কুকরিমুকরি – সোনারচর – আন্ডার চর – চর মোন্তাজ – চর তারুয়া দ্বীপ ভ্রমণ
শেষ পর্ব:
বরাবরের মতই আমাকে সকালে কামরুল ভাই ঘুম থেকে জাগালেন৷ সকালে ভোরে কামরুল ভাই আর জাহাঙ্গীর ভাই পুরা এলাকা ঘুরে এসেছেন প্রায়৷ ঘুম থেকে জেগেই বোতল ভরা পানি নিয়ে আমি আর সিফাত ভাই জঙ্গলে মঙ্গল করতে দৌড় দিলাম৷ এখানে জঙ্গলই মঙ্গলের একমাত্র জায়গা৷ আর কোন উপায় নাই এছাড়া৷
জঙ্গল থেকে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নিলাম৷ নানা এসে হাজির হলে, সুমি আপু নানাকে পাম দিয়ে সকালের রান্নার দায়িত্ব ধরায়ে দেন৷
নানার বেটা ফেঁসে গেল এই যাত্রায়৷ রান্না নানা করবে তাই কোন চিন্তা নাই, সবাই একসাথে ঘুরতে বের হলাম৷ আমি বরাবরের মতই লুঙ্গী পড়ে নিলাম, আমার দেখাদেখি বাকিরাও লুঙ্গী পড়ে নিল ফটাফট৷ তা দেখে সুমি আপুও শাড়ী পড়ে নিলেন একঘন্টা লাগায়ে৷
এই ফাঁকে আমি ক্যাম্প সাইটের পাশে আমার হ্যামক লাগিয়ে আরাম করে নিলাম কিছুক্ষন৷ সুমি আপু রেডি হয়ে আসতেই সবাই হ্যামকে ফটোশুট করে নিল৷ এরপর আমরা সবাই সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম৷
কুকরিমুকরি চরের নারিকেল বাগান এরিয়াটা বেশ কোলাহলপূর্ন৷ অন্যন্য চরের চাইতে এখানেই বেশিরভাগ টুরিষ্ট ঘুরতে আসে৷ যারা আসে মূলত ক্যাম্পিং করে একটা রাত থাকতেই এখানে আসে৷ এই এলাকার পরিবেশটা ক্যাম্পিং করার জন্য শতভাগ নিরাপদ৷
গত রাতে রমিজ ভাই বলেছিলেন এলাকার চেয়ারম্যান খুব ভাল৷ উনি চেষ্টা করছেন জায়গাটাকে প্রথম সারির পর্যটন প্লেস বানানোর জন্য৷ সবাইকে সাথে নিয়ে উনি কাজটা বেশ ভালোই সামলে নিচ্ছেন বুঝতে পারলাম৷ টুরিস্টদের জন্য শৌচাগার নির্মান, থাকার জন্য হোটেল আর পানীয় জলের জন্য পর্যাপ্ত টিউবওয়েল নির্মান সবই চলছিল দেখলাম৷
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চরের প্রায় শেষ মাথা পর্যন্ত চলে এসেছি৷ চলার পথে জাহাঙ্গীর ভাই দেখিয়ে দিলেন হরিণের পায়ের ছাপ৷ খুব ভোরে এখানে হরিণ বিচরন করে৷ তা দেখতে হলে অবশ্য ফজরের আগেই ঘাপটি মেরে জায়গামত বসে থাকতে হবে৷
আমরা ফিরে এলাম সেই জায়গায়, যেই জায়গায় রাতে গাছে চড়ে বসেছিলাম৷ এবার দিনের আলোতে সবাই বসে ছবি তুললাম৷ শাড়ী পড়েই সুমি আপু গাছে চড়ে বসলেন আমাদের সাথে৷
একটা বড় গাছ পেয়ে আমি হ্যামকটা ঝুলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ কিছুক্ষন আরাম করে নেয়াতে বেশ ভাল লাগছিল৷ এটা চরের নির্জন জায়গাগুলোর মধ্যে একটা৷ পরে সবাই এসে হ্যামকে শুয়ে ফটোশু করল নিজেদের মতন৷
এরপর আমরা আরেকটু সামনে গিয়ে গ্রুপ ফটোশুট করলাম৷ আসার সময় আমার কালো চশমাটা লঞ্চে পড়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল৷ তাই রোদে গ্রুপ ছবি তোলার সময় আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল৷ তারপরও তুললাম কিছু ছবি৷ চশমা না থাকলেও মাথার গামছাটা রোদে বেশ ভাল সাপোর্ট দিচ্ছিল৷
আমি এক তার ছেঁড়া টাইপ মানুষ৷ যেখানেই যাই সে দেশ হোক আর বিদেশ আমার লুঙ্গী আর গামছা সাথে থাকা চাই৷ এগুলা না হলে আমার চলে না একদমই৷ আমার কাছে গামছা আর লুঙ্গী আমার শরীরের প্রধান অংশগুলোর অন্যতম মনে হয়৷ তাই যেখানেই যাই সাথে থাকে৷ কারো কাছে হয়ত দেখতে বিষয়টা ক্ষ্যাত লাগে৷ তাতে আমার কি আমি চলি নিজের মত৷ আমি কখনো এসব দিকে তাকাইনি৷ আমার তাকাতে ভালোও লাগেনা৷ নিজের মত থেকেই ঘুরতে ভালবাসি৷ ভ্রমণ আমাকে আনন্দ দেয়৷ আমার আত্মাকে প্রশান্তি দেয়৷
ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম কিভাবে ঠেলা জাল দিয়ে সমুদ্রের পাড়ে ছোট ছোট মাছ ধরে৷ জাহাঙ্গীর ভাই ভিডিও করে নিলেন৷ ঘড়ি দেখলাম প্রায় নয়টা বেজে গেছে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে৷ খাওয়া দাওয়া করে সব গুছিয়ে কচ্ছপিয়ার দিকে রওয়া করতে হবে৷ নানাকে বলেছিলাম পথে যদি সম্ভব হয় আন্ডার চরে একটু নামব৷ জানিনা সময়ে কুলাবে কিনা৷ যেতে পারবকিনা আন্ডার চর৷
সবাই আস্তে আস্তে ক্যাম্পের দিকে পা চালালাম৷ চলার পথে অন্যান্য ক্যাম্পারদের সাথে দেখা করে বিদায় নিয়ে নিচ্ছিলাম৷ বেলা দশটার দিকে আমরা ক্যাম্প সাইটে এসে পৌঁছালাম৷ আমরা ঘুরে আসতে আসতে নানার বেটা গরম ভাত ডিম আর আলুভর্তা করে ফেলেছিল৷
সবাই হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে খেতে বসে গেলাম৷ গরম গরম ভাত ডিম ভাজি আর সাথে আলুর ভর্তা খেতে বেশ লাগছিল৷
খাবার খেয়ে আমরা আমাদের ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিলাম৷ ক্যাম্প সাইটের সামনে সবাই ফটোশুট করলাম৷ এরপর একটা একটা করে সব তাবুগুলো গুছিয়ে নিলাম৷ কামরুল ভাই আমাকে সাহায্য করলেন আমার তাবু গুছাতে৷ তাবু ভাজ করে ব্যাগে ভরে নিলাম৷ নানা অল্প অল্প করে হাড়ি পাতিল গ্যাসের সিলিন্ডার সব নৌকায় তুলে নিলেন৷ সবশেষে আমরা নৌকার দিকে পা বাড়ালাম৷
আজই আমাদের শেষ দিন৷ ফিরে যেতে হবে বিকেল পাঁচটার মধ্যে বেতুয়া লঞ্চ ঘাটে ঢাকার লঞ্চ ধরতে৷ নৌকায় বসতেই নানা ইঞ্জিন চালু করে টান দিলেন৷ গতরাতে নানা এখানে নোঙর করা জেলেদের সহায়তায় ইঞ্জিনের ক্ষয়ে যাওয়া নাট বদলে ঠিক করে নিয়েছিলেন৷ তাই আজ আর কোন সমস্যা নাই৷ যাবার পথে নানাকে আন্ডার চরের কথা বললাম৷ আমাদের সময়ে কুলাবেনা বলে নানা আর সেদিকে যেতে চাইলেন না৷ এখান থেকে কচ্ছপিয়া যেতে দুই আড়াই ঘন্টা লেগে যাবে৷ সেখান থেকে আবার বেতুয়া যেতে প্রায় তিন ঘন্টার মত লাগবে৷ হাতে আসলেই পর্যাপ্ত সময় ছিলনা৷ নানা শর্টকাট নিলেন৷ আমাদের সরু খালের ভিতর দিয়ে নিয়ে চললেন৷ উদ্দেশ্য যত দ্রুত কচ্ছপিয়া পৌঁছানো যায় আমাদের নিয়ে৷
খালের দুপাশে শ্বাসমূল আর কেওড়া গাছের ছড়াছড়ি, এক পলকের জন্য মনে হল যেন সুন্দরবন চলে এসেছি৷ নারিকেল বাগানে হরিণ দেখতে না পেলেও ফিরতি যাত্রাপথে নানা যে সরু খালের ভিতর দিয়ে নিয়ে চললেন সেখানে সৌভাগ্যবশত হরিণের দেখা পেয়ে গেলাম আমরা৷ নানা নৌকার গতি স্লো করে দিলেন৷ হরিণগুলো বনের ভিতরে বিচরন করছিল৷
আমাদের মোবাইল ক্যামেরায় তা ধারন করতে পারলাম না তবে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম সব৷ হাতে সময় থাকলে নানাকে বলতাম আমরা জঙ্গলে নেমে একটু ঘুরি৷ কিন্তু সময় স্বল্পতায় তা সম্ভব হল না৷ নানা নৌকার গতি বাড়িয়ে দিলেন, আবার আমরা কচ্ছপিয়ার দিকে ছুটে চলেছি৷ সরু খাল পার হয়ে বড় খালে প্রবেশ করার আগে এক ট্রলারের সাথে আমাদের নৌকা প্রায় মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হতে রক্ষা পেল৷ নানা আমাদের নৌকাকে একদম খালের পাড়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন৷ এ যাত্রায় আবারও রক্ষা পেলাম৷
আমাদের নৌকা এবার সরু খাল পার হয়ে বড় খালে এসে পড়ল নানা ইঞ্জিনের গতি সর্বেচ্চ করে দিলেন৷ দুপাশে জল কেটে আমাদের নৌকা ছুটে চলেছে, গন্তব্য চর কচ্ছপিয়া৷ আমরা সবাই নৌকায় বসে শেষ মূহুর্তের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম৷
আসলে যেখানেই ঘুরতে যাইনা কেন আমার কাছে ডেস্টিনেশানের চাইতে মধ্যবর্তী জার্নিটাই বেশি ভালো লাগে৷ আমি এই জার্নিটা বেশ উপভোগ করি৷ বেলা একটার একটু আগে আমরা চর কচ্ছপিয়াতে এসে পৌঁছালাম৷
নৌকা থেকে নামতেই রমিজ ভাই দৌড়ে আসলেন স্বাগত জানাতে৷ রমিজ ভাইকে পেয়ে আমরাও খুশি হলাম অনেক৷ একদম সাদা মনের দিল খোলা একজন মানুষ এই রমিজ ভাই৷
ব্যাকপ্যাক নিয়ে নৌকা থেকে নেমে এলাম সবাই৷ একটা দোকানে বসে নানা রমিজ ভাই সহ চা খেলাম৷ রমিজ ভাই একটা ব্যাটারির রিকশা ঠিক করে দিলেন, যেটা আমাদের সোজা চরফ্যাসন পার করে বেতুয়া লঞ্চঘাটে দিয়ে আসবে৷
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চর কচ্চপিয়া ঘাট থেকে বেতুয়ার দিকে যাত্রা করলাম৷ প্রায় আড়াই ঘন্টা চলার পর আমরা ভোলার চরফ্যাসনে এসে পৌঁছালাম৷ আমরা গাড়ি থেকে নেমে জ্যাকব টাওয়ার দেখলাম৷
সবাই মিলে ছবিও তুললাম৷ দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য একট হোটেলে ঢুকলাম৷ খাবারের দাম বেশি দেখে বেতুয়া ঘাটে গিয়েই খাবার সিদ্ধান্ত নিলাম৷
গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই বেতুয়া ঘাটে চলে যাবার জন্য৷ পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা বেতুয়া লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে যাই৷ গাড়ী থেকে নেমে ঘাটের টিকিট কেটে লঞ্চের দিকে আগালাম ব্যাকপ্যাক নিয়ে৷ লঞ্চে পা দিতেই ম্যানেজার হেলাল ভাইয়ের সাথে দেখা৷ আমরা যে লঞ্চে এসেছিলাম সেই একই লঞ্চে ফিরে যাব বাহহহ৷
ম্যানেজার হেলাল ভাই আমাদের স্বাগত জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কি ভাই আজকে কি আবার ক্যাম্পিং হবে নাকি৷ আমরা সবাই হেসে উঠলাম একসাথে৷ দোতালায় আমাদের পছন্দের আগের সেই জায়গাতেই গিয়ে বসলাম আমরা৷ ম্যাট বিছিয়ে সবার ব্যাকপ্যাক রেখে জায়গা ধরে নিলাম৷ আজকে লঞ্চে একটু ভিড় হবে বুঝতে পারলাম তাই জায়গা ধরা৷
আমরা দুপুরের খাবারের জন্য লঞ্চ থেকে নেমে ঘাটের দিকে গেলাম৷ কামরুল ভাই লঞ্চে বসে থাকলেন আমাদের সবার ব্যাকপ্যাক পাহাড়া দেবার জন্য৷ আমরা খেয়ে আসার সময় ভাইয়ের জন্য পার্সেল করে নিয়ে আসব খাবার৷ প্রথমে একটা হোটেলে ঢুকে দেখলাম, জাহাঙ্গীর ভাই বললেন আরো কয়েকটা দেখি৷
হোটেল থেকে বের হতেই সামনের হোটেলের একজন হাত ধরে টেনে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন৷ আমাদের বিভিন্ন মাছের আইটেম দেখালেন৷ আমাদের পছন্দ হল৷ আমরা আমাদের মোবাইলগুলো চার্জে দিয়ে খেতে বসলাম৷ আমাদের জন্য দোকানের একদম শেষ দিকে একটা আলাদা রুমে খাবার পরিবেশন করেছিল৷ তাদের আপ্যায়ন বেশ ভাল লেগেছিল আমাদের৷ পাশের দোকানে না বসে তাদের এখানে চলে এসেছি দেখে ১০ % ডিসকাউন্টও আদায় করে নিলাম৷
আমরা পেট পুরে ভাত খেলাম ইলিশ মাছ দিয়ে সাথে ডিম৷ জাহাঙ্গীর ভাই অন্য মাছ দিয়ে খেয়েছিলেন৷ সম্ভবত সেটা সামুদ্রিক লাল পোয়া মাছ ছিল৷ ভাত খেয়ে আমরা গরুর দুধের সর দেয়া চা খেলাম৷ আমাদের জন্য এক্সট্রা দুধের সর ও বাটিতে করে দিয়েছিল৷ সেটাও চায়ের সাথে মিশিয়ে খেয়েছিলাম৷
গরম গরম মিষ্টি তৈরি হতে দেখে লোভ সামলাতে পারলামনা আমরা৷ দামও কম৷ বেশ কয়েক দফা খেলাম আমরা গরম গরম ছানার মিষ্টি৷ কামরুল ভাইয়ের জন্য আর আমাদের জন্য আলাদা করে মিষ্টি প্যাক করে নিলাম৷
দুপুরের খাবার ভাল লেগেছিল বলে রাতে লঞ্চে খাবার জন্য পার্সেল ও করে নিয়েছিলাম পাঁচ জনের জন্য৷ আমরা তো এখানে খেয়ে নিয়েছি তাই রাতের খাবারের পার্সেল আর কামরুল ভাইয়ের জন্য একটা আলাদা পার্সেল সাথে নিয়ে জাহাঙ্গীর ভাই লঞ্চে চলে গেলেন৷ আমি সিফাত ভাই আর সুমি আপু ঘাটে কিছুক্ষন সময় কাটালাম৷
লঞ্চে উঠার আগে আমাদের চার্জে দেয়া মোবাইলগুলো খাবার হোটেল থেকে বুঝে নিলাম৷ ঘাট থেকে লঞ্চে খাবার জন্য কিছু হালকা নাস্তাও কিনে নিলাম৷ ঠিক বিকাল সাড়ে পাঁচটায় আমাদের লঞ্চ ছেড়ে দিল৷ বেতুয়া ঘাট ছেড়ে আমরা ছুটে চললাম, গন্তব্য ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল৷
প্রতিবার লেখা শেষে চলবে লিখলেও এবার আর চলার রাস্তা নেই বিধায় থেমে যেতে হচ্ছে৷ ধন্যবাদ সবাইকে৷
#ব_দ্বীপ ( দৃষ্টিতে_মুগ্ধতা )
লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু