প্লাস্টিক বিরোধী প্রচারণার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা: বাবর আলী পায়ে হেঁটে ৬৪ জেলা ভ্রমণ করছেন। ক্লান্তিবিহীন ছুটেছেন দেশপ্রেমিক এই চিকিৎসক। আমরা তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি ।
সাথে থাকুন ব তে ব-দ্বীপের ।
আজ প্রকাশিত হচ্ছে ৩য় পর্ব
দশ মাইল (দিনাজপুর) – সৈয়দপুর (নীলফামারী) – চিকলী বাজার (নীলফামারী) = ৩৪.৫০ কিমি
২৭ অক্টোবর, ২০১৯
গা এলিয়ে মহাসড়কে নির্ভাবনায় শুয়ে থাকা খানপাচেঁক কুকুরকে যখন পাশ কাটাচ্ছি,তখন সবে সকাল সাতটা। আজকের যাত্রা শুরু করেছি দিনাজপুরের দশ মাইল থেকে। সকাল ছয়টায় বিছানা ছেড়ে সাড়ে ছয়টায় বেরুবার আগেই মৌ ভাবী এই ভোরবেলাতেই নাশতা নিয়ে রেডি। মুইজ ভাইয়ের বাসা থেকে আমার যাত্রা শুরুর স্থল দশমাইল তথা গতকাল যেখানে শেষ করেছিলাম সেখানে এসে যাত্রা শুরু করতে সাতটা।
হাঁটা শুরু করতেই চোখে পড়ছিল প্রচুর হিমাগার। আজ এদিকটা বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন। রাস্তাগুলোকে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল টানেল। টানেলের শেষ মাথা থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা বেরিয়ে আসছে আর সেই আলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে আসা বাস-ট্রাকগুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এদিকের রাস্তায় বিআরটিসির বাস চলে প্রচুর।
রাস্তার ডানের ইক্ষু ক্ষেত দেখতে দেখতে চলে এলাম দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলসের বিশাল এলাকায়। রাস্তার দু’পাশ জুড়েই এর বিস্তৃতি। রামডুবি মোড়ে আসতেই চোখে পড়ল জাল ঘেরা এক স্থানে প্রচুর হাঁস।
প্যাক প্যাক শব্দে সরগরম জায়গাটা। খানিক পরেই কাহারোল উপজেলার সীমানা শেষ হয়ে গেল। ঢুকে পড়লাম দিনাজপুর সদর উপজেলায়। ব্যাংকালী বাজারের সাথেই একটা স্কুল, নাম সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়।
নতুন ভূষির বন্দর থেকে খানিক এগিয়েই আত্রাই নদী। বিশাল সব চর পড়ে গেছে নদীর বুক জুড়ে। নদীর এপাড়ে সদর উপজেলা শেষ, ওপাড়ে চিরির বন্দর উপজেলা। আত্রাই নদীর উপরের সেতু পেরুতেই কৌতূহলী একদল বাচ্চার সাথে দেখা। দলবেঁধে ওরা ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে পাশের পাড়ায়। প্রিয় দল,প্রিয় ক্রিকেটার এসব নিয়ে গল্প করতে করতেই চলে এলাম পুরাতন ভূষির বন্দর। বাজার পেরিয়ে অল্প এগুতেই এক ছাপড়া দোকানের দোকানি নাম-ঠিকুজি জিজ্ঞেস করতে করতে দু’কাপ চা পান করাল। রাণীর বন্দর বাজার ছাড়িয়ে যেতেই হাইওয়ে পুলিশের একটা গাড়ী ঘিরে বেশ কোলাহল। এক গাদা পুলিশ গাড়ী থেকে নেমে ধুপধাপ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার তার কেটে দিল। এই মহাসড়কে সম্ভবত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিষিদ্ধ। ছলছল চোখে কাটা তারের দিকে চালকদের দৃষ্টি চোখ এড়াল না।
একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এইদিকের মোটামুটি সব বাজারের নামের শেষেই আছে বন্দর। দেশের আর কোন জায়গায় এত বন্দর আছে কিনা কে জানে। বেকিপুল, চম্পাতলী হয়ে ফতেজংপুরের কাছেই পড়ল বিশাল এক কারখানা। শ্রমিকদের ভিড় আশেপাশের এলাকাজুড়ে। পাশেই উচ্চেঃস্বরে গান বাজনা শুনে সেদিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম রক্তদান শিবির চলছে। এরকম গান বাজিয়ে রক্তদান শিবির এবারই প্রথম দেখলাম।
আজকের রাস্তায় ছায়া কম। তাও অল্প যে ক’টা গাছ আছে, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউক্যালিপটাস গাছ। সোনাপুকুর নামক বাজারে এসে ঢুকে পড়লাম পার্বতীপুর উপজেলায়। রাবেয়া বাসস্ট্যান্ড পেছনে ফেলে কুন্দল থেকে শুরু নীলফামারী জেলা। দুই জেলাকে পৃথক করেছে খড়খড়িয়া নামক একটা নদী। ফোনে কথা বলছিলাম দেখে বেশ কিছুক্ষণ ম্যাপে চোখ রাখা হয়নি। এর মাশুল দিতে হল একটু পর। সৈয়দপুরের মূল শহরের রাস্তা না ধরে আমি বাইপাস রোড ধরে নিয়েছিলাম। প্রায় কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে ম্যাপে চোখ পড়তেই মাথা খারাপ হবার জোগাড়। ওই দুই কিলোমিটার ওই তীব্র রোদে চরম পরীক্ষা নিল।
আকাশে উড়োজাহাজ এত নিচু দিয়ে উড়ে যেতে দেখে ধরে নিলাম সৈয়দপুর সন্নিকটে। মূল শহরে ঢুকতেই পড়ল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দেশের অন্যান্য জায়গার স্বাস্থ্য কম্পলেক্সগুলো যেখানে অধিকাংশই পঞ্চাশ বেডের, সেখানে এই হাসপাতাল ১০০ বেড বিশিষ্ট। এক মসজিদের পাশেই অপেক্ষারত ছিলেন সাজিদ ভাই। উনি ধরে নিয়ে গিয়ে লাচ্ছি খাওয়ালেন। তাঁর ধারণা ছিল,এখানেই আজকের মত আমার যাত্রার পরিসমাপ্তি। সৈয়দপুর ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর এগুনোর পরিকল্পনা শুনে উনিই বললেন চিকলী বাজার পর্যন্ত যেতে। ওখানে হাঁটা শেষ করে ফোন দিতে বললেন। উনিই ওখান থেকে আবার সৈয়দপুর নিয়ে আসবেন।
আবার হাঁটা শুরু করতেই সৈয়দপুরের বিশালতা দেখছিলাম। একে উপজেলা শহর মানতেই কষ্ট হচ্ছিল। এমাথা থেকে ওমাথা কমসে কম তিন কি. মি.। মূল শহর পেরিয়ে বাঙ্গালীপুর নামক জায়গা পেরিয়ে হাতের ডান দিকের একটা রাস্তা ঢুকে গেছে পার্বতীপুর উপজেলার দিকে। আর কামারপুকুরে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিশাল ভবন পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আইসঢাল নামক জায়গায়। আর খানিকটা এগিয়েই চিকলী বাজার।
এখানেই আজকের মতো যখন শেষ পদক্ষেপ্টা ফেললাম, মোবাইলের এপ জানান দিচ্ছে আজ পাড়ি দিয়েছি সাড়ে ৩৪ কিলোমিটার পথ। এইখানেই আছে চিকলী সেতু। সেতুর ওপারেই শুরু রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা। কাল শুরু করব এখান থেকেই। সেতু লাগোয়া একটা টংয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফোন দিলাম সাজিদ ভাইকে৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি আসতেই বাইকে চেপে সৈয়দপুরের দিকে যাত্রা। আজ সাজিদ ভাইয়ের সৈয়দপুরের বাড়িতেই থাকা হবে। যে রাস্তা আমি দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে হেঁটে এসেছি,সে রাস্তা দিয়ে ফিরতে সময় লাগল পাক্কা ৯ মিনিট!
সৈয়দপুর শহরে আসতেই দেখা হল সাজিদ ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে। মামুন ভাই,আব্দুল্লাহ ভাই সবাই দিলখোলা মানুষ। উনারা সবাই ব্লাড ডোনেট ফাউন্ডেশন নামক গ্রুপের মেম্বার। চা-পুরির ফাঁকে ফাঁকে গল্প হল অনেক। সৈয়দপুর শহরে বাংলার পাশাপাশি সব জায়গায় উর্দু চলে। মোটামুটি সবাই দুই ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। উনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাতাসে কাবাবের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতেই সাজিদ ভাইয়ের বাড়িতে আসতেই পরিচয় হল শুভ ভাইয়ের সাথে। সম্পর্কে সাজিদ ভাইয়ের ভাতিজা উনি। চাকুরী করেন কক্সবাজারের উখিয়ায়। কথায় কথায় বেরিয়ে এল উখিয়ার গরুবাজারে যে বিল্ডিংয়ে উনি থাকেন,সেই বিল্ডিংয়ে আমার নিত্য আনাগোনা ছিল। গল্পের ঝুলি খুলে বসলাম দুজন। একটু পরে সাজিদ ভাইয়ের বাইকে চেপে তিনজনে খেতে গেলাম খোরাক নামক রেস্তোরাঁয়।
তারপর ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ হয়ে যখন বাড়ি ফিরছি, সৈয়দপুরের আকাশ তখন ছেয়ে গেছে দীপাবলির আতশবাজির রোশনাইতে। এক জায়গায় থেমে কিছুক্ষণ সেটাই উপভোগ করে বাড়ি ফিরে তখনো কানে বাজছে বাজারে এক বুড়োর মুখে শোনা – ‘জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়’।
#পায়ে_পায়ে_৬৪_জেলা