• সব পোস্ট
অন্যান্য অভিজ্ঞতা কুকরিমুকরি - সোনারচর - আন্ডার চর - চর মোন্তাজ...

কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ: পর্ব – ৭

-

কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ  ভ্রমণ

পর্ব  –  ৭:

পর্ব – ৬

পর্ব – ৮

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

তারুয়া দ্বীপ ছেড়ে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে অথৈ সাগরের দিকে৷ নৌকায় বসে আমরা আস্তে আস্তে তারুয়া দ্বীপকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দেখছিলাম৷

তারুয়া থেকে ফেরার সময় চর জমিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম
তারুয়া থেকে ফেরার সময় চর জমিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম

যতই সামনে আগাচ্ছিলাম দ্বীপের আকার ক্রমশই আকারে ছোট হয়ে আসছিল আমাদের চোখে৷ একসময় তা একেবারেই মিলিয়ে গেল৷ আমরা আবার গভীর সমুদ্রে এসে পড়েছি৷

চারপাশে শুধু জল আর জল৷ দূরে কিছু মাছ ধরার ট্রলার দেখা যাচ্ছিল শুধু৷ মধ্য দুপুর আমাদের দুপুরের খাবার তৈরির আয়োজন চলছে৷

যাত্রা পথে সাগরে মাছধরার ট্রলারগুলো এভাবেই দাড়িয়ে ছিল, জুম করে তোলা ছবি
যাত্রা পথে সাগরে মাছধরার ট্রলারগুলো এভাবেই দাড়িয়ে ছিল, জুম করে তোলা ছবি

তারুয়া থেকে আসার সময় সুমি আপুর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল তারপরও উনি বেশ ভালই সহযোগীতা করেছিলেন সিফাত ভাইকে রান্না করতে৷ সিফাত ভাই চুলায় খিচুরী বসিয়ে দিলেন৷

প্রচন্ড বাতাসে চুলা নিভে যাবার অবস্থা৷ শেষে চুলা একটু ভিতরের দিকে চেপে দিয়ে আমাদের ইনস্যুলেশান ম্যাট দিয়ে ঘেরাও দিয়ে বাতাস আটকে দিলাম৷ বাতাস এত বেশি ছিল  যে ম্যাট উড়ে যাবার অবস্থা৷ আমাদের ভারী ব্যাকপ্যাক দিয়ে চাপা দিয়ে কোনরকমে রক্ষা করেছিলাম ম্যাট৷

অনেক সময় লাগিয়ে খিচুরী হয়ে যেতেই চুলায় ডিম চড়িয়ে দিলেন সিফাত ভাই৷ আমাদের নৌকা ঢেউ কেটে কেটে  সামনে এগিয়ে চলছিল৷ বাতাস বেশি হবার কারনে সাগরে ঢেউ বেড়ে গিয়েছিল৷ নানার নৌকা চালাতে সমস্যা হচ্ছিল৷ নৌকার গতি একটু কমিয়ে দিলেন নানা৷ নাহলে নৌকা ঢেউয়ে বেশি দুলছিল৷

নৌকার পাটাতনে বেশ পানি জমে গিয়েছিল৷ এবার ইকবালের হাতে নৌকার হাল ধরিয়ে দিয়ে নানা নিজে গেলেন জল সেচতে৷ ইকবাল একটু সময় বেশি লাগায়৷ তাই নানা নিজেই করতে গেলেন এবার৷ নানা জল সেচতে লাগলেন৷

সেচার সময় নানার সন্দেহ হল একটু, নৌকায় সম্ভবত স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত পানি ঢুকছে, তাড়াতাড়ি ইকবালকে সড়িয়ে নিজের বসার জায়গার তক্তা সরিয়ে ইঞ্জিন চেক করলেন৷

সর্বনাস একদিকে ইঞ্জিনের নাট খুলে পড়ে গেছে৷ প্রপেলার ঘুরার সময় তাই বেশি পানি ঢুকছিল নৌকায়৷ নানা ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন৷ মাঝ সমুদ্রে আমরা নৌকায় বসে ঢেউয়ে দুলছিলাম৷

নানার কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ আমাদের আত্মারাম খাঁচার  বাইরে৷ এ কোন বিপদে পড়লাম৷ আসেপাশে কিছুই দেখা  যাচ্ছেনা৷ এমন এক জায়গায় নৌকা দাড়ানো দূরেও কোন  ট্রলারও দেখা যাচ্ছিল না৷ সবাই আল্লাহ কে ডাকা শুরু  করলাম৷ এই বুঝি সব গেল৷

নানা বহু কষ্টে নাট লাগালেন৷ নৌকা আবার চলতে শুরু  করল৷ আমরা হাপ ছেড়ে বাঁচলাম৷ প্রায় পনের বিশ মিনিট  চলার পর নাট আবার খুলে গেল৷ টের পেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে  দিলেন নানা৷ এবার নাটের প্যাচ একেবারে ক্ষয়ে গেছে৷ আর লাগাবার উপায় নাই৷

আমাদের চিন্তা আরো বেড়ে গেল৷ পৌঁছাতে পারব তো নারিকেল বাগান সহিহ সালামত৷ নাকি এই যাত্রায় শেষ  আমরা৷ প্রায় অনেক্ষন আমরা সাগরে নৌকায় এমনেই ভাসলাম৷

নানার মাথায় বুদ্ধি এল নৌকার ছেড়া তেনা দিয়ে নাট মুড়িয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোন রকমে নাট লাগালেন নানা৷ শেষ চেষ্টা যদি কাজ হয়৷

আমরা সবাই দোয়া করছিলাম যাতে কাজটা হয়ে যায়৷ নাহলে নির্জন সমুদ্রে রক্ষা নাই আমাদের৷ নানা ইঞ্জিন চালু করে নৌকা টান দিলেন৷ এবার নানা ইঞ্জিনের উপরের কাঠ না বসিয়ে খোলা রাখলেন যাতে সব তিনি দেখতে পারেন ঠিকমত৷

নারিকেল বাগান আরো প্রায় দেড় ঘন্টার পথ৷ সিফাত ভাই গিয়ে চেক করলেন ডিম সিদ্ধ হয়েছে কিনা৷ এতক্ষনে মাত্র  পানি গরম হয়েছে অল্প৷ তারমানে আরো অনেক সময় লাগবে৷

চর মোন্তাজ থেকে রওনা দেবার সময় মুড়ি আর চনাচুর নিয়েছিলাম৷ কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই গামলায়  মুড়ি চনাচুর মাখালেন৷ সবাই অল্প খেয়ে নিলাম৷ কখন যে  দুপুরের খাবার খেতে পারব তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই৷

নৌকা চলছে৷ নানার দৃষ্টি বারবার ইঞ্জিনের জোড়া দেয়া নাটের দিকেই ফিরে যাচ্ছিল৷ আমি যা দেখলাম নানার সার্জারি ভালই কাজে লেগেছে৷ কোনরকমে নারিকেল বাগানে পৌঁছাতে পারলেই বাঁচি৷

হঠাৎ নানা বললেন তার এক নাম্বার লেগেছে৷ আমার হাসি পেল মাঝ সমুদ্রে নানা কি বলে এইসব৷ চারপাশে শুধু জল আর জল৷ আমি বললাম এখানে কই করবেন৷ আমাদের খালি কোন বোতলও নাই যে দিব৷ নানা বললেন লাগবে না  বোতল৷ তিনি সমুদ্রেই মুত্র বিসর্জন দিবেন৷

আমাকে সামনের দিকে ফিরে বসে থাকতে বলেই নানা পিছন দিকে ফিরে বসে বোতল খালি করে দিলেন৷ সামনের দিকের ওরা নানার এই আকাম সম্পর্কে জানতে পারল না একদম৷

আরো প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর দূর থেকে নারিকেল বাগান দেখতে পেলাম আমরা৷ নানা নিজেই দেখিয়ে দিয়ে  বললেন ঐটা নারিকেল বাগান৷

প্রচুর মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করা পাড়ে৷ এই নারিকেল বাগান কুকরিমুকরি চরের হট স্পট৷ বেশিরভাগ ট্রাভেলাররা এখানেই ক্যাম্পিং করে থাকে৷ আমরা পাড়ের কাছে যেতেই  দেখি বড় দুইটা বোটে চেপে বহু টুরিস্ট ঘুরতে এসেছে৷ মাথা  পুরাই খারাপ আমাদের৷

আমাদের নির্জন জায়গা পছন্দ৷ এখানে তো পুরা বাজার বসে গেছে৷ নানা আমাদের একটু ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন৷ সেদিকে একটা নির্জন স্পট আছে৷ যদি আমাদের পছন্দ হয় ক্যাম্পিং করব৷

স্পটে পৌঁছাতেই আমরা নেমে পড়লাম সব চেক করে দেখতে৷ জায়গাটা পছন্দ হল আমাদের৷ কিন্তু সমস্যা হল এটা একটু  বেশি ভিতরের দিকে৷ এখানে থাকলে পুরা চর থেকে আলাদা হয়ে যাব আমরা৷ আশেপাশে যেখানেই যাব নদী পার হয়ে যেতে হবে আমাদের৷ তাই আমরা এখানে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম৷

সবাই স্পট থেকে নেমে নৌকায় চলে আসলাম৷ খুব খিদে লেগেছিল সবার৷ তাই পরের জায়গা খোঁজার আগে সবাই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে গেলাম৷ সুমি আপু সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন৷ এত বেশি খিদে লেগেছিল যে সাধারন খিচুরী আর ডিম খেতে অমৃত লাগছিল৷

আমি তো ডাবল খেয়েছিলাম৷ জাহাঙ্গীর ভাই মোটা চালের ভাত তেমন খেতে পারেন না৷ ভাই একটু কম খেলেন৷ আসলে এইসব চর এলাকায় চিকন চাল পাওয়া যায় না৷ আমরা অনেক খুঁজেছিলাম কচ্ছপিয়াতে পাইনি৷ পরে যেটা একটু ভাল পেয়েছিলাম সেটাই নিয়ে নিয়েছিলাম উপায় না দেখে৷

খাবার খেয়ে নেয়াতে একটা সুবিধা হয়েছিল আমাদের৷ আমরা খেতে খেতে দুই বোট ভর্তি টুরিস্ট চলে গেল নারিকেল বাগান ছেড়ে৷ এবার চর পুরাটাই খালি হয়ে গেল৷

নানা তাড়াতাড়ি নৌকা সামনের দিকে নিয়ে গেলেন৷ পূর্ব পাড়ে আমাদের ক্যাম্পের জন্য খালি জায়গা দেখেও নানা পশ্চিম পাড়ে নৌকা ভিড়ালেন৷

এই পাড়ে নলকূপ আর একটা দোকান আছে, আমরা গোসল করে ফ্রেস হবার জন্যই নানা এই পাড়ে নৌকা লাগিয়ে দিয়েছেন৷ এখানে কোন শৌচাগার নেই৷ দুইটা বানানোর কাজ চলছিল মাত্র৷ উপায় না দেখে বোতল ভর্তি পানি নিয়ে আমি আর কামরুল ভাই জঙ্গলে মঙ্গল করতে দৌড় দিলাম৷ এখানে জঙ্গল ই শেষ ভরসা৷ যারা দূর্গম পাহাড়ে অভিযানে যান তারাই কেবল বুঝতে পারবেন বিষয়টা৷

জঙ্গল থেকে বের হয়ে দেখি অন্যরা সামনের সরু খাল পার হয়ে নতুন ক্যাম্প সাইটের সন্ধান করছে৷ আমিও দৌড়ে  সেদিকে গেলাম৷ খালের কাঁদামাটি পার হয়ে সবার সাথে যোগ দিলাম৷ চারপাশে গাছপালা ঘেরা সুন্দর একটা জায়গা পেলাম আমারা৷

খালের কাঁদা পার হয়ে নতুন ক্যাম্প সাইট খুজতে গিয়েছিলাম
খালের কাঁদা পার হয়ে নতুন ক্যাম্প সাইট খুজতে গিয়েছিলাম

সেখানেই ক্যাম্প ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে৷ এখানে বাইরের কেউ বিরক্তও করতে পারবেনা৷ কিন্তু সমস্যা হলো এই খালের কাঁদামাটি পার করে সব জিনিস পত্র এখানে আনা মুশকিল৷ নৌকাও জোয়ার না আসলে কাছে আনা সম্ভব না৷ তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও খালের ঐ পারের খালি জায়গাতেই ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা৷

নারিকেল বাগানে আমাদের প্রথম ক্যাম্প সাইট
নারিকেল বাগানে আমাদের প্রথম ক্যাম্প সাইট

কাঁদামাটির খাল পার হয়ে আমরা পাড়ের ছোট্ট দোকানটায় বসলাম কিছুক্ষন৷ এখানে যত মাছধরার ট্রলার ভিড়ে, তার জেলেরাই মূলত এই দোকানের কাস্টমার৷ মোটামুটি প্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসই এই দোকানে আছে৷

দোকানে বসা জেলেদের থেকে বড় দুইটা ইলিশ মাছ নিতে চাইলাম আমরা৷ দাম বেশি বলাতে পরে কুকরির মেইন  বাজারের আড়ত থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ দোকান থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে নৌকার কাছে গেলাম৷  ক্যাম্পের তাবু সেট করার জন্য নদীর ঐপাড়ে যেতে হবে আমাদের৷ নানা সবাইকে নৌকা করে ঐপাড়ে দিয়ে আসলেন, আমি এইপাড়ে রয়ে গেলাম৷

নানা ফিরে আসলে নানাকে নিয়ে বাজারে যেতে হবে বনের ভিতরের রাস্তা দিয়ে৷ একা গেলে রাস্তা হারানোর ভয় আছে৷  নানা সবাইকে ঐ পাড়ে রেখে ফিরে এলেন৷

নানাকে নিয়ে সন্ধার ঘন্টাখানেক আগে বনের রাস্তা ধরে কুকরিমুকরির বড় বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম৷ কিছুদূর যাবার পর নানা তার পরিচিত এক বাইক চালককে ফোন করে বনের শেষ মাথায় রাস্তার উপড় আসতে বললেন৷

আমরা রাস্তায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাইকওয়ালা হাজির৷ এবার নানা নাতি বাইকে চেপে বসলাম৷ বাইক হওয়াতে সুবিধা হল  কিছুটা সময় বাঁচবে অনেক৷ হেঁটে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে৷ গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বাইকে করে  আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই বাজারে পৌঁছে গেলাম৷

আমি মাছ কিনতে গেলে দাম বেশি চাইবে তাই নানাকেই পাঠালাম দরদাম করতে৷ আমি এক দোকানে বসে রইলাম৷ নানা পুরা বাজার খুঁজে এসে বললেন বড় মাছ নাই৷ কি আর করার মন খারাপ হয়ে গেল৷ এখন আবার ঐ দোকানে গিয়ে বেশি দামে মাছ কিনে নিতে হবে৷

নানা আমার মন খারাপ দেখে হাত ধরে বাজারের ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন৷ কই যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করলে নানা শুধু  বললেন আস আমার লগে৷ নানার পিছে পিছে বাজারের গলি দিয়ে হাঁটছি৷ গলির চিপায় এক দোকানের সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন “এইখানে যে জিনিস আছে আপনার মন ভালা হয়ে যাবে নাতি”৷

আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দোকানদারকে বললেন আমার নাতিরে গরুর দুধের ইশপেশাল চা দেও৷ নানার  বেটার মনে আছে চর মোন্তাজে গরুর দুধের চা খাইতে পারিনাই বলে আমার মন খারাপ ছিল৷ তাই এখানে আছে জেনে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন গরুর দুধের চা খাওয়াতে৷

নানা নাতি মিলে চা খেলাম৷ আহহহহ সে কি স্বাদ৷ তৃপ্তি সহকারে খেলাম৷ দোকানদার বললেন দুধ বাড়ায়ে দিছি ভাই, মজা লাগবে নে৷ আমি পরে আরও এক কাপ খেলাম৷

আন্ডার চরে কাঁচের গ্লাসে করে চা পরিবেশন করলেও এখানে কাপ ই ব্যবহার করে এরা৷ মাছ তো পেলাম না তাই চা খেয়ে নানাকে সাথে নিয়ে বাইকে চেপে বসলাম ফিরে যাবার জন্য৷

বাইকওয়ালা আমাদের বনের মুখ পর্যন্ত দিয়ে এল৷ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ নানাকে নিয়ে বনের পথে হাঁটছি আমি৷ হঠাৎ  দু’জন জেলে পেয়ে গেলাম পথে৷ তারা মাছ নিয়ে আড়তে যাচ্ছিল মহাজনের কাছে বিক্রি করতে৷ তাদের থামিয়ে বড় দুইটা ইলিশ মাছ কিনলাম৷ নানা নিজে দরদাম করাতে অল্পদামে পেয়ে গেলাম৷ মনটা খুশি হয়ে গেল এবার৷ যাক যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা সফল হল আমাদের৷ মাছ নিয়ে নেচে নেচে ক্যাম্প সাইটের দিকে চললাম৷

আমার খুশি দেখে নানাও খুশি৷ আজ রাতে জম্পেস খাওয়া দওয়া হবে৷ মাগরিবের আযান হবার একটু আগেই ক্যাম্প  সাইটে পৌছালাম আমরা৷

আমি বাজারে যাবার পর সিফাত ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই আর কামরুল ভাই কলের ঠান্ডা পানিতে গোসল করেছিল৷ ঠান্ডায় আমার শরীর ভাল না লাগায় আমি গোসল করনি, তবে গামছা ভিজিয়ে ভালমত শরীর মুছে, হাত মুখ পা ভালমত ধুয়ে নিয়েছিলাম বাজার থেকে ফিরে৷

নানাকে নিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা করে খাল পার হলাম৷ সুমি আপুকে ক্লান্ত দেখে নানা নিজেই মাছ নিয়ে চলে গেলেন নৌকায়, সব কেটেকুটে ধুয়ে রেডি করে দেবার জন্য৷ আমি আর সিফাত ভাই তাবু সেট করতে শুরু করলাম৷ পরে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাইও হাত লাগিয়েছিল তাড়াতাড়ি হবার জন্য৷

নানা মাছ কেটে রেডি করে দিয়েছিল রান্নার জন্য
নানা মাছ কেটে রেডি করে দিয়েছিল রান্নার জন্য

আমি বাজার থেকে ফিরে আসার আগেই সবাই মিলে পাশের বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিল৷ আমাদের  সাথে স্থানীয় কিছু মানুষের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ আমাদের দেখে তারা খুব খুশি হয়েছিল৷

নানার মেয়ের জামাই এসে আমাদের অনেক সহযোগীতা করেছিল৷ নৌকা থেকে একে একে চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডার ও  প্রয়োজনীয় সব নিয়ে আসা হল আমাদের ক্যাম্প সাইটে৷ তাবু সেট করার পর সবার ব্যাকপ্যাক তাবুর ভিতরে রেখে লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালালাম তাবু থেকে একটু দূরে৷

আগুনে লাকড়ি দিচ্ছিলাম
আগুনে লাকড়ি দিচ্ছিলাম

সুমি আপু সবার জন্য নুডলস রান্না করলেন৷ নুডলস রান্নার ফাঁকে জাহাঙ্গীর ভাই, কামরুল ভাই আর সিফাত ভাই  তাবুর সামনে ইনস্যুলেশান ম্যাট বিছিয়ে স্থানীয়দের সাথে কার্ড খেলা শুরু করে দিয়েছিল৷

আমি কার্ড খেলা তেমন ভাল পারিনা বলে নানাকে নিয়ে ঘুরতে চলে গেলাম সন্ধার আঁধারে৷ কিছুদূর সামনে যেতেই চরে আরো কিছু ক্যাম্পারদের তাবু নজরে পড়ল৷ তারাও আজ রাতে এখানে থাকবে৷

এটা বেশ বড় গ্রুপ৷ প্রায় ১২ থেকে ১৫ জনের৷ এর কিছু দূরে আরো কয়েকটা গ্রুপের তাবু দেখতে পেলাম৷ নানাকে নিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা ঘুরলাম আমি৷

ঘুরে ক্যাম্প সাইটে ফিরে যেতেই সুমি আপু নুডলস দিলেন খেতে৷ নানা আর আমি সবার পরে যাওয়াতে সুমি আপু  আমাদের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছিল৷ এলাকার লোকদের সাথে নিয়ে অন্যরা আগেই খেয়ে নিয়েছে৷

সবাই কার্ড খেলায় মত্ত৷ সিফাত ভাই স্পিকার বের করে গান চালিয়ে দিলেন৷ কিছুক্ষন পর সুমি আপু সবার জন্য চা  বানালেন৷ কয়েকটা ছোট পানির বোতল কেটে কাপ বানিয়ে এলাকার লোকজন সহ সবাই চা খেলাম৷

আমাদের ক্যাম্প ফায়ার
আমাদের ক্যাম্প ফায়ার

রাত একটু বাড়তেই স্থানীয়রা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন৷ আমরা রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করলাম৷ নানা আগেই মাছ কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল৷ জাস্ট রান্না করতে হবে৷

চলছিল রান্নার কার্যক্রম
চলছিল রান্নার কার্যক্রম

সুমি আপু চুলায় ভাত বসিয়ে দিলেন ভাত হয়ে যাবার পর মাছ রান্না শুরু করতেই এল বৃষ্টি৷ লে হালুয়া পুরা ট্রিপে শুধু এটার ই কমতি ছিল৷

জাহাঙ্গীর ভাই তাবুর ভিতরে ঢুকে পড়লেন৷ সিফাত ভাই সবার ব্যাকপ্যাকগুলো সবচেয়ে মজবুত তাবুর ভিতরে নিয়ে  রাখতে লাগলেন, যাতে ভারী বৃষ্টি হলেও আমাদের কারো ব্যাগের জিনিস পত্র না ভিজে৷

আমি আর কমরুল ভাই ইনস্যুলেশান ম্যাট ওল্টা করে সুমি আপুর মাথার উপড় ধরে রাখলাম, যাতে বৃষ্টির ফোটায়  রান্নায় সমস্যা না হয়৷

বৃষ্টিতে এভাবেই ইনস্যুলেশান ম্যাট দিয়ে ছাউনি বানিয়ে রান্না করা হয়েছিল সেদিন রাতে ৷
বৃষ্টিতে এভাবেই ইনস্যুলেশান ম্যাট দিয়ে ছাউনি বানিয়ে রান্না করা হয়েছিল সেদিন রাতে

কিছুক্ষন পর আমার জায়গায় সিফাত ভাইকে দাড় করিয়ে দিয়ে আমি তাবুর ভিতরে গেলাম বিশ্রাম নিতে৷ আমাদের রান্না হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল৷ দুই আইটেমের ইলিশ মাছ রান্না করেছিল আপু, একটা ইলিশ ভাজি আর একটা ঝোল দিয়ে রান্না৷

একটু পর উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এসে আমাদের সতর্ক করে গেলেন৷ রাতে ভারী বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা৷ সাবধানে থাকার জন্য৷ দমকা হাওয়া শুরু হয়ে গেছে কিছুটা৷

নিরাপত্তা বাহিনীর লিডার রমিজ ভাইয়ের সাথে বেশ ভাল সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল আমাদের৷ আমাদের রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল তাই রমিজ ভাইকে আর দলের সদস্যদের রাতে আমাদের সাথে খাবার নিমন্ত্রন দিলাম৷

এই সময়ে কাজের চাপ বেশি থাকায় রমিজ ভাই খেয়ে যেতে পারলেন না৷ চরে বহু টুরিস্ট, সবাইকে সতর্ক করতে হবে৷ পরে আসবেন বলে চলে গেলেন৷

রান্না হতেই নানা আর ইকবালকে আমি গিয়ে নৌকা থেকে ডেকে নিয়ে আসলাম৷ বৃষ্টিও থেমে গেছে, সবাই মিলে একসাথে খেতে বসলাম৷

আহা সুমি আপুর হাতের রান্না লা জবাব৷ জাহাঙ্গীর ভাই আজকে একটু ভালমতন খেলেন অন্যদিনের চাইতে৷ আমাদের খাওয়া শেষে নানা সব গুছিয়ে রেখে ইকবালকে নিয়ে নৌকায় চলে গেলেন ঘুমাতে৷

আমি বলে দিয়েছিলাম রাতে যদি বৃষ্টি আসে তাহলে ইকবালকে নিয়ে আমাদের তাবুতে চলে আসতে৷ খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিলাম৷ রমিজ ভাই তার দলবল নিয়ে আবার হাজির আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছেকিনা তা দেখতে৷

আমাদের নাকি উনার বেশ পছন্দ হয়েছে৷ একসাথে বসে রমিজ ভাইয়ের ওমান প্রবাসের গল্প শুনলাম৷ কি একটা সমস্যার জন্য উনাকে চলে আসতে হয়েছিল৷ বিদায় নেবার আগে দুইজন গার্ডকে সবসময় আমাদের পাশেই থাকার নির্দেশ দিয়ে অন্যদের নিয়ে চলে গেলেন বাকিদের নিরাপত্তা দিতে৷

নিরাপত্তা বাহিনীর ভাইদের সাথে আড্ডা
নিরাপত্তা বাহিনীর ভাইদের সাথে আড্ডা

দুই গার্ড ভাইকে পেয়ে আমরাও একটু স্বস্তি পেলাম৷ যাক ঝড় তুফান হলে পাশে এই দুই ভাই আছে৷ কিছুক্ষন পর দুই গার্ড  ভাইকে ক্যাম্পের পাহাড়ায় রেখে আমরা চরের রাতের নিস্তব্দতা উপভোগ করতে বের হয়ে গেলাম৷ যাবার সময় একদল তাদের করা ছাগলের বার্বিকিউ খাবার নিমন্ত্রন দিল আমাদের৷ পেট ভরা থাকায় তাদের দাওয়াত কবুল করতে পারলাম না আমরা৷

সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলাম আমরা৷ হেলানো একটা গাছ পেয়ে সবাই একে একে উঠে লাইন ধরে বসে গেলাম৷ গাছটা মোটামুটি ভালই উঁচু৷

তারুয়া দ্বীপে নানা সুমি আপুকে কোলে নিতে পারেনি, তাই নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করছিলাম৷ হঠাৎ দেখি দূর থেকে কেউ  আসছে আমাদের দিকে৷ সিফাত ভাইয়ের মাথায় শয়তানি চিন্তা এল৷ আমরা যেহেতু অন্ধকারে গাছের উপড়ে বসে আছি তাই আমাদের কেউ দেখার সম্ভাবনা নেই৷ সামনে থেকে আসা মানুষদের ভয় দেখানো যাবে৷

ওরা কাছে আসতেই সেই চিৎকার চেচামেচি সবাই গাছের ডালপালা নেড়ে৷ ভয় পেয়ে দুই জন সেই লেবেলের দৌড়৷ অলেম্পিক চ্যাম্পিয়ন উসাইন বোল্টও ফেল মারত ঐ সময় তাদের কাছে৷

মধ্যরাতে ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি গার্ড দুই ভাই নেই৷ হয়ত অন্য কোন দিকে গেছে চেক দিতে৷ কিন্তু না আমাদের দেখে  একটু দূর থেকে টর্চের আলো নেড়ে সংকেত দিলেন তারা যায়নি, একটু দূরে হলেও আমাদের ক্যাম্পের দিকে তাদের নজর আছে৷

নারিকেল বাগানে আমাদের ক্যাম্প সাইট
নারিকেল বাগানে আমাদের ক্যাম্প সাইট

আমাদের ক্যাম্পটা একদম সাগরের কাছাকাছি৷ তাবুর ভিতর থেকে সাগরের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল৷ ঠিক কয়টায় ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই৷

চলবে…

#ব_দ্বীপ  ( দৃষ্টিতে  মুগ্ধতা )

লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু

পর্ব – ৬

পর্ব – ৮

ব-দ্বীপ
শুধুমাত্র আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদশের জল, স্হল, জনপদ আর প্রকৃতিকে উপস্হাপন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য।

Leave a Reply

সর্বশেষ

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি

পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকুরী হতে যে রাজ্যপাটের ভিতঃ বালিয়াটির জমিদার বাড়ি আশপাশে সাভার, ধামরাইয়ের মতো প্রাচীন বনেদী সব জনপদ থাকতে...

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি – হরিকল

এক অদ্ভুত, অপূর্ব সুন্দর পাখি - হরিকল। ভাল করে বলতে চঞ্চুমোটা হরিকল। ইংরেজি নাম Thick Billed Green Pigeon. বৈজ্ঞানিক নাম...

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা, বান্দরবন

পালং খিয়াং (Palong Khiyang) ঝর্ণা বান্দরবন জেলার আলীকদমে অবস্থিত। বেশ দূর্গম পথ , তবে মারাত্মক লেগেছে। ফ্লাশ ফ্লাডে পাহাড়...

আজিজ মাস্টারের বাড়ি

‘মুন্সী’ ‘খাঁ’ টাইটেল যে হিন্দুদেরও হয় তা জানতাম, তবে খুব একটা common  নয়। Afterall ‘মুন্সী’ শব্দটি ফার্সি। হিন্দু মুন্সী পদবীধারীর...

ঝরঝরি ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড রেইঞ্জের সবচাইতে বুনো ট্রেইল বলা হয় এই ঝরঝরি ট্রেইলকে। এই ট্রেইলে মোটামুটি দেখবেন জোঁক, বানর, সাপসহ নানা...

পাঠক প্রিয়

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ

চর কুকরী মুকরি, ঢাল চর, চর মনতাজ ভ্রমণ অল্প খরচেই আপনি ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের দক্ষিনের নদী ও সাগর বেষ্টিত ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়। হাতে ১...

এবার গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে দেখা মিললো তীব্র বিষধর ‘রাসেল ভাইপার‘ সাপ

গতকাল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতে রাসেল ভাইপারের দেখা মিলেছে।  পৃথিবীর ৫ম বিষধর সাপ এই রাসেল ভাইপার, আক্রমণে বিশ্বে ১ম ( মতান্তরে দ্বিতীয় )। অর্থাৎ...

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো - ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া...

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait

কালচিতি / কালাচিতি / কালাচ / common krait : একে বলা হয় রহস্যময় সাপ। ফনাহীন মারাত্মক বিষধর এই সাপে বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানুষ...

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব) ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮) ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব) আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে! একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল...
error: Content is protected !!