কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ
পর্ব – ৪ :
নৌকা চলছে জল কেটে৷ সোনার চর পার হয়ে আমরা সাগরে এসে পরলাম আবার৷ নানা বললেন নাতি মোমাদের আন্ডার চর নিয়ে যাব, জায়গাটা নিরাপদ৷ আমরা বললাম চলেন যাই৷
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে এল৷ মাথার উপড় একরাশ তারকারাজি৷ চাঁদ মামা হেসে চলেছে, মাঝে মাঝে মাঝে মেঘের ভিতরে হারিয়ে গিয়ে আবার বের হয়ে জানান দিচ্ছে আমি হারায়নি চিন্তা করিওনা৷
আমি নৌকার সম্মুখ ভাগে বিছানো চাটাইয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম৷ এ যেন কোন স্বপ্ন৷ নৌকা চলছে তার সাথে সাথে যেন চাঁদ মামাও দৌড়াচ্ছে৷ মূহুর্তের জন্য আমি আনমনা হয়ে যাই৷
কিছুক্ষন পর কামরুল ভাইয়ের ডাকে বাস্তব জগতে ফিরে আসি৷ আমাদের নৌকা সাগরের বুক চিড়ে এগিয়ে চলেছে আন্ডার চরের দিকে৷
রাতের আধারে সাগরের বুকে ভেসে থাকা মাছ ধরার ট্রলারগুলোতে হারিকেনের আলো জ্বলছিল৷ দূর থেকে দেখতে অসাধারন লাগছিল৷
রাত সাড়ে সাতটার দিকে আমরা আন্ডার চরে এসে পৌঁছালাম৷ হাপ ছেড়ে বাঁচলাম৷ সোনার চরের কাছেই বঙ্গোপসাগরে জেঁগে ওঠা এক নির্জন দ্বীপ আন্ডার চর। পুটুয়াখালীর জেলা সদর থেকে ৮০-৯০ কি. মি. দক্ষিনে রাঙ্গাবালী থানার অন্তর্গত চর মোন্তাজ ইউনিয়নের একটি ছোট্ট দ্বীপ এই আন্ডার চর৷
আন্ডার চরে পা দিয়েই খুশিতে মনটা নেচে উঠল, বাজারের দোকানগুলোতে বিজলি বাতি জ্বলতে দেখে৷ মনে মনে ভাবলাম যাক মোবাইলগুলো অন্তত চার্জ দিতে পারব৷ যদিও সাথে পাওয়ার ব্যাংক ছিল৷
চরে নামতেই এক দোকানে দেখলাম চা বানাচ্ছে দোকানি, আর দেরী না করে সবাই সেখানে দৌড়৷ আমি সচরাচর তেমন চা খাইনা৷ খুব কাছের বন্ধুদের সাথে থাকলে খাওয়া হয়৷ কিন্তু ট্রিপে বের হলে এটা আমার লাইফ লাইনে পরিণত হয়৷ চা ছাড়া আমার চলেই না৷
আন্ডার চরের মানুষ খাঁটি গরুর দুধের চা খায়, মাত্র পাঁচ টাকা প্রতি কাপ৷ কিন্তু তারা কাপের পরিবর্তে কাঁচের গ্লাসে চা পরিবেশন করে৷ স্বর পড়া গরুর দুধের মালাই চা আমার খুব প্রিয় জিনিস৷ আমরা দুই দফা চা খেলাম৷ প্রানটা জুড়িয়ে গেল একদম।
দোকানিকে বললাম মোবাইলগুলো একটু চার্জ দিব৷ হেসে বললেন এই এলাকায় বিদ্যুৎ নেই৷ সোলার দিয়ে বাতি জ্বালায় তারা৷ তবে পাশের একটা দোকান দেখিয়ে দিয়ে বললেন ঐখানে যান, ওদের আই পি এস আছে৷ চার্জ দিতে পারবেন৷ মোবাইল চার্জ দিতে গিয়ে দেখি সে দোকানে কম্পিউটার চলছে৷ বাহহহ এই দূর্গম চরেও কেউ কম্পিউটার আর নেট চালাচ্ছে দেখে বেশ ভাল লাগল৷
তরুন ছেলেটা আর তার ভাই মিলে দোকানটা চালায়৷ এখানে যে সব মাছ ধরার ট্রলার ভিড় জমায়, পয়সার বিনিময়ে সেইসব ট্রলারের জেলেদের মোবাইল চার্জ দেয় সে৷ সেইসাথে তাদের মোবাইলে গান, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি লোড করে দেয় পয়সার বিনিময়ে৷ বেশ ভালোই ইনকাম তার প্রতিদিন৷
আমাদের দেখেই বলল চার্জ দিবেন ভাইয়া? আমরা আমাদের মোবাইলগুলো চার্জে দিয়ে চরের বাজারটা ঘুরে দেখতে লাগলাম৷ একটা মুরগির দোকান দেখে সিফাত ভাই বলল আজকে মুরগীর বার্বিকিউ করব৷ সবাই সম্মতি দিলাম৷
কিন্তু দোকান তো বন্ধ৷ এলাকার একজন বাড়ি থেকে দোকানদারকে ধরে নিয়ে আসল৷ আমরা বড় দেখে দুইটা মুরগি নিলাম৷ কিন্তু বার্বিকিউ করার নেট তো নাই৷ সিফাত ভাইকে বললাম গুনার তার দিয়ে কাজ চালায়ে দেয়া যাবে যদি পাওয়া যায়৷
এক দোকান থেকে গুনার তার কিনে নিলাম৷ বাজারের সবাই বেশ কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমাদের দেখছিল৷ মুরব্বীদের মনে হাজারটা প্রশ্ন সুমি আপুকে নিয়ে৷ একটা মেয়ে হয়ে এতগুলো ছেলের সাথে একা এসেছে৷ এটা তারা ভাল দৃষ্টিতে দেখছিলেন না৷ বিষয়টা দৃষ্টি এড়াল না৷ জাহাঙ্গীর ভাইকে বললাম৷ তিনিও একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন৷
সিফাত ভাই সুমি আপু আর কামরুল ভাইকে নিয়ে বাবুল নানার পিছে পিছে গেল ক্যাম্পিং সাইট দেখতে৷ বাবুল নানা বললেন পশ্চিম দিকে নদীর পাড়ে বেশ সুন্দর একটা জায়গা আছে ক্যাম্পিং করার জন্য৷ সবাই নৌকায় উঠে সেদিকেই চলে গেল৷
আমি আর জাহাঙ্গীর ভাই বাজারে থেকে গেলাম৷ মোবাইলগুলো চার্জ হলে সেগুলো নিয়ে আমরা ফিরে যাব৷ বাজারে চক্কর দিতে লাগলাম আমরা৷ আমারা আবার গেলাম সেই চা দোকানে৷ স্থানীয় মানুষগুলোর সাথে ভাব জমানোর ঐটাই মোক্ষম জায়গা৷
দোকানে ঢুকে চা অর্ডার করলাম৷ স্থানীয় এক মুরব্বী এবার বলেই বসলেন, ঐ মেয়ে আপনাদের কি হয়? এতগুলো ছেলের সাথে একা চলে আসছে৷ মনে মনে এটাই শুনতে চেয়েছিলাম কারো আছে৷ বিষয়টা তাদের ক্লিয়ার করা দরকার৷ নাহলে সমস্যা হতে পারে৷
চাচাকে বললাম আমার চাচাতো বোন৷ আসতে চেয়েছে তাই সাথে নিয়ে আসলাম৷ জাহাঙ্গীর ভাই ও মাথা নাড়ালেন৷ চাচা বললেন একা একটা মেয়ে এভাবে আনা ঠিক হয় নাই, আপনারা কাজটা ভাল করেন নাই৷ বললাম ওর বাবা পুলিশের বড় অফিসার৷ উনি জানেন তার মেয়ে কোথায় কার সাথে যায় কি কি করে৷ এবার চাচা একটু নরম হয়ে গেল সেই সাথে পাশের উৎসুক জনতাও৷
জাহাঙ্গীর ভাই কানে কানে বললেন জায়গামতন মেরে দিছেন বদ্দা৷ দোকানি চা দিল৷ আড্ডা জমে গেল৷ একে একে সবার সাথে পরিচিত হলাম আমরা৷ নিজেকে হাইকোর্টের আইনজীবী বানিয়ে ফেললাম আর জাহাঙ্গীর ভাই বেশ লম্বা চওড়া মানুষ সেই সাথে সুদর্শনও বটে, তাকে পুলিশের এসআই বলে পরিচয় করায়ে দিলাম সবার সাথে৷ এবার খাতির যত্ন আরো বেড়ে গেল আমাদের৷
ঐ চাচাও বললেন কোন সমস্যা নাই, এলাকা ভাল নিজেদের মতন থাকেন৷ কিছু লাগলে জানাইয়েন৷ জাহাঙ্গীর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন৷ মনে মনে বললাম ঠেলার নাম বাবাজি শুধু জায়গা মত দিতে পারলেই মমলা খতম৷
চায়ের চুমুকের সাথে আড্ডার সময় বেড়ে চলল৷ তাদের নানান ধরনের প্রশ্ন আর কৌতুহল আমাদের ঘুরেবেড়ানো নিয়ে৷ একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চললাম দুইজনে সমান তালে৷
চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে চরের চারপাশটা একটু ঘুরে দেখলাম জাহাঙ্গীর ভাইকে নিয়ে৷ একটু পূর্বদিকে গিয়ে একটা মাদ্রাসাও দেখলাম৷ এরপর পশ্চিম দিকে একটু আগাতেই চর আন্ডা যুব ক্লাব দেখতে পেলাম৷ বাহ এই চরে ক্লাব ও আছে৷
দরজা খোলা দেখে ঢুকে পড়লাম৷ অল্প সময় কাটানো যাবে৷ ভিতরে কয়েকজন তরুন ক্যারাম খেলছিল৷ আমরা বাইরে থেকে এসেছি বুঝতে পেরে স্বাগতম জানাল৷ ছোট চর এখানের প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনে৷ বাইরে থেকে নতুন কেউ এলে তারা বুঝতে পারে৷ পরিচিত হয়ে তাদের সাথে সময় কাটাতে লাগলাম৷
জাহাঙ্গীর ভাই খুব ভাল ক্যারাম খেলে৷ এক তরুন তাকে খেলার অফার করল৷ ভাই রাজি হয়ে গেলেন৷ আমি নিরব দর্শকের মতন খেলা দেখতে লাগলাম৷ কিছুক্ষন পর বাবুল নানা এসে উপস্থিত৷ আমাদের নিয়ে যেতে এসেছেন ক্যাম্প সাইটে৷
খবর দিল সিফাত ভাই, কামরুল ভাই আর নানা মিলে সব তাবু সেট করে ফেলছে৷ আমাদের আর চিন্তা নাই বাহহহ৷ ক্লাবে উপস্থিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চার্জে দেয়া মোবাইল গুলো বুঝে নিয়ে রাতের আঁধারে নানার পিছে পিছে চরের পশ্চিম দিকে ক্যাম্প সাইটের দিকে আগাতে লাগলাম৷ কুয়াশায় কিছুই ভালমতো দেখা যাচ্ছিল না৷
একদম কাছে গিয়ে টের পেলাম ক্যাম্প ফায়ারে লাকড়ি জ্বলছে আর তাবু গুলো নিজের পায়ে দাড়িয়ে আছে৷ সিফাত ভাই বার্বিকিউর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সুমি আপু আর কামরুল ভাই তাকে সাহায্য করছেন৷ ভাগ্য ভাল সোনার চরের কিছু লাকড়ি সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম৷ যে জায়গায় ক্যাম্প সাইট আশেপাশে লাকড়ির বালাই নেই৷
আমরা গুনা দিয়ে নেট বানাতে পারিনি তাই গুনায় বেঁধে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে বার্বিকিউ করলাম৷ আমার গুনার আইডিয়া টা বৃথা যায় নাই শেষ পর্যন্ত৷ সেই রাতে খাবার তৈরি হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল৷ নানা তার ছোট্ট নাতি ইকবালকে নিয়ে নৌকার সম্মুখে মাদুরা পেতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল৷
খাবার রেডি হলে রাত একটার টার দিকে আমি আর কামরুল ভাই নানাকে আর ইকবালকে ডেকে নিয়ে আসলাম৷ আমাদের ইনস্যুলেশান ম্যাটগুলো লইন ধরে বিছিয়ে দিয়ে সবাই একসাথে খেতে বসলাম৷ খাবারটা বেশ ছিল৷ সিফাত ভাই, সুমি আপু অনেক কষ্ট করেছে, জাহাঙ্গীর ভাই আগুনের তাপে হাত পুড়িয়েছে বার্বিকিউ করার সময়৷ একটু দেড়ী হলেও নানা নাতি ভালমত পেট ভরে খেয়েছে৷
খাবার পর নানা আধোয়া হাড়ি পাতিল সব নৌকায় তুলে রেখে নাতিকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন আবার৷ আমাদের তো চোখে ঘুম নাই৷ সিফাতভাই ব্যাগ থেকে ফানুস বের করে নিয়ে আসলেন৷ উড়ানের সময় দেখি একদিকে একটু ছেড়া৷ সিফাত ভাই সেটা রিপেয়ার করলেন৷ সবাই মিলে মনের আনন্দে ফানুস উড়ালাম আন্ডার চরে।
ফানুষ টা বেশ ভালোই উপড়ে উঠেছিল৷ শেষ পর্যন্ত বেশ কিছুক্ষন উড়ে তা নদীর ওপারে চরে গিয়ে পড়েছিল৷ আমরা সবাই যার যার তাবুতে গিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ শোবার আগে নিরাপত্তার জন্য আমাদের সবার তাবু চারপাশে দিয়ে সুমি আপুর তাবু টা মাঝখানে দিলাম৷
সিফাত ভাইয়ের তাবু আর সুমি তাবুর দরজা মুখোমুখী করে দিলাম যাতে সমস্যা হলে সাথে সাথে রেসপন্স করতে পারে৷ রাত বাড়ছে সেই সাথে শিয়ালের হাক ডাক৷ তাবুর ভিতরে স্লীপিং ব্যাগের ভিতরে শুয়ে চোখটা বন্ধ করলেও সহসা ঘুম আসল না৷ একটু দেড়ী হয়েছিল ঘুম আসতে৷
ঘুম আসার আগ পর্যন্ত আমি আর সিফাত ভাই তাবুর দরজা হালকা খোলা রেখে গল্প করছিলাম৷ সুমি আপুকে নগদে পুলিশের মেয়ে আর জাহাঙ্গীর ভাইকে এস আই বানানোর গল্প শুনে সিফাত ভাইয়ের হাসি আর থামে না৷ আমাদের হাসাহাসিতে আরেক তাবুর ভিতর থেকে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাইও হেসে উঠল ৷ কখন যে ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে নাই৷
চলবে ………
#ব_দ্বীপ ( দৃষ্টিতে_মুগ্ধতা)
লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু
Porer porber apekkhay roilum…