এই বর্ষার শেষ বিকেলে সময় করে এসো-
এক জনমের জমানো ব্যথার সুর তুলেছি মনে,
তুমি এলে তার হিসেব নিয়ে বসবো-
মেলাবো সুর-তাল-লয়…!
বর্ষার এই শেষ বিকেলটায় তুমি এসো,
অতীত স্মৃতিগুলোয় ধুলো পড়ে আছে-
তোমার দেখা যদি এতটুকুও পাই,
ধুলো বালি ঝেড়ে মুছে সাজিয়ে নেবো নতুন করে।
এবারের বর্ষার শেষ বিকেলটায়-
আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
তুমি বলে গিয়েছিলে -যদি ফিরে আসি,
তোমায় নিয়ে যাবো সোনালী রোদ ঝরা সকালে যেখানে-
ভালোবাসারা প্রকৃতির সাথে খেলা করে।
আমি এই বর্ষায় অপেক্ষায় আছি
একগুচ্ছ কদম নয়–
এক মুঠো লাল রঙের কাঁচের চুড়ির-
তোমার হাতে পড়বো বলে,
আজো ভেঙে যাওয়া চুড়িগুলো খুলে ফেলিনি।
আমি অপেক্ষায় আছি–
এই বর্ষার শেষ বিকেলে তুমি ঠিকই আসবে,দেখবে–
সাজানো একটা সুখের স্বপ্ন বুনতে বুনতে,
ক্লান্ত শরীরটা ঠান্ডা হয়ে পড়ে আছে…!
কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ। জলবিদুৎ প্রকল্পের উদ্দেশ্যে তথকালিন পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়।
পানি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে স্থায়ী আধিবাসীরা তাদের বাড়ী-ঘর এবং চাষাবাদযোগ্য জমি হারিয়েছেন। চল্লিশ হাজারেরও অধিক চাকমা আদিবাসী সম্প্রদায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। জমি অধিগ্রহণের ফলে ঐ এলাকায় সৃষ্ট সংঘর্ষের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।এছাড়াও, এ বাঁধ নির্মাণজনিত কারণে জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। বন্যপ্রাণী এবং তাদের বসবাস উপযোগী আবাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শুধু তাই নয়, এর সাথে অনেক স্থানীয় ইতিহাসও জড়িয়ে রয়েছে | এর মধ্যে বর্তমানে পানির নীচে থাকা চাকমা রাকপ্রাসাদ ও বনভান্তের জন্ম, সাধনা, ধমীয় গুরু হয়ের উঠার পেছনের অনেক ইতিহাসও জড়িত | বলা হয়ে থাকে এই স্থানে উনি সাধনা করেছিলেন |
বনভান্ত ছিলেন বৌদ্ধদের একজন ধর্মগুরু। উনার জন্মস্থান মোরঘোনা নামক গ্রামটি বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধের ফলে প্রায় ৫০ ফুট পানির নীচে অবস্থান করছে । এলাকাবাসী সহযোগিতায় বনভান্তের জম্মস্থান সনাক্ত করে কিছুদিন আগে এই চূড়াটি নতুন ভাবে বানানো হয়। ধর্মীয় দিক থেকে এটী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র স্থান |
বনভান্তের স্মৃতিস্তম্ভ কাপ্তাই, ছবি – রাজীব দাশ
এটিতে মূলত কাপ্তাই বেরাইন্নে লেকশোর ক্যাফে থেকে কায়াক/ইঞ্জিল চালিত বোট নিয়ে বাম দিকে গেলে পাবেন। কায়াক করে যেতে আপনার সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট আর বোট করে গেলে ১০ মিনিট মত।
লেকটা খুবই সুন্দর। বর্তমানে আমাদের দেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে বিবেচিত | কিন্তু এর পেছনের গল্পটা হয়ত অনেকেই জানেন না| এটাই তুলে ধরার চেষ্টা করলাম ছোট পরিসরে |
বরাবরের মতই আমাকে সকালে কামরুল ভাই ঘুম থেকে জাগালেন৷ সকালে ভোরে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই পুরা এলাকা ঘুরে এসেছেন প্রায়৷ ঘুম থেকে জেগেই বোতল ভরা পানি নিয়ে আমি আর সিফাত ভাই জঙ্গলে মঙ্গল করতে দৌড় দিলাম৷ এখানে জঙ্গলই মঙ্গলের একমাত্র জায়গা৷ আর কোন উপায় নাই এছাড়া৷
জঙ্গল থেকে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিলাম৷ নানা এসে হাজির হলে, সুমি আপু নানাকে পাম দিয়ে সকালের রান্নার দায়িত্ব ধরায়ে দেন৷
নানা সকালের রান্না করছেন বসে বসে
নানার বেটা ফেঁসে গেল এই যাত্রায়৷ রান্না নানা করবে তাই কোন চিন্তা নাই, সবাই একসাথে ঘুরতে বের হলাম৷ আমি বরাবরের মতই লুঙ্গী পড়ে নিলাম, আমার দেখাদেখি বাকিরাও লুঙ্গী পড়ে নিল ফটাফট৷ তা দেখে সুমি আপুও শাড়ী পড়ে নিলেন একঘন্টা লাগায়ে৷
নারিকেল বাগানের শেষ প্রান্তে হ্যামকে দোলা
এই ফাঁকে আমি ক্যাম্প সাইটের পাশে আমার হ্যামক লাগিয়ে আরাম করে নিলাম কিছুক্ষন৷ সুমি আপু রেডি হয়ে আসতেই সবাই হ্যামকে ফটোশুট করে নিল৷ এরপর আমরা সবাই সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম৷
কুকরিমুকরি চরের নারিকেল বাগান এরিয়াটা বেশ কোলাহলপূর্ন৷ অন্যন্য চরের চাইতে এখানেই বেশিরভাগ টুরিষ্ট ঘুরতে আসে৷ যারা আসে মূলত ক্যাম্পিং করে একটা রাত থাকতেই এখানে আসে৷ এই এলাকার পরিবেশটা ক্যাম্পিং করার জন্য শতভাগ নিরাপদ৷
নারিকেল বাগানে আমাদের ক্যাম্প সাইট
গত রাতে রমিজ ভাই বলেছিলেন এলাকার চেয়ারম্যান খুব ভাল৷ উনি চেষ্টা করছেন জায়গাটাকে প্রথম সারির পর্যটন প্লেস বানানোর জন্য৷ সবাইকে সাথে নিয়ে উনি কাজটা বেশ ভালোই সামলে নিচ্ছেন বুঝতে পারলাম৷ টুরিস্টদের জন্য শৌচাগার নির্মান, থাকার জন্য হোটেল আর পানীয় জলের জন্য পর্যাপ্ত টিউবওয়েল নির্মান সবই চলছিল দেখলাম৷
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চরের প্রায় শেষ মাথা পর্যন্ত চলে এসেছি৷ চলার পথে জাহাঙ্গীর ভাই দেখিয়ে দিলেন হরিণের পায়ের ছাপ৷ খুব ভোরে এখানে হরিণ বিচরন করে৷ তা দেখতে হলে অবশ্য ফজরের আগেই ঘাপটি মেরে জায়গামত বসে থাকতে হবে৷
আমরা ফিরে এলাম সেই জায়গায়, যেই জায়গায় রাতে গাছে চড়ে বসেছিলাম৷ এবার দিনের আলোতে সবাই বসে ছবি তুললাম৷ শাড়ী পড়েই সুমি আপু গাছে চড়ে বসলেন আমাদের সাথে৷
গাছের উপড়ে আমরা সবাই
একটা বড় গাছ পেয়ে আমি হ্যামকটা ঝুলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ কিছুক্ষন আরাম করে নেয়াতে বেশ ভাল লাগছিল৷ এটা চরের নির্জন জায়গাগুলোর মধ্যে একটা৷ পরে সবাই এসে হ্যামকে শুয়ে ফটোশু করল নিজেদের মতন৷
এরপর আমরা আরেকটু সামনে গিয়ে গ্রুপ ফটোশুট করলাম৷ আসার সময় আমার কালো চশমাটা লঞ্চে পড়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল৷ তাই রোদে গ্রুপ ছবি তোলার সময় আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ তারপরও তুললাম কিছু ছবি৷ চশমা না থাকলেও মাথার গামছাটা রোদে বেশ ভাল সাপোর্ট দিচ্ছিল৷
নারিকেল বাগান সমুদ্রের পাড়ে
নারিকেল বাগানে
নারিকেল বাগানে
আমি এক তার ছেঁড়া টাইপ মানুষ৷ যেখানেই যাই সে দেশ হোক আর বিদেশ আমার লুঙ্গী আর গামছা সাথে থাকা চাই৷ এগুলা না হলে আমার চলে না একদমই৷ আমার কাছে গামছা আর লুঙ্গী আমার শরীরের প্রধান অংশগুলোর অন্যতম মনে হয়৷ তাই যেখানেই যাই সাথে থাকে৷ কারো কাছে হয়ত দেখতে বিষয়টা ক্ষ্যাত লাগে৷ তাতে আমার কি আমি চলি নিজের মত৷ আমি কখনো এসব দিকে তাকাইনি৷ আমার তাকাতে ভালোও লাগেনা৷ নিজের মত থেকেই ঘুরতে ভালবাসি৷ ভ্রমণ আমাকে আনন্দ দেয়৷ আমার আত্মাকে প্রশান্তি দেয়৷
ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম কিভাবে ঠেলা জাল দিয়ে সমুদ্রের পাড়ে ছোট ছোট মাছ ধরে৷ জাহাঙ্গীর ভাই ভিডিও করে নিলেন৷ ঘড়ি দেখলাম প্রায় নয়টা বেজে গেছে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে৷ খাওয়া দাওয়া করে সব গুছিয়ে কচ্ছপিয়ার দিকে রওয়া করতে হবে৷ নানাকে বলেছিলাম পথে যদি সম্ভব হয় আন্ডার চরে একটু নামব৷ জানিনা সময়ে কুলাবে কিনা৷ যেতে পারবকিনা আন্ডার চর৷
সবাই আস্তে আস্তে ক্যাম্পের দিকে পা চালালাম৷ চলার পথে অন্যান্য ক্যাম্পারদের সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে নিচ্ছিলাম৷ বেলা দশটার দিকে আমরা ক্যাম্প সাইটে এসে পৌঁছালাম৷ আমরা ঘুরে আসতে আসতে নানার বেটা গরম ভাত ডিম আর আলুভর্তা করে ফেলেছিল৷
সবাই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে গেলাম৷ গরম গরম ভাত ডিম ভাজি আর সাথে আলুর ভর্তা খেতে বেশ লাগছিল৷
ঘুরে এসে সকালের খাবার খেলাম
খাবার খেয়ে আমরা আমাদের ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিলাম৷ ক্যাম্প সাইটের সামনে সবাই ফটোশুট করলাম৷ এরপর একটা একটা করে সব তাবুগুলো গুছিয়ে নিলাম৷ কামরুল ভাই আমাকে সাহায্য করলেন আমার তাবু গুছাতে৷ তাবু ভাজ করে ব্যাগে ভরে নিলাম৷ নানা অল্প অল্প করে হাড়ি পাতিল গ্যাসের সিলিন্ডার সব নৌকায় তুলে নিলেন৷ সবশেষে আমরা নৌকার দিকে পা বাড়ালাম৷
ক্যাম্পের সামনে দাড়িয়ে
খাবার পর ক্যাম্প সাইটে
ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ক্যাম্পের সামনে দাড়িয়ে
আজই আমাদের শেষ দিন৷ ফিরে যেতে হবে বিকেল পাঁচটার মধ্যে বেতুয়া লঞ্চ ঘাটে ঢাকার লঞ্চ ধরতে৷ নৌকায় বসতেই নানা ইঞ্জিন চালু করে টান দিলেন৷ গতরাতে নানা এখানে নোঙর করা জেলেদের সহায়তায় ইঞ্জিনের ক্ষয়ে যাওয়া নাট বদলে ঠিক করে নিয়েছিলেন৷ তাই আজ আর কোন সমস্যা নাই৷ যাবার পথে নানাকে আন্ডার চরের কথা বললাম৷ আমাদের সময়ে কুলাবেনা বলে নানা আর সেদিকে যেতে চাইলেন না৷ এখান থেকে কচ্ছপিয়া যেতে দুই আড়াই ঘন্টা লেগে যাবে৷ সেখান থেকে আবার বেতুয়া যেতে প্রায় তিন ঘন্টার মত লাগবে৷ হাতে আসলেই পর্যাপ্ত সময় ছিলনা৷ নানা শর্টকাট নিলেন৷ আমাদের সরু খালের ভিতর দিয়ে নিয়ে চললেন৷ উদ্দেশ্য যত দ্রুত কচ্ছপিয়া পৌঁছানো যায় আমাদের নিয়ে৷
খালের দুপাশে শ্বাসমূল আর কেওড়া গাছের ছড়াছড়ি, এক পলকের জন্য মনে হল যেন সুন্দরবন চলে এসেছি৷ নারিকেল বাগানে হরিণ দেখতে না পেলেও ফিরতি যাত্রাপথে নানা যে সরু খালের ভিতর দিয়ে নিয়ে চললেন সেখানে সৌভাগ্যবশত হরিণের দেখা পেয়ে গেলাম আমরা৷ নানা নৌকার গতি স্লো করে দিলেন৷ হরিণগুলো বনের ভিতরে বিচরন করছিল৷
আমাদের মোবাইল ক্যামেরায় তা ধারন করতে পারলাম না তবে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম সব৷ হাতে সময় থাকলে নানাকে বলতাম আমরা জঙ্গলে নেমে একটু ঘুরি৷ কিন্তু সময় স্বল্পতায় তা সম্ভব হল না৷ নানা নৌকার গতি বাড়িয়ে দিলেন, আবার আমরা কচ্ছপিয়ার দিকে ছুটে চলেছি৷ সরু খাল পার হয়ে বড় খালে প্রবেশ করার আগে এক ট্রলারের সাথে আমাদের নৌকা প্রায় মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হতে রক্ষা পেল৷ নানা আমাদের নৌকাকে একদম খালের পাড়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন৷ এ যাত্রায় আবারও রক্ষা পেলাম৷
আমাদের নৌকা এবার সরু খাল পার হয়ে বড় খালে এসে পড়ল নানা ইঞ্জিনের গতি সর্বেচ্চ করে দিলেন৷ দুপাশে জল কেটে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে, গন্তব্য চর কচ্ছপিয়া৷ আমরা সবাই নৌকায় বসে শেষ মূহুর্তের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম৷
আসলে যেখানেই ঘুরতে যাইনা কেন আমার কাছে ডেস্টিনেশানের চাইতে মধ্যবর্তী জার্নিটাই বেশি ভালো লাগে৷ আমি এই জার্নিটা বেশ উপভোগ করি৷ বেলা একটার একটু আগে আমরা চর কচ্ছপিয়াতে এসে পৌঁছালাম৷
চর কচ্ছপিয়া ঘাট
নৌকা থেকে নামতেই রমিজ ভাই দৌড়ে আসলেন স্বাগত জানাতে৷ রমিজ ভাইকে পেয়ে আমরাও খুশি হলাম অনেক৷ একদম সাদা মনের দিল খোলা একজন মানুষ এই রমিজ ভাই৷
কচ্ছপিয়া পৌঁছাতেই রমিজ ভাই স্বাগত জানালেন
ব্যাকপ্যাক নিয়ে নৌকা থেকে নেমে এলাম সবাই৷ একটা দোকানে বসে নানা রমিজ ভাই সহ চা খেলাম৷ রমিজ ভাই একটা ব্যাটারির রিকশা ঠিক করে দিলেন, যেটা আমাদের সোজা চরফ্যাসন পার করে বেতুয়া লঞ্চঘাটে দিয়ে আসবে৷
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চর কচ্চপিয়া ঘাট থেকে বেতুয়ার দিকে যাত্রা করলাম৷ প্রায় আড়াই ঘন্টা চলার পর আমরা ভোলার চরফ্যাসনে এসে পৌঁছালাম৷ আমরা গাড়ি থেকে নেমে জ্যাকব টাওয়ার দেখলাম৷
চরফ্যাশনের জ্যাকব টাওয়ারের সামনে
সবাই মিলে ছবিও তুললাম৷ দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য একট হোটেলে ঢুকলাম৷ খাবারের দাম বেশি দেখে বেতুয়া ঘাটে গিয়েই খাবার সিদ্ধান্ত নিলাম৷
গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই বেতুয়া ঘাটে চলে যাবার জন্য৷ পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা বেতুয়া লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে যাই৷ গাড়ী থেকে নেমে ঘাটের টিকিট কেটে লঞ্চের দিকে আগালাম ব্যাকপ্যাক নিয়ে৷ লঞ্চে পা দিতেই ম্যানেজার হেলাল ভাইয়ের সাথে দেখা৷ আমরা যে লঞ্চে এসেছিলাম সেই একই লঞ্চে ফিরে যাব বাহহহ৷
বিদায় বেলায় লঞ্চে উঠার একটু আগে বেতুয়া লঞ্চ ঘাটে
ম্যানেজার হেলাল ভাই আমাদের স্বাগত জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কি ভাই আজকে কি আবার ক্যাম্পিং হবে নাকি৷ আমরা সবাই হেসে উঠলাম একসাথে৷ দোতালায় আমাদের পছন্দের আগের সেই জায়গাতেই গিয়ে বসলাম আমরা৷ ম্যাট বিছিয়ে সবার ব্যাকপ্যাক রেখে জায়গা ধরে নিলাম৷ আজকে লঞ্চে একটু ভিড় হবে বুঝতে পারলাম তাই জায়গা ধরা৷
আমরা দুপুরের খাবারের জন্য লঞ্চ থেকে নেমে ঘাটের দিকে গেলাম৷ কামরুল ভাই লঞ্চে বসে থাকলেন আমাদের সবার ব্যাকপ্যাক পাহাড়া দেবার জন্য৷ আমরা খেয়ে আসার সময় ভাইয়ের জন্য পার্সেল করে নিয়ে আসব খাবার৷ প্রথমে একটা হোটেলে ঢুকে দেখলাম, জাহাঙ্গীর ভাই বললেন আরো কয়েকটা দেখি৷
হোটেল থেকে বের হতেই সামনের হোটেলের একজন হাত ধরে টেনে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন৷ আমাদের বিভিন্ন মাছের আইটেম দেখালেন৷ আমাদের পছন্দ হল৷ আমরা আমাদের মোবাইলগুলো চার্জে দিয়ে খেতে বসলাম৷ আমাদের জন্য দোকানের একদম শেষ দিকে একটা আলাদা রুমে খাবার পরিবেশন করেছিল৷ তাদের আপ্যায়ন বেশ ভাল লেগেছিল আমাদের৷ পাশের দোকানে না বসে তাদের এখানে চলে এসেছি দেখে ১০ % ডিসকাউন্টও আদায় করে নিলাম৷
আমরা পেট পুরে ভাত খেলাম ইলিশ মাছ দিয়ে সাথে ডিম৷ জাহাঙ্গীর ভাই অন্য মাছ দিয়ে খেয়েছিলেন৷ সম্ভবত সেটা সামুদ্রিক লাল পোয়া মাছ ছিল৷ ভাত খেয়ে আমরা গরুর দুধের সর দেয়া চা খেলাম৷ আমাদের জন্য এক্সট্রা দুধের সর ও বাটিতে করে দিয়েছিল৷ সেটাও চায়ের সাথে মিশিয়ে খেয়েছিলাম৷
বেতুয়া লঞ্চ ঘাটে দুধের সর দেয়া চা খাওয়া
গরম গরম মিষ্টি তৈরি হতে দেখে লোভ সামলাতে পারলামনা আমরা৷ দামও কম৷ বেশ কয়েক দফা খেলাম আমরা গরম গরম ছানার মিষ্টি৷ কামরুল ভাইয়ের জন্য আর আমাদের জন্য আলাদা করে মিষ্টি প্যাক করে নিলাম৷
বেতুয়া ঘাটে গরম গরম মিষ্টি পেয়ে হাতছাড়া করিনি নাই
দুপুরের খাবার ভাল লেগেছিল বলে রাতে লঞ্চে খাবার জন্য পার্সেল ও করে নিয়েছিলাম পাঁচ জনের জন্য৷ আমরা তো এখানে খেয়ে নিয়েছি তাই রাতের খাবারের পার্সেল আর কামরুল ভাইয়ের জন্য একটা আলাদা পার্সেল সাথে নিয়ে জাহাঙ্গীর ভাই লঞ্চে চলে গেলেন৷ আমি সিফাত ভাই আর সুমি আপু ঘাটে কিছুক্ষন সময় কাটালাম৷
লঞ্চে উঠার আগে আমাদের চার্জে দেয়া মোবাইলগুলো খাবার হোটেল থেকে বুঝে নিলাম৷ ঘাট থেকে লঞ্চে খাবার জন্য কিছু হালকা নাস্তাও কিনে নিলাম৷ ঠিক বিকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাদের লঞ্চ ছেড়ে দিল৷ বেতুয়া ঘাট ছেড়ে আমরা ছুটে চললাম, গন্তব্য ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল৷
প্রতিবার লেখা শেষে চলবে লিখলেও এবার আর চলার রাস্তা নেই বিধায় থেমে যেতে হচ্ছে৷ ধন্যবাদ সবাইকে৷
তারুয়া দ্বীপ ছেড়ে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে অথৈ সাগরের দিকে৷ নৌকায় বসে আমরা আস্তে আস্তে তারুয়া দ্বীপকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দেখছিলাম৷
তারুয়া থেকে ফেরার সময় চর জমিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম
যতই সামনে আগাচ্ছিলাম দ্বীপের আকার ক্রমশই আকারে ছোট হয়ে আসছিল আমাদের চোখে৷ একসময় তা একেবারেই মিলিয়ে গেল৷ আমরা আবার গভীর সমুদ্রে এসে পড়েছি৷
চারপাশে শুধু জল আর জল৷ দূরে কিছু মাছ ধরার ট্রলার দেখা যাচ্ছিল শুধু৷ মধ্য দুপুর আমাদের দুপুরের খাবার তৈরির আয়োজন চলছে৷
যাত্রা পথে সাগরে মাছধরার ট্রলারগুলো এভাবেই দাড়িয়ে ছিল, জুম করে তোলা ছবি
তারুয়া থেকে আসার সময় সুমি আপুর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল তারপরও উনি বেশ ভালই সহযোগীতা করেছিলেন সিফাত ভাইকে রান্না করতে৷ সিফাত ভাই চুলায় খিচুরী বসিয়ে দিলেন৷
প্রচন্ড বাতাসে চুলা নিভে যাবার অবস্থা৷ শেষে চুলা একটু ভিতরের দিকে চেপে দিয়ে আমাদের ইনস্যুলেশান ম্যাট দিয়ে ঘেরাও দিয়ে বাতাস আটকে দিলাম৷ বাতাস এত বেশি ছিল যে ম্যাট উড়ে যাবার অবস্থা৷ আমাদের ভারী ব্যাকপ্যাক দিয়ে চাপা দিয়ে কোনরকমে রক্ষা করেছিলাম ম্যাট৷
অনেক সময় লাগিয়ে খিচুরী হয়ে যেতেই চুলায় ডিম চড়িয়ে দিলেন সিফাত ভাই৷ আমাদের নৌকা ঢেউ কেটে কেটে সামনে এগিয়ে চলছিল৷ বাতাস বেশি হবার কারনে সাগরে ঢেউ বেড়ে গিয়েছিল৷ নানার নৌকা চালাতে সমস্যা হচ্ছিল৷ নৌকার গতি একটু কমিয়ে দিলেন নানা৷ নাহলে নৌকা ঢেউয়ে বেশি দুলছিল৷
নৌকার পাটাতনে বেশ পানি জমে গিয়েছিল৷ এবার ইকবালের হাতে নৌকার হাল ধরিয়ে দিয়ে নানা নিজে গেলেন জল সেচতে৷ ইকবাল একটু সময় বেশি লাগায়৷ তাই নানা নিজেই করতে গেলেন এবার৷ নানা জল সেচতে লাগলেন৷
সেচার সময় নানার সন্দেহ হল একটু, নৌকায় সম্ভবত স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত পানি ঢুকছে, তাড়াতাড়ি ইকবালকে সড়িয়ে নিজের বসার জায়গার তক্তা সরিয়ে ইঞ্জিন চেক করলেন৷
সর্বনাস একদিকে ইঞ্জিনের নাট খুলে পড়ে গেছে৷ প্রপেলার ঘুরার সময় তাই বেশি পানি ঢুকছিল নৌকায়৷ নানা ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন৷ মাঝ সমুদ্রে আমরা নৌকায় বসে ঢেউয়ে দুলছিলাম৷
নানার কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ আমাদের আত্মারাম খাঁচার বাইরে৷ এ কোন বিপদে পড়লাম৷ আসেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ এমন এক জায়গায় নৌকা দাড়ানো দূরেও কোন ট্রলারও দেখা যাচ্ছিল না৷ সবাই আল্লাহ কে ডাকা শুরু করলাম৷ এই বুঝি সব গেল৷
নানা বহু কষ্টে নাট লাগালেন৷ নৌকা আবার চলতে শুরু করল৷ আমরা হাপ ছেড়ে বাঁচলাম৷ প্রায় পনের বিশ মিনিট চলার পর নাট আবার খুলে গেল৷ টের পেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন নানা৷ এবার নাটের প্যাচ একেবারে ক্ষয়ে গেছে৷ আর লাগাবার উপায় নাই৷
আমাদের চিন্তা আরো বেড়ে গেল৷ পৌঁছাতে পারব তো নারিকেল বাগান সহিহ সালামত৷ নাকি এই যাত্রায় শেষ আমরা৷ প্রায় অনেক্ষন আমরা সাগরে নৌকায় এমনেই ভাসলাম৷
নানার মাথায় বুদ্ধি এল নৌকার ছেড়া তেনা দিয়ে নাট মুড়িয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোন রকমে নাট লাগালেন নানা৷ শেষ চেষ্টা যদি কাজ হয়৷
আমরা সবাই দোয়া করছিলাম যাতে কাজটা হয়ে যায়৷ নাহলে নির্জন সমুদ্রে রক্ষা নাই আমাদের৷ নানা ইঞ্জিন চালু করে নৌকা টান দিলেন৷ এবার নানা ইঞ্জিনের উপরের কাঠ না বসিয়ে খোলা রাখলেন যাতে সব তিনি দেখতে পারেন ঠিকমত৷
নারিকেল বাগান আরো প্রায় দেড় ঘন্টার পথ৷ সিফাত ভাই গিয়ে চেক করলেন ডিম সিদ্ধ হয়েছে কিনা৷ এতক্ষনে মাত্র পানি গরম হয়েছে অল্প৷ তারমানে আরো অনেক সময় লাগবে৷
চর মোন্তাজ থেকে রওনা দেবার সময় মুড়ি আর চনাচুর নিয়েছিলাম৷ কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই গামলায় মুড়ি চনাচুর মাখালেন৷ সবাই অল্প খেয়ে নিলাম৷ কখন যে দুপুরের খাবার খেতে পারব তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই৷
নৌকা চলছে৷ নানার দৃষ্টি বারবার ইঞ্জিনের জোড়া দেয়া নাটের দিকেই ফিরে যাচ্ছিল৷ আমি যা দেখলাম নানার সার্জারি ভালই কাজে লেগেছে৷ কোনরকমে নারিকেল বাগানে পৌঁছাতে পারলেই বাঁচি৷
হঠাৎ নানা বললেন তার এক নাম্বার লেগেছে৷ আমার হাসি পেল মাঝ সমুদ্রে নানা কি বলে এইসব৷ চারপাশে শুধু জল আর জল৷ আমি বললাম এখানে কই করবেন৷ আমাদের খালি কোন বোতলও নাই যে দিব৷ নানা বললেন লাগবে না বোতল৷ তিনি সমুদ্রেই মুত্র বিসর্জন দিবেন৷
আমাকে সামনের দিকে ফিরে বসে থাকতে বলেই নানা পিছন দিকে ফিরে বসে বোতল খালি করে দিলেন৷ সামনের দিকের ওরা নানার এই আকাম সম্পর্কে জানতে পারল না একদম৷
আরো প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর দূর থেকে নারিকেল বাগান দেখতে পেলাম আমরা৷ নানা নিজেই দেখিয়ে দিয়ে বললেন ঐটা নারিকেল বাগান৷
প্রচুর মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করা পাড়ে৷ এই নারিকেল বাগান কুকরিমুকরি চরের হট স্পট৷ বেশিরভাগ ট্রাভেলাররা এখানেই ক্যাম্পিং করে থাকে৷ আমরা পাড়ের কাছে যেতেই দেখি বড় দুইটা বোটে চেপে বহু টুরিস্ট ঘুরতে এসেছে৷ মাথা পুরাই খারাপ আমাদের৷
আমাদের নির্জন জায়গা পছন্দ৷ এখানে তো পুরা বাজার বসে গেছে৷ নানা আমাদের একটু ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন৷ সেদিকে একটা নির্জন স্পট আছে৷ যদি আমাদের পছন্দ হয় ক্যাম্পিং করব৷
স্পটে পৌঁছাতেই আমরা নেমে পড়লাম সব চেক করে দেখতে৷ জায়গাটা পছন্দ হল আমাদের৷ কিন্তু সমস্যা হল এটা একটু বেশি ভিতরের দিকে৷ এখানে থাকলে পুরা চর থেকে আলাদা হয়ে যাব আমরা৷ আশেপাশে যেখানেই যাব নদী পার হয়ে যেতে হবে আমাদের৷ তাই আমরা এখানে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম৷
সবাই স্পট থেকে নেমে নৌকায় চলে আসলাম৷ খুব খিদে লেগেছিল সবার৷ তাই পরের জায়গা খোঁজার আগে সবাই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে গেলাম৷ সুমি আপু সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন৷ এত বেশি খিদে লেগেছিল যে সাধারন খিচুরী আর ডিম খেতে অমৃত লাগছিল৷
আমি তো ডাবল খেয়েছিলাম৷ জাহাঙ্গীর ভাই মোটা চালের ভাত তেমন খেতে পারেন না৷ ভাই একটু কম খেলেন৷ আসলে এইসব চর এলাকায় চিকন চাল পাওয়া যায় না৷ আমরা অনেক খুঁজেছিলাম কচ্ছপিয়াতে পাইনি৷ পরে যেটা একটু ভাল পেয়েছিলাম সেটাই নিয়ে নিয়েছিলাম উপায় না দেখে৷
খাবার খেয়ে নেয়াতে একটা সুবিধা হয়েছিল আমাদের৷ আমরা খেতে খেতে দুই বোট ভর্তি টুরিস্ট চলে গেল নারিকেল বাগান ছেড়ে৷ এবার চর পুরাটাই খালি হয়ে গেল৷
নানা তাড়াতাড়ি নৌকা সামনের দিকে নিয়ে গেলেন৷ পূর্ব পাড়ে আমাদের ক্যাম্পের জন্য খালি জায়গা দেখেও নানা পশ্চিম পাড়ে নৌকা ভিড়ালেন৷
এই পাড়ে নলকূপ আর একটা দোকান আছে, আমরা গোসল করে ফ্রেস হবার জন্যই নানা এই পাড়ে নৌকা লাগিয়ে দিয়েছেন৷ এখানে কোন শৌচাগার নেই৷ দুইটা বানানোর কাজ চলছিল মাত্র৷ উপায় না দেখে বোতল ভর্তি পানি নিয়ে আমি আর কামরুল ভাই জঙ্গলে মঙ্গল করতে দৌড় দিলাম৷ এখানে জঙ্গল ই শেষ ভরসা৷ যারা দূর্গম পাহাড়ে অভিযানে যান তারাই কেবল বুঝতে পারবেন বিষয়টা৷
জঙ্গল থেকে বের হয়ে দেখি অন্যরা সামনের সরু খাল পার হয়ে নতুন ক্যাম্প সাইটের সন্ধান করছে৷ আমিও দৌড়ে সেদিকে গেলাম৷ খালের কাঁদামাটি পার হয়ে সবার সাথে যোগ দিলাম৷ চারপাশে গাছপালা ঘেরা সুন্দর একটা জায়গা পেলাম আমারা৷
খালের কাঁদা পার হয়ে নতুন ক্যাম্প সাইট খুজতে গিয়েছিলাম
সেখানেই ক্যাম্প ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে৷ এখানে বাইরের কেউ বিরক্তও করতে পারবেনা৷ কিন্তু সমস্যা হলো এই খালের কাঁদামাটি পার করে সব জিনিস পত্র এখানে আনা মুশকিল৷ নৌকাও জোয়ার না আসলে কাছে আনা সম্ভব না৷ তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও খালের ঐ পারের খালি জায়গাতেই ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা৷
নারিকেল বাগানে আমাদের প্রথম ক্যাম্প সাইট
কাঁদামাটির খাল পার হয়ে আমরা পাড়ের ছোট্ট দোকানটায় বসলাম কিছুক্ষন৷ এখানে যত মাছধরার ট্রলার ভিড়ে, তার জেলেরাই মূলত এই দোকানের কাস্টমার৷ মোটামুটি প্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসই এই দোকানে আছে৷
দোকানে বসা জেলেদের থেকে বড় দুইটা ইলিশ মাছ নিতে চাইলাম আমরা৷ দাম বেশি বলাতে পরে কুকরির মেইন বাজারের আড়ত থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ দোকান থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে নৌকার কাছে গেলাম৷ ক্যাম্পের তাবু সেট করার জন্য নদীর ঐপাড়ে যেতে হবে আমাদের৷ নানা সবাইকে নৌকা করে ঐপাড়ে দিয়ে আসলেন, আমি এইপাড়ে রয়ে গেলাম৷
নানা ফিরে আসলে নানাকে নিয়ে বাজারে যেতে হবে বনের ভিতরের রাস্তা দিয়ে৷ একা গেলে রাস্তা হারানোর ভয় আছে৷ নানা সবাইকে ঐ পাড়ে রেখে ফিরে এলেন৷
নানাকে নিয়ে সন্ধার ঘন্টাখানেক আগে বনের রাস্তা ধরে কুকরিমুকরির বড় বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম৷ কিছুদূর যাবার পর নানা তার পরিচিত এক বাইক চালককে ফোন করে বনের শেষ মাথায় রাস্তার উপড় আসতে বললেন৷
আমরা রাস্তায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাইকওয়ালা হাজির৷ এবার নানা নাতি বাইকে চেপে বসলাম৷ বাইক হওয়াতে সুবিধা হল কিছুটা সময় বাঁচবে অনেক৷ হেঁটে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে৷ গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বাইকে করে আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই বাজারে পৌঁছে গেলাম৷
আমি মাছ কিনতে গেলে দাম বেশি চাইবে তাই নানাকেই পাঠালাম দরদাম করতে৷ আমি এক দোকানে বসে রইলাম৷ নানা পুরা বাজার খুঁজে এসে বললেন বড় মাছ নাই৷ কি আর করার মন খারাপ হয়ে গেল৷ এখন আবার ঐ দোকানে গিয়ে বেশি দামে মাছ কিনে নিতে হবে৷
নানা আমার মন খারাপ দেখে হাত ধরে বাজারের ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন৷ কই যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করলে নানা শুধু বললেন আস আমার লগে৷ নানার পিছে পিছে বাজারের গলি দিয়ে হাঁটছি৷ গলির চিপায় এক দোকানের সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন “এইখানে যে জিনিস আছে আপনার মন ভালা হয়ে যাবে নাতি”৷
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দোকানদারকে বললেন আমার নাতিরে গরুর দুধের ইশপেশাল চা দেও৷ নানার বেটার মনে আছে চর মোন্তাজে গরুর দুধের চা খাইতে পারিনাই বলে আমার মন খারাপ ছিল৷ তাই এখানে আছে জেনে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন গরুর দুধের চা খাওয়াতে৷
নানা নাতি মিলে চা খেলাম৷ আহহহহ সে কি স্বাদ৷ তৃপ্তি সহকারে খেলাম৷ দোকানদার বললেন দুধ বাড়ায়ে দিছি ভাই, মজা লাগবে নে৷ আমি পরে আরও এক কাপ খেলাম৷
আন্ডার চরে কাঁচের গ্লাসে করে চা পরিবেশন করলেও এখানে কাপ ই ব্যবহার করে এরা৷ মাছ তো পেলাম না তাই চা খেয়ে নানাকে সাথে নিয়ে বাইকে চেপে বসলাম ফিরে যাবার জন্য৷
বাইকওয়ালা আমাদের বনের মুখ পর্যন্ত দিয়ে এল৷ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ নানাকে নিয়ে বনের পথে হাঁটছি আমি৷ হঠাৎ দু’জন জেলে পেয়ে গেলাম পথে৷ তারা মাছ নিয়ে আড়তে যাচ্ছিল মহাজনের কাছে বিক্রি করতে৷ তাদের থামিয়ে বড় দুইটা ইলিশ মাছ কিনলাম৷ নানা নিজে দরদাম করাতে অল্পদামে পেয়ে গেলাম৷ মনটা খুশি হয়ে গেল এবার৷ যাক যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা সফল হল আমাদের৷ মাছ নিয়ে নেচে নেচে ক্যাম্প সাইটের দিকে চললাম৷
আমার খুশি দেখে নানাও খুশি৷ আজ রাতে জম্পেস খাওয়া দওয়া হবে৷ মাগরিবের আযান হবার একটু আগেই ক্যাম্প সাইটে পৌছালাম আমরা৷
আমি বাজারে যাবার পর সিফাত ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই আর কামরুল ভাই কলের ঠান্ডা পানিতে গোসল করেছিল৷ ঠান্ডায় আমার শরীর ভাল না লাগায় আমি গোসল করনি, তবে গামছা ভিজিয়ে ভালমত শরীর মুছে, হাত মুখ পা ভালমত ধুয়ে নিয়েছিলাম বাজার থেকে ফিরে৷
নানাকে নিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা করে খাল পার হলাম৷ সুমি আপুকে ক্লান্ত দেখে নানা নিজেই মাছ নিয়ে চলে গেলেন নৌকায়, সব কেটেকুটে ধুয়ে রেডি করে দেবার জন্য৷ আমি আর সিফাত ভাই তাবু সেট করতে শুরু করলাম৷ পরে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাইও হাত লাগিয়েছিল তাড়াতাড়ি হবার জন্য৷
নানা মাছ কেটে রেডি করে দিয়েছিল রান্নার জন্য
আমি বাজার থেকে ফিরে আসার আগেই সবাই মিলে পাশের বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিল৷ আমাদের সাথে স্থানীয় কিছু মানুষের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ আমাদের দেখে তারা খুব খুশি হয়েছিল৷
নানার মেয়ের জামাই এসে আমাদের অনেক সহযোগীতা করেছিল৷ নৌকা থেকে একে একে চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডার ও প্রয়োজনীয় সব নিয়ে আসা হল আমাদের ক্যাম্প সাইটে৷ তাবু সেট করার পর সবার ব্যাকপ্যাক তাবুর ভিতরে রেখে লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালালাম তাবু থেকে একটু দূরে৷
আগুনে লাকড়ি দিচ্ছিলাম
সুমি আপু সবার জন্য নুডলস রান্না করলেন৷ নুডলস রান্নার ফাঁকে জাহাঙ্গীর ভাই, কামরুল ভাই আর সিফাত ভাই তাবুর সামনে ইনস্যুলেশান ম্যাট বিছিয়ে স্থানীয়দের সাথে কার্ড খেলা শুরু করে দিয়েছিল৷
আমি কার্ড খেলা তেমন ভাল পারিনা বলে নানাকে নিয়ে ঘুরতে চলে গেলাম সন্ধার আঁধারে৷ কিছুদূর সামনে যেতেই চরে আরো কিছু ক্যাম্পারদের তাবু নজরে পড়ল৷ তারাও আজ রাতে এখানে থাকবে৷
এটা বেশ বড় গ্রুপ৷ প্রায় ১২ থেকে ১৫ জনের৷ এর কিছু দূরে আরো কয়েকটা গ্রুপের তাবু দেখতে পেলাম৷ নানাকে নিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা ঘুরলাম আমি৷
ঘুরে ক্যাম্প সাইটে ফিরে যেতেই সুমি আপু নুডলস দিলেন খেতে৷ নানা আর আমি সবার পরে যাওয়াতে সুমি আপু আমাদের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছিল৷ এলাকার লোকদের সাথে নিয়ে অন্যরা আগেই খেয়ে নিয়েছে৷
সবাই কার্ড খেলায় মত্ত৷ সিফাত ভাই স্পিকার বের করে গান চালিয়ে দিলেন৷ কিছুক্ষন পর সুমি আপু সবার জন্য চা বানালেন৷ কয়েকটা ছোট পানির বোতল কেটে কাপ বানিয়ে এলাকার লোকজন সহ সবাই চা খেলাম৷
আমাদের ক্যাম্প ফায়ার
রাত একটু বাড়তেই স্থানীয়রা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন৷ আমরা রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করলাম৷ নানা আগেই মাছ কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল৷ জাস্ট রান্না করতে হবে৷
চলছিল রান্নার কার্যক্রম
সুমি আপু চুলায় ভাত বসিয়ে দিলেন ভাত হয়ে যাবার পর মাছ রান্না শুরু করতেই এল বৃষ্টি৷ লে হালুয়া পুরা ট্রিপে শুধু এটার ই কমতি ছিল৷
জাহাঙ্গীর ভাই তাবুর ভিতরে ঢুকে পড়লেন৷ সিফাত ভাই সবার ব্যাকপ্যাকগুলো সবচেয়ে মজবুত তাবুর ভিতরে নিয়ে রাখতে লাগলেন, যাতে ভারী বৃষ্টি হলেও আমাদের কারো ব্যাগের জিনিস পত্র না ভিজে৷
আমি আর কমরুল ভাই ইনস্যুলেশান ম্যাট ওল্টা করে সুমি আপুর মাথার উপড় ধরে রাখলাম, যাতে বৃষ্টির ফোটায় রান্নায় সমস্যা না হয়৷
বৃষ্টিতে এভাবেই ইনস্যুলেশান ম্যাট দিয়ে ছাউনি বানিয়ে রান্না করা হয়েছিল সেদিন রাতে
কিছুক্ষন পর আমার জায়গায় সিফাত ভাইকে দাড় করিয়ে দিয়ে আমি তাবুর ভিতরে গেলাম বিশ্রাম নিতে৷ আমাদের রান্না হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল৷ দুই আইটেমের ইলিশ মাছ রান্না করেছিল আপু, একটা ইলিশ ভাজি আর একটা ঝোল দিয়ে রান্না৷
একটু পর উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এসে আমাদের সতর্ক করে গেলেন৷ রাতে ভারী বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা৷ সাবধানে থাকার জন্য৷ দমকা হাওয়া শুরু হয়ে গেছে কিছুটা৷
নিরাপত্তা বাহিনীর লিডার রমিজ ভাইয়ের সাথে বেশ ভাল সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল আমাদের৷ আমাদের রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল তাই রমিজ ভাইকে আর দলের সদস্যদের রাতে আমাদের সাথে খাবার নিমন্ত্রন দিলাম৷
এই সময়ে কাজের চাপ বেশি থাকায় রমিজ ভাই খেয়ে যেতে পারলেন না৷ চরে বহু টুরিস্ট, সবাইকে সতর্ক করতে হবে৷ পরে আসবেন বলে চলে গেলেন৷
রান্না হতেই নানা আর ইকবালকে আমি গিয়ে নৌকা থেকে ডেকে নিয়ে আসলাম৷ বৃষ্টিও থেমে গেছে, সবাই মিলে একসাথে খেতে বসলাম৷
আহা সুমি আপুর হাতের রান্না লা জবাব৷ জাহাঙ্গীর ভাই আজকে একটু ভালমতন খেলেন অন্যদিনের চাইতে৷ আমাদের খাওয়া শেষে নানা সব গুছিয়ে রেখে ইকবালকে নিয়ে নৌকায় চলে গেলেন ঘুমাতে৷
আমি বলে দিয়েছিলাম রাতে যদি বৃষ্টি আসে তাহলে ইকবালকে নিয়ে আমাদের তাবুতে চলে আসতে৷ খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিলাম৷ রমিজ ভাই তার দলবল নিয়ে আবার হাজির আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছেকিনা তা দেখতে৷
আমাদের নাকি উনার বেশ পছন্দ হয়েছে৷ একসাথে বসে রমিজ ভাইয়ের ওমান প্রবাসের গল্প শুনলাম৷ কি একটা সমস্যার জন্য উনাকে চলে আসতে হয়েছিল৷ বিদায় নেবার আগে দুইজন গার্ডকে সবসময় আমাদের পাশেই থাকার নির্দেশ দিয়ে অন্যদের নিয়ে চলে গেলেন বাকিদের নিরাপত্তা দিতে৷
নিরাপত্তা বাহিনীর ভাইদের সাথে আড্ডা
দুই গার্ড ভাইকে পেয়ে আমরাও একটু স্বস্তি পেলাম৷ যাক ঝড় তুফান হলে পাশে এই দুই ভাই আছে৷ কিছুক্ষন পর দুই গার্ড ভাইকে ক্যাম্পের পাহাড়ায় রেখে আমরা চরের রাতের নিস্তব্দতা উপভোগ করতে বের হয়ে গেলাম৷ যাবার সময় একদল তাদের করা ছাগলের বার্বিকিউ খাবার নিমন্ত্রন দিল আমাদের৷ পেট ভরা থাকায় তাদের দাওয়াত কবুল করতে পারলাম না আমরা৷
সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলাম আমরা৷ হেলানো একটা গাছ পেয়ে সবাই একে একে উঠে লাইন ধরে বসে গেলাম৷ গাছটা মোটামুটি ভালই উঁচু৷
তারুয়া দ্বীপে নানা সুমি আপুকে কোলে নিতে পারেনি, তাই নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করছিলাম৷ হঠাৎ দেখি দূর থেকে কেউ আসছে আমাদের দিকে৷ সিফাত ভাইয়ের মাথায় শয়তানি চিন্তা এল৷ আমরা যেহেতু অন্ধকারে গাছের উপড়ে বসে আছি তাই আমাদের কেউ দেখার সম্ভাবনা নেই৷ সামনে থেকে আসা মানুষদের ভয় দেখানো যাবে৷
ওরা কাছে আসতেই সেই চিৎকার চেচামেচি সবাই গাছের ডালপালা নেড়ে৷ ভয় পেয়ে দুই জন সেই লেবেলের দৌড়৷ অলেম্পিক চ্যাম্পিয়ন উসাইন বোল্টও ফেল মারত ঐ সময় তাদের কাছে৷
মধ্যরাতে ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি গার্ড দুই ভাই নেই৷ হয়ত অন্য কোন দিকে গেছে চেক দিতে৷ কিন্তু না আমাদের দেখে একটু দূর থেকে টর্চের আলো নেড়ে সংকেত দিলেন তারা যায়নি, একটু দূরে হলেও আমাদের ক্যাম্পের দিকে তাদের নজর আছে৷
নারিকেল বাগানে আমাদের ক্যাম্প সাইট
আমাদের ক্যাম্পটা একদম সাগরের কাছাকাছি৷ তাবুর ভিতর থেকে সাগরের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল৷ ঠিক কয়টায় ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই৷
এই শহরের তপ্ত রোদে আমি একদিন ধুলিমাখা ঝড় হবো।
দিগ্বিদিক ছুটে ছুটে উড়িয়ে নেবো সব জঞ্জাল।
আমি একটা আকাশ হবো,
যার বিশালতার কাছে মানুষের মানষিকতা হবে মূল্যহীন।
আমি সেই আকাশে এক চিলতে মেঘ পাঠাবো শুধু তোমার খোঁজে।
পৃথিবীর সমস্ত কলুষতাকে উপড়ে ফেলবো দু’জন মিলে।
আমি একটা পাহাড় হবো–
সাদা কালো মেঘগুলো আমার গাঁ ঘেষে যাবার সময়,
আমি তাদের উদার হওয়ার শিক্ষা দিবো।
আমি একটা বিশাল সাগর হবো–
যতটুকু পানিতে পা ভিজে সেটা বাদ দিয়ে-
যতটুকু পানিতে মনের ময়লা ধুয়ে যেতে পারে,
আমি সেই জল হবো,
শুদ্ধ করবো সব জঞ্জাল, কলুষতা, অহংকার।
আমি একটি মেঠো পথ হবো–
সেই পথের বাঁকে বাঁকে থাকবে সরলতা, ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ভরসা।
আমি একজন মানুষ হবো–
শুধু দুটো হাত, দুটো পা, দুটো চোখ, একটি মুখের অবয়বের মানুষ যাকে বলে তা না-
আমি হবো বিবেকে জাগ্রত, অহংকারহীন, ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক।
আমি সেই মানুষ হবো-
যার থাকবেনা লোভ, লালসা, থাকবেনা ছিনিয়ে নেয়ার অভ্যাস।
শুধু থাকবে একটি সুন্দর বিবেক, আর বিশ্বাস।
যার অন্তরে থাকবে অশেষ ভালোবাসা শুধু সরল মানুষগুলোর জন্য।
বাস স্টেন্ডে নেমে আমরা সবাই সেখানের একটা খাবার হোটেলে ঢুকলাম। সবার ব্যাগ গুলো একটা টেবিলের উপর রেখে সবাই নাস্তা করতে বসলাম। সেখানকার হোটেল গুলোতে পরোটা বা রুটির চেয়ে লুচির চাহিদা বেশি। তাই পরোটা না বানিয়ে তারা শুধু লুচিই বানায়। আবার ভাতও রান্না হয়েছে। আমি ভাত খেলাম। আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে। বাকিরা লুচি, ডিম ও ডাল ভাজি দিয়ে নাস্তা করলো। নাস্তা শেষে আমরা দু’টো অটো নিয়ে চলে গেলাম আলীকদম ব্রীজের গোড়ায়।
আমাদের প্রথম দিনের প্ল্যান ছিলো মাতামুহুরি নদী, পোয়ামুহুরী ঝর্ণা এবং রূপমূহুরী ঝর্ণাতে যাওয়ার। আর সেখানে যেতে হলে আর্মি চেকপোষ্টের অনুমতি নিতে হয়। এজন্য সবার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি সহ নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নাম্বার এন্ট্রি করে রাখলো। সেখানেরই এক আর্মি ভাইয়ের সাথে আমাদের বেশ খাতির হয়ে যায়, উনার নাম আমির ভাই। কামরুলদের এলাকার লোক উনি।
সবাই তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলতে বলতে আমি বিশাল সেই ব্রীজের উপরে এসে দাঁড়ালাম। ব্রীজের নিচ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল মাতামুহুরি নদী।
আলীকদম ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আছি
নদীর পিছনেই দেখা যাচ্ছে বড় বড় পাহাড়ের সারি। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় দূরের পাহাড় গুলোকে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছিলো!
ব্রীজের উপর থেকে সামনে মাতামুহুরি নদী আর পিছনে পাহাড়
সবাই মিলে নৌকা ঠিক করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জানা গেলো যে, সেখানে শুধু একটি ঝর্ণায় যাওয়ার অনুমতি মিলেছে আর নৌকা ভাড়াও অনেক বেশি। আমির ভাই অনেক চেষ্টাও করেছিলেন অনুমতি নেয়ার জন্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো না। পরে আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো।
মাতামুহুরি নদীর পাড়ে বসে আছি
সবাই আমরা আলীরগুহায় যাবো তাই অটো ঠিক করলাম। ব্যাগ গুলো সেখানেইর একটি দোকানে রেখে গিয়েছিলাম। সকাল প্রায় সাড়ে ১০ টার দিকে আলীরগুহার দিকে রওনা হলাম।
আলীকদম ব্রীজ
আলীকদম উপজেলা সদর থেকে মাত্র ০৩ কিলোমিটার দূরেই মাতামুহুরি নদী ও তৈন খাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দু’পাহাড়ের চূঁড়ায় প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট “আলীরগুহা বা আলীর সুড়ঙ্গ”। আমরা আনুমানিক আধাঘন্টা পরে তৈন খালের মাথায় এসে পৌঁছালাম।
খালের পাড়ে ছোট্ট একটি টং দোকান আছে। খাল পার হয়ে আমাদের ওপাড়ে গিয়ে ট্রেকিং শুরু করতে হবে। আমি ড্রেস চেন্জ্ঞ করার মতো কোনো সুবিধাজনক জায়গা না পেয়ে পরনের ভারী কাজের জামাতেই এগুলাম।
আলীরগুহা যাওয়ার পথে ঝিরিতে আমাদের টিম
আমরা ছোট্ট একটা নৌকা দিয়ে খাল পার হলাম। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো ঝিরি, ঝিরিটা বেশ সরু।
আলীরগুহার ঝিরি
এর আগে আমি এমন ঝিরি দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি অবাক হলাম ঝিরিতে মোটামুটি বেশ পানি ছিলো। সবাই নিচে না নেমে ঝিরির গাঁ ঘেঁষে থাকা শক্ত পাথরের মতো পাহাড়ের দেয়াল ধরে ধরে সামনে এগুতে লাগলো।
ঝিরি পথে যাত্রা
আমি ট্রেকিং সেন্ডেলের পরিবর্তে ট্রেকিং শু নিয়েছিলাম। তাই ঝিরিতে নামলে শু এর ভিতর অনেক পানি ঢুকে যাবে ভেবে সবাই আমাকে ঝিরি পার হতে সাহায্য করেছিলো।
কিন্তু, এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে নেমেই ঝিরি পার হতে হবে। অগত্যা আমাকে জুতা খুলে ফেলতে হলো। ঝিরি থেকে প্রায় ১৫০ ফিট উপরে সেই গুহা। প্রায় ০১ ঘন্টার মতো হাঁটার পর আমরা গুহার কাছে এলাম। আরও একটা গ্রুপও ছিলো আমাদের সাথে।
ঝিরি থেকে গুহায় উঠা খুবই কষ্টকর। একটা মোটা গাছের সাথে ছোট ছোট ডাল দিয়ে সিঁড়ি করে দিয়েছিলো কেউ। গাছের সাথে একটা মোটা রশিও ঝুলানো ছিলো। বৃষ্টি আর কাঁদায় সিঁড়িটা খুবই পিচ্ছিল হয়ে আছে।
সিঁড়ি বেয়ে রশি ধরে উপরে উঠা
এক এক করে সবাই উপরে উঠলো। উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম কিছু বাদুড় উড়ে গেলো। অনেকটা অন্ধকার ঝিরি। হালকা ভয়ও লাগছিলো আমার। হাতের ডানপাশেই পাহাড়ের গা ঘেঁষা গুহার ছোট্ট মুখ। গুহার ভেতর অনেক অন্ধকার থাকে বলে আলো জ্বালিয়ে ঢুকতে হয়।
গুহার মুখ
প্রথম ২/৩ জন গুহায় ঢুকার পর আমি ঢুকলাম। গুহার মুখ এতটা ছোট ছিলো আর ভিতরে যেতেই দেখলাম অনেক বড় চওড়া জায়গা। এই গুহা লম্বায় প্রায় ১০০ ফিট। প্রথমবার গুহায় ঢুকার অনুভূতি অসম্ভব ভালো লেগেছিলো আমার। গুহার ভিতরে সবাই ছবি তুলেছিলো। তারপর কিছুক্ষণ থেকে আমরা আবার ফিরার প্রস্তুতি নিলাম।
গুহার ভিতরে আমরা
একে একে সবাই গুহা থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে রশি ধরে নিচে নেমে আসলো। ঠিক সেই সময়ের জন্য নিজেকে আমার ভিন্ন জগতের মনে হয়েছে। কি যে অদ্ভূত সুন্দর অভিজ্ঞতা।
সিঁড়ি বেয়ে নামার সময়
ফিরার পথে অর্ধেক এসে বিপরীত দিকে আরেকটি রাস্তা চলে গেছে। শুনেছি এই পাহাড়ে নাকি একাধিক গুহা রয়েছে। তবে ‘আলীরগুহা’ সবচেয়ে পরিচিত গুহা।
আমরা বিপরীত পাশের সেই রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়লো একটি লোহার সিঁড়ি।
ফিরার পথে লোহার সিঁড়ি
সবাই সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চাইলাম। কিন্তু, শাহিন ভাই বললো আমাদের এখানে আর বেশি দেরি করা যাবে না। কারণ, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মারায়ন তং পাহাড়ে ক্যাম্পিং।
প্রায় ১২ টার মধ্যে আমরা ঝিরি শেষ করে খালের পাড়ে চলে এলাম। সবাই খাল পার হয়ে অটো দিয়ে আলীকদম ব্রীজের সাথের সেই আর্মি ক্যাম্পের কাছে ফিরে এলাম যেখান থেকে আমরা গিয়েছিলাম।
আর্মি ক্যাম্পের সেই আমির ভাই আমাদের দেখেই একগাল হেসে সামনে এগিয়ে এলেন, হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। সবাইকে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করালেন তিনি এবং বললেন যদি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় আমরা যেনো ওনাকে জানাই। অতঃপর আমির ভাই সহ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে যার যার ব্যাগ নিয়ে আমরা সেখান থেকে চলে এলাম আবাসিক এ।
এখান থেকে মূলত মারায়ন তং-এর যাত্রা শুরু করতে হয়। কয়েকটা ছোটখাটো দোকান ও খাবার হোটেল আছে এখানে। ততক্ষণে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। বেলা প্রায় ০১ টা বাজে তখন।
আমরা সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম, মুরগীর মাংস, আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে। খাবার মোটামুটি ভালোই ছিলো। খাবার শেষ করে শাহিন ভাই সেদিন রাতের জন্য খাবারের অর্ডার করলেন সেই হোটেলেই। রাতের জন্য মুরগীর বিরিয়ানি অর্ডার করা হলো।
মূলত মারায়ন তং যাওয়ার আগে এটাই সর্বশেষ বাজার যেখান থেকে আপনি খাবার অর্ডার করতে পারবেন। তারপর প্রয়োজনীয় খাবার পানি এবং কিছু শুকনো খাবার নিয়ে আমরা রওনা হলাম। তখন প্রায় দুপুর ০২ টার কিছু বেশি বাজে।
মারায়ন তং যাত্রা শুরু
সবাই যার যার ব্যাগ, তাবু, খাবার পানি নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। আবাসিকের ডান পাশ দিয়ে চলে গেছে সোজা একটি রাস্তা, এই রাস্তা দিয়াই সবাই মারায়ন তং পাহাড়ের যাত্রা শুরু করে।
মারায়ন তং-এর উচ্চতা প্রায় ১৬৪০ ফিট। এখানে অনেক আদিবাসীদের বসবাস। হাঁটতে হাঁটতে সমতল পথ পার হতে হতে কিছু আদিবাসীদের ছোট ছোট ঘর চোখে পড়লো।
ট্রেকিং করছি
তখন আমের মৌসুম ছিলো। আশেপাশের ছোট ছোট গাছ গুলোতে প্রচুর আমি দেখতে পেলাম। যেনো হাত দিয়েই পাড়া যাবে। তবে অনুমতি ছাড়া পাহাড়ীদের গাছের কোনো ফল ছিঁড়া উচিত নয়। যতই সামনে এগুতে লাগলাম পাহাড়ের উচ্চতা টের পাচ্ছিলাম।
ইট বিছানো পাহাড়ী সরু রাস্তা
সেই পাহাড়ের প্রায় পুরো রাস্তাটাই ছিলো ইট বসানো এবং ভীষণ খাঁড়া রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে জঙ্গলের মতো অসংখ্য গাছ আছে। যাত্রার শুরু থেকেই আমাদের সঙ্গী হয়েছিল একটি পাহাড়ী কুকুর।
তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার সোনালী সঞ্চয়। হয়ত স্পর্শের মাদকতা থাকবেনা আর কখনোই। স্বপ্নের খুঁড়েঘর বাঁধা হবে না আর। পুর্নিমার জোসনাস্নিগ্ধ একটা রাতও আসবে না আর দুজনার। বৃষ্টির ফোটারা ঝরতে ঝরতে ক্লান্ত হয়ে পরবে, হয়ত একসাথে ভিজা হবেনা আর। কারনে অকারনে ঝগড়া করা হবেনা আর। অভিমান ভাংগতে তোমার কপালে চুমুর তিলক কাটতে হবেনা আর। সমাজবৃত্তের পৃষ্টদেশটা বড্ড অদ্ভুত, বিচ্ছেদের বেরীবাঁধ এটেঁ দিল। তবুও তুমি মনখারাপী মেয়ে হইও না। ভালো থাকার পরশপাথর নেই আমার। তাই আমার জমানো সবটুকু বাক্সবন্দী ভালেবাসা তোমায় দিলাম। আমি না হয় থেকে গেলাম স্পর্শের বাইরে।