• ফিচারড
  • সব পোস্ট
অন্যান্য অভিজ্ঞতা নির্বাসনের দিনলিপি-০১

নির্বাসনের দিনলিপি-০১

-

সেন্ট মার্টিন এর একটা রিসোর্টে পড়ে আছি ৪ দিন। ঠিক পড়ে থাকাও নয়, ৫ জন মিলে উড়াধুড়া খাওয়া, আড্ডা, ঘোরাঘুরি চলতেছে।  আসতেছিলাম সলো ক্যাম্পিং এ। টেকনাফে দেখা হয়ে গেল যশোরের দুই পরিচিত ছোটভাই আর দুইজন হবু ডাক্তারের সাথে। যশোরের দুইজন সেই পিচ্চিকাল থেকে পরিচিত। একসাথে আড্ডা, ডিসি পার্কে সকালবেলা জগিং, অনেক অনেক গল্প আছে এদের সাথে। আর ডাক্তার দুইজনের সাথে সদ্য পরিচয়। টেকনাফ থেকেই বেশ হইহল্লা করে একসাথে সেন্ট মার্টিন আসা গেল, উঠলাম পশ্চিম বিচে একদম বিচ লাগোয়া একটা রিসোর্টে। 

৫ম দিন ওরা ৪ জন বিদায় নিল। এবার একটা ভালো লোকেশন খুজে নিজের ক্যাম্প পাতানোর পালা। কিন্তু না, সেটি হচ্ছেনা। টেকনাফ থেকে রওয়ানা দিয়েছে গরীবের রবিনসন ক্রুসো খ্যাত ইয়াশ আর হবু স্বাধীন নোয়াখালির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট যেআইসি (জামিল ইকরাম চৌধুরী)। রবিনসন ইয়াশ কক্সবাজার ট্রিপ শেষে টেকনাফে এসে একরাত ছিল, শাহপরীর দ্বীপে পরী খুজতে গিয়েছিল, না পেয়ে এখন সমুদ্রযাত্রা করে চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে সেন্ট মার্টিন আসতেছে। এই গরীবের সাথে আরো দুই হাতি যোগ হচ্ছে। অগত্য সেদিনটাও রিসোর্টে গ্যাট হয়ে পড়ে রইলাম। 

ইয়াশ আর জামিল চলে আসলে সেদিনটাও রিসোর্টে পড়ে রইলাম। উদ্দেশ্য একটু আইসব্রেকিং আর রেস্ট। ইয়াশের সাথে সেই ২০১৬ সালের কালাপাহাড় ট্রিপের পর দেখা। অনেক গল্প সল্প হলো, ৪ বছরের জমানো গল্প আমাদের। পরদিন সকালে নাস্তা করে আমরা পশ্চিম বিচের দিকে লোকেশন খুজতে বের হলাম। আমাদের সাথে দুইটা তাবু। মানুষ আমরা ৩ জন। টেনেটুনে হয়ে যায়। বেশ অনেকটা সময় ধরে হাটার পর আমরা একটা মনমতো জায়গা পেলাম।

পুরা উম্মুক্ত একটা নারিকেল বিথী। সামনের সমুদ্রে একটা ল্যাগুনের মত। ইউ শেপের পাথরের দেয়ালের ভেতর বেশ খানিকটা সমুদ্র, জোয়ারের সময় ও নিরাপদে দাপাদাপি করা যায়। এদিকটাতে পর্যটকের আনাগোনাও কম, জনবসতিও তেমন নাই। জায়গাটা আমাদের পছন্দ হলো। নির্বাসনের জন্য অতি উত্তম স্থান!

জায়গাটার আসল মালিক কে আমরা জানিনা, একটা মাইগ্রেটেড রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করে। তাদের ঘরবাড়ি ভিতরের দিকে। আমরা থাকব সমুদ্রের দিকে। তাদের অনুমতি নিয়ে তাবু ফেললাম। শুরু হয়ে গেল নির্বাসন জীবন। ওই পরিবারের বাচ্চাদের সাথে কর্পোরেট ডিল হলো। পারডাব ৪০ টাকা, সদ্য গাছ থেকে পেড়ে খাওয়াবে। আমরা রোজ একেকজন দুইটি করে ডাব খাব। কিচেনের দায়ীত্ব সমান ভাগ হলো।

বাজার করার দায়ীত্ব জামিলের, কাটাকাটি আর লাকড়ি জোগাড়ের দায়ীত্ব আমার, রান্নার দায়ীত্ব ইয়াশের, তবে মাছও কাটবে ইয়াশ। ৩ জনের ভেতর একমাত্র আমিই “সেই রকম চা/কফি খোর” কাজেই চায়ের দোকানের রান্না/বেচা বিক্রির দায়ীত্ব ও আমার! একটা পাথরের চুলা বানানো হলো, অনেক নারিকেল পাতা, আর ডাটার লাকড়ী জোগাড় করা হল।

ব্যাপক বাক বিতন্ডা আর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো একেকদিন একজন করে বাজারে যাব। ক্যাম্পের সবাই একসাথে ঘুরতে যাবোনা, অন্তত একজন পাহারায় থাকব। গোসল আর খাবার পানির ব্যবস্থা হলো ওই ফ্যামিলির টিউবওয়েলে, টয়লেট ওদের প্রাগৈতিহাসিক নারকেল পাতার ট্রাট্রিখানায়। 

প্রথম দিন দুপুরেই ইয়াশ তার জাদু দেখালো। শর্টকাট রান্নায় সে করল সরিষার তেলের খিচুড়ি আর ডিম ওমলেট! জিবে জল আসা স্বাদ। সেই সকালে পরোটা ডালের নাস্তা হয়েছিল কাজেই বেশ ক্ষুধা ছিল, গপাগপ খাওয়া হয়ে গেল। এরপর শেষ দুপুরে আমি আর জামিল সমুদ্রে ঝাপ দিলাম। ইয়াশ একটা ছাতা মেলে বালিতেই ঘুমিয়ে গেল!

ঘন্টা খানেক লোনা পানিতে চুবিয়ে আমরা যখন উঠে এলাম ইয়াশ তখনো লেজি পান্ডার মতো চার হাত পা মেলে আকাশ বাতাস কাপিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। জামিল সতর্ক করলো, ইয়াশ এভাবে কাপাইতে থাকলে বিপন্ন এই দ্বীপ যেকোন সময় সমুদ্রবক্ষে তলিয়ে যাবে। অগত্য দ্বীপ বাচানোর তাগিদেই হোক আর নিজেরা বাচার তাগিদেই হোক ইয়াশকে হাত পা ধরে ঘুম থেকে টেনে তুললাম, ইয়াশ একা একা সমুদ্রে নেমে জলজ্বীনের মতো (জলপরীর পুরুষ ভার্সন) একটু জলকেলি করে আসলো।

আমাদের সাথে দুইটা হ্যামক ছিল যেগুলা আগেই ঝুলানো হয়েছিল। লোকাল বয় রাশেদকে গাছে তুলে দিলাম ডাব পাড়তে, শেষ বিকেলে দুই হ্যামকে দুইজন আর বালিতে হাত পা ছড়িয়ে ভেজা গায়ে ডাব হাতে আমরা যখন পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্ত দেখছি তখন আমাদের মনে হলো- জীবন সুন্দর!

সন্ধার দিকে টিউবওয়েলে গোসল দিয়ে ভদ্রলোকের পোশাক পরে আমরা দুইজন হ্যামকে ঝুলে গেলাম, একজন বসল ক্যাম্পিং টুলে। লোকাল মশারা ফিস্টের উৎস খুজে না পাওয়ায় এদিনে মশা ছিল না। সন্ধার অন্ধকারে শুরু হলো আমাদের মেইল ট্রেনের মত গতিমান আড্ডা। আড্ডার ফাকে ফাকে ছাগলের মতো মুখ না চালাইলেই নয় বিধায় একটু খেটেখুটে মুড়ি মাখানো হলো, আবার শুরু হলো আড্ডা। ইয়াশের চোখে তখন বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন, জামিল একমনে মুড়ি চিবুচ্ছে আর আমি হ্যামকে ঝুলে ইয়াশের স্বপ্নের গল্প শুনছি। সেই আড্ডার সময়ে মনে হয়েছিল- জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও আনন্দেরই, যদি আমরা সেটা চাই।

আড্ডা, হইচই, গল্পে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেলো। রাতের ডিনার মেনু স্যুপ পারহেড একগ্লাস স্যুপ। এসব স্যুপ ট্যুপ, নুডলস এসবে আমি বেশ দক্ষ। আমি স্যুপ  বানায়ে ফেললাম। ৩ জনে ৩ গ্লাস স্যুপ দিয়ে রাতের ডিনার শেষ করলাম। জি না! খেলা এখনো শেষ হয়নাই, বাকি আছে। ইয়াশের নাকি রাতে হালকা ডিনারে হবে না, গ্রেভি হেভি ডিনার ছাড়া হুজুর এক্সপ্রেসের ঘুম আসবেনা। এদিকে আমি আর জামিল কেউই আর চুলার আশেপাশে যাবোনা। কাজেই বেচারা ইয়াশ তার পেটের লবিংয়ে পড়ে বিস্কুটের দোকান এই গভীর রাতে আবার উম্মুক্ত করলো। 

এরপর আর কি? আবার ঝুলে বসে আড্ডা শুরু। এভাবেই বেজে গেল রাত প্রায় দুইটা!

এবার তো নিদ্রাপুরে যেতেই হয়। ঠিক হলো এক তাবুতে মাল পত্র সহ ঘুমাবো আমি। অন্য তাবুতে ইয়াশ আর জামিল। তবে গরমের একটু প্রকোপ থাকায় আমি একটা পাতলা কম্বল নিয়ে হ্যামকে উঠে এলাম। বাকি দুইজনে দুইটা তাবুতে ঢুকে গেলো। দুইজন তাবুর ভেতর থেকে আর আমি হ্যামক থেকেই টুকটাক গল্প শুরু করলাম। এরপর কিছুক্ষনের ভেতরেই ইয়াশের তাবু থেকে নোজ গ্রেনেড ফাটা শুরু হয়ে গেল, পুরা দ্বীপ তখন নোকিয়া ১১০০ মোবাইলের মত ভাইব্রেশন দিচ্ছে। এই শোরগোলের মধ্যে আমি আর জামিল কখন নিদ্রাপুরে রওনা দিয়েছিলাম সেটা আজ আর আমাদের কারোর ই মনে নেই। 

চলতে থাকবে…….

আমাদের দেশ, আমাদের প্রকৃতি, সমুদ্র, জঙ্গল আমাদের সম্পদ। ভ্রমণে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার জানা ও করাটা জরুরি। ভ্রমণকালীন ই শুধু নয়, সবসময়েই পরিবেশ ও প্রকৃতির যত্ন নিন। প্লাস্টিক, পলিথিন যথাযথ পরিবেশ বান্ধব উপায়ে ডাম্পিং করুন, যথাসম্ভব বর্জন করুন। পরিবেশ বাচুক, আমরাও বাচি। ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যাই।

বিঃ দ্রঃ- সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ নিয়ে “রহস্যময় ভ্রমন” নামে আরেকটা ভ্রমণ গল্প সিরিজের লাস্ট গল্পটি বাকি আছে। সেটা আর এটা পৃথক যাত্রার গল্প।

কৃতজ্ঞতাঃ নাজমুস সাকিব

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!