ছোট্ট পুকুর, অনেকটা পথ মাড়িয়ে আসা, খুব আলো নেই, খুব গম্ভীর হয়ে বার্ডাররা বসে আছেন, ওইখানে পাখিরা গোসল করতে আসে, নীলমনি থেকে শুরু করে বিচিত্র সব বুলবুল আর ফ্লাইক্যাচার, ভাল ছবি তোলা অবশ্য প্রায় অসম্ভব ই, রেকর্ড শট নিতেই ওইখানে যাওয়া। ঘড়ির কাঁটায় সময় গড়ায়, কারো দেখা নেই, মাঝেমধ্যে অবশ্য হোয়াইট টেইল রবিনের মেয়েপাখিটা আমাদের সামনে লেজ নাচিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে যাচ্ছে। ঘুমে ঢলে ঢলে পড়ছি। খুব সতর্ক, একটু অসাবধান হলেই ওই পুকুরের পানির স্বাদ পেয়ে যাব।
সন্ধ্যার দিকে হুট করে শাটারের মুহুর্মুহু আওয়াজে ঝিমুনি চলে গেল, গাছের উপর একজোড়া সবুজ রঙা সুন্দর পাখি বসে আছে, এই সৌন্দর্য অবিশ্বাস্য, অন্য রকম, অপার্থিব! কেউ যেন নিজের হাতে এঁকেছে এদের, নিয়ন সবুজ, আকাশি আর রক্তরঙা লালে! আমি শাটার প্রেস করতে ভুলে গেলাম। ততক্ষনে ওরা নেমে এসেছে নীচে, গোসল করছে, আমি মন্তমুগ্ধের মত ক্লিক ক্লিক করেই যাচ্ছি, যদিও সেখানে কোন ভাল ছবির সম্ভাবনা খুব অল্প। ক্যামেরা স্ক্রিনে দেখি একটা ছবিও ভাল না, তাতে কি, ফ্রেমবন্দী করেছি। এর মধ্যে সবার অগোচরে আবার যে কখন ও আমার খুব কাছে এসে বসেছে, সেদিকে কারো খেয়াল নেই৷ এইবার মিস হল না আর।
এই অপূর্ব সুন্দর পাখির নাম সবুজ হাঁড়িচাচা, কিংবা সবুজ তাউড়া। মনটাই খারাপ হয়ে যায় নামটা শুনলে! নামটা যদি হত শ্যামসুন্দর, কেমন হত? ইংরেজিতে এদের নাম Common Green Magpie. নামে কমন হলেও বাংলাদেশে কোথাও ই খুব কমন না।
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পাখি কি জিজ্ঞেস করায় প্রিয় চিকিৎসক বড়ভাই Shawn Dev দাদা বলেছিলেন, সবুজ তাউড়া। আমার অবশ্য এই লিপ্সটিক দেওয়া পাখি খুব ভাল লাগত, কোন পর্যায়ে, আমার অপছন্দের কেউ এদের ছবি আপলোড দিলেও লাভ রিয়াক্ট দিতাম। এই প্রথম এদের দর্শন পেলাম সাতছড়িতে। এই এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা! শুধু এদের জন্য ই আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য দিন গুনছিলাম, সে মাহেন্দ্রক্ষণ চলেই আসবে এত দ্রুত, জানতাম না।
ইদানীং পাখিদের ডাক আয়ত্ব করার চেষ্টা করছি। এদের ডাক শুনে বুঝলাম, এই ডাক আগে শুনেছি, আর কোথাও না, সাতছড়িতেই৷ গতবর্ষায় প্রজাপতি খোঁজার সময়ে। সেবার বেগুনী কোকিলসহ অসংখ্য পাখি মিস করেছিলাম, এইবার হাতছাড়া হওয়া পাখি বেশ অল্প।
আমি নিজেকে কখনোই বার্ড ফটোগ্রাফার ভাবি না, বার্ডার ভাবি, প্রকৃতিপ্রেমী মাত্র। এইবার উদ্দেশ্য ছিল বার্ডিং ই, স্পেসিজ বাড়ানো, কিন্ত ভাগ্যের কি মজা, এর মধ্যেও এত ভাল ভাল ছবি পেয়ে গেলাম!
খুব খারাপ লেগেছে এক জিনিস, সাতছড়িতে অনেকেই ময়লা আবর্জনা ফেলেছেন, ন্যাশনাল পার্কে যাওয়ার আমি নিষেধ করার অধিকার রাখি না কাউকে, কিন্ত একজন ভালমানুষ, প্রকৃতিপ্রেমিক কখনই এই ধরনের কাজ করতে পারেন না। এই বোধশক্তিটা খুব জরূরী আমাদের সবার জন্য। নয়ত এই সবুজ হাড়িচাঁচাদের শুধু বিদেশী পেইজের ছবি দেখেই মন ভরতে হবে। প্রকৃতি আমাদের সতর্ক করছে, আমরা কি শুনছি?
লেখা ও ছবি : ডা: নিসর্গ মহসিন