ধুপপানির পথে
পর্ব ১
গত বছরের জুলাই মাস। তখনো পর্যন্ত বিলাইছড়ির ধুপপানি ঝর্ণায় যাওয়া হয়ে উঠে নি৷ যদিও জ্যামিতিক হারে বেড়ে ওঠা অসংখ্য ট্রাভেল গ্রুপের কল্যাণে ধুপপানি গত কয়েকবছর ধরেই ট্যুরিস্টদের হটস্পট৷ দিনে কম করে হলেও ২০ থেকে ৩০ বার ধুপপানি ঝর্ণার ছবি ভিডিও চোখে পড়তো। যেমন করে গত কয়েকদিনে চায়নার একটা জল কটেজের ছবি এতোবার দেখেছি যে এখন দেখলে মনে হচ্ছে, ওহ আচ্ছা! এইটা! আমিতো অনেক বার গিয়েছি এখানে। সবই গ্রুপ গুলার কল্যাণ৷
তবে ফেইসবুকের ছবিতে বা ভিডিও তে যা পাওয়া যায় না, তা হলো যাত্রাপথ। দি জার্নি। আমার সাথে কেউ একমত হবে কিনা জানি না, তবে আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি যাত্রাপথে সবসময়ই মূল গন্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে৷ ধুপপানি ট্রিপের ক্ষেত্রে এই কথা আরো একটু বেশি খাটে।
আমরা ট্রাভেলার হিসেবে একটু ছন্নছাড়া। নির্দিষ্ট কোন ভ্রমণসঙ্গীর দল অতীতে থাকলেও বর্তমানে তেমন কেউ নেই । আবার ইভেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছে ধরা দিবো তেমন ও নই৷ কিছু দাদারা আছেন। সময় সুযোগ মিলে গেলে আমাদের সাথে জয়েন করেন।
আমরা দুজন ছাড়া সেবার আসিফ ভাই আকরাম ভাই আর জাকির ভাই ছিলো সাথে। আমরা তো বাজেট ট্রাভেলার। পাঁচজন নিয়ে ধুপপানি ট্রিপে যাওয়া মানে নৌকা ভাড়া অনেক বেশি পড়ে যাবে৷ তারপর আর কী? বাজেট ট্রাভেলারদের শেষ ভরসা টিওবি (ট্রাভেলার অব বাংলাদেশ)। টিওবি থেকে আমাদের সাথে যোগ দিলো তীর্থ দা আর সবার ছোট্টু ফারদিন। এই সাতজন মিলে সাতসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার ট্রিপটা আমাদের মনে রাখার মতই ভালো ছিলো।
কাপ্তাই ঘাট থেকে ট্রলারে উঠার পর থেকে পুরো দুইটা দিন শুধু জল আর জল। ণ কাটা, মুপ্পেছড়া কিংবা ধুপপানি ঝর্ণায় পৌঁছাতে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ জলপথ।
কী নেই এই পঁথে? কিছুদূর পর পরেই জলের রূপ ও পাল্টাতে থাকে। এই দুদিনে নৌকাপথের প্রতিটি মুহূর্তই উপভোগ করেছি আমি। এজন্যই বোধই বেদেনীদের আমার ছোটবেলা থেকেই হিংসে হয়৷ জলজ জগতের ঈশ্বরী ওরা।
কাপ্তাই লেকের সুবিস্তৃত্ব জলরাশির সাথে শরতী আকাশের মেলবন্ধন দেখতে দেখতে দুঘন্টার পঁথ পাড়ি দিয়ে আমরা বিলাইছড়ি পৌঁছাই।
আমরা অনেক দেরি করে রওনা দিয়েছিলাম কাপ্তাই থেকে যার জন্য বিলাইছড়ি পৌঁছাতেই দুপুর হয়ে গিয়েছিল।
যখন সবার ণকাটা, মুপ্পেছড়া দেখে ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছিলো, আমরা সপ্তরথী স্লোকোচ তখন দুপুরের খাবার শেষ করে হেলে দুলে রওনা দেওয়ার আয়োজন করছিলাম।
অবশ্য এটা আমাদের প্ল্যানিং এর মধ্যেই ছিলো যাতে করে ঝর্ণায় গিয়ে বিভিন্ন গ্রুপের ইভেন্ট থেকে যাওয়া অন্তত শ-কয়েক লোকের সাথে ধাক্কাধাক্কি করতে না হয়৷ আমাদের পরিকল্পনা সফল ও হয়েছিলো। বিকাল হয়ে আসাতে ঝর্ণা মোটামুটি টুরিস্ট শূন্যই পেয়েছিলাম।
ন-কাটার দিকে যাওয়ার সময় হৃদের জলের রূপটা আবার অন্যরকম। ঝিলের পানির মতো শান্ত, পাতা রঙা সবুজ জল৷ নরম হাওয়ার সাথে যার সখ্য৷
কিছুক্ষণ পর পর দুপাশে আদিবাসীদের জনপদ চোখে পড়ে। শেওড়া গাছের ছায়ায় ডিঙি নৌকায় বসে কোন এক জেলে মাছ ধরায় রত।
কোন এক কুড়ে ঘরের পাশেই কজন বাচ্ছা ছেলে মেয়ে স্নানের ছলে জলখেলায় উন্মত্ত। হাজার বছরের পরিচিত এসব দৃশ্য বিমুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে আমাদের নৌ পথ শেষ হয়৷
নৌকা থেকে নেমে ৪০/৪৫ মিনিটের হাঁটা পথ পেরুলেই নকাটা। আমরা প্রথমে মুপ্পেছড়াতে চলে যাই৷ সহজ ট্রেইল। তবে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর অনেক মানুষের হাঁটাহাঁটির কারণে কিছু জায়গা খুব পিচ্ছিল ছিলো৷
আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিলো ঝর্ণায় কাটানোর জন্য৷ যে যার খায়েশ মতো ঝর্ণায় গড়াগড়ি খাওয়ার সুযোগ ছিলো৷
বিশেষ করে জাকির আর আরমান সেই যে মুপ্পেছড়ার উপরে গিয়ে বসেছিলো, একেবারে শেষদিকে অনেক ডাকাডাকির পর তবে নেমে আসে। ততক্ষণে আমরা ফিরতি পথে রওনা দিয়েছি৷
নৌকায় উঠার আগে আদিবাসীদের পাড়া আছে৷ পাড়ার চায়ের দোকানগুলো দেখলাম যথেষ্ট জমজমাট৷ আমাদের ছোট্ট গাইডের টাকা চুকিয়ে হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা নৌকায় গিয়ে বসলাম।
গৌধুলির এই সময়টাতে ছাদবিহীন নৌকায় ভ্রমণ করা সবসময় লোভনীয়। যেন রাঙা আকাশে বিছিয়ে দেয়া জলপথ।
সেদিনের মতো সারাদিনের সারাংশে রাজ্যের প্রশান্তি নিয়ে আমরা ফিরছিলাম বিলাইছড়ির গন্তব্যে৷
চলবে…
লিখা ও ছবি: প্রিয়াংকা পিউ