কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ
পর্ব – ৭:
পর্ব – ৮
১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তারুয়া দ্বীপ ছেড়ে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে অথৈ সাগরের দিকে৷ নৌকায় বসে আমরা আস্তে আস্তে তারুয়া দ্বীপকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দেখছিলাম৷
যতই সামনে আগাচ্ছিলাম দ্বীপের আকার ক্রমশই আকারে ছোট হয়ে আসছিল আমাদের চোখে৷ একসময় তা একেবারেই মিলিয়ে গেল৷ আমরা আবার গভীর সমুদ্রে এসে পড়েছি৷
চারপাশে শুধু জল আর জল৷ দূরে কিছু মাছ ধরার ট্রলার দেখা যাচ্ছিল শুধু৷ মধ্য দুপুর আমাদের দুপুরের খাবার তৈরির আয়োজন চলছে৷
তারুয়া থেকে আসার সময় সুমি আপুর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছিল তারপরও উনি বেশ ভালই সহযোগীতা করেছিলেন সিফাত ভাইকে রান্না করতে৷ সিফাত ভাই চুলায় খিচুরী বসিয়ে দিলেন৷
প্রচন্ড বাতাসে চুলা নিভে যাবার অবস্থা৷ শেষে চুলা একটু ভিতরের দিকে চেপে দিয়ে আমাদের ইনস্যুলেশান ম্যাট দিয়ে ঘেরাও দিয়ে বাতাস আটকে দিলাম৷ বাতাস এত বেশি ছিল যে ম্যাট উড়ে যাবার অবস্থা৷ আমাদের ভারী ব্যাকপ্যাক দিয়ে চাপা দিয়ে কোনরকমে রক্ষা করেছিলাম ম্যাট৷
অনেক সময় লাগিয়ে খিচুরী হয়ে যেতেই চুলায় ডিম চড়িয়ে দিলেন সিফাত ভাই৷ আমাদের নৌকা ঢেউ কেটে কেটে সামনে এগিয়ে চলছিল৷ বাতাস বেশি হবার কারনে সাগরে ঢেউ বেড়ে গিয়েছিল৷ নানার নৌকা চালাতে সমস্যা হচ্ছিল৷ নৌকার গতি একটু কমিয়ে দিলেন নানা৷ নাহলে নৌকা ঢেউয়ে বেশি দুলছিল৷
নৌকার পাটাতনে বেশ পানি জমে গিয়েছিল৷ এবার ইকবালের হাতে নৌকার হাল ধরিয়ে দিয়ে নানা নিজে গেলেন জল সেচতে৷ ইকবাল একটু সময় বেশি লাগায়৷ তাই নানা নিজেই করতে গেলেন এবার৷ নানা জল সেচতে লাগলেন৷
সেচার সময় নানার সন্দেহ হল একটু, নৌকায় সম্ভবত স্বাভাবিকের চাইতে দ্রুত পানি ঢুকছে, তাড়াতাড়ি ইকবালকে সড়িয়ে নিজের বসার জায়গার তক্তা সরিয়ে ইঞ্জিন চেক করলেন৷
সর্বনাস একদিকে ইঞ্জিনের নাট খুলে পড়ে গেছে৷ প্রপেলার ঘুরার সময় তাই বেশি পানি ঢুকছিল নৌকায়৷ নানা ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন৷ মাঝ সমুদ্রে আমরা নৌকায় বসে ঢেউয়ে দুলছিলাম৷
নানার কপালে চিন্তার ভাঁজ৷ আমাদের আত্মারাম খাঁচার বাইরে৷ এ কোন বিপদে পড়লাম৷ আসেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা৷ এমন এক জায়গায় নৌকা দাড়ানো দূরেও কোন ট্রলারও দেখা যাচ্ছিল না৷ সবাই আল্লাহ কে ডাকা শুরু করলাম৷ এই বুঝি সব গেল৷
নানা বহু কষ্টে নাট লাগালেন৷ নৌকা আবার চলতে শুরু করল৷ আমরা হাপ ছেড়ে বাঁচলাম৷ প্রায় পনের বিশ মিনিট চলার পর নাট আবার খুলে গেল৷ টের পেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন নানা৷ এবার নাটের প্যাচ একেবারে ক্ষয়ে গেছে৷ আর লাগাবার উপায় নাই৷
আমাদের চিন্তা আরো বেড়ে গেল৷ পৌঁছাতে পারব তো নারিকেল বাগান সহিহ সালামত৷ নাকি এই যাত্রায় শেষ আমরা৷ প্রায় অনেক্ষন আমরা সাগরে নৌকায় এমনেই ভাসলাম৷
নানার মাথায় বুদ্ধি এল নৌকার ছেড়া তেনা দিয়ে নাট মুড়িয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কোন রকমে নাট লাগালেন নানা৷ শেষ চেষ্টা যদি কাজ হয়৷
আমরা সবাই দোয়া করছিলাম যাতে কাজটা হয়ে যায়৷ নাহলে নির্জন সমুদ্রে রক্ষা নাই আমাদের৷ নানা ইঞ্জিন চালু করে নৌকা টান দিলেন৷ এবার নানা ইঞ্জিনের উপরের কাঠ না বসিয়ে খোলা রাখলেন যাতে সব তিনি দেখতে পারেন ঠিকমত৷
নারিকেল বাগান আরো প্রায় দেড় ঘন্টার পথ৷ সিফাত ভাই গিয়ে চেক করলেন ডিম সিদ্ধ হয়েছে কিনা৷ এতক্ষনে মাত্র পানি গরম হয়েছে অল্প৷ তারমানে আরো অনেক সময় লাগবে৷
চর মোন্তাজ থেকে রওনা দেবার সময় মুড়ি আর চনাচুর নিয়েছিলাম৷ কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই গামলায় মুড়ি চনাচুর মাখালেন৷ সবাই অল্প খেয়ে নিলাম৷ কখন যে দুপুরের খাবার খেতে পারব তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই৷
নৌকা চলছে৷ নানার দৃষ্টি বারবার ইঞ্জিনের জোড়া দেয়া নাটের দিকেই ফিরে যাচ্ছিল৷ আমি যা দেখলাম নানার সার্জারি ভালই কাজে লেগেছে৷ কোনরকমে নারিকেল বাগানে পৌঁছাতে পারলেই বাঁচি৷
হঠাৎ নানা বললেন তার এক নাম্বার লেগেছে৷ আমার হাসি পেল মাঝ সমুদ্রে নানা কি বলে এইসব৷ চারপাশে শুধু জল আর জল৷ আমি বললাম এখানে কই করবেন৷ আমাদের খালি কোন বোতলও নাই যে দিব৷ নানা বললেন লাগবে না বোতল৷ তিনি সমুদ্রেই মুত্র বিসর্জন দিবেন৷
আমাকে সামনের দিকে ফিরে বসে থাকতে বলেই নানা পিছন দিকে ফিরে বসে বোতল খালি করে দিলেন৷ সামনের দিকের ওরা নানার এই আকাম সম্পর্কে জানতে পারল না একদম৷
আরো প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর দূর থেকে নারিকেল বাগান দেখতে পেলাম আমরা৷ নানা নিজেই দেখিয়ে দিয়ে বললেন ঐটা নারিকেল বাগান৷
প্রচুর মাছ ধরার ট্রলার নোঙর করা পাড়ে৷ এই নারিকেল বাগান কুকরিমুকরি চরের হট স্পট৷ বেশিরভাগ ট্রাভেলাররা এখানেই ক্যাম্পিং করে থাকে৷ আমরা পাড়ের কাছে যেতেই দেখি বড় দুইটা বোটে চেপে বহু টুরিস্ট ঘুরতে এসেছে৷ মাথা পুরাই খারাপ আমাদের৷
আমাদের নির্জন জায়গা পছন্দ৷ এখানে তো পুরা বাজার বসে গেছে৷ নানা আমাদের একটু ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন৷ সেদিকে একটা নির্জন স্পট আছে৷ যদি আমাদের পছন্দ হয় ক্যাম্পিং করব৷
স্পটে পৌঁছাতেই আমরা নেমে পড়লাম সব চেক করে দেখতে৷ জায়গাটা পছন্দ হল আমাদের৷ কিন্তু সমস্যা হল এটা একটু বেশি ভিতরের দিকে৷ এখানে থাকলে পুরা চর থেকে আলাদা হয়ে যাব আমরা৷ আশেপাশে যেখানেই যাব নদী পার হয়ে যেতে হবে আমাদের৷ তাই আমরা এখানে না থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম৷
সবাই স্পট থেকে নেমে নৌকায় চলে আসলাম৷ খুব খিদে লেগেছিল সবার৷ তাই পরের জায়গা খোঁজার আগে সবাই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে গেলাম৷ সুমি আপু সবাইকে খাবার বেড়ে দিলেন৷ এত বেশি খিদে লেগেছিল যে সাধারন খিচুরী আর ডিম খেতে অমৃত লাগছিল৷
আমি তো ডাবল খেয়েছিলাম৷ জাহাঙ্গীর ভাই মোটা চালের ভাত তেমন খেতে পারেন না৷ ভাই একটু কম খেলেন৷ আসলে এইসব চর এলাকায় চিকন চাল পাওয়া যায় না৷ আমরা অনেক খুঁজেছিলাম কচ্ছপিয়াতে পাইনি৷ পরে যেটা একটু ভাল পেয়েছিলাম সেটাই নিয়ে নিয়েছিলাম উপায় না দেখে৷
খাবার খেয়ে নেয়াতে একটা সুবিধা হয়েছিল আমাদের৷ আমরা খেতে খেতে দুই বোট ভর্তি টুরিস্ট চলে গেল নারিকেল বাগান ছেড়ে৷ এবার চর পুরাটাই খালি হয়ে গেল৷
নানা তাড়াতাড়ি নৌকা সামনের দিকে নিয়ে গেলেন৷ পূর্ব পাড়ে আমাদের ক্যাম্পের জন্য খালি জায়গা দেখেও নানা পশ্চিম পাড়ে নৌকা ভিড়ালেন৷
এই পাড়ে নলকূপ আর একটা দোকান আছে, আমরা গোসল করে ফ্রেস হবার জন্যই নানা এই পাড়ে নৌকা লাগিয়ে দিয়েছেন৷ এখানে কোন শৌচাগার নেই৷ দুইটা বানানোর কাজ চলছিল মাত্র৷ উপায় না দেখে বোতল ভর্তি পানি নিয়ে আমি আর কামরুল ভাই জঙ্গলে মঙ্গল করতে দৌড় দিলাম৷ এখানে জঙ্গল ই শেষ ভরসা৷ যারা দূর্গম পাহাড়ে অভিযানে যান তারাই কেবল বুঝতে পারবেন বিষয়টা৷
জঙ্গল থেকে বের হয়ে দেখি অন্যরা সামনের সরু খাল পার হয়ে নতুন ক্যাম্প সাইটের সন্ধান করছে৷ আমিও দৌড়ে সেদিকে গেলাম৷ খালের কাঁদামাটি পার হয়ে সবার সাথে যোগ দিলাম৷ চারপাশে গাছপালা ঘেরা সুন্দর একটা জায়গা পেলাম আমারা৷
সেখানেই ক্যাম্প ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে৷ এখানে বাইরের কেউ বিরক্তও করতে পারবেনা৷ কিন্তু সমস্যা হলো এই খালের কাঁদামাটি পার করে সব জিনিস পত্র এখানে আনা মুশকিল৷ নৌকাও জোয়ার না আসলে কাছে আনা সম্ভব না৷ তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও খালের ঐ পারের খালি জায়গাতেই ক্যাম্প ফেলেছিলাম আমরা৷
কাঁদামাটির খাল পার হয়ে আমরা পাড়ের ছোট্ট দোকানটায় বসলাম কিছুক্ষন৷ এখানে যত মাছধরার ট্রলার ভিড়ে, তার জেলেরাই মূলত এই দোকানের কাস্টমার৷ মোটামুটি প্রায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসই এই দোকানে আছে৷
দোকানে বসা জেলেদের থেকে বড় দুইটা ইলিশ মাছ নিতে চাইলাম আমরা৷ দাম বেশি বলাতে পরে কুকরির মেইন বাজারের আড়ত থেকে কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ দোকান থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে নৌকার কাছে গেলাম৷ ক্যাম্পের তাবু সেট করার জন্য নদীর ঐপাড়ে যেতে হবে আমাদের৷ নানা সবাইকে নৌকা করে ঐপাড়ে দিয়ে আসলেন, আমি এইপাড়ে রয়ে গেলাম৷
নানা ফিরে আসলে নানাকে নিয়ে বাজারে যেতে হবে বনের ভিতরের রাস্তা দিয়ে৷ একা গেলে রাস্তা হারানোর ভয় আছে৷ নানা সবাইকে ঐ পাড়ে রেখে ফিরে এলেন৷
নানাকে নিয়ে সন্ধার ঘন্টাখানেক আগে বনের রাস্তা ধরে কুকরিমুকরির বড় বাজারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম৷ কিছুদূর যাবার পর নানা তার পরিচিত এক বাইক চালককে ফোন করে বনের শেষ মাথায় রাস্তার উপড় আসতে বললেন৷
আমরা রাস্তায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বাইকওয়ালা হাজির৷ এবার নানা নাতি বাইকে চেপে বসলাম৷ বাইক হওয়াতে সুবিধা হল কিছুটা সময় বাঁচবে অনেক৷ হেঁটে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে৷ গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বাইকে করে আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই বাজারে পৌঁছে গেলাম৷
আমি মাছ কিনতে গেলে দাম বেশি চাইবে তাই নানাকেই পাঠালাম দরদাম করতে৷ আমি এক দোকানে বসে রইলাম৷ নানা পুরা বাজার খুঁজে এসে বললেন বড় মাছ নাই৷ কি আর করার মন খারাপ হয়ে গেল৷ এখন আবার ঐ দোকানে গিয়ে বেশি দামে মাছ কিনে নিতে হবে৷
নানা আমার মন খারাপ দেখে হাত ধরে বাজারের ভিতরের দিকে নিয়ে গেলেন৷ কই যাচ্ছি জিজ্ঞাসা করলে নানা শুধু বললেন আস আমার লগে৷ নানার পিছে পিছে বাজারের গলি দিয়ে হাঁটছি৷ গলির চিপায় এক দোকানের সামনে নিয়ে গিয়ে বললেন “এইখানে যে জিনিস আছে আপনার মন ভালা হয়ে যাবে নাতি”৷
আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দোকানদারকে বললেন আমার নাতিরে গরুর দুধের ইশপেশাল চা দেও৷ নানার বেটার মনে আছে চর মোন্তাজে গরুর দুধের চা খাইতে পারিনাই বলে আমার মন খারাপ ছিল৷ তাই এখানে আছে জেনে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন গরুর দুধের চা খাওয়াতে৷
নানা নাতি মিলে চা খেলাম৷ আহহহহ সে কি স্বাদ৷ তৃপ্তি সহকারে খেলাম৷ দোকানদার বললেন দুধ বাড়ায়ে দিছি ভাই, মজা লাগবে নে৷ আমি পরে আরও এক কাপ খেলাম৷
আন্ডার চরে কাঁচের গ্লাসে করে চা পরিবেশন করলেও এখানে কাপ ই ব্যবহার করে এরা৷ মাছ তো পেলাম না তাই চা খেয়ে নানাকে সাথে নিয়ে বাইকে চেপে বসলাম ফিরে যাবার জন্য৷
বাইকওয়ালা আমাদের বনের মুখ পর্যন্ত দিয়ে এল৷ প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে৷ নানাকে নিয়ে বনের পথে হাঁটছি আমি৷ হঠাৎ দু’জন জেলে পেয়ে গেলাম পথে৷ তারা মাছ নিয়ে আড়তে যাচ্ছিল মহাজনের কাছে বিক্রি করতে৷ তাদের থামিয়ে বড় দুইটা ইলিশ মাছ কিনলাম৷ নানা নিজে দরদাম করাতে অল্পদামে পেয়ে গেলাম৷ মনটা খুশি হয়ে গেল এবার৷ যাক যে উদ্দেশ্যে এসেছি তা সফল হল আমাদের৷ মাছ নিয়ে নেচে নেচে ক্যাম্প সাইটের দিকে চললাম৷
আমার খুশি দেখে নানাও খুশি৷ আজ রাতে জম্পেস খাওয়া দওয়া হবে৷ মাগরিবের আযান হবার একটু আগেই ক্যাম্প সাইটে পৌছালাম আমরা৷
আমি বাজারে যাবার পর সিফাত ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই আর কামরুল ভাই কলের ঠান্ডা পানিতে গোসল করেছিল৷ ঠান্ডায় আমার শরীর ভাল না লাগায় আমি গোসল করনি, তবে গামছা ভিজিয়ে ভালমত শরীর মুছে, হাত মুখ পা ভালমত ধুয়ে নিয়েছিলাম বাজার থেকে ফিরে৷
নানাকে নিয়ে ছোট ডিঙ্গি নৌকা করে খাল পার হলাম৷ সুমি আপুকে ক্লান্ত দেখে নানা নিজেই মাছ নিয়ে চলে গেলেন নৌকায়, সব কেটেকুটে ধুয়ে রেডি করে দেবার জন্য৷ আমি আর সিফাত ভাই তাবু সেট করতে শুরু করলাম৷ পরে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাইও হাত লাগিয়েছিল তাড়াতাড়ি হবার জন্য৷
আমি বাজার থেকে ফিরে আসার আগেই সবাই মিলে পাশের বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছিল৷ আমাদের সাথে স্থানীয় কিছু মানুষের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ আমাদের দেখে তারা খুব খুশি হয়েছিল৷
নানার মেয়ের জামাই এসে আমাদের অনেক সহযোগীতা করেছিল৷ নৌকা থেকে একে একে চুলা, গ্যাসের সিলিন্ডার ও প্রয়োজনীয় সব নিয়ে আসা হল আমাদের ক্যাম্প সাইটে৷ তাবু সেট করার পর সবার ব্যাকপ্যাক তাবুর ভিতরে রেখে লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালালাম তাবু থেকে একটু দূরে৷
সুমি আপু সবার জন্য নুডলস রান্না করলেন৷ নুডলস রান্নার ফাঁকে জাহাঙ্গীর ভাই, কামরুল ভাই আর সিফাত ভাই তাবুর সামনে ইনস্যুলেশান ম্যাট বিছিয়ে স্থানীয়দের সাথে কার্ড খেলা শুরু করে দিয়েছিল৷
আমি কার্ড খেলা তেমন ভাল পারিনা বলে নানাকে নিয়ে ঘুরতে চলে গেলাম সন্ধার আঁধারে৷ কিছুদূর সামনে যেতেই চরে আরো কিছু ক্যাম্পারদের তাবু নজরে পড়ল৷ তারাও আজ রাতে এখানে থাকবে৷
এটা বেশ বড় গ্রুপ৷ প্রায় ১২ থেকে ১৫ জনের৷ এর কিছু দূরে আরো কয়েকটা গ্রুপের তাবু দেখতে পেলাম৷ নানাকে নিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা ঘুরলাম আমি৷
ঘুরে ক্যাম্প সাইটে ফিরে যেতেই সুমি আপু নুডলস দিলেন খেতে৷ নানা আর আমি সবার পরে যাওয়াতে সুমি আপু আমাদের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছিল৷ এলাকার লোকদের সাথে নিয়ে অন্যরা আগেই খেয়ে নিয়েছে৷
সবাই কার্ড খেলায় মত্ত৷ সিফাত ভাই স্পিকার বের করে গান চালিয়ে দিলেন৷ কিছুক্ষন পর সুমি আপু সবার জন্য চা বানালেন৷ কয়েকটা ছোট পানির বোতল কেটে কাপ বানিয়ে এলাকার লোকজন সহ সবাই চা খেলাম৷
রাত একটু বাড়তেই স্থানীয়রা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন৷ আমরা রাতের খাবারের আয়োজন শুরু করলাম৷ নানা আগেই মাছ কেটে ধুয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিল৷ জাস্ট রান্না করতে হবে৷
সুমি আপু চুলায় ভাত বসিয়ে দিলেন ভাত হয়ে যাবার পর মাছ রান্না শুরু করতেই এল বৃষ্টি৷ লে হালুয়া পুরা ট্রিপে শুধু এটার ই কমতি ছিল৷
জাহাঙ্গীর ভাই তাবুর ভিতরে ঢুকে পড়লেন৷ সিফাত ভাই সবার ব্যাকপ্যাকগুলো সবচেয়ে মজবুত তাবুর ভিতরে নিয়ে রাখতে লাগলেন, যাতে ভারী বৃষ্টি হলেও আমাদের কারো ব্যাগের জিনিস পত্র না ভিজে৷
আমি আর কমরুল ভাই ইনস্যুলেশান ম্যাট ওল্টা করে সুমি আপুর মাথার উপড় ধরে রাখলাম, যাতে বৃষ্টির ফোটায় রান্নায় সমস্যা না হয়৷
কিছুক্ষন পর আমার জায়গায় সিফাত ভাইকে দাড় করিয়ে দিয়ে আমি তাবুর ভিতরে গেলাম বিশ্রাম নিতে৷ আমাদের রান্না হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল৷ দুই আইটেমের ইলিশ মাছ রান্না করেছিল আপু, একটা ইলিশ ভাজি আর একটা ঝোল দিয়ে রান্না৷
একটু পর উপকূলীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এসে আমাদের সতর্ক করে গেলেন৷ রাতে ভারী বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা৷ সাবধানে থাকার জন্য৷ দমকা হাওয়া শুরু হয়ে গেছে কিছুটা৷
নিরাপত্তা বাহিনীর লিডার রমিজ ভাইয়ের সাথে বেশ ভাল সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল আমাদের৷ আমাদের রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল তাই রমিজ ভাইকে আর দলের সদস্যদের রাতে আমাদের সাথে খাবার নিমন্ত্রন দিলাম৷
এই সময়ে কাজের চাপ বেশি থাকায় রমিজ ভাই খেয়ে যেতে পারলেন না৷ চরে বহু টুরিস্ট, সবাইকে সতর্ক করতে হবে৷ পরে আসবেন বলে চলে গেলেন৷
রান্না হতেই নানা আর ইকবালকে আমি গিয়ে নৌকা থেকে ডেকে নিয়ে আসলাম৷ বৃষ্টিও থেমে গেছে, সবাই মিলে একসাথে খেতে বসলাম৷
আহা সুমি আপুর হাতের রান্না লা জবাব৷ জাহাঙ্গীর ভাই আজকে একটু ভালমতন খেলেন অন্যদিনের চাইতে৷ আমাদের খাওয়া শেষে নানা সব গুছিয়ে রেখে ইকবালকে নিয়ে নৌকায় চলে গেলেন ঘুমাতে৷
আমি বলে দিয়েছিলাম রাতে যদি বৃষ্টি আসে তাহলে ইকবালকে নিয়ে আমাদের তাবুতে চলে আসতে৷ খাওয়া শেষে একটু বিশ্রাম নিলাম৷ রমিজ ভাই তার দলবল নিয়ে আবার হাজির আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছেকিনা তা দেখতে৷
আমাদের নাকি উনার বেশ পছন্দ হয়েছে৷ একসাথে বসে রমিজ ভাইয়ের ওমান প্রবাসের গল্প শুনলাম৷ কি একটা সমস্যার জন্য উনাকে চলে আসতে হয়েছিল৷ বিদায় নেবার আগে দুইজন গার্ডকে সবসময় আমাদের পাশেই থাকার নির্দেশ দিয়ে অন্যদের নিয়ে চলে গেলেন বাকিদের নিরাপত্তা দিতে৷
দুই গার্ড ভাইকে পেয়ে আমরাও একটু স্বস্তি পেলাম৷ যাক ঝড় তুফান হলে পাশে এই দুই ভাই আছে৷ কিছুক্ষন পর দুই গার্ড ভাইকে ক্যাম্পের পাহাড়ায় রেখে আমরা চরের রাতের নিস্তব্দতা উপভোগ করতে বের হয়ে গেলাম৷ যাবার সময় একদল তাদের করা ছাগলের বার্বিকিউ খাবার নিমন্ত্রন দিল আমাদের৷ পেট ভরা থাকায় তাদের দাওয়াত কবুল করতে পারলাম না আমরা৷
সমুদ্রের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলাম আমরা৷ হেলানো একটা গাছ পেয়ে সবাই একে একে উঠে লাইন ধরে বসে গেলাম৷ গাছটা মোটামুটি ভালই উঁচু৷
তারুয়া দ্বীপে নানা সুমি আপুকে কোলে নিতে পারেনি, তাই নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করছিলাম৷ হঠাৎ দেখি দূর থেকে কেউ আসছে আমাদের দিকে৷ সিফাত ভাইয়ের মাথায় শয়তানি চিন্তা এল৷ আমরা যেহেতু অন্ধকারে গাছের উপড়ে বসে আছি তাই আমাদের কেউ দেখার সম্ভাবনা নেই৷ সামনে থেকে আসা মানুষদের ভয় দেখানো যাবে৷
ওরা কাছে আসতেই সেই চিৎকার চেচামেচি সবাই গাছের ডালপালা নেড়ে৷ ভয় পেয়ে দুই জন সেই লেবেলের দৌড়৷ অলেম্পিক চ্যাম্পিয়ন উসাইন বোল্টও ফেল মারত ঐ সময় তাদের কাছে৷
মধ্যরাতে ক্যাম্পে ফিরে এসে দেখি গার্ড দুই ভাই নেই৷ হয়ত অন্য কোন দিকে গেছে চেক দিতে৷ কিন্তু না আমাদের দেখে একটু দূর থেকে টর্চের আলো নেড়ে সংকেত দিলেন তারা যায়নি, একটু দূরে হলেও আমাদের ক্যাম্পের দিকে তাদের নজর আছে৷
আমাদের ক্যাম্পটা একদম সাগরের কাছাকাছি৷ তাবুর ভিতর থেকে সাগরের গর্জন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল৷ ঠিক কয়টায় ঘুমিয়েছিলাম মনে নেই৷
চলবে…
#ব_দ্বীপ ( দৃষ্টিতে মুগ্ধতা )
লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু
পর্ব – ৮