মারায়ন তং এ ক্যাম্পিং, আলীরগুহা, দামতুয়া ঝর্ণা, ডিম পাহাড় ভ্রমন
পর্ব: ০১
আমার বিশ্বাস, ইচ্ছেশক্তি থাকলে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন একটা সময় এসে আসলেই সত্যি হয়ে যায়।
বলছিলাম আমার প্রথম পাহাড় ভ্রমণ মারায়ন তং ভ্রমণের কথা। সময়টা ছিলো গতবছর(২০১৯) রমজানের ঈদের ৩য় দিন। তারিখ ছিলো ০৭ জুন (শুক্রবার)।
সত্যি বলতে ছোটবেলা থেকেই অনেকটা রক্ষণশীল পরিবারে বড় হওয়ার কারণে ঘরের বাইরে তেমন করে বের হওয়া হয়নি বললেই চলে। এইসএসসির পর শহরে এসে টুকিটাকি ঘুরেছি কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনে ও বান্দরবানের কমন প্লেস গুলোতে। সমুদ্র ভিষণ ভালো লাগে আমার, যদিও এখন পাহাড়ই প্রথম পছন্দ।
ক্যালেন্ডারের ছবিতে অথবা মুভির সিনে পাহাড় দেখতাম। তখনও সেভাবে পাহাড়ের প্রতি আগ্রহ ছিলো না। কিংবা, ভ্রমণও যে একটা মানুষের নেশা হতে পারে তা কল্পনাতেই ছিলোনা। কিন্তু, ধীরে ধীরে আমার পাহাড়ের প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগলো। আমার ফ্রেন্ড কামরুলের প্রোফাইলে প্রায়ই দেখতাম বিভিন্ন পাহাড় এবং ঝর্ণার ছবি।
আমি দেখে অনুপ্রাণিত হতাম আর মনে মনে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করতাম। তাকে (কামরুলকে) একদিন বললাম পরবর্তী ট্যুর প্লান করলে আমাকে যাতে জানায়। এর মধ্যেই বেশ কয়েকবার তারা ট্যুর প্লান করে ঘুরেও এসেছে। প্রতিবারই আমাকে জানালেও বিভিন্ন কারণে আমার আর যাওয়া হলো না।
অতঃপর গত রমজানের পর ঈদের ৩য় দিন আমরা বান্দরবানের মারায়ং তং এ যাবো বলে ঠিক হলো। রমজানের শেষের দিকে আমার ভিষণ জ্বর ছিলো, তাই একটু ভয়ে ছিলাম যেতে পারবো কিনা।
দিনটা ছিলো শুক্রবার। ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান থাকায় আমি সেদিন দুপুরের মধ্যেই মোটামুটি ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। রাতের গাড়ি, তাই খুব তাড়া নেই। আমি, কামরুল আর ভাগিনা হাবিব ছাড়া বাকি সবাই ঢাকা থেকে আসবে। ঈদের ছুটিতে কামরুলও গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরে ছিলো। রাত ১০ টায় ঢাকা থেকে গাড়ি ছেড়েছে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। ফেনী থেকে গাড়িতে উঠবো আমরা।
হাবিব খুবই ভালো ছেলে। শুধু প্রশ্ন একটু বেশি করে আর কি। আমরা ০৩ জন রাতের খাবার খেয়ে নিলাম, সাথে মোবাইল গুলোও চার্জ করে নিলাম খাবার হোটেল থেকে। রাত প্রায় ০২ টার পর আমাদের গাড়ি ফেনী পৌঁছালো। আমরা গাড়িতে উঠতেই আবার টান দিলো গাড়ি। সিটে বসে রিলাক্স লাগছিলো। রাত সাড়ে তিনটায় গাড়ি চকরিয়াতে এসে যাত্রা বিরতি দিলো। সবাই নেমে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম।
সেখানেই একে একে আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো কামরুল। আমরা মোট ১৩ জন ছিলাম। শাহিন ভাই, অনিক ভাই, এ্যানি , শারমিন আপু, রুহুল ভাই, আরমান ভাই, শাহেদ ভাই, হাবিব (শারমিন আপুর ভাগিনা লাগে সুতরাং আমাদেরও ভাগিনা), এফএম মাহবুব, প্রদীপ ভাই , আমি, কামরুল এবং আরও একজন ভাই ছিলো এখন নাম মনে পড়ছে না। খাওয়া শেষে সবাই গাড়িতে উঠলাম। গন্তব্য আলীকদম।
ভোর ০৫ টায় আমরা আলীকদমের প্রায় কাছাকাছি এলাম। সেখানে কিছু লোক নেমে গেলো। এবার পুরো বাসে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। রাত থাকার কারণে এতোক্ষন পর্যন্ত কিছুই দেখা যায় নি। কিন্তু, ভোরের সোনালী আলো ফুটতেই দেখতে পেলাম বান্দরবানের আসল সৌন্দর্য।
বিশাল সব আকাশচুম্বী পাহাড়ের সাথে শুভ্র মেঘের খেলা আমার রাতের সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিলো। বাস চলছে। আমি জানালা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছি দূরের পাহাড়ের দিকে, যেখানে আকাশের সাথে পাহাড়ের মাথা লেগে আছে। মেঘ গুলো হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়।
গাড়ি যতই সামনে এগুতে লাগলো ততই রাস্তা গুলো সরু থেকে আরও বেশি সরু হতে লাগলো। উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী রাস্তা। আমি এর আগেও বান্দরবান এসেছি, কিন্তু এতো সৌন্দর্য তখন মনে হয় খেয়াল করিনি।
আমি অবাক দৃষ্টিতে দেখছি এবং মনে মনে কিছুটা ভয় ও পাচ্ছি এমন উঁচু আর সরু রাস্তা দেখে। কিছুদূর যেতেই দেখলাম পাহাড়ের খুব গভীরে নিচুতে একটি বিশাল মালবাহী ট্রাক উল্টে পড়ে আছে। কিছুদিন আগেই নাকি এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল। আমার ভয় আরও বেড়ে গেলো। ভয় আর সৌন্দর্যের দেখার আনন্দের মাঝামাঝি তে কিছুক্ষণের জন্য আমি কেমন উদাস বনে গেলাম।
সকাল ০৬ টায় ইয়াংচা বাজারের আর্মি চেক পোস্টের সামনে এসে আমাদের বাস থামলো। ০৭ টার আগে কোনো গাড়ি সামনে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই আমরা সবাই কিছুসময়ের জন্য বাস থেকে বাজারে নেমেছিলাম।
এতো সকালে তখনও দুই/একটা ছোট খাবার হোটেল ছাড়া আর কিছুই খোলেনি। বাজারে মোটামুটি অনেক গুলো দোকান এবং ছোট একটি মসজিদ আছে। মসজিদের গাছে অনেক কাঁচা আম আর আমড়া ধরেছিলো।
শাহিন ভাই, আরমান ভাই, অনিক ভাই সহ আরও কয়েকজন সেখান থেকে কিছু কাঁচা আম আর আমড়া পেড়ে সবাইকে দিলো। ওখানের মানুষগুলো খুবই সহজ সরল, কেউ তেমন কিছু বললো না আমাদের।
আমি বেশ কয়েকবার বাজারের নামটা পড়ে মনে রাখার চেষ্টা করছিলাম। ইয়াংছা বাজার, ইয়াংছা বাজার। বারবার নাম পড়া দেখে কামরুল হাসছিলো। বাজারের মাথায় মোটামুটি মাঝারি একটা লোহার ব্রীজ।
ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। ততক্ষণে গাড়ি ছাড়ার অনুমতি পেলাম। প্রায় ০৯ টার দিকে আমরা আলীকদম বাস স্টেন্ডে পৌঁছালাম।
চলবে…
লিখা ও ছবি: ছায়েরা আখতার সুমি