• পরিচিতি
  • ভ্রমণ
  • সব পোস্ট
পরিচিতি থানচির গহীনে

থানচির গহীনে

-

থানচি মানেই এক অন্যরকম ভালোবাসা। দুর্গম ট্রেকিং রুট, দুই ধাঁরে উঁচু উঁচু পাহাড়ের সাথে সাঙ্গু নদীর অববাহিকা , এডভেঞ্চার প্রেমী যেকাউকে আকর্ষণ করতে বাধ্য।

আর বেশি ভূমিকা না দিয়ে, সরাসরি ট্যুরে চলে আসি।

ঢাকা থেকে আমরা ৯ জনের একটা গ্রূপ ১৬ই সেপ্টেম্বর বুধবার বান্দরবানের উদ্দেশে রওনা করি। কপাল করে এমন একটা বাস পাই, যেটা আমাদেরকে বান্দরবান যে পৌঁছাতে পেরেছিল , তাঁতেই হাজার শুকরিয়া।

ভোর ৬ টার দিকে বান্দরবান পৌঁছানোর কথা থাকলেও , বাসের অতি মানবীয় আচরণে আমরা সকাল ৭:৩০ এ নামতে পারি বান্দরবন।

দ্রুত সকালের নাস্তা শেষ করে, আমরা একটা চাঁদের গাড়ি ঠিক করে ফেলি , আর রওনা করি , থানচির উদ্দেশে।

এটা আমার দ্বিতীয় বার থানচি যাওয়া, বান্দরবন থেকে থানচি যাওয়ার রুট , যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য।

দুই পাশের সারি সারি পাহাড়ে, মেঘ রোদ্রের খেলার সাথে , চাঁদের গাড়ির উপর দিয়ে মাথা বের করে দিয়ে চলতে থাকি থানচির পথে।

তবে সবাই একসাথে , চাঁদের গাড়িতে দাঁড়াবেন না , এতে গাড়ির ব্যালেন্স হারাতে পারে। যা পাহাড়ি পথে , খুবই বিপদজনক।

পথিমধ্যে, বিজিবি চেকপোস্টে আমাদের সবার নাম এন্ট্রি করে নেই। এখানে একটি সুন্দর ক্যাফেটেরিয়াও হয়েছে এখন, যা আমি আগেরবারে দেখিনি। তাঁদের আমড়ার জুসটা নাকি খুবই ফেমাস, তবে বাজেট ট্রাভেলর হিসাবে আমার আর ট্রাই করা হয়নি।

বেলা ১২ টা নাগাদ আমরা পৌঁছাই থানচি , সেখানে আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষারত ছিল আমাদের গাইড, সিমিয়ান দাঁ।

থানচি থানায় দ্রুত নাম এন্ট্রি করে, আমরা আমাদের দুপুরের লাঞ্চ করে নেই, এবং ইঞ্জিন বোটে করে রওনা করি বড় পাথর-তিন্দুর উদ্দেশে।

দুইটা বোট নিয়েছিলাম, এক এক বোটে সর্বোচ্চ, পাঁচ জন বসতে পারে, এবং সবাইকে অবশ্যই লাইফ-জ্যাকেট পরে নিতে হবে।

আর হে, সবথেকে ইম্পরট্যান্ট , এখান থেকেই আপনার ফোনের নেটওয়ার্ক কমতে শুরু করবে, এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই আপনি প্রবেশ করবেন নেটওয়ার্ক বিহীন এক অন্য রাজ্যে।

সাঙ্গুর বুকচিড়ে, দুপাশের উঁচু সবুজ পাহাড়ের মধ্য দিয়ে ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তিন্দু বড় পাথর । এখানকার , বিশাল বিশাল দৈত্যাকার পাথর গুলো আপনার নজর কাড়তে বাধ্য।

বোট থেকে নেমেই, ট্রেকিংয়ের প্রস্তুতি, ব্যাগ গুলো বোটে রেখে,

শুরু করলাম আমাদের ট্রেকিং।

গন্তব্য লীলুক ঝর্ণা , খারা পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম । উপরে উঠা যেন শেষ হচ্ছিলনা আর। আমাদের গাইড আমাদেরকে পথ দেইখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাদের গন্তব্যে।

খাড়া পাহাড় বেয়ে মোটামুটি যখন উপরে চলে এসেছি, তখনই ঝর্ণা আমাদের সামনে দেখা দিল, তবে দূর থেকে । ঝর্ণার পানি দূর থেকে পড়তে দেখে আবারো নতুন উদ্যমে শুরু করলাম সামনে এগুনো।

দুরথেকে দেখা, লীলুকের প্রথম রূপ
দুরথেকে দেখা, লীলুকের প্রথম রূপ

এবার শুধু নামার পালা,

তাই আগের থেকে কষ্ট কম হচ্ছে । সর্বমোট ঘন্টা দুয়েকের ট্রেকিং শেষে আমরা লীলুক ঝর্ণার সামনে এসে হাজির।

ঝর্ণায় পর্যাপ্ত পানি ছিল, এবং সেই সাথে ছিল প্রচুর বাতাস।

ঝর্ণার কাছাকাছি যাওয়া আগেই আমাদের পুরো শরীর ভিজে শেষ ।

লীলুক ঝর্ণা, বাংলাদেশের অন্যতম একটি উঁচু ঝর্ণা। ঝর্ণার মায়াবী কান্নায় সিক্ত হয়ে আসতেই মনচাচ্ছিলো না সেখান থেকে । কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে আসছে , তাই আমরা রওনা করে দিলাম ।

দানবীয় লীলুক ঝর্ণা
দানবীয় লীলুক ঝর্ণা

পূর্বের নেয় , ট্রেকিং করে ফিরে আসলাম তিন্দু, যেখানে আমাদের বোট অপেক্ষা করছিল। এবার রেমাক্রি যাওয়ার পালা ।

সন্ধ্যা হয় হয়, এমন মুহুর্তের এই বোট জার্নিটা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম রেমাক্রি।

আমরা আজ রাতে এখানেই থাকব, সবাই ফ্রেস হয়ে কটেজে উঠে পড়লাম। কটেজটা বেশ সাজানো গুছানো ছিল ।

আমরা আমাদের গাইডের সাথে কথা বলে , আগে থেকেই এই কটেজ এবং এখানে খাওয়ার বিষয়টি ঠিক করে রেখেছিলাম।

কটেজে রেস্ট নিয়ে , বেরিয়ে পড়লাম রাতের রেমাক্রি ঘুরে দেখতে । কয়েকটি ছোট ছোট দোকান রয়েছে , সেখানে চা – বিস্কুট খেয়ে চললো রাতের আড্ডা।

আমাদের সাথে যোগ দিলো , আমাদের গাইড সহ আরো লোকাল কয়েকজন , বেশ ভালো একটা আড্ডা শেষে , রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কারণ পরদিন খুব ভোরে উঠা লাগবে ।

আজ আমাদের শেষ দিন, খুব ভোরে উঠেই কটেজ থেকেই দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের খেলা ।

আজকে আমরা নাফাখুম যাবো ।

আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমাদের ট্রেকিং করেই নাফাখুম যাওয়ার কথা, এবং সেভাবেই আমরা আমাদের ট্রেকিং শুরু করলাম।

সাথে করে লাইফ-জ্যাকেট নিয়ে নিলাম, এবং হালকা নাস্তাও করে নিলাম।

ট্রেকিং শুরুর প্রথম দিকে , বেষকয়কজন লোকাল লোকজন বললো, বোট নিয়ে যেতে, পানি কিছুটা বেশি । কিন্তু আমরা আমাদের আগের সিদ্ধান্ততেই অনড়, এবং ট্রেকিং করেই চলতে থাকলাম ।

এখানে বলে রাখা ভালো, রেমাক্রি থেকে নাফাখুম রুটে, সবসময় বোট পাওয়া যায় না । যখন পানি কিছুটা বেশি থাকে , তখনই আপনি অনেকখানি পথ বোটে করে পাড়ি দিতে পারবেন ।

যাইহোক, আমরা আমাদের ট্রেকিং টা খুব ভালোই, উপভোগ করতে থাকলাম। ভোরের ঠান্ডা হিমেল বাতাস , এবং ঝিরিপথের পানির কল কল শব্দ আপনাকে অন্য এক জগতে নিয়ে যেতে বাধ্য ।

ঘন্টা দেড়েক ট্রেকিং করার পর, একটা ছোট ঝর্ণা পেলাম, সুড়ঙ্গের মতো ছোট একটা পথ, আর সেটার শেষেই ঝর্ণাটর অবস্থান । এখানে কিছুক্ষন শীতল হয়ে, ঝর্ণার পাশেই একটা ছোট পাহাড়ি দোকান ছিল, সেখানে কিছু চা-নাস্তা শেষ করে, আবার রওনা করি ।

ঘন্টা তিনেকের ট্রেকিং শেষে আমরা পৌঁছাই , বাংলার নায়াগ্রা খেত নাফাখুমে ।

নাফাখুম
নাফাখুম

প্রচুর পানি ছিল ঝর্ণায়, আমরা লাইফ-জ্যাকেট পরে খুমের পানিতে নেমে পড়লাম , অনেকে আবার ঝাঁপও দিচ্ছিল।

বেশ কিছুটা সময় , এখানে আমরা আমাদের ঝর্ণা বিলাস শেষ করে রেমাক্রির উদ্দেশে রওনা করি।

এবার গ্রূপের সবাই , মোটামুটি বেঁকে বসেছে, হেঁটে আর যাবো না, তাই ফিরার পথে বোটে করে ফিরে আসি রেমাক্রি ফলসে।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক বসে রইলাম মধ্য দুপুরের রোদ্রুল খোলা আকাশের নিচে, রেমাক্রি ফলসটাই যে এমন, কখন যে দুই ঘন্টা পার হয়ে গেল বোঝা মুশকিল।

ঠান্ডা পানির প্রবাহে হয়তো তখন কোনকিছু টের পাইনি, কিন্তু বোটে করে যখন থানচির উদ্দেশে রওনা করি, তখনি সবাই মোটামুটি হাত এবং নাক জ্বালাপোড়া অনুভব করি।

বুঝতে বাকি রইল না , সূর্যি মামা আমাদের চামড়ার বারবিকিউ করে ফেলেছে।

যাইহোক , আমরা থানচি চলে আসি, এবং দুপুরের খাবার খেয়ে , চাঁদের গাড়িতে করে বান্দরবান বেক করি। আগে থেকেই ঢাকার বাসের টিকেট করা ছিল, তাই রাতের খাবার শেষ করেই ঢাকার উদ্দেশে রওনা করি।

আর এভাবেই ইতি টানলাম এবারের থানচি অভিযানের ।

সাবধানতা :

বর্ষা মৌসুমে এই রুটে না অসাই উত্তম, তবে আপনি যদি এডভেঞ্চার প্রেমী হন, তাহলে আপনাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়েই এই রুটে যেতে হবে। অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে নিবেন, আপনি সাঁতার পারলেও লাইফ জ্যাকেট পরিধান করে থাকবেন।

এবং গাইডের সাথে কথা না বলে, কোথাও নেমে পড়বেন না, সর্বদা গাইডকে অনুসরণ করুন।

যা যা অবশ্যই সাথে রাখবেন :- জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি,

দরকারি ঔষুধ ।

খরচ :

বাস টিকেট – ১১,১৬০ (আসা-যাওয়া)

চাঁদের গাড়ি- ৩,৩০০ (আসা-যাওয়া)

ইঞ্জিন বোট- ১০,০০০ (২ টা বোট এবং নাফাখুম থেকে ফেরার সময় আলাদা একটা বোট।)

গাইড – ৩,০০০

কটেজ- ১,৫০০

এবং দুই দিনের খাবার দাবার সহ, আমাদের জনপ্রতি ৩৮০০ টাকা করে খরচ হয় ।

পরিশেষে , যেখানেই যান, অবশ্যই সবসময় খেয়াল রাখবেন, আপনার দ্বারা যেন পরিবেশের ক্ষতি না হয় । তাই আপনার সাথে করে নিয়ে যাওয়া অপচনশীল দ্রব্য , ফেলে রেখে আসবেন না ।

হ্যাপি এন্ড সেফ ট্রাভেল।

Courtesy: MD Shahadat Hossen

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!