ধুপপানির পথে
পাহাড়ের কৃষ্ণপক্ষ চেয়ে দেখেছেন কখনো? যারা পাহাড়ে যায় তারা জানে৷ পুর্ণিমার আকাশের চেয়েও যেন কোথাও একটু বেশি মোহনীয় পাহাড়ি আমবশ্যার রাতগুলো ৷ দূষণমুক্ত পরিবেশে তারায় ভরা রাতের আকাশ হয়ে উঠে ঝরা বকুলের উঠান৷
সেদিন সন্ধ্যার পর, এমনি এক আকাশের তলায় আমরা আড্ডায় গানে মেতে উঠেছিলাম। সারা দিনের ক্লান্তি কাটিয়ে নিজেদের রিচার্জ করে নেওয়ার আয়োজন।
বিলাইছড়ি বাজারে একেবারে শেষ দিকে অনেকখানি উচুতে আমাদের কটেজ। রিভার ভিউ ছিলো না। তবে কোলাহল মুক্ত সুনসান ছিলো। রাতের খাওয়ার আগে আমরা পুরো বাজারটাই ঘুরেফিরে দেখছিলাম। ৮/৯ টার মধ্যেই সব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
পরদিন ধুপপানি ঝর্ণায় ছবি তোলার জন্য মনে মনে একটি রংধনু ছাতার খোঁজ করছিলাম আমি। পেয়েও গিয়েছিলাম। তবে দামে না হওয়াতে আর কেনা হয় নি।
কথামতো পরের দিন ভোর বেলাতেই ইঞ্জিন নৌকা এসে হাজির৷ সকালের নাস্তা খিচুড়ি আর ডিম প্যাকেট করে নৌকাতেই দিয়ে দেওয়া হয়। জলে বসেই সকালের জল খাবার খাওয়াটাও ধুপপানি ট্রেকের একটা বোনাস।
দুইটা চেকপোস্ট পেরিয়ে প্রায় ২ ঘন্টা পর উলুছড়িতে পৌঁছায়৷ সকালের বাকি ঘুমটুকু এই দুই ঘন্টাতেই সেরে ফেলা যায়।
উলুছড়ি থেকে গাইড নিয়ে ডিঙি নৌকায় পাড়ি দিতে হয় বাকি জল পথ। ৩০/৩৫ মিনিটের মতো ডিঙি নৌকায় থাকতে হয়৷
এই টুকু পথ সৌন্দর্যের আঁধার যেন। বর্ষায় ডুবে যাওয়া হাওরের মতো ভিউ পাওয়া যায় এখানে। গাছগাছালির মধ্য দিয়ে শান্ত সবুজ জলে মাঝির বৈঠা চলে।
দুপাশে পাহাড়ের সারি চোখে পড়ে। নিজেদের কোলাহল থেকে বার হয়ে একটু চুপচাপ চারপাশে তাকালেই মনে হবে আপনি মানুষের পৃথিবী ছেড়ে ঠিক ঠিক কোন অলকায় চলে এসেছেন৷
নৌকা যেখানে নামিয়ে দে সেখান থেকেই ট্র্যাকিং শুরু৷ আমাদের দের ঘন্টার মতো লেগেছিল ধুপপানি পৌঁছাতে। কঠিন কিছু না৷ তবে কড়া রোদে তিনটে বড় পাহাড় পেরিয়ে হাঁপিয়ে উঠার মতো।
ধুপপানির সৌন্দর্য্য জগৎ বিদিত। এর সুবিশাল উচ্চতা দূর দূরান্ত থেকে সৌন্দর্য্য পিপাসুদের আকর্ষণ করে৷
তবে আমরা কিছুটা দমে গিয়েছিলাম পানির সল্পতা দেখে৷ তথাপি ঝর্ণার জল ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কিছুক্ষণ জলে ভেজার পর ক্লান্তি ছেড়ে শুধু শুদ্ধতা আর উচ্ছলতা বাকি থাকে।
ফেরার পথে প্রথম যে পাড়াটা পড়ে সেখানে এসে কাপড় চোপড় ছেড়ে বিশ্রাম করে নিচ্ছিলাম যে যার মতো৷ এক দিদির ঘরে দেখলাম বাঁশ কোড়লের খোসা পড়ে আছে৷
বাঁশ কোড়ল চট্টগ্রামবাসীদের প্রিয় খাবার৷ যদিও খুব দুর্লব এখন৷ পাহাড়ি দিদিদের রান্না চেকে দেখার লোভ সামাল দিতে পারলাম না। রান্নাঘরে গিয়ে উনাকে বলতেই হাসি হাসি মুখে এক টুকরো দিয়ে দিলেন। নাপ্পি দিয়ে বাঁশকোড়ল রান্না৷ নাপ্পি আমি আগে কখনো খায়নি৷ এই ট্যুরে সেই অভিজ্ঞতাও পেয়ে গেলাম।
নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই আমরা বিলাইছড়ি পৌঁছে যাই। যাওয়ার সময় রোদ ছিলো। ফেরার সময় বৃষ্টি। দেখলাম সেই বৃষ্টিতে ভিজেই স্কুল ছাত্ররা নৌকা চালিয়ে বাড়ি ফিরছে।
কত ভিন্ন এই জলের মানুষের জীবন। ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে এতোটা পথ নিজেরা নৌকা চালিয়ে স্কুলে যায়৷ আবার স্কুল থেকে ফিরে সেই নৌকাতেই চলে জীবিকার সন্ধান।
শরৎচন্দ্রের সেই পরিহাসের কথাটা মনে পড়ে যায়৷ দুইক্রোশ হেঁটে আসা ছাত্রদের মতো এদের দেখেও নিশ্চয় সরস্বতী লজ্জায় মুখ লুকাবেন। এরকম আরো কতো টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি নিয়ে আমরা কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই৷ প্রকৃতি সবসময় আমাদের দু হাত ভরে দিয়েই ফেরত পাঠায়।
লিখা ও ছবি: প্রিয়াংকা পিউ