“দুর্জ্জয় সমন ভয় ত্বরিবার তরে
অভয়া দুর্গা নাম রাখিলাম দ্বারে
১২৭৮ সন ”
এখনো থেকে যাওয়া অক্ষত ঘর বাড়ির মাঝে দুটি দালান আছে বসতির জন্য, একটি বড় মন্দির। আর বিচ্ছিন্ন একটু দূরে ছোট মন্দির একটা।
বসতির জন্য করা বড় দুইটি দালানের একটির দরজার উপরে স্থায়ী ভাবে খচিত উপরের কথা কটি।
ধরে নেয়া যায় সেই বৎসর ( ১২৭৮ বাংলা) অথবা তারো আগে থেকে এই বাড়িতে চলে আসছে দুর্গা পূজা। মাঝে গ্যাপ গিয়েছে এক বৎসর, ১৯৭১ সালে।
দেশ ছেড়ে না পালালে মা দুগ্গারও সাধ্য হতো না রক্ষা করা।
মহিষাসুরের চাইতেও হাজারগুণে নৃশংস ছিলো দেশীয় রাজাকার আর পাঞ্জাবী সেনারা।
‘পুরোনো’ পূজা দেখতে চান অনেকে। ‘পুরোনো পূজা’ মানে অনেক আগে থেকে চলে আসছে, এমন পারিবারিক পূজা। এই বাড়ির পূজা শুধু পুরোনোই নয়, সারা বছর ঢাকা বা গোপালগঞ্জে থেকে শুধু পূজোর কদিনের জন্য বাড়ি যান না এরা। স্থায়ীভাবেই সম্বৎসর থাকেন বাড়িতে।
তাই ‘পুরোনো পূজা’ দেখতে আগ্রহীরা নির্দ্ধিধায় চলে যেতে পারেন এই বাড়িটিতে।
ঘন্টা খানেক যা দেখেছি এই বাড়ির লোকজন-কে, সমাদরও পাবেন ভালো, ধরে নেয়া যায়।
কর্তা – গিন্নী সবাই অতিথি বৎসল। কিছু লক্ষণ দেখেছি এর।
নিজের থেকে এরা ‘ঘোমটা’টি সরিয়ে দিয়েছেন প্রতিমার মুখ দর্শন করানোর জন্য।
সিঁড়িতে ‘লেপ্টে’ বসতে দেখে মুছে দেয়ার জন্য বাধা দিচ্ছিলেন বাড়ির বধু একজন।
বসছিলাম ছবি নেয়ার জন্য।
দোতলার রেলিং এ মেলে দেয়া ছিলো তোষক কাপড়চোপড় ।
নিজে থেকেই সরিয়ে দিয়েছেন ছবি নেয়ার সুবিধার জন্য।
তেড়ে আসেন নি – কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন বলে।
বধূ একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিগো দিদি, বলি হবে না?
বলি হবে ৮ টা!
হতেই হবে।
বাড়িতেই এতো এতো লোকজন।
পাড়া প্রতিবেশীও কি বাদ থাকবে নাকি!
তিন দিনের নিত্য প্রসাদ।
অন্তত একদিন মেঝেতে আসন বিছিয়ে দধি মাংস সহকারে অন্ন ব্যঞ্জন।
সহজলভ্য দুধের জন্য রসগোল্লার জন্য খ্যাত পুরো ফরিদপুর।
দধিতো থাকবেই।
বলি নিয়ে জানালেন, বলি হবে ৮ টা।
৭ টা পাঁঠা ১ টা মেষ।
পুরোনো সেই প্রথাটি এখনো ধরে রেখেছেন।
অতীতে মহিষ বলি দেয়া হতো কি না কে জানে!
থাকলেও সে লোপ পেয়েছে হয়তো শত শত বৎসর আগে।
হিন্দুদের মাঝে মহিষ বলিদানের প্রথা ছিলো।
কাঠমুন্ডুর দরবার স্কোয়ারে বলি দেয়া হতো – শত শত, হাজার হাজার!**
অবিশ্বাস্য বা কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে লেখার সম্ভাবনা থাকলেও এটাই ইতিহাস।
তবে এই প্রথা রহিত করেন গোর্খা শাসক পৃত্থি নারায়ণ শাহ (১৭২৩ – ১৭৭৫)।
রাজ পরিবারের গৃহদেবতা ছিলেন তেলেজু দেবী।
রাজকীয় তেলেজু মন্দির ছিলো।
যুদ্ধ জয় করে ফিরে নরবলি দিয়েছিলেন দেবীকে তুষ্ট করতে।
কিন্তু রাতে স্বপ্নে এসে অসন্তোষ প্রকাশ করেন দেবী।
সেই থেকে এই বলিদান হচ্ছে না দরবার স্কোয়ারে।
যাক, বলির কথা শুনার পর এদিক ওদিক তাকালাম, বাঁধা আছে কিনা কোথাও, ৭ পাঁঠা আর ১ মেষ।
চোখে পড়লো না।
হয়তো আনা হয়নি এখনো।
তবে হাব-ভাবে কথা বার্তায় মনে হলো, সময় পেলে মোয়া আর নাড়ু খেয়ে আসা যেতো।
গল্প জুড়তে হতো একটু সময় নিয়ে। নিজের বাড়ির পূজোর কথা, ‘৭১ থেকেই যা বন্ধ স্থায়ী ভাবে।
পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন দালানকোঠাও আছে মোটামুটি আগের মতোই, বিশাল বড় উঠোন ঘিরে সব দালান।
মন্দিরের সামনে ঢেউ টিনের চৌচালা বড় নাটমন্দির।
সামনে বিস্তৃত ঘাস বিছানো খোলা মাঠ পাড় হয়ে জঙ্গলের মতো গাছ ঘেরা বিশাল পুকুর।
ধাপে ধাপে নেমে গেছে শান বাঁধানো ঘাট।
মাছ চাষের খাবার বিষ দিয়ে কলুষিত করা পুকুর নয়, স্বচ্ছ টলটলে জলের পুকুর।
আমি নিশ্চিত, এই বাড়িতে পূজো দেখতে গেলে এই পুকুরেও নামা যাবে।
কারণ বাড়ির বাইরের লোকজনকে দেখেছি এই পুকুরে স্নান করতে।
পুকুরের ঘাটলাটার মুখের দুই পাশে দুই তুলসী বেদী, সবুজ সতেজ পাতায় ছাওয়া।
এই ঘাট পেরিয়ে ওদিকে আবার আরেক মন্দির।
এতোটা বড় নয়, তবে মৌলিকত্ব আছে নির্মান কাঠামোয়।
সেটি লক্ষী নারায়ণ মন্দির। নির্মাণ সাল ১৩৩০।
বাড়িটি নির্মাণের ৫২ বছর পরের। তাও এখন শত বছর হতে চললো প্রায়।
এই বাড়ির সবচাইতে ভালো লাগা দিকটি হচ্ছে শিশু কিশোর যুবা বৃদ্ধা নারী পুরুষ সব মিলিয়ে জমজমাট এক বাড়ি।
পূর্বপুরুষের জমিদারি বা এখনকার বিরাট এই বাড়ির ঠাটবাটের চিহ্ন নেই কারো চোখে মুখে।
নিতান্তই গ্রামের আর দশটা পরিবারের মত সাধারণ পরিবার।
না, কোন আলোকসজ্জা বা সাজ সজ্জার প্রস্তুতি চোখে পড়ে নি।
এটা এক শুভ লক্ষণ।
আশা করা যায় পূজা হবে সাত্ত্বিক মতে।
তাই, হৈ হুল্লোড় আলোর ঝলকানির উৎসব নয়, সত্যিকারের পূজো দেখতে হলে কাছাকাছি এটাই হতে পারে সর্বোত্তম destination।
নইলে হতাশ হতে হবে ‘আজাইরা কামে’ ১৬/১৮ ঘন্টা ড্রাইভের বাগেরহাটের হাকিমপুরের শিকদার বাড়ির পূজো দেখতে গেলে।
ভালো কথা, ঠিকানাটাইতো বলা হয় নি।
এটা গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের উত্তর নারায়ণপুর গ্রামে।
ভুঁইয়া বাড়ি বা মন্দির বাড়ি বললেই দেখিয়ে দেবে যে কেউ ।
পূজো দেখার সাথে বাড়তি বোনাস থাকবে ঘুরেফিরে বাড়িটি দেখা আর সাঁতার জানা থাকলে, পুকুরটিতে সাঁতার কাটা।
** The Kali Puja, which lasts for a period of ten days, commemorates the victory of the bloodthirsty Kali, the goddess of de- struction, over the demon Mahishasur, who is usually represented in the form of a buffalo, It reaches its climax in the ceremony of the blessing of the colors, when the army propitiates the goddess by the sacrifice of thousands of buffaloes, every officer being expected to furnish one or more animals, according to his rank.
THE LAST HOME OF MYSTERY By Alexander Powel , Page 199-200
লিখাঃ তপন রায়