সাইংপ্রা (১ম পর্ব)
কয়েক মাস আগে নাম অব্দি না জানা এই অদেখা ভয়ংকর সৌন্দর্য্যের গল্পটার শুরু করেছিলেন পলাশ ভাই!
আমার দেখা একজন অন্যতম অসাধারণ ট্রেকার!
বেশ কিছু ট্যুর একসাথে করেছি আমরা। সেই সুবাধে আমি উনার পারদর্শিতার সাক্ষী।
গল্পচ্ছলে একবার বলেছিলেন উনার স্বপ্ন সাইংপ্রার কথা! ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন একবার সাইংপ্রা যেতে গিয়ে। ফ্লাশ ফ্লাডে পরে কোনোমতে জান নিয়ে ফেরত এসেছিলেন। আর বলেছেন কতখানি বুনো আর ভয়ংকর সৌন্দর্য্যে ঘেরা এই ট্রেইল!!
তারপর সাইংপ্রা নিয়ে হালকা ঘাটাঘাটি করে আর অদ্রির পোস্ট পড়ে জানতে পারলাম সাইংপ্রার নির্মম রহস্যে ঘেরা ভয়ংকরুপী বুনো সৌন্দর্য্যের কথা! জানতে পারলাম এখনো অব্দি মাত্র ৭/৮ টা টিম (সম্ভবত) সাইংপ্রা গেছে।
তাতেই বুঝে নিয়েছিলাম এরকম একটা ভার্জিন ট্রেইল কতোখানি রুপ আর অহমিকা তার গর্ভে ধারণ করে বসে আছে!
Ayub Ali ছেলেটাকে আমার বনমানব মনে হয়!
আরও মনে হয় বিধাতা তাকে ভুলে এই লোকালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। রক ক্লাইম্বিং করে, ট্রেনিং ও নিয়েছে বেশ কিছু, স্বপ্ন তার মাউন্টেন এভারেস্ট!
শুধু স্বপ্ন দেখো বসে থাকার লোকদের দলে সে পড়ে না।
সম্ভবত পাহাড়ে ঘুরাঘুরি তার জীবনের একমাত্র ইচ্ছা আর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
শুনলাম কদিন আগে তারা তিনজন সাইংপ্রা গেছে!
শুনতেই প্রথমে কানে বাজলো সাইংপ্রা!
সেই রহস্যে ঘেরা সাইংপ্রা!
নিষিদ্ধ আর দূর্লভ্য বস্তুর প্রতিই বরাবর আকর্ষণ বেশি, আর সেই মানবধর্মের বাইরে আমি ও পড়ি না!
গায়ের জোর কতোখানি জানিনা তবে মনের জোরের তাগিদে মনটা বেঁকে বসলো সাইংপ্রা যাবো!
আলীকে বললাম চলো সাইংপ্রা যাই, ৪/৫ জন হলেই এনাফ, আলী, যে কিনা আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং ভরসার বন্ধু, সে আমাকে বলে বসলো আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো সমস্যা নেই, তবে মনে রেখো তুমি এক প্রকার জীবনের রিস্ক নিয়ে সেখানে যাবে। বুনো পাহাড়ি রাস্তায় বিভিন্নরকম বিপদের কথা বাদ দিলাম, সেখানে ভালুক আছে!
আর আমরা কিন্তু সাইংপ্রা ক্যাম্পিং করবো!
শুনতেই প্রথমে একটা মনে না জানা ভয় চেপে বসলো। কঠিন পাহাড়ি রাস্তা, বিশাল বিশাল বোল্ডারওয়ালা পিচ্ছিল দীর্ঘঝিরিপথ, নানান রকমের এক্সিডেন্টের ঝুঁকি সাথে বোনাস হিসেবে ভাল্লুক আর ফ্লাশফ্লাডের ভয় তো আছেই!
নাহ্, আর যাহোক সাইংপ্রা আমাকে দিয়ে সম্ভব না!
কিন্তু, এবার যদি সাইংপ্রা মিস করি সম্ভবত আর কখনো সুযোগ না ও হয়ে উঠতে পারে প্রকৃতির এই রুপের দেখা মিলবার।
আমার এই পাহাড়ি ভবঘুরে জীবন আমি বেছে নিয়েছি, কারণ পাহাড় আমাকে যতটা না আনন্দ দেয় তার চেয়ে বেশি মানসিক শান্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়!
মনস্থির করলাম,পাহাড় নিয়ে নিজের মনের কোণের বাড়ন্ত ভয়টুকু দপ করে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য হলে ও সাইংপ্রা যাবো। ডিসিশন ফাইনাল করে সম্ভাব্য ডেট ঠিক করলাম যাত্রার।
আমাদের সাথে যোগদান করলো Tahmid Al Masum ভাই, Debashis ভাই, Arif ভাই।
যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে এবং বাকি টিম কে সাপোর্ট করে যাওয়ার মত অদম্য মনোবল শক্তিতে ভরপুর তিনজন ব্যক্তিত্ব, এবং অবশ্যই ভ্রমণপীয়াসু ট্রেকার হিসেবে ও তাদের জায়গা উপরের দিকে!
নিলয় ভাইয়া!
যে কিনা প্ল্যানের শুরু থেকে আমাদের সাথে ছিলো, আর যে যাবে বলেই সাইংপ্রা যাওয়ার দুঃসাহস করে বসেছিলাম আমি (নিঃসন্দেহে যে কোন ছোট বোনের কাছে তার বড় ভাই যে কোন কঠিন পরিরিস্থিতে ও সর্বোচ্চ ভরসার জায়গা)।
বোনাস হিসেবে জয়েন করলো আরো তিনজন!
ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স (Vertical dreamers) এর মতো মাউন্টেরিং ক্লাবের দুজন এক্সপেরিয়েন্সড মেম্বার্স, একজন অদম্য সলো ট্রাভেলার, একজন প্রাণবন্ত তরুণ সাইকেলিস্ট আর জিডিএমের কজন এক্সপেরিয়েন্সড মেম্বার আর আমার মতো একজন আনাড়ি ট্রাভেলার সমেত আমাদের দশজনের একটা টিম আলীর এর সার্বিক নেতৃত্বে রেডি হলো অদেখা সৌন্দর্য্য কে ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নপথে যাত্রা দিতে!
উদ্দেশ্য রুংরাং, ক্রিসতং এবং সাইংপ্রা।
ক্রিসতং বাংলাদেদেশের সেকেন্ড মুস্ট প্রমিনেন্ট পিক। চিম্বুক রেঞ্জের সর্বোচ্চ উচ্চতার পাহাড় ক্রিসতং উচ্চতার দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য পাহাড় থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলে ও একে আলাদা করা যায় এর অনন্য গাঠনিক বৈশিষ্ট, চারপাশে পাথুরে দেওয়াল এবং চূড়ার উপরের দৃশ্যে!
রুংরাং (ধনেশ পাখির পাহাড়) অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যের রুংরাং ও আমাদের গন্তব্যে ছিলো!
নির্ধারিত দিনে যাত্রা শুরু, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আলীকদম পৌছে নাশতা সেরে বাইকে চেপে ২১ কিলো পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম দুপুর দেড়টার দিকে। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা ধরে প্রকৃতি ও জোঁকের কামড় অনুভব করতে করতে হেঁটেছি ঘন্টার পর ঘন্টা!
সাথে গাইড না থাকায় সমস্যা ও হয়েছে খানিকটা! একবার তো রাস্তা ও হারিয়েছি! তবু ও মুটামুটি ক্লান্তভাবে সন্ধ্যা ৭.৩০ নাগাদ আমরা মুরং আদিবাসীর একটা পাড়ায় পৌছাই!
সন্ধ্যায় রাস্তা হারানোর পর ভেবেছিলাম আজ বুঝি আর পাড়ার সন্ধান পাবো না, হতাশ ও ক্লান্ত ছিলাম বেশ অনেকটা!
পাড়ায় পৌছে পাড়ার পাশে একটা ছোট ঝিরিতে গোসল সেরে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে মাচাং এ ফিরে এসে আলীর রান্না করা খিচুড়ি তে পেট পূজা সারলাম।।
সবার ঘুম দরকার!
কালকের দিনটা কঠিন হবে, ভীষণ কঠিন হবে!
কারণ কালকের গন্তব্য বুনো ক্রিসতং সামিট করা এর হিংস্র সাইংপ্রাতে পা রাখা!
পাহাড়ি গাইড দাদা বললেন উনার ই ক্রিসতং যেতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘন্টা, আর সাইংপ্রা যেতে ৩ ঘন্টা!
রাস্তা ও বেশ কঠিন।
পাহাড়ের লোক যখন বললো রাস্তা বেশ কঠিন তাতে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের যা বুঝার বুঝে নিয়েছিলাম।
ভয় আর ক্লান্তি ভর করা চোখজুড়াতে ঘুম নেমে আসতে আমার সময় লাগে নি একটু ও!
এখন শুধু অপেক্ষা কাল সকালের!…
লিখা ও ছবিঃ আফরিন সানজিদ
চলবে…