি, পাহাড়ের চূড়ায় না গিয়ে তো ফিরে যাব না ।
সিদ্ধান্ত নিলাম ক্যাম্পে গিয়ে আমরা অনুমতি নেব এখানে রাতে থাকার আর চূড়ায় যাওয়ার ৷ ক্যাম্প থেকে আরো প্রায় ১কি:মি উপরে মেইন পয়েন্ট ।
জুম ঘরে ব্যাগ আর বাকি জিনিসপত্র গুলো রেখে আমরা রওনা দিলাম ক্যাম্পের দিকে ৷ মেঘলা আকাশ, সূর্য্য ডুবে গেছে, একটু একটু অন্ধকার আকাশে বাসা বাঁধছে।
হালকা আলোয় আমরা ক্যাম্পে পৌঁছাই ৷ আমাদের দেখে সৈনিক ৩জন হাতে রাইফেল নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো ৷ আমরা জানলাম তাদের সব কিছু।
তারা রীতিমতো অবাক, এতগুলো ক্যাম্প পারি দিয়ে কি ভাবে বাঙালি এখানে চলে এলো ?
আমরাও অবাক এটা শুনে, যে এখানে বাঙালি আসা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
বাঙালি এখানের মানুষ গুলোর চোখের বিষ ৷ আর্মির পার্মিশান ছাড়া পরিচিত বা আত্মীয় স্বজন মানুষ ছাড়া এখানে আগে কোনো বাঙালি আসতে পারে নাই ৷
এগুলো শুনে আমরা সবাই চুপ ।
তাদের মেইন ইন চার্জকে খবর দিয়া হলে উনি নামাজ শেষ করে আসবেন বলে জানা গেল ৷ তখন অন্ধকার হয়ে গেছে আবছা আলোয় আমরা আশপাশটা দেখছি, কি সুন্দর পাহাড়, নদী।
ইতি মধ্যে সব ক্যাম্পে খবর হয়ে গেছে, এখানে বাঙালি কি ভাবে আসলো? এতগুলো চেক পোষ্ট পার হয়ে কি ভাবে সম্ভব হল এটা ৷
নামাজ শেষে অফিসার আসলো, উনার ফোনে একের পর এক ফোন ঢুকছে, বাঙালি ৪জন কি ভাবে পাংখু পাড়া আর্মি ক্যাম্প অব্দি পৌঁছে গেলো, তারা সবাই ঠিক আছে কিনা? এই ক্যাম্পটাই এদিকের শেষ আর্মি ক্যাম্প।
আর্মিরা কথা বলে সিদ্বান্ত নিল আমাদের জুরাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিবে ৷ জুম ঘর বা পাড়ায় কোথাও থাকতে দিবে না ।
পাড়ায় ঢুকেই আমাদের কেমন যেনো সন্দেহ হয়েছিলো তাদের কথা বার্তায় । কারবারি আমাদের পাড়ায় রেখে দিতে চেয়েছিলেন ৷ আমরা রাজি না হয়ে বার বার জুম ঘরটা দেখিয়ে দিচ্ছিলাম ৷ পড়ে বললো ঠিক আছে আপনাদের ইচ্ছে, আর বলেছিল ক্যাম্পে না যাওয়ার জন্যে ৷ আর্মি যেন জানতে না পারে। সব কিছু মিলিয়ে কেমন যেন ঘোলাটে লাগছিলো সব। আর্মিদের কাছে অনুরোধ করলাম, আমরা এতো দূর যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি সেটা আমাদের পূরণ করতে দেওয়ার জন্য ।
আর্মি ক্যাম্প থেকে রওনা দিলাম, তখন রাত ৮টা ৷ অন্ধকার পথ হালকা ঠান্ডা বাতাস, মাঝে মাঝে জোনাকি পোকার আগমন এসব দেখে দেখে ১০টার দিকে আমরা জুরাইছড়ি পাড়ায় এসে পৌঁছাই ৷ পাংখু পাড়া ক্যাম্প থেকে পাড়ার মেম্বারকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল ৪জন বাঙ্গালী যাচ্ছে, তাদের কে জুরাইছড়ি ক্যাম্পে দিয়ে আসার জন্যে ।
আমরা মেম্বারকে খুঁজে নিই, মেম্বার আমাদের নিয়ে ক্যাম্পে যায়। ক্যাম্পে গিয়ে আমাদের সাথে সৈনিক রা গল্পে মেতে উঠলেন ৷ এই অসম্ভব কাজ কি ভাবে সম্ভব করলাম আমরা, কি ভাবে শেষ ক্যাম্প অব্দি চলে গেলাম?
আমাদের একটা চেকপোষ্টে বসানো হলো, একটু পর একজন সাদা পাঞ্জাবি পড়া লোক ফোনে কথা বলতে বলতে আমদের দিকে এলো, বুঝলাম উনি এখানের বড় অফিসার। আমাদের সবার নাম টিকানা কি করি,সব জিজ্ঞেস করেন। আমরা সব বলি, জিজ্ঞেস করলেন কিছু খাওয়া হলো কিনা ৷ আমরা বললাম, আমরা দুপুরেও খাইনি ৷
আমাদের জন্য খাবার এনে দিলো, ভাত মাংস সবজি। খেতে খেতে আমাদের জন্য রাতে থাকার জায়গা বানিয়ে ফেললেন সৈনিকরা । একটা স্টোর রুমকে ৩০ মিনিটের মধ্যে বেড বালিশ মশারী সব দিয়ে বিছানা তৈরি করে দিল তারা । আমরা খেয়ে দেয়ে গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমায়ে গেছিলাম মনে নেই ।
কি অদ্ভুত একটা দিন কাটলো ৷
পরের দিন সকালে উঠে পুকুরে গিয়ে মুখ ধুয়ে এসে দেখি আমাদের জন্যে খিচুড়ি বানিয়ে এনেছে ৷
খেয়ে রওনা দিলাম, আর্মি বোট ঠিক করে আমাদের বোটে তুলে দিল ৷
শুবলং এসে নেমে, বাজারে যাই ।
বাজারে একটা হোটেলে গিয়ে আমাদের সেই লিজেন্ড মুরগিকে জবাই করে বিরিয়ানি বানিয়ে খাই ৷ তারপর বোট ধরে রাঙামাটি ফিরি।
ঈদমোবারক
লিখা ও ছবি : আর. ডি রোহিত ৷
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমরা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কিন্তু কর্তৃপক্ষের যথার্থ অনুমতি নিয়ে ভ্রমণ করাকেই আমরা উৎসাহিত করি। লিখা ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ লেখকের। এডমিন প্যানেলের অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত।