প্লাস্টিক বিরোধী প্রচারণার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা: বাবর আলী পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করছেন। ক্লান্তিবিহীন ছুটেছেন দেশপ্রেমিক এই চিকিৎসক। আমরা তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
সাথে থাকুন ব তে ব-দ্বীপের ।
আজ প্রকাশিত হচ্ছে ২য় পর্ব
ঠাকুরগাঁও – দশমাইল, দিনাজপুর (৪৬.৫০ কি. মি.)
সেই ছয়সকালে (সকাল ছয়টা বাজে আর কি!) ঘুম ভাঙল রান্নাঘরে রুবাইয়া আপুর মায়ের টুংটাংয়ে। সকালে না খেয়ে বের হওয়া আর কপালে রইল না। ব্যালকনিতে তাকিয়ে নির্মেঘ আকাশ দেখে মনটা খুশি হয়ে গেল।
বিশাল এক প্লেট নুডলস খেয়ে আর লিকার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বেরুতে বেরুতে পৌনে সাতটা। আংকেল কিছুটা রাস্তা এগিয়ে দিতে এলেন। বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে জগ্ননাথপুর আসতে বেশি সময় লাগল না। অল্প এগুতেই চোখে পড়ল দারুণ সুসজ্জিত আরডিআরএস নামক এক এনজিওর অফিস। এই অঞ্চলে এই এনজিওটা বেশ জনপ্রিয় বলেই মনে হল। পাশেই একটা উঁচু জায়গা দেখে দীঘি মনে হতেই একটু উপরে উঠেই আশাহত হতে হল। ওরকম কিছু চোখে পড়ল না।
এইবার রাস্তার দু’পাশে সঙ্গ দিল বিশাল সব সেগুন গাছ। সেদিকে তাকাতে তাকাতেই কানে এল – ‘ভাবী সালাম’। তাকিয়ে দেখি ক্লাস ফোর-ফাইভ পড়ুয়া এক ছেলে তারই সমবয়সী স্কুল ড্রেস পরিহিত এক মেয়েকে এই নামে সম্বোধন করছে! কৌতূহল নিয়ে ক্যামেরার ছুতোয় একটু দাঁডিয়ে কথা-বার্তা শুনে বুঝলাম বন্ধুর প্রেমিকাকেই ভাবী বলে সম্বোধন করছে। ছোট খোচাবাড়ী,বড় খোচাবাড়ী পেরোতেই চোখে পড়ছিল সাইকেলে স্কুলগামী পিচ্চি-পাচ্চাদের। এদিকের লোকাল বাসগুলোর ছাদে লাল-সাদা-সবুজ পতাকা চোখে পড়ছিল। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই জানাল লোকালরা বাসের ছাদে পতাকা দেখে কোন রুটের বাস সেটা চেনে।
বড় খোচাবাড়ী থেকে ২৯ মাইল পর্যন্ত পুরোটাই শিশু গাছের ছাওয়া। রোদ্দুর উঠে গেলেও হাঁটতে তাই খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছিল না। পাশেই বয়ে চলছিল ক্ষীণ ধারার এক খাল। এদিকে সব বাড়ির সামনেই পাকা চাতাল। কুঁড়েঘর হোক কিংবা পাকা বাড়ী,বাড়ীর সামনে ধান শুকানোর সুবিধার্থে পাকা চাতাল আছেই। আর চোখে পড়ছিল বিশাল সব ফুলকপির ক্ষেতে। আমার প্রিয় সবজিটিকে দু’চোখে প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছিলাম।
ঠাকুরগাঁও জেলার সীমানা পেরুতেই এদিকের বেশির ভাগ বাজারের নাম বদলে গেছে মাইলে। কোনোটা ২৯ মাইল বাজার,কোনোটা ২৬ মাইল বাজার। ২৮ মাইল বাজারের পরে একটা সেতু পার হবার সময় চোখ আটকে গেল সেতুর তলায়। মানুষ,গরু-ছাগল,হাঁস সবাই হাঁটু সমান পানিতে গোসল করছে। বটতলা বাজার থেকে একটু এগোলেই সিংড়া জাতীয় উদ্যান যাবার রাস্তা। আমি অবশ্য তেমন একটা আগ্রহ দেখালাম না। দেশের জাতীয় উদ্যানগুলোর অবস্থা তথৈবচ।
এক গাদা বাচ্চাকে স্কুলের শিক্ষক রাস্তা পার করে দিচ্ছেন,এই দৃশ্য চোখে পড়ল ভোগনগরের কাছে। পথিমধ্যে এক লোক থামিয়ে জিজ্ঞেস করল- ‘আপনি কি কোন কোম্পানী থেকে আসছেন ভাই?’ তেমন কোন কোম্পানীর খোঁজ এই দেশে এই সব বনের মোষ তাড়ানো কাজে কেউ পেলেই তো! চাকাইয়ের টালিথা কুমী চার্চ থেকে এগিয়েই বীরগঞ্জ বাজার।
উপজেলা সদর হলেও জেলা সদরের মতই ব্যস্ততা চারপাশে। রুবাইয়া আপুর বাবা আগেই বলে রেখেছিলেন বীরগঞ্জে সাধনা সুইটসের মিষ্টি যেন মিস না করি।
স্পঞ্জ মিষ্টিটা খেতে ভালোই ছিল। এগিয়ে বীরগঞ্জ জাতীয় উদ্যানের গা ঘেঁষে চলে। সামাজিক বন বিভাগের অধীনে এই উদ্যানটি। রাস্তা থেকে বেশ ক’টা পায়ে হাঁটার ট্রেইল ঢুকেছে ভেতরের দিকে। আজ সকালে ৪-৫ কি.মি. যাবার পর থেকে বাঁ পায়ে কেমন জানি ভোঁতা একটা যন্ত্রণা হচ্ছিল। সেটা গতি কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। জাতীয় উদ্যান পার হতেই প্রবেশ করলাম কাহারোল উপজেলায়।
এর মধ্যেই ফোনে কিছুক্ষণ পরপরই আমার খোঁজ নিচ্ছিলেন দিনাজপুরের মুইজ মাসুম ভাই। উনার বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা আজ। রামপুর থেকে হাতের ডানের রাস্তা দিয়ে এবার মুকুন্দপুর। উদ্দেশ্য কান্তজীউ মন্দির যাওয়া।
আগেও বার দুয়েক এসেছি। পথে যখন পড়েছেই,আরেকবার ঢুঁ মেরে এলাম। এখানে এসেই এক বিপত্তি। এক ছেলে এসে জিজ্ঞেস করল – ‘আপনাকে বীরগঞ্জে হাঁটতে দেখেছি। কি করেন আপনি?’ এবার পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত শুনে আমাকে আজকের গন্তব্যের কথা শুধাতেই আমি উত্তর দিলাম – দশমাইল। কিভাবে যাব প্রশ্নের জবাবে হেঁটে যাব জানালাম। আমার দিকে তাকিয়ে বলল -‘আপনার মনে হয় টাকা-পয়সার সমস্যা।আমি দিব টাকা? ‘ আমার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার পরেও ওই ছেলে থামে না। তার বাইকের পেছনে করে দশমাইল এগিয়ে দিতে চায়। অনেক কষ্টে তাকে নিরস্ত্র করে কান্তনগর মোড়ে পৌঁছাতেই চোখে পড়ল একটা ভাষ্কর্য। তেভাগা আন্দোলনকে স্মরণীয় করে রাখতে এর নতুন নামকরণ হয়েছে তেভাগা চত্বর।
বার মাইল থেকে বাকি পথটুকু গাড়ীর হেডলাইটের আলোতে হেঁটে দশ মাইল পৌঁছাতেই দেখি মুইজ মাসুম ভাই তার বন্ধু-বান্ধবসমেত ফুল নিয়ে হাজির। আজকের হাঁটা এখানেই শেষ। এন্ডোমন্ডো বকছে হেঁটেছি প্রায় সাড়ে ৪৬ কি. মি.।
এখান থেকে মুইজ ভাইয়ের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাড়ীতে গেলাম টমটমে। একে একে পরিচিত হলাম মামুন ভাই,মানিক ভাই আর শিপন ভাইয়ের সাথে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প, দেশপ্রেম, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে দারুণ আড্ডা হল। চঞ্চল ভাই আর রুকু ভাই আসতেই মৌ ভাবীর রান্না করা সুস্বাদু খাবারটা দিয়ে সারা হল রাতের খাবার।
চলবে…
কৃতজ্ঞতা: বাবর আলী