পর্বঃ ২
(সমুদ্র পথে- হরিনা ঘাটা, লালদিয়ার বন, বিহঙ্গ দ্বীপ, সুন্দরবন এর কচিখালী, শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, টেংরাগিরি ফরেস্ট, আশার চর, চর বিজয় – Victory Island, গঙ্গামতির চর, কুয়াকাটা হয়ে আবার বরগুনায় ফিরে আসা, প্রায় ২০০ + কিমি এর মতো সমুদ্র ভ্রমন)
যারা ১ম পর্ব পড়েন নি তাদের ১ম পর্ব পড়ে আসার অনুরোধ রইলো।
আমাদের মাছ ধরার ট্রলার চলা শুরু করলো বলেশ্বর নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা ধরে। এর মধ্যে ক্ষুধায় পেট চো চো করছিলো। তাই ইব্রাহিম ভাই এর বাসা থেকে রান্না করে আনা মোটা চালের ভাত, আলু ভর্তা, মুরগির মাংস আর ডাল দিয়ে সবাই খাওয়া আরম্ভ করলাম। সাগরের মাঝে আমাদের কাঠের নৌকা তে দুলুনি এর সাথে খাবার বেশ এনজয় করলাম।
ঘন্টা দেড়েক চলার পর সুন্দরবন এর ডিমের চর ও পক্ষীর চর কে হাতের বাম পাশে ফেলে আমরা চলে এলাম সুপতি খাল ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা কচিখালী তে। আমাদের ফরেস্ট পারমিট ছিলো না, তাই আমরা কচিখালী খাল এ ঢুকিনি।
আস্তে আস্তে বিকেল হচ্ছিলো। আমরা তখন ছুটে চললাম সাগর পার ধরে জামতলা সী বীচ এর দিকে যতটুকু যাওয়া যায়। এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েক টা হরিন, বন্য শুকর, বানর দেখতে পেলাম। বক, মদন টাক সহ অসংখ্য নাম না জানা পাখিও দেখতে পেলাম।
এভাবে বেশ কিছুক্ষন যাওয়ার পর জামতলা সী বীচ এর সামনে থেকে আমরা ট্রলার ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। যেহেতু আমাদের ১ম রাতের বেজ ক্যাম্প হবে বিহঙ্গ দ্বীপ এ। ভাটার টান ও আরম্ভ হলো। আমাদের ট্রলার বেশ স্পীড পেলো। এরই মাঝে ফোন এর নেটওয়ার্ক পেলে আরিফ ভাই এর কল। উনি ঘাটের ওই দিকে আছেন। তাই আমরা ঘাটের দিকে চললাম। পুরো সমুদ্র ধরে ফিরে যাওয়াতে নৌকা বেশ দুলছিলো। আমরাও উপভোগ করছিলাম।
এমন সময় দূরে একটি নৌকা দেখা গেলো ইলিশ ধরার নৌকা। তো আমরা ঐ নৌকা এর দিকে ট্রলার চালাতে বললাম। কাছাকাছি আসাতে ঐ নৌকার মাঝিকে ইশারা দিলাম যে মাছ কিনবো। সেও নৌকা নিয়ে আমাদের কাছে আসলো।
এই সময় আসলে ইলিশের সীজন ছিলো না। তারপর ও জেলেকে জিজ্ঞাসা করলে বলে যে, সে কিছুক্ষন আগে এসে জাল ফেলেছে, প্রথম বারে দুই টি ইলিশ পেয়েছে। আবার জাল তুলবে একটু দেরীতে। আমাদের দেরী হচ্ছিলো। তাই ২ টি ইলিশ ই দরদাম করে কিনে নিলাম। কিনে নিয়ে প্রসেসিং করতে দিয়ে দিলাম আমাদের ট্রলার এ। যদিও রাতের খাবারে আমাদের জন্য রান্না হচ্ছিলো খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস।
আমরা সন্ধ্যার আগে গিয়ে ঘাটে পৌছুলাম এবং আরিফ ভাই সহ ট্রলার এর আরো ১ জন লোক কে উঠিয়ে নিয়ে বিহঙ্গ দ্বীপ এর দিকে ট্রলার চালালাম।
আমরা ক্যাম্প করবো উত্তর – পূর্ব কোনে যেখানে বালির বীচ আছে। কিন্তু ভাটা এর কারনে আমাদের বোট সেদিকে যেতে পারলো না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।
আমরা ট্রলার নিয়ে নামলাম দক্ষিন – পশ্চিম সাইডের একটি খাল এর পাড়ে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত হলো আমরা তাবু সহ অনান্য জিনিষ নিয়ে পায়ে হেটে ক্যাম্প সাইডে যাবো। এতে রাতে জঙ্গলে হাইকিং অভিজ্ঞতা টাও হয়ে যাবে। আর আমাদের ট্রলারে রান্না চলতে থাকবে। রাতে জোয়ার এলে ট্রলার ঘুড়ে আমাদের ক্যাম্প প্লেস এ আসবে।
তো আমরা তাবু, টর্চ লাইট সহ আনুষাংগিক জিনিষ পত্র নিয়ে হেটে রওনা হলাম। যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। বিহঙ্গ দ্বীপ টা খুব বেশী পুরোনো না হলেও, গাছ গাছালি, লতা পাতায় ভরপুর। আরো আছে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এর গাছ পালা থেকে বের হয়ে আসা শ্বাস মূল। বেশ সাবধানে আমাদের পা ফেলতে হচ্ছিলো।
এই বিহঙ্গ দ্বীপ টি আসলে মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ। যা বলেশ্বর নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনা তে অবস্থিত। এর একপাশে সুন্দরবন এর শরণখোলা রেঞ্জ এর সুপতি ও কচি খালী। অপর পাশে পাথরঘাটা ও চর দুয়ানি উপজেলা। এক পাশে ডিমের চর, পক্ষীর চর ও বঙ্গোপসাগর। যদিও এই বনে হিংস্র কোন পশু পাখি থাকার কথা না। তবে আরিফ ভাই জানালো এই বনে বন্য শুকর, শেয়াল আছে কিছু। বিষাক্ত সাপ আছে। বেজী, গুই সাপ ও আছে। কিছু দিন আগে নাকি একটি বেশ বড় অজগর সাপ ও অবমুক্ত করা হয়েছে। প্রচুর পাখিও আছে।
যাই হোক আমরা অন্ধকারে বেশ সাবধানে পা ফেলে ক্যাম্প প্লেস এর দিকে যাচ্ছিলাম। যদিও দ্বীপ টা বেশী বড় না, তারপর ও ঘুর পথে প্রায় ২ কি.মি হেটে আমরা ক্যাম্প প্লেস এ পৌছুলাম। পৌছে সবাই বালিতে বসে কিছুক্ষন আলোচনা করলাম কিভাবে কি হবে । এরপর সবাই কাজে লেগে গেলাম।
প্রথমেই ওয়াইল্ড লাইফ ক্যাম্পিং এর প্রধান শর্ত আলো এর জন্য ও হিংস্র বন্য প্রানী থেকে রক্ষা পেতে ক্যাম্প ফায়ার জালানো। তো সবাই আশে পাশে থেকে জ্বালানি হিসেবে কাঠ, ছন, পাতা, শুকনো লতা এই সব সংগ্রহ করতে শুরু করলো। মোটামুটি সংগ্রহ করা হলে এক সাইডে আগুন জালানো হলো। এদিকে জ্বালানি সংগ্রহ চলতে থাকলো। এরপর আমাদের ক্যাম্প সাজানো।
একে একে সবার তাবু সেট করা হলো বালির উপর। যদিও এক তাবুতে ২/৩ জন করে থাকতে হবে। এরপর ক্যাম্প সাইডে কার্বলিক এসিড এর বোতল রাখা হলো সাপ থেকে প্রটেকশন পেতে।
এরপর শুরু হলো ক্যাম্প ফায়ার কে ঘিরে আড্ডা। এদিকে আকাশে চাঁদটাও আজ পরিপূর্ন হয়ে উঠেছে। এই জনমানব হীন জঙ্গলে, নির্জন পরিবেশ এ শেয়াল এর ডাক, ক্যাম্প ফায়ার, তাবু, আড্ডা, গান, আহ! কেউ এই পরিবেশ এ না থাকলে তাকে কোন ভাবেই বোঝানো সম্ভব না যে ফিল টা কেমন আসে।
আমাদের আড্ডা চলতে চলতে সাগরে জোয়ার শুরু হলো। জোয়ার এর পানি প্রায় আমাদের ক্যাম্প এর কাছে চলে আসলো। আর এর সাথে সাথেই আমাদের ট্রলার ও চলে আসলো। তো ট্রলার আসলে আমরা সবাই হাটু পানি অবধি ভিজে ট্রলার এ উঠলাম।
উঠে রাতের খাবার সারলাম, হাঁসের মাংস ও খিচুড়ি দিয়ে। অসাধারন ছিলো সেই টেস্ট।
এরপর ঘুমানোর পালা। বিহঙ্গ দ্বীপ এ অজগর, শেয়াল আর বন্য শুকর এর কাহিনী শুনে কেউ কেউ তাবুতে থাকার সাহস পেলো না। কয়েকজন ট্রলার এর কেবিন এ মাঝি দের সাথে ঘুমুলো। ট্রলার এর উপর একটি তাবু সেট করে ২ জন ঘুমালো। আর আমরা যারা ক্যাম্প এ তারা তাবুতে ফিরে আসলাম। তাবুর বাইরে শুরু হলো আবার আড্ডা।
মাথার উপর পূর্ণ পূর্ণিমার চাঁদ! সাগরে জোয়ার এর গর্জন! ক্যাম্প ফায়ার! বলতে গেলে আমার লাইফের সেরা কয়েক টি মুহূর্তের এক টি। মধ্যরাতে ক্যাম্প ফায়ার টা আরেক টু ভালো ভাবে জালিয়ে দিলাম, মরে যাওয়া দুটি গাছের গুড়ি দিয়ে। এরপর ক্লান্ত চোখে তাবুতে ঢুকলাম। তাবুর চেইন লাগিয়ে গায়ে মশা না কামড়ানো এর ক্রীম ” অডোমস ” গায়ে মেখে, স্লিপিং ব্যাগ খুলে লাইফ জ্যাকেট মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম . . . । ।
(চলবে)
লিখা ও ছবি: জাহিদ ইবনে জাহান ও তার টিম