প্লাস্টিক বিরোধী প্রচারণার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা: বাবর আলী পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করছেন। বাংলাদেশের পথে পথে পায়ে হেঁটে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছে অক্টোবর ২৫, ২০১৯ তারিখ। ক্লান্তিবিহীন ছুটেছেন দেশপ্রেমিক এই চিকিৎসক। আমরা তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সাথে থাকুন ব তে ব-দ্বীপের।
আজ প্রকাশিত হচ্ছে ১ম পর্ব
কুয়াশা ফিকে হয়ে আসার আগেই সকালবেলা রকি ভাইয়ের নানীশাশুড়ি আর শাশুড়ির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম। রাতেই বলে রেখেছিলাম আমি খুব ভোরে বেরুব,তাই সকালের নাশতার আয়োজনের কষ্টটা যেন করা না হয়। আশির আশেপাশের বয়সের নানী সেসব শুনলে তো! এন্ডোমন্ডো এপটা চালু করে গুটি গুটি পায়ে হাঁটা শুরু করলাম চৌরঙ্গী মোড়ের উদ্দেশ্যে। ‘পঞ্চগড় ০ কি.মি. লেখা মাইলফলকটা ওখানেই।
আগের রাতেই ওদিকটা হেঁটে এসেছি। ডিস্টিলারী মোড় থেকে এগিয়ে ধাক্কামারার চত্বরে পৌঁছাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল। ধাক্কামারার মোড়ের ট্রাফিক বক্সটাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা দ্বীপ। সবুজ ঘাসের মাঝে যেন মাথা উঁচু করে রেখেছে। করতোয়া নদীর উপর নির্মিত সেতু পেরিয়ে চৌরঙ্গীতে গিয়ে এমন কাউকে খুঁজছিলাম যিনি আমাকে একটা ছবি তুলে দিতে পারেন।একজন ভ্যানওয়ালা দয়াপরবশ হয়ে একটা ছবি তুলে দিতেই পা চালালাম।
মহাসড়ক এন-৫ ধরেই যাত্রা। গন্তব্য ঠাকুরগাঁও। আজ পাড়ি দিতে হবে ৪০ কি.মি. পথ। সকালের আরামদায়ক আবহাওয়ায় যদ্দুর পারি এরিয়ে থাকব,এই পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই যাত্রা। দু’পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি।
চোখ বুলাতে বুলাতে যাচ্ছি এমন সময় ডাক এল ‘এক্সকিউজ মি’ বলে। ফিরে তাকাতেই রাস্তার অপর পাশ থেকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল এক তরুণকে। আমার সাথে কথা বলে এক কাপ চায়ের আমন্ত্রণ দিলেন। বাজারটা একটু পেছনের দিক ভলে আমি ইতস্তত করলেও ভদ্রলোকের আন্তরিকতায় সাড়া না দিয়ে পারা গেল না।
মিলগেট পেরুতেই বিশাল সব চোখে পড়ছিল।এর চেয়েও নজরকাড়া ব্যাপার হল অতিকায় গাছগুলো ঘিরে প্রচুর পরিমাণে ফার্ণের উপস্থিতি। খানিকটা এগিয়েই পঞ্চগড় সুগার মিলের বিশাল টিনের নির্মিত কারখানা দৃষ্টিসীমায় এল। এই মিলগুলোর একটা মজার ব্যাপার হল,এগুলো সারাবছর খোলা থাকে না। আখ কাটার পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চালু থাকে এ কারখানাগুলো। রাস্তার এক পাশে মূল কারখানা আর অপর পাশে কোয়ার্টার,রেস্ট হাউজ,মসজিদ ইত্যাদি। সুগার মিল চোখে পড়লেও সুগার মিলের মূল কাঁচামাল তথা ইক্ষু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
এবার রাস্তার দু’পাশে সঙ্গ দিচ্ছে রেইনট্রি,মেহগনি আর শিশু গাছ। জুট মিল বাজার পেরিয়ে ময়দানদীঘির কাছটায় আসতেই জাঁকিয়ে বৃষ্টি এল। আশেপাশে দোকান-পাট না থাকাতে এই যুবক বয়সে শিশু তথা শিশু গাছই ভরসা। বৃষ্টি একটু কমতেই ময়দানদীঘির পাড়ে উঠে চারপাশে চক্কর লাগালাম।
কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়ল হিমালয় ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি। আমার পর্বতপ্রেমী চোখ খুঁজে পাচ্ছে এমন সব নামই। সকালেই এক জায়গায় মাউন্ট এভারেস্ট কলেজের ব্যানার পড়েছিল চোখে। এবারে টানা হেঁটে বোদা এসে ফটোগ্রাফার ফিরোজ সাবাহ ভাইকে ফোন দিতেই আরেক দফা চা-মিষ্টি হয়ে গেল।
পথে নামতেই এবার তেড়ে বৃষ্টি। অল্প হাঁটতেই পঞ্চগড় জেলার সীমানা শেষ হয়ে গেল।
প্রবেশ করলাম ঠাকুরগাঁও জেলায়। কিছু জায়গায় শিশু গাছগুলো বড় হয়ে মাথার উপর চাঁদোয়া তৈরি করেছে।
অপর পাশ থেকে সাইকেলে আসা এক বালক আমাকে দেখে একটু সুরে সুরে ‘পাগল….. ‘ বলাতে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই বালক তার লাইনটি শেষ করল ‘পাগল…. মন মনরে’ বলে! মুচকি হাসি বিনিময় করে বালক সাইকেলে দূরে মিলিয়ে গেল।
পথে দু’জায়গার চা বিরতি লোকজনের কৌতূহল নিবৃত্ত করতেই কেটে গেল। পথে হাসপাতাল পেলাম দু-তিনটা। এনজিও পরিচালিত এসব হাসপাতাল খুব পরিপাটি।
মুন্সিরহাট পেরিয়ে ভুল্লি বাজার নামে এক বড়সড় বাজারের দেখা পেলাম। ভুল্লি নদীর উপর নির্মিত সেতুর দুপাশেই বাজার। বৃষ্টিতে জুতা ভিজে যাওয়ায় খানিকটা বেকায়দায় পড়লেও টান হেঁটে সালন্দার কাছে গিয়ে পড়কাম বিশাল এক জমায়েতের মুখে। সম্ভবত কোন সম্ভ্রান্ত মানুষের জানাজা। একটু পরেই ফোন দিলেন রুবাইয়া আপুর মা। আজকে উনাদের বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা। উনি কিভাবে আসতে হবে জানিয়ে দিলেন। পা চালিয়ে গন্তব্যের কাছে আসতেই আন্টিকে ফোন দিয়ে জানলাম পথের দিশা। আংকেল আমাকে এগিয়ে নিতে এসেছিলেন। উনার পিছু পিছু শহরের পূর্ব গোয়ালপাড়ায় তাদের সাজানো-গোছানো বাড়ীটাতে ঢুকছি তখন বিকেল চারটে প্রায়। ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে শহর দেখতে বেরুলাম আংকেলের সাথে। আংকেল বারবার জিজ্ঞেস করছিল- ‘তোমাকে সাথে নিয়ে গেলে হেঁটে যেতে হবে? নাকি গাড়ী নিতে পারব?’ আমি হেসে জবাব দিলাম -‘এখন তো গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।গাড়ী নিতে আপত্তি নেই।’ শহরের এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আংকেল ডিসি অফিস, বড় মাঠ, জেলা স্কুল, মির্জা ফখরুলের বাড়ী দেখালেন। এর মধ্যেই ঠাকুরগাঁওয়ে কর্মরত মেজর ডা. সুমন খীসা দাদাকে ফোন করলাম। উনি বর্তমানে ডেপুটশনে বিজিবি হাসপাতালে কর্মরত। দেখা হতেই পুরো হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখালেন আর করলেন আপ্যায়নের চুড়ান্ত। আরো বেশ কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে সুমন’দা তার গাড়ীতে আমার আজকের বাসস্থানের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন।
#SayNoToSingleUsePlastic
কৃতজ্ঞতায়: বাবর আলী