স্বর্গচুত্য প্রথম মানব দম্পতির ভূপৃষ্ঠে অবতরনের সেই উষালগ্নে সৃষ্টি সুখের উচ্ছ্বাসে ভাসতে পারেনি মানব জাতি। এখনকার চাকচিক্যময় মানব সভ্যতা তখন ছিল এক বুনো সম্প্রদায়ের প্রতিচ্ছবি । অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। ছিল না ভাষা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা কৌশলগত কোন জ্ঞান। পেরিয়ে গেছে শত সহস্র বছর। মানুষ গুহা থেকে পৌঁছে গেছে কম্পিউটারে, সাগরবক্ষে নির্মান করেছে আলোকময় দ্বীপমালা, মরুভূমিতে মরুদ্যান। বার্তাবাহক কবুতর জন্ম দিয়েছে পকেটবন্ধি স্মার্টফোন। ফেইসবুক, ভাইবার এর যুগে ইন্টারনেট এখন মৌলিক অধিকার।
বিবর্তনের গল্প বলছিলাম, সহজ করে বললে আমাদের টিকে থাকা, বেড়ে উঠা, এগিয়ে যাওয়ার গল্পে শুধুমাত্র দৃশ্যত বাইরের পরিবর্তনের গল্প এটি। শুধুমাত্র বললাম কারণ শুধু দৃশ্যত এসব কাঠামোই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, টিকেও থাকবে না। আপনার চিন্তা, চেতনা, দৃষ্টি, স্পর্শ, এমনকি নিঃশ্বাসের সাথে মিশে আছে অদৃশ্য আমিত্ব। আপনি তাকে ব্যক্তিত্ব, বিবেক, মমতা, ভালোবাসা, এমনকি প্রেমও ভাবতে পারেন। আমি নাম দিলাম অনুভূতি। সময়ের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি ধাপে সেই অনুভূতি পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন বুনো সম্প্রদায় থেকে আজকের আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা, শুদ্ধতার পার্থক্য দেখলেই অনুভূতির বিবর্তন বুঝা যায়।
ধর্ম আর অনুভূতি দুটো অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি বিশ্বাস করি ধর্মগ্রন্থতে কতগুলো শব্দ থাকে মাত্র। মন্দিরে থাকে ইট পাথরের দেয়াল আর সাজানো মুর্তি। নিরাকার ঈশ্বর মানুষের মনের চেয়ে মস্তিষ্কে থাকে বেশি। শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য – জীবনের প্রতিটি ধাপে আপনার মস্তিষ্ক, মনন কতটা স্নিগ্ধ , উর্বর হল সেটায় ধর্ম। ঈশ্বর মানুষের কর্মের বিচারে কর্মফল দেন (কর্মযোগ)। মনের সারল্য, সততা, ভক্তিতে মুগ্ধ হয়
( ভক্তিযোগ)। আপনার বিশ্লেষণ ধর্মী শুদ্ধ, সুস্থ, সুন্দর জ্ঞানে ( জ্ঞানযোগ) ঈশ্বর তার সৌন্দর্য্য দেখায়। ধর্মের আদিকথা তথা ঈশ্বর কিংবা মোক্ষ লাভের এই তিন পথের কথা শাস্ত্রেই বলা আছে।
আপনি বুঝেন কিংবা না বুঝেন, ঈশ্বর আপনাকে কর্ম, ভক্তি, আর জ্ঞান দিয়েই পরিমাপ করছে প্রতিনিয়ত। আপনার মানসিক সৌন্দর্য্যও তথা অনুভূতিগুলোও প্রভাবিত হয় এই তিনটি জিনিস ধারা ; এটায় ধর্ম।
ঈশ্বরের কাছে আপনি এতটায় ক্ষুদ্র যে আপনার জন্মপরিচয় (জাত), বংশপরিচয় ( সামাজিক অবস্থান) , কর্মপরিচয় এখানে মূল্যহীন। আপনি যদি জাত বিশ্বাস করেন, মানেন তবে আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে ঈশ্বরেরও জাত আছে। ছোট জাতের ঈশ্বর, বড় জাতের ঈশ্বর। খোলাসা করে বলছি, ধর্ম বলে ঈশ্বর আত্মারূপে সকল জীবের মধ্যে সমভাবে বিরাজমান। ধর্মগ্রন্থগুলোর কোথাও পাবেন না বড় জাতের মানুষদের মাঝে বড় মাপের ঈশ্বর বিরাজমান। কর্মের ব্যাপ্তি, ধরণ অনুযায়ী ধর্মেই জাতের কথা বলেছে। কোথাও বড়, ছোট বলা হয়নি। আপনি বুঝে কিংবা না বুঝে নিজেকে বড় জাতের প্রাণী ভেবে আত্ম অহংকারে ভুগতে পারেন। এতে ধর্ম কিংবা ঈশ্বরের কিছু আসে যায় না। হিন্দু ধর্ম এতটা হীন কিংবা ঠুনকো নয় যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করবে। সংকীণতা, আত্মগরিমা এসব আপনি সমাজ থেকেই শিখেছেন। শুরুতে সভ্যতার বিবর্তনের গল্পটা শুধুমাত্র এই জন্যই লেখা। মানব সভ্যতার বিকাশের প্রতিটি ধাপে সমাজ এমন অনেক কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে। আবার সেই সমাজেই সময়ের পরিবর্তনে নিজেকে শুধরে নিয়েছে। যেভাবে দাস প্রথা, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে নিজেকেই হিন্দু ভাবতে লজ্জা হয় আমার । ২০১৭ তে বাস কতগুলো মানুষ নিজেদের ধর্মের মধ্যেই ছোট বড় বিভাজন তৈরি করে ফেলেছে। যেটার ধর্মীয় কোন ভিত্তি নেই। আমি নিশ্চিত অল্পকিছু দিনের মধ্যে দাসপ্রথা, সতীদাহ প্রথার মত এই জাতপ্রথাও হাস্যকর কৌতুকে পরিনত হবে। সে আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের তাতে কিছুই আসে যায় না। এটায় অনুভুতির বিবর্তন। স্থান, কাল, পারিপ্বার্শিক অবস্থান আপনার মন, চিন্তা চেতনা, তথা ধর্মকে নিয়ন্ত্রন করে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। জাতপ্রথা উদাহরণ মাত্র।
আবারো বলছি ঈশ্বর আপনাকে কর্ম, ভক্তি, আর জ্ঞান দিয়েই পরিমাপ করছে প্রতিনিয়ত। আপনার মানসিক সৌন্দর্য্যও তথা অনুভূতিগুলোও প্রভাবিত হয় এই তিনটি জিনিস ধারা ; এটায় ধর্ম।
সবাইকে পুজোর অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ভালো কাটুক সবার পুজো।