কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ
পর্ব – ৫:
১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সকাল সাড়ে ছয়টায় কামরুল ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল৷ শুভ সকাল আন্ডার চর৷ রাতে আমি ভালমত খেয়াল করিনি, আমাদের ক্যাম্প সাইট টা আসলেই জোশ একটা জায়গায় ছিল৷ একদম নদীর কিনারায় উঁচু জায়গায়৷
কামরুল ভাই ফজরের নামাজ আন্ডার চর বাজারের মসজিদে আদায় করে এসে আমাকে ঘুম জাগালেন৷
স্থানীয় এক চাচা বলেছিল এই চরে আগে মানুষজন খুব কম ছিল, অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল এই চর৷ খুব কম মানুষ এটা সম্পর্কে জানত বলে এটাকে আন্ধার চর বলে ডাকত তারা৷ এটা দিয়ে বোঝাত অন্ধকারে থাকা চর যার সম্পর্কে মানুষজন তেমন জানে না৷
কালের পরিক্রমায় নির্জন আর অনুকুল পরিবেশ পেয়ে বিভিন্ন পাখি এই চরে ডিম পারা শুরু করে৷ সেই থেকে এই চরকে আন্ডার চর বলে মানুষ৷ দাপ্তরিক ভাষায় অবশ্য আন্ডার চরের পরিবর্তে তারা চর আন্ডা লেখে৷
জাহাঙ্গীর ভাই সবার আগে উঠে জগিং করে পুরা চর চক্কর দিয়ে আসলেন৷ আমাদের তিনজনের শোরগোলে সুমি আপু ও উঠে গেল ঘুম থেকে৷ এলাকার একজন মুরব্বী এসে দেখে গেল আমাদের, খোঁজ নিলেন রাতে কোন সমস্যা হইছে কিনা৷ বুঝলাম গত রাতে জাহাঙ্গীর ভাইকে পুলিশ বানায়ে দেওয়াতেই এই খাতির৷
হাত মুখ ধুয়ে সবাই ফ্রেস হয়ে তাবু আর ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিলাম৷ গত রাতের গরুর দুধের চায়ের স্বাদটা এখনো মুখে লেগে আছে৷ আবার খেতে মন চাইল কিন্তু ক্যাম্প সাইট থেকে বাজার একটু দূর হওয়ায় আর হাতে সময় কম থাকায় খাওয়া হল না৷
কোন সমস্যা নাই চর মোন্তাজে নিশ্চই একইরকম চা পাব৷ সে আশায় সবার ভারী ব্যাকপ্যাক আর সব জিনিসপত্র নৌকায় উঠায়ে বসতেই দেখি নানার মুখ কালো৷
ঘটনা কি জিজ্ঞাসা করতেই নানা বললেন, গাঙ্গের পানি অনেক নীচে নেমে গেছে, নৌকা ঠেলা দিয়া পানিতে নামানো লাগবে নাতি৷ কি আর করা জাহাঙ্গীর ভাই, সুমি আপু আর আমাদের সব মালপত্রগুলো নৌকায় উঠায়ে দিয়ে আমি, কামরুল ভাই আর সিফাত ভাই নানার সাথে নৌকা ঠেলা শুরু করলাম৷
কিন্তু নৌকা তো নামে না, ভাল মতন ফেঁসে গেছে চরে৷ প্রচুর বল প্রয়োগ করতে হবে আমাদের নামাতে গেলে৷ আমাদের অত বল নাই তাই শ্লোগান দিয়ে নানার বল বাড়ানোর চেষ্টা করলাম সবাই৷
” শউয়ার নানা হেইয়্যো ” বলে জোড়ে ধাক্কা দিলাম সবাই, শুনে নানা নিজেই হেসে উঠল৷ নানা লোংগী গোজ মেরে নিল শেষ চেষ্টা করার জন্য আমরাও সর্ব শক্তি দিয়ে নানার সাথে ঠেলা দিলাম ” শাউয়ার নানা হেইয়্যো ” বলে৷
শেষ পর্যন্ত সবার প্রচেষ্টায় নৌকা পানিতে ভাসল৷ নানা ইঞ্জিন চালু করে টান দিলেন৷ গন্তব্য চর মোন্তাজ৷ নৌকা আন্ডার চর ছেড়ে সামনে এগিয়ে চলল৷ আমি কিছুক্ষন অপলক নয়নে আন্ডার চরের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ চরটা ভাল লেগেছে৷
নানাকে বললাম যদি সম্ভব হয় ফিরে যাবার সময় এই চরে দিনের আলোয় একবার নেমে ঘুরে দেখতে চাই৷ নানা বলল সময় কাভার করলে চেষ্টা করবেন আবার আসতে৷
দুইপাশে সবুজ চর আর মাঝখানে সরু খাল বেয়ে এগিলে চলল আমাদের নৌকা৷ দেখতে এত সুন্দর লাগছিল বলে বোঝাতে পারব না৷
বাজার করার সময় ইমারজেন্সী হিসাবে কিছু বিস্কিট, চিপস, চনাচুর আর মুড়ি নিয়েছিলাম সাথে কচ্ছপিয়া থেকে রওনা দেবার আগে৷ মুড়ি চনাচুর চিপস গতদিন খেয়ে ফেলেছিলাম৷ বিস্কিটের প্যাকেটগুলো রয়ে গেছিল ব্যাগে৷ সুমি আপা সেগুলো বের করে সবাইকে খেতে দিলেন৷ চর মোন্তাজে না পৌঁছানো পর্যন্ত নাস্তা হবে না আমাদের৷ প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর আমরা চর মোন্তাজে এসে পৌঁছালাম৷
চর মোন্তাজ বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত রাঙ্গাবালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন। চর মোন্তাজ ইউনিয়নের আয়তন ৫৬৬৪ হেক্টর ( ১৩,৯৯৭ একর )৷ ২০১১ সালের আদম শুমারির তথ্য মতে চর মোন্তাজ ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা ১৯,৫৬৯ জন আর সাক্ষরতার হার ৪৩.৩%৷
নানা ঘাটে নৌকা লাগিয়ে দিতেই আমরা নেমে পড়লাম আমরা৷
আসেপাশে যে চর গুলো আছে তার মধ্যে চর মোন্তাজ সবচেয়ে বেশি পরিচিত মানুষের কাছে৷ অন্যান্য চরের চাইতে এখানে সুযোগ সুবিধাও একটু বেশি৷ মানুষ এদিকে ঘুরতে আসলে চর মোন্তাজে না নেমে যায় না৷
এই চরের পরিবেশটাও সুন্দর৷ আমরা যখন চরে পা রাখি তখন অনেক নতুন ট্রলার তৈরির কাজ চলছিল চর মোন্তাজে৷
মাছ ধরার মৌসুম তাই কেউ নতুন ট্রলার বানাচ্ছে কেউ বা পুরানোটা রিপেয়ার করে নিচ্ছে গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ ধরার জন্য৷ এখানে সেলফোনের নেটওয়ার্ক ভাল পাওয়ায় সবাইকে সাথে নিয়ে ফেসবুক লাইভে গেলাম৷
নানা তাগাদা দিলেন সময় কম যেতে হবে বহুদূর সেই তারুয়া দ্বীপে৷ দেরী না করে আমরা সবাই নাস্তা করার জন্য দোকানের দিকে দৌড়ালাম৷ কলা বনরুটি দিয়ে নাস্তা করলাম সবাই৷
ভেবেছিলাম গরুর দুধের চা খাব৷ কিন্তু কপাল খারাপ এইখানে গরুর দুধের চা পেলাম না৷ তাই সাধারন কনডেন্স মিল্কের চা খেতে হল৷ নানা অবশ্য আসার সময় নৌকাতে আশা দিয়েছিল গরুর দুধের চা পাবার কিন্তু পেলাম না৷
নাস্তা করে চরে বেশ কিছু সময় ঘুরে বেড়ালাম আমরা৷ নানা ডাক দিলেন নৌকায় উঠে বসতে৷
লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে৷ তাই সময় নষ্ট না করে সবাই উঠে পড়লাম নৌকায় আবার৷ নানা ইঞ্জিন চালু করে টান দিলেন নৌকা৷ গন্তব্য তারুয়া দ্বীপ।
চলবে …
#ব_দ্বীপ ( দৃষ্টিতে_মুগ্ধতা )
লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু