লোকে বলে পাহাড় নাকি মানুষকে হাতছানি দিয়ে তার পানে যাওয়ার জন্য ডাকে। যার জন্য শত কষ্ট হবে জানা সত্ত্বেও মানুষ পাহাড়ে ছুটে যায়।
নইলে ঘুম, খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে কেন মানুষ পাহাড়ে যাবে? পাহাড়ে এতো হাঁটাহাঁটি করে কী মজা পাওয়া যায়? অনেকের কাছেই এটা এক বিরাট প্রশ্ন! কিছু তো একটা অবশ্যই পাহাড়ে আছে যার দরুণ মানুষ পাহাড়ে বারবার ছুটে যায়!
“ক্রিসতং” এ বেশ ক‘বছর ধরে যাবো যাবো করেও যাওয়া হচ্ছিলো না। এই নামটা যখন প্রথম শুনি তখনি মনে গেঁথে গিয়েছিলো।
একচুয়েলি, প্রথম যাবার প্ল্যান ছিলো ২ রা ফেব্রুয়ারিতে। ঐদিনের যাবার প্ল্যান ভেস্তে যাওয়ায় পরে ঠিক করি ১৬ ই ফেব্রুয়ারী যাবো। টানা ৩ দিন বন্ধ আছে। ইজিলি কাভার করা যাবে। সেই মোতাবেক Apu Nazrul ভাইয়ের সাথে কথা বলে তারিখ ফিক্স করলাম।
১৬ তারিখ যত সামনে আসে ততই ভয় কাজ করতে থাকলো। ছুটি যদি না পাই! তাইলে তো শেষ! নিজেও বুঝতে পারছিলাম এবার ক্রিসতং না যেতে পারলে সহসা যাওয়া হবে না। তাই যেভাবেই হোক ছুটি ম্যানেজ করতে হবে।
অবশেষে সোমবার মৌখিক ছুটি ম্যানেজ করা গেলো। ঐদিকে বন্ধু MD Rashel Siddiqui তার আগের সপ্তাহেই ইনবক্স গুঁতা দিয়েছিলো যাবো কিনা তা কনফার্ম তাকে জানাতে। তাহলে সেও ছুটি নিবে। আমার ছুটি কনফার্ম হবার সাথে সাথে তাকে জানিয়ে দিলাম বন্ধু এইবার তুই ব্যাকপ্যাক গোছাতে পারিস।
পাহাড়ে যাবার নিয়ত করা মানেই ভিতরে ভিতরে বিশাল একটা এক্সসাইটমেন্ট কাজ করে। প্রচুর হাঁটাহাঁটি করা লাগবে। এমনিতেই আমার হাঁটার অভ্যাস কম। ইদানিং সাইক্লিং করারও সময় পাচ্ছি না। একটু শারীরিক প্রিপারেশান লাগেই নইলে পাহাড়ে সমস্যা ভুগতে হয়। এমনিতেই ওজন বেড়ে গেছে। ওভার ওয়েট আছি। আগেরবার যখন অমিয়াখুম গিয়েছিলাম তখন ট্রেকিং করতে খুব একটা বেগ পোহাতে হয় নি হাইটফোবিয়ার প্যানিক টা ছাড়া।
কনফিডেন্স ছিলাম এবারো ঠিকটাক পেরে যাবো। যদিও ক্রিসতং–রুংরাং এর ট্রেকিং করা অমিয়াখুমের চেয়েও অনেক বেশী কঠিন এবং ট্রেইলও বেশ বড়। সবচেয়ে বড় কথা এই ট্রেইলে পানির বেশ সংকট! প্রথম দিন ট্রেকিং এর শেষ ঘন্টা পানি নিয়ে বেশ মজার একটা কান্ড হয়েছিলো!
ট্যুর মেম্বার শুরুতে ছিলাম ৭ জন। এর মধ্যে আমি আর শাকিল ভাই ছাড়া বাকী সবাই ঢাকা থেকে রওনা দিবে। চাঁদপুর থেকে রাত ৯ টার বাসে করে কুমিল্লা বিশ্বরোড এসে রাত ১১ টায় নামলাম। ওদিকে ঢাকার বাস তখনো কাঁচপুর ব্রিজও পার হয় নি অথচ বাস ছাড়ছে সোয়া ১০ টায় ফকিরাপুল থেকে। একে তো বৃহস্পতিবার তার উপর টানা ৩ দিন সরকারি বন্ধ।
নুরজাহান হোটেলে বসে অবসর সময় পার করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। অপেক্ষা করাটা আমার খুবই অপছন্দের একটা কাজ। রাত ১ টার কিছু পর বাস আসলো। গন্তব্য চকোরিয়া। ঘুম যাওয়াটা মাঝে মাঝে বেশ কষ্টের পর্যায়ে পরে যায়। যদি সেটা হয় বাসে! রাস্তার জ্যাম, এক্সিডেন্ট সবকিছু মিলিয়ে চকোরিয়া পৌঁছাতে একটু দেরী হলো। চকোরিয়া পৌঁছে প্রথমে হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সারলাম।
হোটেলের নামটা বেশ অদ্ভুত ছিলো! বীর বাঙ্গালী!
চকোরিয়া নেমেই অপু নজরুল ভাই আলিকদমের বাস টিকেট কেটে ফেলেছিলেন। নাস্তা শেষ পর্যায়ে বাস কণ্ডাক্টার এসে তাড়া দিচ্ছিলো বাস ফুল হয়ে গিয়েছে এখনি তারা ছেড়ে যাবে।
বাসে উঠে পরলাম আরেক ঝামেলায়! আমরা টিকেট কেটেছিলাম সামনের সিটে। উঠে দেখি বাস কন্ডাক্টার আরেকটা ট্রাভেল গ্রুপকে সামনে বসিয়ে দিয়েছে। যাই হোক, পরে আমরা নিজেদের মধ্যে মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে সেই ঝামেলা সলভড করি!
চকোরিয়া থেকে আলিকদমের দিকে যাবার রাস্তাটাও বেশ সুন্দর। লামা থেকে শাকিল ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলো। আলিকদম পৌঁছাতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগলো।
আলিকদম পৌঁছে প্রথম কাজ হলো চান্দের গাড়ীতে করে ২১ কিলো যাওয়া। সেখান থেকে আমাদের ট্রেকিং শুরু। আলিকদম যাবার পর সেখানে দেখি ভার্টিক্যাল ড্রিমারের আয়োজনে ম্যারাথন হচ্ছে। মজার বিষয় হচ্ছে সেখানে দুইজন পূর্ব পরিচিত মানুষের সাথে বহু বছর পর দেখা হলো।
ওমর আর রাফি। ওমর বন্ধু কাউসারের কাজিন। সে ভার্টিক্যাল ড্রিমারের সদস্য এবং ম্যারাথনে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছে। আর রাফি রানার হিসেবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। রাফির সাথে সেই ২০১৬ এর পর প্রথম দেখা। তিনাপ সাইতারে একসাথে গিয়েছিলাম আমরা। রাফি বড় মাপের ট্রেকার। মাল্টি ট্যালেন্টেড ছেলে। সে এখন সাদা পাহাড়ে ট্রেকিং করে বেড়ায়।
অপু নজরুল লোকটার সাথে মনে হয় বান্দরবানের সবারেই পরিচয় আছে। আলিকদমের অলিগলিতে তার পরিচিতদের ঠেলায় আমাদের রওনা দিতে দেরী হচ্ছিলো। একটু পর পরেই বিভিন্ন জন এসে তার সাথে কথা বলছে।
আলিকদমে বেশ মজার একটা ঘটনা ঘটেছে।
অপু নজরুল ভাই জানালো ম্যারাথনের একজন পার্টিসিপেন্ট নাকি আমাদের সাথে ক্রিসতং যাবে! উনি ১২ কিলো থেকে আমাদের সাথে এড হবে। মানুষের কী এনার্জি রে ভাই! এই গরমে পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করে আবার ৩ দিনের ট্রেকিং করতে যাবে! শুনে চোখ কপালে উঠে যাবার জোগাড়! ১২ কিলো থেকে উনি আমাদের সাথে যোগ দিলো। আমার শহর চাঁদপুরের মানুষ। পাপ্পু দিদি! পুরা ট্যুরে এই মানুষটার ঝাড়ি খায় নাই এমন একজনও ছিলো না! সবচাইতে বেশি ঝাড়ি খেয়েছে “গ্রেট আসিফ ভাই“!!
২১ কিলো থেকে আমরা ট্রেকিং যখন শুরু করি সূর্য তখন মাথার ঠিক উপরে। ঘড়িতে ১২ টা বাজে। প্রায় ১ বছর পর ট্রেকিং করতে যাচ্ছি। শুরুতে কিছুটা অস্বস্তি লাগছিলো। তার উপর কাঁধে বেশ ভারী ব্যাকপ্যাক! সাথে দুই লিটার পানির বোতল। এটা নিয়ে পুরো পথ ট্রেকিং করতে হবে। ঐদিকে রাসেলের নাকি পোর্টার লাগবে। কিন্তু এই ট্রেকে পোর্টার পাওয়া কঠিন।
১ম দিন আমাদের গন্তব্য খ্যামচং পাড়া। এটি মুরং পাড়া।
শুরুতে বেশ খানিকটা পথ ইটের সলিং করা রাস্তা। এই পথের সবচাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে পানির সংকট। কোন ঝিরি এই পথে পরবে না। পানি খুব হিসেব করে খেতে হবে।
পুরো পথে আমরা প্রায় ২৫/৩০ টা পাহাড় উঠানামা করেছি। একবার উঠা তো আবার নামা। চোখ দিয়ে যা দেখা যায় তা কখনোই লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। এটা আমি বিলিভ করি। পথ টা অদ্ভুত রকমের সুন্দর ছিলো। ভাষায় প্রকাশ করা আমার জন্য অনেক কঠিন। এক সপ্তাহ পর সেই পথের কথা লিখতে বসে আবেগতাড়িত হচ্ছি না বললে মিথ্যা বলা হবে। মনে চাচ্ছে সেই বুনো পথ ধরে আবার হেঁটে চলি।
পাহাড় ভীষণ অদ্ভুত। সত্যিই অনেক অদ্ভুত! যে পাহাডের পথ মাড়ায় নি সে বুঝবে না পাহাড়ের পথেরও একটা ভাষা আছে, সুর আছে।
ট্রেকিং এর শুরুতেই ক্রিসতং, রুংরাং এর চূড়া দেখা যাচ্ছিলো। ক্রিসতং হচ্ছে চিম্বুক রেঞ্জের সর্বোচ্চ চূড়া। প্রায় ২৯০০ ফুট উঁচু। রুংরাং এর উচ্চতা ২৫০০ ফুটের আশেপাশে। যদিও আমাদের উদ্দেশ্য চূড়ায় সামিট করা না। বন ঘুরে দেখবো, বনে ল্যাটাবো এটাই ছিলো আসল উদ্দেশ্য।
কিছুদূর যাবার পর ঐ দূরে তিন্দু, সাঙ্গু, বড় পাথর দেখা যাচ্ছিলো। বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম। “তিন্দু” কে বলা হয় বাংলার ভূ–স্বর্গ। তিন্দু আসলেই অনেক সুন্দর। তিন্দুর সকাল আমার ভীষণ রকমের প্রিয়।
অপু নজরুল ভাই পথে বিভিন্ন পাহাড়ী ফুল দেখাচ্ছিলেন। এই লোকটার পাহাড়, ফুল, গাছ নিয়ে বেশ ভালো জ্ঞান আছে। উনার সাথে ঘুরলে অনেক কিছুর সম্পর্কেই জানা যায়। লোকটা একটা “চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া“! পথে একটা জায়গায় এসে পরলাম যার দুপাশে বিশাল বড় বড় পাহাড়ী ঘাস। “গ্রেট আসিফ ভাই” এটাকে কোরিয়ান কি জানি একটা বলেন! এটা উনার নিজস্ব সংঙ্গা মেইবি!
এক পর্যায়ে পথ দুদিকে চলে গেছে। বামে ইটের সলিং ধরে গেলে তিন্দু বাজার পর্যন্ত যাওয়া যায়। আজকাল বাইকাররা অহরহ এই পথে তিন্দু যায়। তিন্দুতে এখন এ পথ দিয়ে বিদ্যুৎও চলে গেছে। আরেকটা পথ ডানদিক দিয়ে খ্যামচং পাড়ায় চলে গেছে। আমরা দ্বিতীয় পথেই যাবো। এখান থেকেই মাটির রাস্তা শুরু।
অপু নজরুল ভাই আর আসিফ ভাই ছাড়া এই রুট সবার জন্যেই নতুন। আসিফ ভাই গত বর্ষায় এসেছিলেন অপু নজরুল ভাইয়ের সাথেই। আছাড় খেতে খেতে খ্যামচং পাড়ায় গিয়েছিলেন। উনার মুখেই সেসব বর্ণনা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবার অবস্থা খেয়েছিলো। গতবারের চ্যালেঞ্জ নিতে এবার এসেছেন।
আমরা শুরুতে বেশ বিশ্রাম নিতে নিতে যাচ্ছিলাম। এতো প্যারা নাই। পাড়ায় রাত ৮/৯ টায় গেলেই হবে। পথে খুব সুন্দর একটা জুম ঘর পরলো৷ সাথে হাড়িপাতিল কিছুই নাই। রান্না করবো কিভাবে এই ভেবে জুমঘরে রাত কাটানোর প্ল্যান বাদ দিতে হলো। যদিও আমাদের সাথে রান্নার সব রসদেই ছিলো।
পথ চলা আবার শুরু। চারপাশে তাকাতে তাকাতে ধীরলয়ে এগোতে থাকলাম। পথিপধ্যে বেশ কিছু উঁচু গাছ পরলো। পাখিদের গান তো আছেই। হিমন দাদা ডিএসএলআর নিয়ে আসছে। পাহাড়ে পাখির ছবি তুলবে বলে। উনাকে খুব হতাশ দেখলাম ক‘বার! হাঁটতে হাঁটতে একটা ঘরের মতো পেলাম। শুরু হলো আবার ল্যাটানী। শুয়ে, বসে, চিতকাত হয়ে যে যেভাবে পারলো সেভাবেই ল্যাটাইলো। কেউ আবার ভাতঘুম দিয়ে দিলো!
ল্যাটানি শেষে আবার উঠলাম। এবার বেশ খানিকটা খাঁড়া পাহাড় বেয়ে উঠে গেলাম। উঠতেই হঠাৎ হাতে বামশাশের ঝোপে খসখসানি শব্দ কানে আসলো। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম মানুষ। কয়েকবার হাঁকডাক দিলাম। কোনো সাড়াশব্দ আসলো না।
অমিক বারবার বলতেছিলো ভাল্লুক হবে। তার নাকি খুব ভাল্লুক দেখার শখ। আমি আর অপু নজরুল ভাই তাকে বারবার বোঝাচ্ছিলাম ভাল্লুক সামনাসামনি অনেক ভয়ংকর! কে শোনে কার কথা। অমিকের এক কথা সে ভাল্লুক দেখতে চায়! অপু ভাই তাকে বললো এক পাহাড়ী ছেলে ভাল্লুকের আক্রমণে এখানে মারা গিয়েছিলো।
যাই হোক ভাল্লুক, মানুষ কিছুই চোখে পরলো না। হয়তো গয়াল টয়াল হবে! পথের এ জায়গাটা বেশ ভালো লাগছিলো। শেষ বিকেলে বাতাস পাহাড়ে উপরের গাছের পাতাগুলোকে প্রাণোচ্ছল্লাসে ভরিয়ে দিচ্ছিলো। পাতাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিলো তারা খুশিতে দোল খাচ্ছে।
ঐদিকে পাপ্পু দিদিকে খুঁজে পাচ্ছি না। কিঞ্চিৎ টেনশন হতে লাগলো। কারণ একটু পর সন্ধ্যা নামবে। উনার কাছে লাইট নেই তাছাড়া রাতে পাহাড়ে একা ট্রেকিং করা একদমেই উচিত না। এ পথে ভাল্লুকের ভয় আছে। ভাত ঘুম দেয়ার পর থেকেই উনি কেমন যেনো চাঙ্গা হয়ে গিয়েছেন। হাতে ব্যাগ দুইটা নিয়ে সবার আগে আগে হেঁটে চলে গেছেন। উনার এমন কাজে টিম লিডার খানিকটা বিরক্ত!
লাল সূর্যটা পাহাড়ে কোলে ঘুমিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সমুদ্রের বুকে সূর্য ডুব দেয়া আর পাহাড়ে সূর্যের ঘুম দুইটা পুরোই আলাদা লাগে। কোনটা বেশী সুন্দর সে তুলনায় যাবো না। সুন্দরের মধ্যে তুলনা করাটা ঠিক মনে হয় না কারণ প্রতিটি সুন্দর জিনিসের নিজস্ব স্বকীয়তা থাকে যার রং, রুপ, দর্শন একদমেই আলাদা।
পাপ্পু দিদির দেখা অবশেষে পেলাম। উনি নাকি ২০/৩০ মিনিট ধরে এক জায়গাতেই বসে আছেন। উনার ভাষ্যমতে পাহাড়ের নাকি আত্মা আছে। উনি সেই আত্মার সাথে বসে বসে কথা বলেছেন!
এবার অন্ধকারে পথ চলা শুরু। ব্যাগ থেকে আগেই হেডল্যাম্প বের করে রেখেছিলাম। রাতে ট্রেকিং এর আলাদা মজা আছে আবার প্যারাও আছে। মজাটা হচ্ছে রাতে হালকা ঠান্ডা লাগে খুব একটা ঘামায় না পানি তৃষ্ণা তাই কম লাগে অন্যদিকে প্যারাটা হচ্ছে দ্রুত ট্রেক করা যায় না। খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়, চারপাশের দৃশ্য দেখা যায় না।
এই ট্রেকের মধ্যে বেশ কবার অপু নজরুল ভাই আর আসিফ ভাইয়ের মধ্যে পাড়ায় কখন পৌঁছাবো সেটা নিয়ে হালকা তর্ক হয়েছিলো। পথটা অনেক লম্বা ছিলো তাছাড়া প্রথম দিন ট্রেকিং এ একটু খারাপ লাগে। সবাই তাই বারবার জিজ্ঞেস করছিলো আর কতক্ষণ লাগবে খ্যামচং পাড়ায় যেতে। তো তখন অপু ভাই যে সময় বলে আসিফ তার চেয়ে আরো বাড়িয়ে বলেন। আসিফ ভাইয়ের মতে অপু ভাই সময় কম বলেন!
খ্যামচং পাড়ার গেটে চলে আসলাম। এর মধ্যে আসিফ ভাইয়ের উৎপাত শুরু। বেচারার কাছে যা পানি ছিলো তা শেষ। এখন উনি সবার কাছে পানি চেয়ে বেড়াচ্ছেন! উনার পানির চাওয়ার এক্সপ্রেশানটা বেশ মজার ছিলো। এই মানুষটা চলন্ত বিনোদন। তবে উনি মাল্টি ট্যালেন্ডেড লোক। পুরো ট্যুরে সবাইকে কি পরিমান যে বিনোদন দিয়েছেন বলে বুঝানো মুশকিল! ট্যুরে এমন মানুষ থাকলে সেই রকমের মজার হয়।
লাস্ট এক ঘন্টা পানির তেষ্টায় সবার অবস্থাই খারাপ। গলা শুকিয়ে চৈত্র মাস। মনে হচ্ছিলো কারবালার প্রান্তরে এসে পরেছি।
অপু ভাইয়ের কাছে আধা লিটার পানি ছিলো তাও শেষ। কারো কাছেই পানির নেই কিন্তু পাড়ায় পৌঁছাতে আরো ঘন্টা খানেক বাকী।
রাতে ঠিকঠাক ট্রেক করা যাচ্ছিলো না। এ পথটা সমান না। উঁচু নীচু পথ। তাও আবার পাহাড়ের ঢালের রাস্তা। ভুলভাল হলে নীচে পড়ার শংকা।
রাসেল, পাপ্পু দিদি সবার পিছনে। রাসেল দ্রুত ট্রেকিং করতে পারে না। তার নাকি সাফোকেশান হয় দ্রুত ট্রেকিং করলে। পাপ্পু দিদির চশমা ভেঙ্গে গেছে। তাই রাতে কিছু দেখতে পারছেন না ভালো করে। দুজনের কাছে লাইটও নেই। তাই শাকিল ভাই আর আমি তাদেরকে নিয়ে পিছনে বেশ আস্তে আস্তে হাঁটছি।
মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কখন পাড়ায় পৌঁছাবো। পানির তেষ্টায় মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। মন চাচ্ছিলো এক দৌড় দিয়ে পাড়ায় চলে যাই। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। ট্রেকিং এ টিম ওয়ার্ক খুব জরূরী। একজন সমস্যায় পরলে বাকীদের তাকে সাপোর্ট দিতে হয়।
আহ! অবশেষে খ্যামচং পাড়ার দেখা মিললো। পাড়ার ঘরের আলো দেখে কী যে খুশি হলাম! উফ!
কিন্তু কোন ঘরে আমরা উঠবো তা তো জানি না। আমরা ৪ জন সবার পিছনে ছিলাম। বাকীরা বেশ আগেই পাড়ায় চলে আসছে। অপু ভাইয়ের নাম ধরে কয়েকবার চিৎকার দিয়ে ডাক দিলাম কিন্তু সাড়াশব্দ মেলে না। মেজাজ পুরাই খারাপ হয়ে আছে। একে তো পানির তেষ্টায় পুরাই অবস্থা খারাপ তার উপর বাকীদের পাচ্ছি না।
খ্যামচং পাড়ার মানুষজন বাংলা বোঝে না তেমন বলতেও পারে না! পাড়ার এক ঘরে জিজ্ঞেস করলাম কারবারীর ঘর কোনটা! কথায় যতটুকু বুঝলাম আরো নীচে যেতে হবে। পাহাড়ের পাড়াগুলো সমতলের মতো না। পাহাড়ের ঢালে ঘরগুলো বানানো হয়।
অবশেষে কথাবার্তা আওয়াজ শুনে কারবারী ঘর চিনলাম। আহ! শান্তি!
পাড়ায় ঢুকলাম রাত সোয়া ৮ টা নাগাদ। অপু ভাই ট্রেকিং এর শুরুতেই বলেছিলো পাড়ায় আসতে ৮ টা বাজবে।
ঘরে ঢুকেই এক পেট পানি খেলাম। অপু ভাই আগেই এসে কলা রেডী করে রেখেছিলো। সাথে সাথে ৩ টা পেটে চালান করে দিলাম। পাহাড়ী কলা যারা খেয়েছে তারাই এর স্বাদ বুঝবে!
ব্যাগ খুলে যা দেখলাম তাতে কান্না হাসি এর মাঝামাঝি অবস্থায় পরে গেলাম। এক লিটার বোতলের অর্ধেক পরিমান পানি ব্যাগের সাইডের ম্যাশ পকেটে! ঐদিকে ট্রেকিং এর শেষ একটা ঘন্টা পানির জন্য কতই না হাহাকার করেছি!
এবার রান্নাবান্নার পালা। আইটেম জুমের চালের সবজি খিচুড়ি আর মুরগী। আরেক দল ঐদিন পাড়ায় আসছিলো। তাদের থেকে একটা মুরগী ধার নেয়া হলো। তাদেরকে ম্যানিয়াং পাড়ায় যেয়ে মুরগী কিনে দেয়া হবে এই শর্তে।
আসিফ ভাইয়ের ডাক শুনে বারান্দা যেয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। পুরো আকাশ ভর্তি তারা। উফ! কোন বিশেষণেই এই দৃশ্যকে আটকানো যাবে না। শুয়ে শুয়ে তারা দেখলাম কিছুক্ষণ।
ঠান্ডা লাগছিলো খুব তাই বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। নিজের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছিলো স্লিপিং ব্যাগ না নেয়ার জন্য। স্লিপিং ব্যাগ থাকলে সারারাত বারান্দাতেই শুয়ে আকাশে তারা দেখে কাটিয়ে দেয়া যেতো। এখানেই ঘুমানো যেতো! খুব মিস করলাম!
এক বুক আফসোস নিয়েই রান্নাবান্নার কাজে হাত লাগালাম। আম্মা আর উম্মে সারাহ যদি এই দৃশ্য দেখতো তাহলে আমার
খবরেই ছিলো। যে ছেলে বাসায় তেমন কিছু করে না সে কিনা পাহাড়ে রান্নার কাজে সাহায্য করছে!
রাত ১২ টায় রান্না শেষ হলো। এবার খাওয়া দাওয়ার পালা। খাবো কি ঘুমেই তো চোখ নিভু নিভু করছে। কোনো রকমে খেয়ে দিলাম এক ঘুম। শরীর খুব ক্লান্ত আজ।
পরের দিন ক্রিসতং এ যাবো। আমার বহুদিনের স্বপ্ন অবশেষে ধরা দিচ্ছে….একটি সুন্দর দিনের অপেক্ষা।
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
লিখাঃ Safa Uddin Ahmed