• সব পোস্ট
অন্যান্য অভিজ্ঞতা কুকরিমুকরি - সোনারচর - আন্ডার চর - চর মোন্তাজ...

কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ: পর্ব – ৩

-

কুকরিমুকরি – সোনারচর- আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ:

পর্ব – ৩:

১ম পর্ব

কুকরি মুকরি ছেড়ে আমরা এগিয়ে চলেছি৷ ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা সাগরে এসে পড়লাম৷

এবার নানার বোট চালাতে একটু সমস্যা হচ্ছে, আজ বাতাস একটু বেশি, ঢেউ ও বেশ ভাল সাগরে৷ চলতে চলতে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছি যে দুইপাশে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না মাছ ধরার কিছু নৌকা ছাড়া৷

প্রায় দুপুর হয়ে এল, এবার খাবারের আয়োজন শুরু করতে হবে৷ নানা হাঁড়ি পাতিল সব বের করে দিয়ে নৌকায় চুলা জ্বালিয়ে দিয়ে নৌকার হাল ধরলেন৷

সিফাত ভাই তার স্পেশাল খিচুরী রান্না শুরু করল৷ বাতাস বেশি হওয়াতে রান্না করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল৷ আমরা সবাই মিলে কাটাকুটি করে হেল্প করলাম৷

চুলায় রান্না বসাতে বসাতে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই গামলায় মুড়ি আর চনাচুর মিশিয়ে রেডি করে ফেললেন৷ সিফাত ভাই সব গুছিয়ে চুলায় খিচুরীর হাঁড়ি বসিয়ে দেবার পর সবাই মিলে মুড়ি চনাচুর খেতে শুরু করলাম৷

যাত্রাপথে আমরা
যাত্রাপথে আমরা

যাত্রা পথে বেশ কয়েকটা জেলে নৌকায় ঢু মারলাম তাজা ইলিশ মাছ কেনার জন্য৷ শেষে ছোট একটা জেলে নৌকা থেকে পছন্দমত তাজা ইলিশ কিনে নিলাম৷ গরম খিচুরী দিয়ে টাটকা ইলিশ ভাজা খেতে বেশ ভাল লাগবে৷

মাছ কেনার পর সুমি আপু রান্নার কাজ শুরু করল, মাছ দুই আইটেমের বানাবেন আপু একটা ফ্রাই আইটেম, আরেকটা ঝোল দিয়ে করবেন৷

উত্তাল সাগরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল নৌকা৷ মাছ কাটতে আমাদের সমস্যা হচ্ছিল৷ নানা তার সঙ্গী ছোট্ট নাতিকে নৌকার হাল ধরিয়ে দিয়ে আমাদের মাছ কেটে ভালমত ধুয়ে রান্নার জন্য রেডি করে দিলেন৷ সুমি আপু এবার রান্না করা শুরু করলেন৷ তীব্র হাওয়ায় রান্না হতে অনেক সময় লাগছিল৷ কিছু করার নেই আমাদের৷

ঐ যে সামনে সোনার চর
ঐ যে সামনে সোনার চর

আরও ঘন্টা দুয়েকের মত চলার পর আমরা সাগর ছেড়ে তীরে ভিড়লাম৷ এবার সরু চ্যানেল ধরে আমাদের নৌকা সোনার চরের প্রবেশ দ্বারে ঢুকে পড়ল৷

দুইপাশে সবুজের আনাগোনা৷ নদীর দুই পাড়ে সুন্দরবনের মত বড় বড় শ্বাসমূলের ছড়াছড়ি৷ আমাদের নৌকা বনবিভাগের কার্যালয়ের সামনে এসে পৌঁছাল৷

সোনার চরে থাকতে হলে বন বিভাগের অনুমতি নিতে হবে৷ আমরা অনুমতি নিয়ে সোনার চরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম৷ এর মধ্যে সুমি আপুর ইলিশ মাছ রান্না হয়ে গেছে৷ ইলিশের গন্ধে পুরো নৌকা ছেয়ে গেছে৷

নৌকা এগিয়ে চলেছে সোনার চরের দিকে৷ মিনিট বিশেক পর আমরা সোনার চরে পৌঁছে গেলাম৷ বাংলাদেশের অপার এক সৌন্দর্যের নাম সোনার চর।

বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা অপরূপ প্রাকৃতিক এক লীলাভূমি। প্রায় ১০ হাজার একর আয়তনের চরটি দুর্গম হলেও প্রকৃতিক সৌন্দর্যের কমতি নেই।

সোনার চরের নামের পেছনেও কারণ আছে। চরটি সোনা দিয়ে তৈরি না হলেও সূর্যের প্রখর রোদ যখন এর বালুর ওপর পড়ে তখন সোনার মতই চিক চিক করে৷ তাই লোকেরা একে সোনার চর বলে ডাকে৷

যদিও প্রথম কবে চরটি জেগে ওঠে সেই সঠিক তথ্য কারও জানা নেই তবে পটুয়াখালী প্রশাসনের ওয়েবসাইটের তথ্য মতে, ২০০৪ সালের দিকে বঙ্গোপসাগরের কোল জুড়ে জেগে ওঠে চরটি।

আয়তনের দিক থেকে সুন্দরবনের পরেই এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশাল সমুদ্র সৈকত।

নৌকা থেকে চরে নেমেই সবার আগে প্যান্ট বদলে লুঙ্গী পড়ে নিলাম৷ এই পরিবেশের সাথে আসলে লুঙ্গী ছাড়া যায় না৷ এরপর তাবু লাগানো শুরু করে দিলাম আমরা৷

চারপাশটা একদম নীরব৷ মাঝে মাঝে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে৷ চরের পাশেই নদীতে দুজন জেলে নৌকায় বসে মাছ ধরছিল৷ নদীর ঠিক এমন জায়গায় নৌকাটা রাখা ছিল বেশ চমৎকার লাগছিল দেখতে৷

জেলেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত ৷ সোনার চর
জেলেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত ৷ সোনার চর

তাবু লাগিয়ে পাশে দুই গাছের ফাঁকে আমার হ্যামকটা ঝুলিয়ে দিলাম৷ যে যার ইচ্ছামত ঝুলাঝুলি আর ফটোসেশান করল৷ আমি গিয়ে বাবুল নানাকে ধরে নিয়ে আসলাম নৌকা থেকে৷ আজকে নানাকে হ্যামকে ঝুলাবো৷

জাহাঙ্গীর ভাই অবশ্য অন্য প্লানে ছিল৷ পরে বলব সে কথা৷ নানাকে আমি আর জাহাঙ্গীরভাই মিলে ধরে হ্যামকে শোয়ায়ে দিলাম৷ প্রথমে ছিড়ে পড়ে যাবার ভয়ে কু কা পরলেও পরে আরাম পেয়ে নানা আর নামতে চায়না৷ নানাকে হ্যামকে রেখে আমরা একটু ভিতরের দিকে গেলাম, বনের ভেতরটা ঘুরে দেখতে৷

চারপাশটা এত সবুজ দেখতে অসাধারন, পাখিদের কিচির মিচিরে মনটা ভাল হয়ে গেল৷ বেশ অনেকটা দূর পর্যন্ত গেলাম ভিতরে৷ যত যাই তত আরো ভিতরে যেতে মন চাইছিল সবার৷

কামরুল ভাই বলল বনে রাস্তা হারালে বিপদে পড়ে যাব৷ নানাও আসেনাই সাথে৷ তাই ক্যাম্প সাইটে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম সবাই মিলে আর বেশি ভিতরে না গিয়ে৷ ঘুরে আসার পথে আমরা পর্যাপ্ত লাকড়ি জোগার করে নিয়ে আসলাম সাথে৷

সোনার চরে প্রচুর শুকনো কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ আগুন জ্বালাতে আর কোন সমস্যা হবেনা আমাদের৷ আমরা সব লাকড়ি একপাশে স্তুপ করে সাজিয়ে রাখলাম৷

নানা এত লাকড়ি দেখে নৌকা থেকে চিল্লায়ে বলল কি নাতি সারাজীবন কি এইহানেই থাকার ইচ্ছা আছে নাকি৷ এত লাকড়ি জ্বলতে তো মেলাদিন লাগব৷ এখনো অনেক বেলা আছে দেখে আমরা মজা করছিলাম৷

নানা এসে বলল ক্ষুধা লেগেছে৷ আমাদের খাওয়ার কথা মনেই ছিল না৷ পরিবেশটা এত সুন্দর যে সব ভুলে গিয়েছিলাম৷ সবাই সবকিছু তাবুর ভিতরে রেখে নৌকায় ফিরে গেলাম৷ দুপুরে কারো খাওয়া হয়নি৷

সবাই বসে একসাথে খাব এবার গরম গরম ইলিশ আর খিচুরী৷ আমরা হাত মুখ সব ধুয়ে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে গেলাম সবাই৷ নানা আগেই খাবার প্লেইট গ্লাস সব ধুয়ে পরিষ্কার করে রেখেছিল আমরা বনের ভিতরে ঘুরতে ঘুরতে৷

সুমি আপু সবাইকে খাবার পরিবেশন করলেন৷ রান্নাটা জোশ ছিল৷ সবাই পেট ভরে খেলাম৷ এক কথায় সেদিন সবাই সুমি আপুর রান্নার ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম৷ সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম সামনের সব ট্রিপে সুমি আপাকে নেওয়াই লাগবে আমাদের৷ ট্রিপে এই রকম মজার খাবার খাওয়ার এ ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই৷ নানা আর তার ছোট্ট নাতি ইকবালও বেশ প্রশংসা করল সুমি আপার রান্নার৷

সোনার চরে দুপুরের খাবার খওয়া একসাথে ৷
সোনার চরে দুপুরের খাবার খওয়া একসাথে ৷

দিনটা আসলেই বেশ চমৎকার কেটেছে আমাদের৷ প্রত্যাশার চাইতে অনেক ভাল৷ আসলে ট্যুরমেট মনের মত হলে, যে কোন ট্রিপই আনন্দময় হয়৷ হঠাৎ বনবিভাগের একটা টহল বোট পাশ দিয়ে গেল৷

আমাদের চারটা ছেলের সাথে একটা মেয়ে দেখে তারা পরামর্শ দিল রাতে এই জায়গাটা আমাদের জন্য নিরাপদ হবে না৷ তাদের জনবল কম৷ নিরাপত্তা দিতে পারবেনা৷ থাকলে নিজ দায়িত্বে থাকতে হবে৷ কিছু হলে তারা দ্বায় নিবেনা৷

অনিচ্ছা স্বত্বেও সুমি আপুর কথা চিন্তা করে আমরা সোনার চরে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ জাস্ট রাতে থাকারই তো ব্যপার৷ আমরা তো ভালমত সব ঘুরেই নিয়েছি চরে৷ রাতটা নাহয় অন্য কোন চরে থাকব৷

সব গুছিয়ে নিয়ে নৌকায় চেপে বসলাম আবার৷ যে লাকড়িগুলো জড়ো করেছিলাম তার কিছু নৌকায় তুলে নিলাম, কারন জানিনা সামনে যে চরে গিয়ে উঠব সেখানে রাতের বেলা লাকড়ি পাব কিনা৷ তখন সমস্যায় পড়ব৷

নানা ইঞ্জিন চালু করে সন্ধার একটু আগে টান দিলেন নৌকা৷ এবার সিদ্ধান্ত নানার উপড় ছেড়ে দিলাম৷ দেখি নানা কোন চরে নিয়ে নৌকা ভিড়ায়৷

চলবে …

লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!