আড়িয়াল বিল
শ্রীনগরের আড়িয়াল বিল সম্পর্কে কিছু কথোপকথন।
আপনি যদি শ্রীনগরের হয়ে থাকেন, অজানা তথ্য দিচ্ছি! মাত্র চার মিনিট চেয়ে নিচ্ছি..
আড়িয়ল বিল দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন বিল। এর প্রতিবেশ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে হাজার বছর ধরে। ধারণা করা হয়, অতি প্রাচীন কালে এ স্থানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল ছিল, পরে উভয় নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের ফলে এই স্থান শুষ্ক হয়ে বিলে পরিণত হয়। ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ জেলা এবং পদ্মা নদীর মাঝখানে একটি ছিটমহলসম জলাভূমি এ আড়িয়ল বিল।
ইতিহাসবিদ যতীন্দ্র মোহন রায় তার ‘ঢাকার ইতিহাস’ (১৯১২) গ্রন্থে বিল অধ্যায়ে বলেন, ‘সম্ভবত ঢাকা জেলার বিলগুলোর মধ্যে আয়তন ও প্রসস্থতায় আড়িয়ল বিল সর্বপেক্ষা বৃহৎ।
টেইলার সাহেব উহাকে চূড়াইন বিল বলিয়াও অভিহিত করিয়াছেন।’ এ সু-প্রসস্থ বিলটি পূর্ব-পশ্চিমে ১২ মাইল দীর্ঘ এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৭ মাইল প্রস্থ।
এ বিলের দক্ষিণ প্রান্তে দয়হাটা, শ্যামসিদ্ধি, প্রাণীমণ্ডল, গাদিঘাট, উত্তর রাঢ়ীখাল; উত্তরে শ্রীধরপুর, বাড়ৈখালী, শেখরনগর, মদনখালী, আলমপুর, তেঘরিয়া; পূর্বপ্রান্তে হাঁসাড়া, ষোলঘর, কেউটখালী, মোহনগঞ্জ; পশ্চিমে কামারগাঁও, জগন্নাথপট্টি, কাঁঠালবাড়ি, মহতপাড়া প্রভৃতি।’
মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকা জেলার ৩টি উপজেলায় বিস্তৃত রয়েছে দেশের প্রাচীন জলাভূমি আড়িয়ল বিল। তবে উত্তর-পূর্বাংশে সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন, শেখরনগর, চিত্রকোট ও রাজানগর ইউনিয়নের কিছুটা অংশে বিস্তৃত। এ বিলটি মূলত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। পশ্চিমে একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে পশ্চিম-উত্তর অনেকটা বেঁকে গেছে।
২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্থের এ জলাভূমির আয়তন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। শ্রীনগর, নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৭০টি গ্রাম নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে আড়িয়ল সভ্যতা ও এর জীবনধারা।
তিনটি উপজেলার মধ্যে শ্রীনগরে রয়েছে ৮টি ইউনিয়ন, ভাগ্যকূল ইউনিয়নের জগন্নাথপট্টি ও কামারগাঁও মৌজা, বাঘড়া ইউনিয়নের পূর্ব মৌড়া মৌজা, শ্যামসিদ্ধি ইউনিয়নের মত্তগ্রাম ও গাদিঘাট মৌজা, শ্রীনগর ইউনিয়নের দয়হাটা মৌজা, ষোলঘর ইউনিয়নের বিল আড়িয়ল ও ষোলঘর মৌজা, বাড়ৈখালী ইউনিয়নের বাড়ৈখালী, বিল আরৈ, শ্রীধরপুর, দাসের চক ও পূর্ব মরিচপট্টি মৌজা, হাঁসাড়া ইউনিয়নের আলমপুর, লস্করপুর ও হাঁসাড়া মৌজা, রাঢ়ীখাল ইউনিয়নের রাঢ়ীখাল ও মাইজপাড়া মৌজা; দোহার উপজেলার মধ্যে রয়েছে ৪টি ইউনিয়ন, নারিশা ইউনিয়নের হাঁসী, ঝনকী ও শিমুলিয়া মৌজা, সুতার পাড়া ইউনিয়নের ঘাটা, সুতার পাড়া, দামুয়া ও মুন্সিকান্দা মৌজা, মুকসুদপুর ইউনিয়নের পশ্চিম মোড়া মৌজা, রাইপাড়া ইউনিয়নের লস্কর কান্দা ও ইউসুফপুর মৌজা; নবাবগঞ্জ উপজেলার মধ্যে রয়েছে ৪টি ইউনিয়ন, বক্সনগর ইউনিয়নের বড় বক্সনগর, ছোট জাফরপুর, দীঘিড়পাড়, টুকনিকান্দা, ছোট বক্সনগর, বর্দ্ধন পাড়া ও কোমরগঞ্জ মৌজা, চূড়াইন ইউনিয়নের বড় গোবিন্দপুর, দুর্গাপুর, চূড়াইন, তিলখোলা, কামারখোলা, মনসুরনগর, সেরাজুদ্দীনপুর ও পশ্চিম মরিচপট্টি মৌজা, গালিমপুর ইউনিয়নের সুরগাঁও ও গালিমপুর মৌজা, কলাকোপা ইউনিয়নের বড় জাফরপুর ও বারৈখোলা মৌজা।
এ বিলকে ঘিরে চার থানার ১০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা চলে। শত শত বছর ধরে বিলে বসবাস করছে এ অঞ্চলের আধিবাসী।
আড়িয়ল বিলের প্রাচীন নাম ছিল চূড়াইন বিল। তবে আড়িয়ল বিল নামেই সর্বত্র পরিচিত, কি ভাবে বিলের নাম আড়িয়ল হলো তা এখন আর স্পষ্ট নয়; তবে ইতিহাস পাঠ এবং লোকমুখে শুনে জানা যায়, আড়িয়াল খা নদী ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা নদী হিসেবে বিক্রমপুরের ভেতর দিয়ে উত্তর-দক্ষিণমুখী প্রবাহিত ছিল। আর পদ্মার একটি শাখা পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে আড়িয়াল খাঁ নদীর সঙ্গে এসে মিলিত হয়, দুটি নদীর স্রোত যেখানে এসে মিলিত হয় সেখানে তীব্র আড়াআড়ি হতে প্রচণ্ড ঘূর্ণায়মানের সৃষ্টি হয়; এ ঘূর্ণায়মান হতে প্রচণ্ড কূমের সৃষ্টি হয়, সে কূম হতেই কালে কালে জায়গাটি শুষ্ক হয়ে বিলে পরিণত হয়, আর এ বিলের নাম হয় আড়িয়ল বিল।
বর্তমান মাদারীপুরের কাছে আড়িয়াল খাঁ নদীর একটি অংশ দেখা যায়। অন্য যে কথা শোনা যায় তা হল, আড়িয়ল অর্থ জলজ ভূমির আধার, যে স্থানটিকে প্রচুর মৎস্য সম্পদের অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আড়িয়ল বিলে প্রচুর মৎস্য ও জলজ উদ্ভিদের অভয়ারণ্য বিধায় স্থানীয়দের কাছে জায়গাটি ‘আড়িয়াল’ হিসেবে চিহ্নিত, আড়িয়াল> আড়িয়ল শব্দের উদ্ভব হয়েছে, আর আড়িয়ল ও বিলের সমন্বয়ে বিলের নাম হয় আড়িয়ল বিল।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শ্রীনগর উপজেলার আড়িয়াল বিলের দূরত্ব প্রায় ৪২ কিলোমিটার। ঢাকার গুলিস্থান, আবদুল্লাপুর বা মিরপুর থেকে মাওয়াগামী যেকোন বাসে চড়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে যাওয়া যায়। শ্রীনগরের বাজার থেকে রিকশা নিয়ে গাদিঘাট যেতে হবে। ঘাট থেকে হাতে টানা বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় শ্রীনগর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আড়িয়াল বিলে যেতে পারবেন। চাইলে কয়েকজন মিলে ১০০০-১৫০০ টাকার মধ্যে নৌকা ভাড়া করে সারাদিন আড়িয়াল বিল ঘুরতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
ঢাকার কাছাকাছি হওয়ায় সকালে রওনা দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসা যায়। তবে রাত্রিযাপনের প্রয়োজনে মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে হোটেল থ্রি স্টার ও হোটেল কমফোর্টের মতো বেশকিছু সাধারন মানের হোটেল পাবেন। এছাড়া মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত আকর্ষণীয় রিসোর্টের মধ্যে পদ্মা রিসোর্ট, মাওয়া রিসোর্ট এবং মেঘনা ভিলেজ হলিডে রিসোর্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্ষা এলে আড়িয়ল বিল পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলা সাহিত্যে-সংস্কৃতির লীলাভূমি বিক্রমপুর। আর বিক্রমপুরের বর্ষা না দেখলে শিল্প, সাহিত্য আর সংস্কৃতির প্রেমিক হিসেবে নিজের পরিচয়টাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বর্তমানে বর্ষায় বিক্রমপুরের আগের সেই সৌন্দর্য আর নেই, তবে আড়িয়ল বিলে বর্ষায় তার কিছুটা ছাপ এখনও পাওয়া যায়।