কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ
পর্ব – ৬:
১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমাদের নৌকা চর মোন্তাজ ছেড়ে ছুটে চলেছে৷ আধাঘন্টার মত চলার পর চারপাশে শুধু অথৈ জল আর জল৷ আমরা আবার সাগরে এসে পড়লাম৷ তবে আজ সাগর কিছুটা শান্ত৷
নৌকা তড়তড়িয়ে এগিছে চলেছে সামনের দিকে৷ দূরে মাছ ধরার ট্রলারগুলো দেখা যাচ্ছে৷ সেই ট্রলারগুলোর আশপাশে আরো ছোট ছোট নৌকায় গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জাল বুনে যাচ্ছে জেলে ভাইরা৷ মাথার উপড় প্রচন্ড রোদ৷ নানার নৌকার খোল নাই৷ আমরা আমাদের ইনস্যুলেশান ম্যাটগুলো মাথার উপড়ে দিয়ে বসে রইলাম৷ এতে রোদের তাপ কিছুটা কম অনুভব হচ্ছিল৷
ক্লান্ত শরীরে জাহাঙ্গীর ভাই শুয়ে পড়লেন আমার পাশে৷ কিছুক্ষন পর সিফাত ভাইও তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন৷ কামরুল ভাই একা নৌকার সামনে বসে ছিল৷ সুমি আপু নানার পাশে বসে আছেন, নানা নৌকার হাল ধরে এগিয়ে চলেছেন৷
সাগরের মাঝখানে তাই আমার আত্মারাম খাঁচার বাইরে৷ এখানে কিছু হলে আমাদের নাম নিষানাও কেউ খুঁজে পাবেনা৷ সিফাত ভাইকে শোবার জায়গা করে দিতে আমি উঠে নৌকার পিছনে চলে গেলাম নানার পাশে৷ এতে নৌকার ব্যালেন্স হল৷
নৌকার পাটাতনে বেশ কিছু পানি জমে গেছে৷ নানা ইকবালকে লাগিয়ে দিল কাজে৷ ইকবাল একটা বেলচা দিয়ে নৌকার জল সেঁচতে শুরু করল৷ ছোট বাচ্চা কিন্তু নানার সাথে থেকে থেকে বেশ পাকাপোক্ত হয়ে গেছে৷
অন্য সব বাচ্চাদের মত না ইকবাল৷ কথা কম বলে, চুপচাপ থাকে বেশি৷ কেউ কথা না বললে কথা বলেনা৷ ছেলেটার স্বভাব চরিত্রও ও ভাল৷ তাই আমাদের সবার অনেক আদর পেয়েছে সে৷
আমরা যখন চরে নেমে ঘুরতাম ছেলেটাকে সাথে যেতে বললেও যেত না৷ বোলত মামা আপনারা যান আমি গেলে ব্যাগ আর মালপত্র দেখবে কে, নানাও থাকবেনা৷ এইটুকু ছেলের সেন্স দেখে আমি অবাক৷ আমরা যেখানেই নেমেছি যাই খেয়েছি আসার সময় ইকবালের জন্য প্যাকেটে করে আলাদা করে নিয়ে এসেছি সবসময়৷ এগুলা পেয়েই ছেলেটা বেশ খুশি থাকত৷
ইকবাল পানি সেঁচে ক্লান্ত হয়ে নৌকার মাঝখানে দাড়িয়ে থাকল৷ মালপত্রের জন্য সেখানে বসার কোন জায়গা নেই তাই তাকে ডেকে আমার পাশে বসালাম৷
হঠাৎ সাগরে ঢেউ একটু বেড়ে গেল৷ নৌকা চালাতে নানার একটু সমস্যা হচ্ছে এবার৷ দূরে অনেক দূরে লম্বা লম্বা গাছ দেখা দিতেই নানাকে বললাম ঐগুলার পাশ দিয়ে যেতে নানা বলল ঐদিকে গেলে অনেক দেরী হয়ে যাবে৷ সামনে এইরকম আরো চর পড়বে৷ তখন কাছ দিয়ে নিয়ে যাবেন৷
নৌকা চলছে অথৈ জল কেটে৷ সিফাত ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই ঘুম৷ নৌকার পিছন দিকে আমি আর সুমি আপু নানার সাথে বসে উপভোগ করছিলাম জার্নি৷ প্রায় বারটার দিকে আমরা একটা চরের কাছে ভিড়লাম তবে নামিনি সেই চরে৷ আমরা নৌকায় বসেই সেই চরের সৌন্দর্য্য দেখে দেখে সামনে আগাতে লাগলাম৷
ইকবালকে পাঠায়ে ঘুমে থাকা সবাইকে জাগিয়ে দিলাম৷ চরের চারপাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি৷ কিছু জেলে নৌকা দেখা যাচ্ছিল৷ তারা হয়ত যাত্রা বিরতি দিয়েছে৷ দুপুরে রান্না করে খেয়ে আবার সমুদ্রে চলে যাবে মাছ ধরতে৷
নানাকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন এটা চর জমির৷ এই চরে মানুষজন নাই বললেই চলে৷ আশপাশের জেলেরা অস্থায়ী ভাবে যাত্রা বিরতি করে এখানে মাছ ধরতে সাগরে গেলে৷ একটু কাছে যেতেই দেখি আরো কিছু নৌকার জটলা৷ এইখানে মানুষ একটু বেশি, তারা চরে আগুন জ্বালিয়ে রান্না করছিল৷
নানাকে বললাম এখানে একরাত থাকলে কেমন হয়৷ নানা বললেন থাকা যায় তবে নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে তাই না থাকাই ভাল এই চরে৷ চর জমির ছাড়িয়ে যেতেই সামনে নতুন চরের দেখা পেলাম৷ সেটাতেও প্রায় একইরকম বড় বড় গাছ দেখা যাচ্ছিল, দুই একটা জেলে নৌকা দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা৷ তবে এই চরটা একটু ছোট৷ চর জমিরের মত বড় না৷
নানাকে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন এটা চর কালি৷ এখানকার জেলেরা একে কালির চর বলে৷ ঠিক কি কারনে এমন নাম এর উত্তর নানার জানা নেই৷ দূর থেকে আমরা ছবি তুললাম৷
চর তারুয়া দ্বীপে যেতে আরো সময় লাগবে আমাদের৷ চর কালি পেছনে ফেলে আমরা আবার সাগরের গভীরে এসে পড়লাম৷ চারপাশে শুধু জল আর জল৷ ঢেউ বেশি থাকায় সামনে যেতে সমস্যা হচ্ছিল৷ নৌকা বেশ লাফাচ্ছিল ঢেউয়ের তালে৷ পানির ছিটা গায়ে এসে লাগতে শুরু করল৷ ব্যাগ মালপত্র সব ভিজে যাবার দশা৷
সিফাত ভাই আর আমি গিয়ে আমাদের ইনস্যুলেশান ম্যাটগুলো উল্টা করে তা দিয়ে সব ঢেকে দিলাম যাতে মালপত্র না ভিজে৷ দুপুর বারটার দিকে দূর থেকে আমরা চর তারুয়া দ্বীপ দেখতে পেলাম৷ দূর থেকে নৌকায় বসে দ্বীপটা বেশ সুন্দর লাগছিল দেখতে৷ যত কাছে যাচ্ছিলাম একটু একটু করে ততই দ্বীপটা আকারে বড় হতে লাগল৷
কিছু জেলে ছোট নৌকা নিয়ে জাল থেকে ইলিশ মাছ সংগ্রহ করছিল৷ এখানে পানি কিছুটা কম চতুরপাশে খুঁটি গেড়ে গোল করে জালের ঘেরাও বানিয়ে ফেলেছে তারা৷ যাবার পথে মাছ সে জালের ঘেরে আটকে যায়৷ কিছু মাছ লাফিয়ে জালের ঘের পার করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে৷ লাফ দেবার সময় কখনো কখনো জালের উপড়িভাগে আটকে ঝুলে থাকে মাছ৷
সে রকম দৃশ্য প্রথমবার দেখলাম জীবনে৷ জালের মাঝে তাজা ইলিশ মাছ আটকে ঝুলে আছে৷ জেলেরা ট্রলার থেকে ছোট নৌকা নিয়ে গিয়ে সেগুলো সংগ্রহ করছে৷ সেই সাথে জাল সবখানে ঠিক আছে কিনা সেটাও চেক করছে৷ ছিঁড়া ধরা পড়লে তা মেরামত ও করে নেয় তারা সাথে সাথে৷ নাহলে মাছ পালাবে৷
বেলা সাড়ে বারটার দিকে আমাদের নৌকা তারুয়া দ্বীপে এসে পৌঁছাল৷ আমরা ছোট একটা সমস্যায় পড়লাম, ঐসময় ভাটা হওয়াতে পাড়ে পানি কম ছিল৷ তাই নৌকা আটকে গেল চরে৷
নানা নৌকা থামিয়ে দিয়ে বললেন আর সামনে যেতে পারবেন না৷ খেয়াল করলাম যে পানিতে নৌকা দাড়িয়ে আছে সেটা পাড় হয়ে চরে উঠতে গেলে প্যান্ট ভিজে যাবে সবার৷
তারপরও কি আর করার আমরা সবাই এক্সট্রা কাপড় সাথে নিয়ে নেমে গেলাম পানিতে৷ সুমি আপু সাইজে একটু ছোট হওয়ার তার জন্য পানি একটু বেশি ছিল ঐ জায়গায়৷ আপু নামতে সমস্যা হবে ভেবে নানার বেটা লোংগী গোজ মেরে পানিতে নেমে গেলেন নাতনীকে কোলে করে পার করে দিতে৷
নানার কোলে সুমি আপা উঠবে আহা, এটা ভেবেই আমরা সবাই মজা করা শুরু করলাম সুমি আপুর সাথে৷ আমাদের মজা নেবার সুযোগ না দিয়ে আপু পানিতে ঝাপ দিলেন৷ প্যান্ট ভিজিয়ে আমাদের সাথেই চরে এসে গেলেন তিনি৷ জাহাঙ্গীর ভাই আর আমি নানাকে পেয়ে বসলাম৷ ” কি নানা সুযোগ তো মিস কইরা ফালাইছেন, নাতনী তো কোলে উঠল না ” নানা বেটা লজ্জা পেল ভালমত৷ আমার আর জাহাঙ্গীর ভাইয়ের জ্বালায় নানা আমাদের ফেলে অন্য দিকে দৌড় দিলেন৷ জাহাঙ্গীর ভাই আমি হেসে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা৷
দ্বীপটা দেখে পছন্দ হয়ে গেছিল৷ আমি তো নামার সময় আমার তাবুটাই সাথে নিয়ে নিয়েছিলাম৷ এই দ্বীপটার সামনের অংশ বিশাল ফাঁকা৷
জনবসতি দ্বীপ থেকে একটু দূরে ভিতরের দিকে৷ তবে এখানে ক্যাম্প করার পরিবেশ ভাল৷ কেউ চাইলে চিন্তা ছাড়াই এখানে ক্যাম্পিং করতে পারবেন নিরাপদে৷
আমরা সন্মুখের খালি চরটা পার হতেই সামনে বিস্তির্ন খোলা সবুজ মাঠ দেখতে পেলাম৷ মাঠের মাঝখানে ছোট ছোট বরই গাছ দেখলাম৷ গাছগুলো বেশ ছোট হাত দিয়ে পেরে বরই খাওয়া যায়৷
ভাগ্যাক্রমে আমারা যখন যাই গাছে বরই ছিল৷ সিফাত ভাই আর আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম৷ পরে অন্যরাও এসে শুরু করে দিয়েছিল৷ আমি একটা গাছের নীচে একটু ছায়ায় আমার তাবু টা সেট করে ফেললাম৷
যতক্ষন আছি রেস্ট নেয়া যাবে খারাপ লাগলে৷ এই দ্বীপে টুরিস্টদের জন্য মোটামুটি সুবিধা আছে৷ শৌচাগার ব্যবস্থাও আছে এখানে৷ কিছু দোকানপাট ও আছে৷ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায় একটু দূরের দ্বীপ হলেও৷ আমাদের আগে আরো বেশ কয়েকটা গ্রুপ এখানে এসেছে সকালে৷ তারা এখানে ক্যাম্পিং করে থাকবে৷
জাহাঙ্গীর ভাই আর কামরুল ভাই দোকানের দিক থেকে ঘুরে আসলেন৷ ঐ দিকের পরিবেশ ভাল বলে মনে হয়েছে তাদের৷ তারা ফিরে এসে তাবুতে বিশ্রাম নিয়েছিল৷ সবাই ছবি তুললাম নিজেদের মতন করে৷ দ্বীপটা ভাল লেগে যাওয়ায় একবার ভাবলাম আমরাও এখানে থেকে যাই৷ কিন্তু পরে আর থাকিনি এখানে৷
আমাদের পছন্দ করা দ্বিতীয় ক্যাম্পিং প্লেইস ছিল কুকরি মুকরির হট স্পট নারিকেল বাগান৷ প্রায় অনেক্ষন তারুয়া দ্বীপে সময় কাটানোর পর নানা এসে বললেন রওনা দিলে ভাল হয়৷ বেলা থাকতেই নারিকেল বাগান পৌঁছানো যাবে৷ এদিকে আমাদের খেদমত করতে করতে সুমি আপু ক্লান্ত৷ খোলা রোদে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে আপুর৷ কামরুল ভাই আমাকে সাহায্য করলেন তাবু গুছিয়ে নিতে৷
সব গুছিয়ে নিয়ে আমরা নৌকার দিকে আগাতে লাগলাম৷ পথে আমরা বেশকিছু ছবি তুললাম৷ নানা আগে আগে চলে গেলেন৷ নৌকার কাছে এসে হাঁটু পানি মাড়িয়ে আমরা সবাই নৌকায় উঠে বসলাম৷ নানা ইঞ্জিন চালু করো নৌকা টান দিলেন৷ গন্তব্য কুকরিমুকরির ‘ নারিকেল বাগান ‘৷
চলবে…
#ব_দ্বীপ ( দৃষ্টিতে মুগ্ধতা )
লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু