Home Blog Page 10

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ২

সাইংপ্রা (২য় পর্ব)

ভ্রমণ_ডায়েরির_পাতা_থেকে (৬ অক্টোবর,২০১৮)

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা (১ম পর্ব)

আমার মাথার ঠিক পিছনেই মুটামুটি বড়সড় একটা চারকোণা জানালা কাটা আছে!

একজনের স্লিপিং ব্যাগ সিংগেল লেয়ার বানিয়ে দুজন শেয়ার করার ফলে পা ঢাকতে গিয়ে মুখ ঢাকতে না পারা চোখে মিষ্টি রোদ আর কানে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে জানান দিলো ‘মামণি, সকাল হয়ে গেছে এবার উঠে পড়ো!’

খুব কষ্টে আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে দেখি চারপাশে ঘন কুয়াশা!

তারপর বুঝে পেলাম না,আমরা আসলে মেঘের ভেতরে আছি। সবার ঘুম ভাঙ্গতে এখনো দেরী। ঘড়িতে প্রায় ৬ টা বাজে। দেখলাম আরিফ ভাই প্রাকৃতিক ডাকে সারা দিতে চলে যাচ্ছে বাহিরে!

এইখানে ঝোপঝাড় ই ভরসা।
কিন্তু আপনার প্রাকৃতিক কাজ সারার সময় যে আশেপাশের শুকর এসে আপনাকে বিরক্ত করবে না সে ভরসা দিতে পারছি না!!

একে একে উঠে পড়লাম সবাই!
ফ্রেশ হয়ে নাশতা করবো! ট্রেকিং জগৎ এ সবার প্রাণরক্ষাকারী সেই স্যুপি নুডুলস দিয়ে।

খেয়াল করলাম আমার পা দুটো দারুণ বিট্রে করে বসে আছে। যেন পা বলছে ঘুমা মা, তুই ঘুমা!
এতো শান্তির ওয়েদার ছেড়ে কোথাকার কি ক্রিসতং!

পা বিট্রে করলে তাও ঠিকাছে, কিন্তু জুতা!
জুতা বিট্রে করলে পাহাড়ি রাস্তা আরো বেশি কঠিন হয়ে যায়! আমার ট্রেকিং করতে হবে তাহমিদ ভাইয়ের জুতা দিয়ে যা কিনা আমার পা থেকে দু সাইজ বড়!

একবার তো দেবুদা কে বলেই বসলাম, দাদা সবাই ক্রিসতং ঘুরে আসুক, আমরা দুজন ল্যাটাই।
দেবুদা বললো সাইংপ্রা যেও না দরকার হলে, কিন্তু ক্রিসতং তো মাস্ট যেতে হবে।

ক্যামচাং পাড়া,যেখানে শান্তির ঘুম দিয়ে পরদিনের যাত্রা শুরু করেছিলাম!
ক্যামচাং পাড়া, যেখানে শান্তির ঘুম দিয়ে পরদিনের যাত্রা শুরু করেছিলাম!

সকল কল্পনা সল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমরা রওনা দিলাম সকাল ৮ টায়।
গাইড দাদা বলেছে ২ ঘন্টা লাগে যেতে। আমরা আসা যাওয়াই ৫ ঘন্টা ধরে নিলাম।
ক্রিসতং থেকে পাড়ায় ফিরে তারপর ব্যাগ টা নিয়ে রওনা দিবো সাইংপ্রার উদ্দেশ্যে! রাতটা ওখানেই ক্যম্পিং করে থাকবো!!

এখন উদ্দেশ্য ক্রিসতং!

আপস এন্ড ডাউন হিল আছে কিছু, এ ব্যাতীত রাস্তা কঠিন মনে হলো না কারো! ৪৫-৫০ মিনিট হাঁটার পর রেইন ফরেস্টের মতো একটা জায়গাতে এসে পড়লাম।

গা ছমছম করা অনূভূতি পাচ্ছিলাম কেমন যেন, বাশঝাড়, বৃষ্টিস্নাত মাটি, পাথুরে খাড়া উঁচু জায়গা, জোঁক আর অন্ধকারচ্ছন্ন জায়গা!

ক্রিসতং যাত্রার পথে আমাদের প্রিয় জায়গা,এখানে বসে বসে সবাই আলোচনা করছিলাম এখানে বানজি জাম্পের ব্যবস্থা করা যেতো আরামসে!
ক্রিসতং যাত্রার পথে আমাদের প্রিয় জায়গা,এখানে বসে বসে সবাই আলোচনা করছিলাম এখানে বানজি জাম্পের ব্যবস্থা করা যেতো আরামসে!

সব মিলিয়ে বলা যায় সে এক দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি! আমরা কোনরকম না থেমেই হাঁটতে থাকলাম!

ক্রিসতং চূড়ায় পৌছে গাইড দাদা ও দুয়েকজন বসে পড়াতে আমরা বুঝলাম সামিট পয়েন্টে পা রেখেছি!

না, জার্নিটা যতটা বেশি কষ্টসাধ্য মনে হয়েছিলো ততটা কষ্টসাধ্য হয় নি। গাইড দাদা বললো এখনো অব্দি যেকটা টিম নিয়ে এসছি আপনারা সবচে বেচি তাড়াতাড়ি এসছেন।।

মূলত টিম বড় হলে স্লো হয়ে যায়। আমাদের দশজনের টিম স্লো না হয়ে সবাই যথাসাধ্য ফাস্ট ট্রেক করে ২ ঘন্টায় ক্রিসতং সামিট পয়েন্টে এসে পৌছেছি এটা সত্যিই আনন্দের ছিলো!

আহ্, ক্রিসতং!
আহ্, ক্রিসতং!

ক্রিসতং চূড়ায় ৩০ মিনিট মতো রেস্ট প্লাস ছবি তুলে আমরা পাড়ায় ব্যাক করার উদ্দেশ্যে পা দিলাম!

আমরা ১ টায় পাড়ায় ব্যাক করলাম।
পাড়ায় পৌছে টেন্ট ব্যাগ পানি সব গুছিয়ে হালকা বিস্কিট খেজুর খেয়ে রওনা দিলাম সাইংপ্রার উদ্দেশ্যে!

সত্যি বলতে তখন এনার্জি লেভেল কিছুটা ডাউন হয়েই ছিলো যেহেতু সকাল থেকে রেস্ট বাবদ ৪ ঘন্টা ট্রেক হয়ে গেছিলো আমাদের!

পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করারর ৩০-৩৫ মিনিটের মাথায় দেখা মিললো জুমঘরের!

ঐ দেখা যায় জুমঘর!
ঐ দেখা যায় জুমঘর!

আহা সেই এক অন্যরকম শান্তি!
আমরা সেখানে জিরিয়েয়ে নিলাম মিনিট ১৫। আর ডিসিশন নিলাম সাইংপ্রা থেকে ফিরে যদি সম্ভব হয় এখানে একটা রাত কাটাবো!

আবারো হাঁটা শুরু, আরো ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর এবার খাড়া উঁচু পাহাড় বেয়ে নামার পালা!

একে তো খাড়া, তারউপর পাথুরে ঝুরা মাটি, রাস্তা যেন প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে এক কদম এদিক ওদিক মানে বড় রকমের দুর্ঘটনা!

পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে চলে এললাম সেই পাহাড় ধ্বসের জায়গাটা। সম্ভবত পুরো ট্রেইলের সবচেয়ে কঠিনতম অংশ!
অদ্রির রিভিউ পোষ্টে পড়ছি এই জায়গাটা তারা রোপ ব্যবহার করে র‍্যাপলিং করে নেমেছিলো।

আমাদের রোপ নেই, সম্পূর্ণ রিস্ক নিয়ে পাহাড় বেয়ে নামাটাই ভরসা! একপা ব্যালেন্স হারানো মানে হলো প্রায় খাড়া ২০০ ফিট নিচে তলিয়ে যাওয়া।

খুব সতর্কতার সহিত পার হয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বসে পড়লাম ওই জায়গায়!

গাইড দূর পাহাড়ে সাইংপ্রা দেখিয়ে দিলো!
ভেবেছিলাম লক্ষ্যের অনেক কাছে!
কিন্তু রাস্তা তখনো অনেক বাকি!

আবারো পাহাড়ের গা ঘেষে নামা শুরু। মিনিট ১৫-২০ এক নামার পর দেখা পেলাম ঘন বাশ ঝাড়ের!
এভাবে অনেক্ষন বাশঝাড়ের জঙ্গল দিয়ে নামতে নামতে একপর্যায়ে সত্যিকার অর্থে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে গেছি সবাই!
এ রাস্তা যেন শেষ হয় না।

মনে হচ্ছিলো ঝিরিপথের দেখা পেলেই মনে শান্তি জাগবে। এক পর্যায়ে অপেক্ষার অবসান হয়ে ঝিরিপথে এসে নামলাম!
কিন্তু না! বিপত্তির তো সবে শুরু!
সে খবর তখনো আমাদের জানা ছিলো না…

শুনেছি ঝিরিতে বড় বড় কাঁকড়া পাওয়া যায়!
চিন্তা করলাম ডিনারটা কাঁকড়া দিয়েয়ে ই সারবো।
তাই গাইড দাদাকে বলে রাখলাম পথিমধ্যে পাওয়া কাঁকড়া ধরতে।

ঝিরিতে পৌছে কিছুক্ষন রেস্ট করে সম্ভবত ৫ টাই রওনা দিই। ঝিরপথে রওনা দেওয়ার পর প্রথম বড় বোল্ডারটার দেখা পেলাম। বোল্ডারটাতে না উঠা অব্দি বাকি ঝিরিপথের দৃশ্য দেখা যাচ্ছিলো না!

বোল্ডারে উঠার পর ঝিরিপথের যে দৃশ্য দেখলাম তাতেই আমার কলিজার পানি অর্ধেক শুকিয়ে গেছে!

মাত্র ২০ দিন আগে হেঁটে আসা পদ্মঝিরির দৃশ্যে চোখে ভেসে উঠলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ঝিরিপথ মানেই এক অন্যরকম স্বস্তি! তাই আশা করছিলাম ঝিরিপথে নামলে এবার আরামসে পৌছে যাবো গন্তব্যে!

কিন্তু এই ঝিরিপথের চেহেরা দেখে ঝিরিপথ সম্পর্কে ধারণা ই পাল্টে গেলো। এই ঝিরিপথের যে দৃশ্য দেখলাম তাতে মনে হলো সম্ভবত ঐ পাহাড় বেয়ে উঠা নামাই ভালো ছিলো! এ দূর্গম্য ঝিরিপথ আর হাঁটতে চাই না!

আলো প্রায় কমে এসেছে!
পিচ্ছিল বড় বড় বোল্ডার। চারপাশে জঙ্গল যেন চিম্বুল ঝিরিকে আরো বেশি ওয়াইল্ড আর অতিপ্রাকৃতিক রুপ এনে দিয়েছে!

বোল্ডার,বোল্ডার আর বোল্ডার!
বোল্ডার, বোল্ডার আর বোল্ডার!

পুরোটা টাইম জুড়ে শঙ্কা ছিলো যে কোন মুহূর্তে বোল্ডার থেকে পা পিছলে বড় অঘটন ঘটবে! (শেষ পর্যন্ত ঘটেছিলো ও বটে!)

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনালো।
বলা যায় আলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।
ঝিরিপথে আমরা হাঁটা শুরু করেছি প্রায় ১.৫ ঘন্টা হয়ে গেলো, কিন্তু না! এই রাস্তা শেষ হওয়ার কোনো নামম নেইই।
উল্টা সময়ে সময়ে বোল্ডারের সাইজ ও পরিমান আরো  দ্বিগুন হতে লাগলো।

এবার মনে সত্যি সত্যি অনেক ভয় চেপে আসলো। একটা ওয়াই জংশনে এসে বোল্ডারে বসে পড়লাম আমরা। না,আর কিঞ্চিত পরিমান ও দিনের আলো অবশিষ্ট নেই।গাইড দাদা বললো আরো আধাঘন্টা রাস্তা বাকি!

১০ জন টিম মেম্বার অন্ধকারে চিম্বুল ঝিরিতে ট্রেক করেছিলাম ওটা ভাবলে এখনো আমার শরীরের পশম দাড়িয়ে যায়!

মানসিক ভাবে দূর্বল হওয়া যাবে না এটাই ট্রেকিং এর প্রথম রুল। কিন্তু না,এইভাবে চলা সম্ভব না। আমরা সবাই সত্যিকার অর্থে মানসিক দৃঢ়তা হারাবো। ৪ জনের কাছে হেডলেম্প ছিলো বাকি ৬ জনের কাছে নেই।

চার হেডলেম্প দিয়ে পথ চলতে হবে দশ জনকে!
ওইটা জ্বালিয়ে আবার ট্রেক শুরু করলাম।

আমি এর আগে ও রাতে ট্রেক করেছি বেশ কয়েকবার।কিন্তু এ রাতের অনূভুতি আর রাস্তা,সেটা কোনো কিছুর সাথে তুলনা চলে না!

পিচ্ছিল বোল্ডার একে অন্যকে যতখানি সম্ভব সাপোর্ট দিয়ে চলতে লাগলাম, আমরা কজন সামনে গাইড দাদার সাথে, আরিফ ভাই মাঝখানে এবং আলী সবার শেষে এইভাবে পথ চলছিলাম, (আমাদের টিমের একজন অল্রেডি পথ চলা থামিয়ে দিয়েছিলো ক্লান্তি আর ভয়ে, তাকে পুরোপুরি সামাল দিচ্ছিলো আলী)..

এরমধ্যে ঘটে গেলো অঘটন!
এক বোল্ডার হয়ে আরেক বোল্ডার উঠার সময় ব্যালেন্স হারিয়ে আরিফ ভাই পড়ে গেলো খাড়া প্রায় ২০ ফুট নিচে।

আমরা সবাই একসাথে সজোরে চিৎকার! একবারের জন্য সবাই ভয় পেয়ে ভেবেছিলাম মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছি!
তবে সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় ছিলেন! মাথা ফাটা, শরীরে বিভিন্ন অংশে ছিড়ে যাওয়া আর গুমোট ব্যথা পেয়ে এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি।

তাড়াতাড়ি করে ২-৩ জন গিয়ে তাকে নিচ থেকে নিয়ে আসলেন, আর সাথে থাকা ফার্স্ট এইড/মেডিসিন দিয়ে যতটা সম্ভব থাকে সাময়িক ভাবে সুস্থ করে, বেশ কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবারো পথ চলা শুরু।

এইভাবে আরো কতক্ষন বড় বড় পিচ্ছিল বোল্ডারে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে ট্রেক করেছি জানিনা। একটা সময় পানির প্রবল শব্দ পেয়ে বুঝতে পারলাম সাইংপ্রার প্রথম ধাপ (ক্যাসকেডে) চলে এসেছি!

না শরীর আর মানতে চাইছে না! পারলে এখুনি টেন্ট গেড়ে এখানে শুয়ে পড়তে চাই!
কিন্তু না,সেটা সম্ভব না, সেই ওয়ে নাই।।

আমাদের আবার উঠতে হবে পাশের খাড়া পাহাড় বেয়ে!
যেতে হবে সাইংপ্রা আপার স্ট্রিমে। গাইড দাদা বললো বেশি না আরো ১৫ মিনিট!

সম্ভবত এই ১৫ মিনিট কথাটা গত ১ ঘন্টায় ১০ বার শুনেছি!
মনে মনে বললাম আপনার ১৫ মিনিটের গুষ্টিকিলাই!

এবার খাড়া উঁচু পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকলাম সবাই!
অন্ধকার গহীন বুনো জঙ্গল! কোনো ট্রেইল নেই!
জোঁকে ভরপুর! মনে হচ্ছিলো আমাদের যেন বাই ওয়ান গেট ১০ টেনশন ফ্রি এর অফার দিয়েছিলো যেটা আমরা নির্বুদ্ধিতায় কিনে নিয়েছি।

প্রায় ৩৫-৪০ মিনিট খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে আবার নিচে নামার পর সাইংপ্রা চতুর্থ র্স্টেপের দেখা পেলাম!
পৌছার সাথে সাথে বসে পড়লাম বোল্ডারে পা ভিজেয়ে…

আমরা ৪ জন আমি আরিফ ভাই, পলাশ ভাই আর আন্নি!
রাতের তারা ভরা আকাশ আর সাইংপ্রা!
যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি!

পুরো টিম এখনো এসে পৌছায়নি। আমরা অপেক্ষায় আছি। আর সম্ভবত বাকিরা ও আমার মতো করে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিচ্ছিলো মনে মনে!

হুট করে পলাশ ভাই আর আরিফ ভাই বলে উঠলো, ‘কংগ্রাচুলেশন! যদি ভুল করে না থাকি সম্ভবত বাংলাদশের প্রথম কোনো মেয়ে ট্রেকার হিসেবে তোমরা দুজন সাইংপ্রা স্পর্শ করেছো।

আহ্! এটা শুনেই সাইংপ্রা স্পর্শের আনন্দটা দ্বিগুন হয়ে গেছিলো আমার!

(অবশ্য পরে জানতে পারি আমাদের আগে আর একজন মেয়ে গেছিলেন)

আহ সা  ইংপ্রা!
এখন শুধু সকাল হলেই তোমায় স্বচক্ষে গ্রাস করার অপেক্ষা!!

বাকি টিমমেটদের নিয়ে আলী একটু পর হাজির হলো! আসার সাথে সাথেকাজে নেমে পড়লো ও!
কি খেয়ে যে এতো এনার্জি পায় ছেলেটা খোদা জানে!
সবাই যখন রেস্ট নিতে ব্যস্ত তখন সে টেন্ট বিছাতে ব্যস্ত!
ওখানে টেন্ট ফেলার মতো খুব একটা সুবিধাজনক জায়গা ছিলো না, তবুও রাতটা কাটাতে হবে!

আমরা বসে বসে রাতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম!
আমার কাছে চাঁদনী রাতের চেয়ে ও এই লক্ষ কোটি তারাদের আকাশ ই বেশি পছন্দ!

টেন্ট টাঙ্গানো হয়ে গেলে আমরা মুটামুটি সবাই চেঞ্জ করে টেন্টের ভেতর ঢুকে পড়লাম!

রাতের ক্যাম্পিং এর একমাত্র ছবি!
রাতের ক্যাম্পিং এর একমাত্র ছবি!

আলী সাথে আরো দুজন সম্ভবত রান্না করায় ব্যস্ত।
আমি টেন্টে চোখ বুজার সাথে সাথে ঘুম নেমে এলো চোখে!

একটু পর খেয়াল হলো ওরা আমাকে খেতে ডাকছে, কিন্তু না!আমি সাফসাফ বলে দিয়েছি খাবো না, আমি ঘুমাই। তোমরা খাও!

ঠিকিই না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। চোখ বুজতে বুজতে এটাই ভাবছিলাম কাল সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গবে, না জানি আমার সকাল টা কতো স্বর্গীয় হবে!

টিক-টক-টিক-টক-টিক!
এখন অপেক্ষা এক স্বর্গীয় সকালের!

ছবি ও লিখা: আফরিন সানজিদ

১ম পর্ব

নিকলী বেড়িবাঁধ

নিকলী বেড়িবাঁধ, কিশোরগঞ্জ

অনেক দিন ধরে প্ন্যান করছিলাম নিকলী যাব নিকলী যাব! সময় আঁর সুযোগ যেন হয়ে উঠছিল না! এটা শুধু যেন হবে আমাদের ট্যুর! তো জামাই বাচ্চা ফেলে রওনা দিলাম!

একা যাবার সাহস করি নাই! তাই ভবঘুরের সাথে ব্যাগ বোচকা বেধে সকাল ৬ টায় রওনা! সাথে ছিল ছোট বেলার বন্ধু আর প্রান প্রিয় কিছু মানুষ!

তো এত সকালে তো কোন দিন উঠি না! নিজের কাছে ই কেমন চোর চোর লাগছিল কারন স্পটে ই সকাল ৬ টায় থাকতে বলেছে! তখন খুব রাগ লাগছিল!এত সকাল সকাল কেন!

পরে বুঝেছিলাম নিকলী যেতে ৪ টা বেজে গিয়েছিল! বেশ দুর! দিনে গিয়ে দিনে আসা মানে সকাল ৬ আর রাত ১২:৩০!

নিকলী

যাই হোক নিকলীর সৌন্দর্যের কাছে এসব সব হাঁর মানে! শাহবাগ থেকে ৬০০ ফিট দিয়ে রওনা দিলাম পথে ই নাস্তা করে নিলাম! কারন মাঝখানে ভাল খাবারের দোকান কম পরবে!

দুপুর ৩ টায় গিয়ে পৌঁছালাম! সবাই বললে লান্চ করে নিতে কিন্তু আমার মন নিকলী নিকলী করছে! পরে ভাবলাম খেয়ে ই নেই!

নাকে মুখে খেয়ে মাইক্রো যখন নিকলীর দু পাস ঘেসে যাচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল কখন নামবো!

ঘাঁটে এসে নামলাম আগে ই নৌকা ঠিক করা ছিল ! আল্লাহর নাম নিয়ে উঠে পরলাম।

দুপুর ৪ টার রোদেও পুড়ে যাচ্ছিলাম! কিন্তু চারদিকের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম!

চারদিকে ইলিশের রং এর মত চকচকে পানি! কোথাও বেশী কোথাও কম! মানুষ জন পায়ে হেটে ই পার হচ্ছে! আমার প্ন্যান হচ্ছে পানি তে নামা যাবে না!

নিকলীতে নৌকায়
নিকলীতে নৌকায়

যা ইনজয় করবো নৌকায় বসে! কিন্তু কিছু দুরে আসার পরে দেখলাম “গরিবের রাতারগুল”! আমি জানিনা এই নাম কোথা থেকে আসল! কিন্তু সবাই একি নাম বলছিল!

আমি নামে নয়, জায়গা দেখে রীতিমত অবাক! নামবো কি নামবো না ভাবতে ভাবতে দেখি আমার এক সঙ্গী আরেক সঙ্গী কে নামাতে গিয়ে ফেলে দিয়েছে! চার দিকে হই হই শুরু হল এর মধ্য আমি ও নেমে গিয়ে পানিতে ভিজার মজা নেওয়া শুরু করলাম!

উঠতে ইচ্ছা করেছিল না! কিন্তু সন্ধা ছুঁই ছুঁই! ঊঠতে তো হবে ই! উঠে চেন্জ করে রওনা দিলাম! অসম্ভব সুন্দর একটা দিন ছিল! এখনো চোখে ভাসে!

কিশোরগঞ্জ একদিনের ভ্রমনের জন্য নিকলী বেড়িবাঁধ ঘুরে আসতে পারেন।

বর্ষার সময় এই জায়গা ভ্রমনের জন্য বেশ উপযুক্ত। যারা মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান।

এক সময়কার পাটের দেশ হিসেবে খ্যাত নিকলী উপজেলা। কিশোরগঞ্জের প্রাচীণতম উপজেলা নিকলী কে বর্ষা মৌসুমে মিনি পর্যটন কেন্দ্র বলা হয়ে থাকে।

নিকলীর নৌকা বাইচ দেশ ব্যাপী সমাদৃত। পাটের জন্য বিখ্যাত বলে বৃটিশ আমলে নিকলী দামপাড়া থেকে সূদুর লন্ডনে পাট পাঠানো হতো, এজন্য বৃটিশদের একটি সিল মোহর ছিল (N D P) মানে N = নিকলী, D= দাম, P = পাড়া।

নামকরন:

নিকলীর সাতার প্রতিযোগিতা দেশ বিদেশে ব্যাপক সুনাম রয়েছে। নিকলী নামকরণের জনশ্রুতি এমন যে, মোঘল বাহিনী খাজা ওসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে এবং তাঁকে ধাবিত করতে এই এলাকায় পৌঁছায় এবং সেখানে ছাউনি ফেলে। তাদেঁর অস্থায়ী আবাস স্থলে স্থানীয় লোকজন জড়ো হলে দলের প্রধান সিপাহীদের বলেন, “উছলে নিকালো”। এই ফারসি শব্দ উচ্চারণ বিকৃতিতে পরবর্তিতে নিকলী হয়েছে।

অন্য একটি জনশ্রুতি অনুসারে, নিখিল চন্দ্র মানে এক জনপ্রিয় জমিদার এখানে বাস করতেন। এই জমিদারের নামানুসারে নিকলী নামের উদ্ভব।

নিকলী উপজেলার ঐতিহাসিক ও মনোরম জায়গা সমুহ:

১/ বেরিবাধ ২/ প্রাচীণ গুরাই মসজিদ ৩/ মোহরকোণা পুরণো বাড়ী ৪/ প্রাচীণ চন্দ্রনাথ আখড়া ৫/ ছাতিরচর হাওর ৬/ মোহরকোনা ব্রীজ ৭/ নিকলী – হিলচিয়া সাবমার্চ রোড    ৮/ কুর্শা ব্রীজ।

নিকলীর জলাশয় ও প্রধান নদী:

সোয়াইজনী, বাউলাই, ধনু, সিঙ্গুয়া ও ঘোড়াউএা, তেগুলিয়া বিল, বড়বিল, বড়লিয়ারকন্দ বিল, নেওরা বিল উল্লেখযোগ্য।

নিকলী থানা গঠিত হয় ১৮৮১ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ২৪ মার্চ ১৯৮৩ ইং কিশোরগঞ্জ শহর থেকে ২৭ কিঃ মিঃ দূরে নিকলী উপজেলার আয়তন ২১৪.৪০ বর্গ কিলোমিটার যার উত্তরে করিমগঞ্জ উপজেলা এবং মিটামইন উপজেলা, দক্ষিণে বাজিতপুর উপজেলা; পূর্বে অষ্টগ্রাম উপজেলা ও মিটামইন উপজেলা আর পশ্চিমে কটিয়াদি উপজেলা ও করিমগঞ্জ উপজেলা।

নিকলী উপজেলার মোট ইউনিয়ন ৭ টি। ১/ নিকলী সদর, ২/ দামপাড়া ৩/ কারপাশা, ৪/ শিংপুর ৫/ জারইতলা, ৬ / গুড়ই ৭ / ছাতিরচর।

নিকলীতে মোট হাওর ১৯ টি এবং সম্মিলিত জলাভূমির আয়তন ১৪৮৪৫ হেক্টর। সবচেয়ে ছোটটি ১ হেক্টর, সবচেয়ে বড়টি ১৮৭৬ হেক্টর। এই ১৯টি হাওরের কোনটির নামই “নিকলী হাওর” নয়।

নিকলী উপজেলা কিশোরগঞ্জের প্রাচিনতম জনপদগুলোর একটি, নিকলী থানার বয়স প্রায় ২০০ হতে চলল।

নিকলীর মানুষ ভাটির মানুষ, হাওর আর নদী ঘিরেই এদের জীবন, প্রতিটা গ্রাম কোননা কোন হাওরের কান্দায়, ১৯টা হাওর ঘিরে এই জনপদ, প্রত্যেকের ঠিকানা গ্রামের পাশের হাওরের নামেই হয় সাধারণত।

১৯ টি হাওরের নামের তালিকাঃ

ভাটিবরতিয়া হাওর, বারৈয়ার হাওর, ভূষাকান্দা বিল, বড় হাওর, বুল্লার হাওর, চানপুর হাওর, গোড়াদিঘা হাওর, গুরাই হাওর, জড়ইতলা হাওর, কালিয়াইন হাওর, কাইল্যার হাওর, খুনখুনি হাওর, মধ্যনগর হাওর, মহিতুলপা হাওর, মিঠামইন উত্তর হাওর, মিঠামইন দক্ষিণ হাওর, নোয়াপারা হাওর,পশ্চিম বাইদ হাওর, পশ্চিমবান্ধ হাওর৷

তথ্য সুত্র গুগল

ছবি ও মূল লেখা : রিনি রাজিউন তিশা

পানতুমাই, বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের গল্প

‘পানতুমাই’ বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রামের গল্প:

পানতুমাই সিলেট জেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের একটি গ্রাম যা ভারত সীমান্তের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পানতুমাই গ্রামের স্থানীয় নাম “পাংথুমাই” কিন্তু সঠিক উচ্চারণ “পানতুমাই”। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম বলার যথেষ্ঠ কারন রয়েছে।

নয়নাভিরাম, অপূর্ব, অসাধারন, নান্দনিক, হৃদয়স্পর্শী, এই সবগুলো শব্দও যদি এই নামের সঙ্গে লাগানো হয় তারপরও “পানতুমাই” সৌন্দর্যের বিশ্লেষণ করা শেষ হবে না। অবশ্য বাংলাদেশেই যে এত চমৎকার, নৈর্সগিক একটি গ্রাম আছে তা অনেকেরই অজানা! দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, শহর, নগরীর সৌন্দর্যের খেতাব থাকলেও বাংলাদেশের ছোট্ট অথচ অনিন্দ্য সুন্দর এই গ্রামের কোন খেতাব নেই।

আমাদের প্রতিবেশী ভারতের মেঘালয়ের গহীন অরণ্যের কোল ঘেঁসে বাংলাদেশের বুকে নেমে এসেছে অপরূপ সুন্দর এক ঝর্ণাধারা। যার কুল কুল ধ্বনিতে মন নাচিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির পানে। ঝর্ণাটির স্থানীয় নাম ফাটাছড়ির ঝর্ণা, কেউ কেউ একে ডাকেন বড়হিল ঝর্ণা বলে।

বড়হিল ঝর্ণা, ছবি - ইমরান হোসেইন হৃদয়
বড়হিল ঝর্ণা, ছবি – ইমরান হোসেইন হৃদয়

ঝর্ণাটি প্রতিবেশী দেশ ভারতের মধ্যে পড়লেও পিয়াইন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে উপভোগ করা যায় ঝর্ণাটির অপূর্ব রূপ সুধা। পাশেই বিএসএফ ক্যাম্প, আর বরইগাছের সারি দিয়ে দুই দেশের সীমানা ভাগ করা। অবশ্য বিজিবির কোনো চৌকি নেই এখানে, তাই সীমানার কাছাকাছি যাওয়া চিন্তা না করাই মঙ্গলজনক। সীমান্তের কাছাকাছি না গিয়েও ঝর্ণাটির মোহনীয় সৌন্দর্য্য রস উপভোগ করতে পারবেন প্রাণভরে বাধাহীন।

গ্রামের শেষে, পাহাড়ি গুহা বেয়ে উচ্ছল ভঙ্গিমায় ছুটে চলছে হরিণীর মতোই লীলায়িত নাম না জানা ঝর্ণার জলরাশি। ছিটকে পড়ে মেলে ধরেছে নিজের রূপের মাধুরী।

বড়হিল ঝর্ণা, ছবি – ইমরান হোসেইন হৃদয়

তবে সাবধান, ঝর্ণার কাছাকাছি যাওয়া নিষেধ। অনেক আগে ঝর্ণার কাছে যদিও যাওয়াও যেত, ঝর্ণার পানিতে নেমে গোসলও করা যেত, কিন্তু সেই সময় বিএসএফ এর ক্যাম্প ছিল না। তবে ভ্রমন পিপাসুরা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এর অপরূপ নৈর্সগিক সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে পারবেন।

যাওয়ার উপায়ঃ

সিলেটের আম্বরখানা পয়েন্ট থেকে সিএনজি নিয়ে যাবেন গোয়াইনঘাট থানা সংলগ্ন বাজারে। ভাড়া পড়বে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সেখান থেকে আরেকটি সিএনজিতে পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের পাংথুমাই বা পানতুমাই যেতে ভাড়া লাগে মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। পানতুমাইয়ে কোনো খাবার হোটেল বা থাকার ব্যবস্থা না থাকায় শুকনা খাবার অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। রাতে থাকতে চাইলে স্থানীয়দের সহায়তা নিয়ে থাকাই উত্তম। তবে এক্ষেত্রে আপনার ২০০-৩০০ টাকা ব্যয় হতে পারে।

পরিবেশ স্বচ্ছ রাখি।

লেখা: Imran Hossain Hridoy

আরো বিস্তারিত দেখুন।

সুবলং বা শুভলং জলপ্রপাত, কাপ্তাই – রাঙ্গামাটি

শুভলং ঝর্ণা ও শুভলং টি এন্ড টি পাহাড়, কাপ্তাই লেক, রাঙামাটি

ভ্রমণ পিয়াসুদের জন্য প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি হচ্ছে রাঙামাটির শুভলং ঝর্ণা ও শুভলং টি এন্ড টি পাহাড়।

সুউচ্চ পাহাড় থেকে পড়া ঝর্ণার পানি আপনাকে বিমোহিত করবেই। ঝর্ণার হিমশীতল পানি আপনার ক্লান্তিকে নিমিষেই দূর করে দিবে।

শুভলং ঝর্ণা, ছবি : খালিদ হাসান
শুভলং ঝর্ণা, ছবি : খালিদ হাসান

শুভলং ঝর্ণার পাশেই আছে শুভলং টি এন্ড টি পাহাড়। এডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ হলে উঠে যেতে পারেন পাহাড়ে। তবে এর জন্য প্রয়োজন পাহাড় জয় করার ইচ্ছা শক্তি আর শারীরিক দক্ষতা।

অধিকাংশ মানুষই অর্ধেক যাওয়ার পর ফিরে আসে। তাই এক্ষেত্রে আপনাকে কৌশলতা অবলম্বন করতে হবে। কিছুদূর যাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে নিন তারপর আবার ট্রাকিং শুরু করুন।

ভাগ্য সহায় হলে দেখা পেয়ে যাবেন বানর আর হরিণের। উপরে একটি পুলিশ ক্যাম্প আছে। ক্যাম্পেতে বসে রেস্ট নিতে পারেন। আমি শিউর উপরে উঠার পর আপনার সমস্ত পরিশ্রম স্বার্থক হয়ে যাবে নিচের দিকে তাকালে।

মনে হবে রাঙামাটি জেলাটি কাপ্তাই লেকের পানির মধ্যে ভেসে আছে। আর ছোট ছোট দ্বীপ স্বরূপ পাহাড়কে মনে হবে কচুঁরিপানার মত পানিতে ভেসে আছে। এই পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য সারা জীবন মনে রাখার মত।

কাপ্তাই লেক ছবি - জাহিদ হাসান
কাপ্তাই লেক, ছবি – জাহিদ হাসান

শুভলং ঝর্ণা আর শুভলং টি এন্ড টি ভ্রমণ করার আরেকটি ভাল দিক হলো যাওয়ার পথের সৌন্দর্য। লেকের ছোট ছোট পাহাড়ের সৌন্দর্য আপনার মনকে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য।

দুইপাহাড়ের মাঝদিয়ে বয়ে যাওয়া লেককে দেখে আমার মনে হয়েছিল আমি বোধহয় পথ হারিয়ে থাইল্যান্ড চলে এসেছি। আবার বার বার এর সুবিশাল জলরাশি দেখে টাংগুয়ার হাওরের কথা মনে হচ্ছিল।

যেভাবে যাবেন:

ঢাকা থেকে রাঙামাটি। রাঙামাটির রিজার্ভ বাজারে নৌকা পাবেন। সারাদিনের জন্য ভাড়া করুন ১৩০০-১৫০০ টাকার মধ্যে। ১০-১৫ জন যেতে পারবেন নৌকাতে। যেতে দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। লেকের ভিতর আরো ৭-৮ টা টুরিস্ট স্পট আছে। সবগুলো ঘুরে দেখতে পারেন।

যারা সাতার জানেন না তারা অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট ইউজ করবেন। আর লেকের ভিতর ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।

লিখা: জাহিদ হাসান

বাউয়্যাছরা লেক ও হরিনমারা ট্রেইল

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও মীরসরাইয়ের বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান একটি পরিবেশবান্ধব পর্যটন স্পট। ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

প্রধান সড়ক ধরে যাবার পথে
প্রধান সড়ক ধরে যাবার পথে উদ্যান

এই বনের আয়তন ২৯৩৩.৬১ হেক্টর। বন ছাগল, বন কুকুর, মেটে কাঠমৌর, কালাপিঠ চেরালেজ, সবুজ তাউরা এই বনের গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ও পাখি। এছাড়াও এই বনে ২৫০ প্রজাতির গাছ ও ১৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।

জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানকার বনাঞ্চলে হরিণ, ভাল্লুক, খরগোশ, অজগর সাপ, বনমোরগ, বন ছাগল, শুকর ও বিলুপ্ত প্রজাতির অসংখ্য পাখি রয়েছে।

এছাড়া এখানকার সৃজিত বাগানে চাপালিশ, জাম, সেগুন, কদম, চিকরাশি, গামারিসহ বিভিন্ন প্রকার কাঠ-ঔষধি বৃক্ষ, বাঁশ ও সাইকাস উদ্ভিদ রয়েছে। শুধু তাই নয় এই বনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক প্রাকৃতিক ঝর্ণা।

এই বারৈয়্যাঢালা জাতীয় উদ্যানের মিরসসরাইয় অংশের ছোট কমলদহের ওয়াহেদপুর গ্রামে রয়েছে বাউয়্যাছরা পানি সেচ প্রকল্প ও লেক। এটা একটা কিত্রিম লেক। শুষ্ক মৌসুমে এলাকার কৃষকদের সেচের পানির যোগান দেয় এই লেক।

বাউয়াছরা লেক
বাউয়াছরা লেক এর পাশে লেখক

স্থানীয়ভাবে একে ‘বাউয়্যাছরা লেক’ বললেও পর্যটকদের জন্য এটা ‘নীলাম্বরী লেক’ নাম ধারন করে সবুজের মাঝে লীল জলরাশির সৌন্দর্য্য বিলায় ৷

বাউয়াছরা লেক লেক থেকে একটু ভিতরের দিকে গেলেই খুব সুন্দর কয়েকটা ঝর্না দেখতে পাওয়া যায়। এগুলা হল হাঁটু ভাঙ্গা, হরিনমারা ও সর্প প্রপাত

ছোট কমলদহের বিখ্যাত ড্রাইভার হোটেলের সামনে নেমে,  মহাসড়ক পার হয়ে বারৈয়্যাঢালা জাতীয় উদ্যান লেখা ফলকের লাগোয়া সরু রাস্তা ধরে ৫ মিনিটের মতো হাটলে রেল লাইন দেখতে পাওয়া যায়, তার আগে হাতের ডানপাশে একটা ঈদ্গাহ পরবে।

রেল লাইন এর ধারে
রেল লাইন এর ধারে

রেল লাইন পার হয়ে ক্ষেতের মাঝ এর রাস্তা ধরে গিয়ে বাম দিকে পাহাড়ি পথে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হেঁটে গেলেই বাউয়াছরা লেক পরবে।

রেললাইন পার হয়ে মেঠোপথ ধরে বাউয়াছরা লেকের দিকে চলা
রেললাইন পার হয়ে মেঠোপথ ধরে বাউয়াছরা লেকের দিকে চলা

লেকের বাম দিকে হাটা শুরু করলে বাউয়াছড়া ঝিরি পাবেন, (চাইলে নৌকা দিয়েও লেক পার হওয়া যায়, ভাড়া জন প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা) এ ঝিরি দিয়ে কিছুদূর হেঁটে গেলে ওয়াই (Y) জংশন পরবে। জংশনের বাম দিকে ৫/৭ মিনিটের মত সামনে এগিয়ে গেলে পাবেন হাটুভাঙ্গা ঝর্ণা।

হরিনমারা যাবার পথে
হরিনমারা যাবার পথে

হাটুভাঙ্গা থেকে আবার ওয়াই (Y) জংশনে ফিরে এসে ডানের ঝিরিতে ১০ মিনিটে মতো হাটলে আরেকটা ওয়াই (Y) জংশন দেখতে পাওয়া। এবার বামের ঝিরি ধরে ৬/৭ মিনিট হেঁটে গেলেই পৌঁছে যাবেন হরিণমারা ঝর্ণায়।

বর্ষায় হরিনমারা, ছবি - খোকা বাবু ভাই
বর্ষায় হরিনমারা, ছবি – খোকা বাবু ভাই

হরিনমারা ঝর্না দেখে এসে আবার সেই ওয়াই (Y) জংশনে ফিরে আসতে হবে, যেখান থেকে বাম দিকের ঝিরির রাস্তা ধরেছিলেন। এবার ওয়াই (Y) জংশনের ডান দিকের ঝিরি ধরে কিছু দূর গেলে সর্প প্রপাত দেখতে পাবেন।

ঝর্না দেখে ফিরে এসে বিখ্যাত ড্রাইভার হোটেলে খাবার খেতে ভুলবেন না। খাবার বেশ সস্তা আর মুখরোচক।

ভরা বর্ষায় এই ট্রেইলে না ঢুকলে হরিনমার ঝর্নায় পানি পাওয়া মুশকিল, আর বর্ষায় রাস্তা বেশ পিচ্ছিল থাকে জোঁকের আনাগোনাও বেড়ে যায়।

শুষ্ক সময়ে হরিণমারা
শুষ্ক সময়ে হরিণমারা

যদি নিজের উপড় কনফিডেন্স না থাকে তাহলে লোকাল গাইড নিয়ে নিবেন। নাহলে রাস্তা হরাবার সম্ভাবনা বেশি।

যেখানেই যান দয়াকরে প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হউন। ট্রেইলের পথে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না, বাংলাদেশকে ভালবাসুন, উপভোগ করুন এর অপার সৌন্দর্য।

বাউয়াছরা লেকে
বাউয়াছরা লেক এ লেখক

লিখা ও ছবি: রবি চন্দ্রবিন্দু

ভ্রমণ ডায়েরির পাতা থেকে, সাইংপ্রা: পর্ব – ১

সাইংপ্রা (১ম পর্ব)

কয়েক মাস আগে নাম অব্দি না জানা এই অদেখা ভয়ংকর সৌন্দর্য্যের গল্পটার শুরু করেছিলেন পলাশ ভাই!
আমার দেখা একজন অন্যতম অসাধারণ ট্রেকার!

বেশ কিছু ট্যুর একসাথে করেছি আমরা। সেই সুবাধে আমি উনার পারদর্শিতার সাক্ষী।

গল্পচ্ছলে একবার বলেছিলেন উনার স্বপ্ন সাইংপ্রার কথা! ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন একবার সাইংপ্রা যেতে গিয়ে। ফ্লাশ ফ্লাডে পরে কোনোমতে জান নিয়ে ফেরত এসেছিলেন। আর বলেছেন কতখানি বুনো আর ভয়ংকর সৌন্দর্য্যে ঘেরা এই ট্রেইল!!

তারপর সাইংপ্রা নিয়ে হালকা ঘাটাঘাটি করে আর অদ্রির পোস্ট পড়ে জানতে পারলাম সাইংপ্রার নির্মম রহস্যে ঘেরা ভয়ংকরুপী বুনো সৌন্দর্য্যের কথা! জানতে পারলাম এখনো অব্দি মাত্র ৭/৮ টা টিম (সম্ভবত) সাইংপ্রা গেছে।

তাতেই বুঝে নিয়েছিলাম এরকম একটা ভার্জিন ট্রেইল কতোখানি রুপ আর অহমিকা তার গর্ভে ধারণ করে বসে আছে!

Ayub Ali ছেলেটাকে আমার বনমানব মনে হয়!
আরও মনে হয় বিধাতা তাকে ভুলে এই লোকালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। রক ক্লাইম্বিং করে, ট্রেনিং ও নিয়েছে বেশ কিছু, স্বপ্ন তার মাউন্টেন এভারেস্ট!

শুধু স্বপ্ন দেখো বসে থাকার লোকদের দলে সে পড়ে না।
সম্ভবত পাহাড়ে ঘুরাঘুরি তার জীবনের একমাত্র ইচ্ছা আর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

শুনলাম কদিন আগে তারা তিনজন সাইংপ্রা গেছে!
শুনতেই প্রথমে কানে বাজলো সাইংপ্রা!
সেই রহস্যে ঘেরা সাইংপ্রা!

নিষিদ্ধ আর দূর্লভ্য বস্তুর প্রতিই বরাবর আকর্ষণ বেশি, আর সেই মানবধর্মের বাইরে আমি ও পড়ি না!
গায়ের জোর কতোখানি জানিনা তবে মনের জোরের তাগিদে মনটা বেঁকে বসলো সাইংপ্রা যাবো!

আলীকে বললাম চলো সাইংপ্রা যাই, ৪/৫ জন হলেই এনাফ, আলী, যে কিনা আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং ভরসার বন্ধু, সে আমাকে বলে বসলো আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো সমস্যা নেই, তবে মনে রেখো তুমি এক প্রকার জীবনের রিস্ক নিয়ে সেখানে যাবে। বুনো পাহাড়ি রাস্তায় বিভিন্নরকম বিপদের কথা বাদ দিলাম, সেখানে ভালুক আছে!

আর আমরা কিন্তু সাইংপ্রা ক্যাম্পিং করবো!

শুনতেই প্রথমে একটা মনে না জানা ভয় চেপে বসলো। কঠিন পাহাড়ি রাস্তা, বিশাল বিশাল বোল্ডারওয়ালা পিচ্ছিল দীর্ঘঝিরিপথ, নানান রকমের এক্সিডেন্টের ঝুঁকি সাথে বোনাস হিসেবে ভাল্লুক আর ফ্লাশফ্লাডের ভয় তো আছেই!

নাহ্, আর যাহোক সাইংপ্রা আমাকে দিয়ে সম্ভব না!
কিন্তু, এবার যদি সাইংপ্রা মিস করি সম্ভবত আর কখনো সুযোগ না ও হয়ে উঠতে পারে প্রকৃতির এই রুপের দেখা মিলবার।

আমার এই পাহাড়ি ভবঘুরে জীবন আমি বেছে নিয়েছি, কারণ পাহাড় আমাকে যতটা না আনন্দ দেয় তার চেয়ে বেশি মানসিক শান্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়!

মনস্থির করলাম,পাহাড় নিয়ে নিজের মনের কোণের বাড়ন্ত ভয়টুকু দপ করে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য হলে ও সাইংপ্রা যাবো। ডিসিশন ফাইনাল করে সম্ভাব্য ডেট ঠিক করলাম যাত্রার।

আমাদের সাথে যোগদান করলো Tahmid Al Masum ভাই, Debashis ভাই, Arif ভাই।
যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে এবং বাকি টিম কে সাপোর্ট করে যাওয়ার মত অদম্য মনোবল শক্তিতে ভরপুর তিনজন ব্যক্তিত্ব, এবং অবশ্যই ভ্রমণপীয়াসু ট্রেকার হিসেবে ও তাদের জায়গা উপরের দিকে!

নিলয় ভাইয়া!
যে কিনা প্ল্যানের শুরু থেকে আমাদের সাথে ছিলো, আর যে যাবে বলেই সাইংপ্রা যাওয়ার দুঃসাহস করে বসেছিলাম আমি (নিঃসন্দেহে যে কোন ছোট বোনের কাছে তার বড় ভাই যে কোন কঠিন পরিরিস্থিতে ও সর্বোচ্চ ভরসার জায়গা)।

বোনাস হিসেবে জয়েন করলো আরো তিনজন!

আমরা দশজন
আমরা দশজন

ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স (Vertical dreamers) এর মতো মাউন্টেরিং ক্লাবের দুজন এক্সপেরিয়েন্সড মেম্বার্স, একজন অদম্য সলো ট্রাভেলার, একজন প্রাণবন্ত তরুণ সাইকেলিস্ট আর জিডিএমের কজন এক্সপেরিয়েন্সড মেম্বার আর আমার মতো একজন আনাড়ি ট্রাভেলার সমেত আমাদের দশজনের একটা টিম আলীর এর সার্বিক নেতৃত্বে রেডি হলো অদেখা সৌন্দর্য্য কে ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নপথে যাত্রা দিতে!

উদ্দেশ্য রুংরাং, ক্রিসতং এবং সাইংপ্রা।

ক্রিসতং বাংলাদেদেশের সেকেন্ড মুস্ট প্রমিনেন্ট পিক। চিম্বুক রেঞ্জের সর্বোচ্চ উচ্চতার পাহাড় ক্রিসতং উচ্চতার দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য পাহাড় থেকে অনেক পিছিয়ে থাকলে ও একে আলাদা করা যায় এর অনন্য গাঠনিক বৈশিষ্ট, চারপাশে পাথুরে দেওয়াল এবং চূড়ার উপরের দৃশ্যে!

রুংরাং (ধনেশ পাখির পাহাড়) অনিন্দ্য সৌন্দর্য্যের রুংরাং ও আমাদের গন্তব্যে ছিলো!

নির্ধারিত দিনে যাত্রা শুরু, সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ আলীকদম পৌছে নাশতা সেরে বাইকে চেপে ২১ কিলো পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম দুপুর দেড়টার দিকে। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা ধরে প্রকৃতি ও জোঁকের কামড় অনুভব করতে করতে হেঁটেছি ঘন্টার পর ঘন্টা!

ঘাসের সাইজ আমার দ্বিগুণ, আর জোকের সাইজ আর সংখ্যার কথা বাদ
ঘাসের সাইজ আমার দ্বিগুণ, আর জোকের সাইজ আর সংখ্যার কথা বাদ

সাথে গাইড না থাকায় সমস্যা ও হয়েছে খানিকটা! একবার তো রাস্তা ও হারিয়েছি! তবু ও মুটামুটি ক্লান্তভাবে সন্ধ্যা ৭.৩০ নাগাদ আমরা মুরং আদিবাসীর একটা পাড়ায় পৌছাই!

সন্ধ্যায় রাস্তা হারানোর পর ভেবেছিলাম আজ বুঝি আর পাড়ার সন্ধান পাবো না, হতাশ ও ক্লান্ত ছিলাম বেশ অনেকটা!

পাড়ায় পৌছে পাড়ার পাশে একটা ছোট ঝিরিতে গোসল সেরে কিছুটা চাঙ্গা হয়ে মাচাং এ ফিরে এসে আলীর রান্না করা খিচুড়ি তে পেট পূজা সারলাম।।

সবার ঘুম দরকার!
কালকের দিনটা কঠিন হবে, ভীষণ কঠিন হবে!
কারণ কালকের গন্তব্য বুনো ক্রিসতং সামিট করা এর হিংস্র সাইংপ্রাতে পা রাখা!

পাহাড়ি গাইড দাদা বললেন উনার ই ক্রিসতং যেতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘন্টা, আর সাইংপ্রা যেতে ৩ ঘন্টা!
রাস্তা ও বেশ কঠিন।

পাহাড়ের লোক যখন বললো রাস্তা বেশ কঠিন তাতে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের যা বুঝার বুঝে নিয়েছিলাম।

ভয় আর ক্লান্তি ভর করা চোখজুড়াতে ঘুম নেমে আসতে আমার সময় লাগে নি একটু ও!
এখন শুধু অপেক্ষা কাল সকালের!…

লিখা ও ছবিঃ আফরিন সানজিদ

চলবে…

২য় পর্ব

স্বচ্ছ ধারার কমলদহ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামের একটা ছোট উপজেলা সীতাকুন্ড। পাহাড় সমুদ্রের মিলন মেলা যেন এখানেই। প্রকৃতি প্রেমীদের আত্মার খোরাক মেটাতে কি নেই এখানে।

চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে ২২°২২´ থেকে ২২°৪২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১°৩´ থেকে ৯১°৪৮´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ জুড়ে অবস্থিত সীতাকুণ্ড উপজেলার আয়তন ২৭৩.৪৭ বর্গ কিলোমিটার। এ উপজেলার উত্তরে মীরস্বরাই উপজেলা, দক্ষিণাংশে পাহাড়তলী (সিটি গেইট), পশ্চিমে সন্দ্বীপ চ্যানেল, পূর্বে হাটহাজারী উপজেলা।

সীতাকুণ্ড থানা গঠিত হয় ১৯৭৯ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে। সীতাকুন্ডের নামকরণ নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুসারীরা মনে করেন রামায়ণে বর্ণিত সীতা এখানে আগমন করেন এবং একটি কুন্ডে স্নান করেন। এই কারণে সীতাকুন্ডে নামের উৎপত্তি হয়েছে। অন্য মতে রাম স্বয়ং তার স্ত্রী সীতার নামেই সীতাকুন্ড নামকরণ করেছিলেন।

অন্য আরেক তথ্যমতে, দক্ষ রাজার মহাযজ্ঞের সময় শিব তার স্ত্রী সতীর শবদেহ খন্ড বিখন্ড করেন এবং তার নামানুসারে সীতারকুন্ড কালের বির্বতনে বিকৃত হয়ে সীতাকুন্ড ধারণ করে।

প্রকৃতি প্রেমীদের আকর্ষনের জন্য সীতাকুন্ডে যেমন সমুদ্র সৈকত রয়েছে ঠিক তেমন রয়েছে অসংখ্য ট্রেইল ও ঝর্ণা।

স্বচ্ছ ধারার কমলদহ
স্বচ্ছ ধারার কমলদহ

সীতাকুন্ডের এই অসংখ্য ট্রেইলের মধ্যে অন্যতম সুন্দর একটি ট্রেইল হল বড় কমলদহ ট্রেইল। এই ট্রেইলে ঢুকলেই দেখা মেলে অনিন্দ সুন্দরী কমলদহ ঝর্ণার। অনেকে এটাকে রুপসী ঝর্নাও বলে।

কমলদহ ট্রেইলে বেশ কিছু ঝর্ণা ও ছোট বড় ক্যাসকেইড আছে। এই ট্রেইলের উপরের দিকে ডানে বায়ে ঝিরি পথ ভাগ হয়ে গেছে। ঝিরি পথগুলো ধরে সামনে আগালেই দেখা মিলবে ছোট বড় ঝর্ণা আর মনোমুগ্ধকর ক্যাসকেডের।

অনেকেই ক্যাসকেড কি জানে না। অনেকেই আবার একে জলপ্রপাতের সাথে গুলিয়ে ফেলে। পাহাড়ে জমে থাকা পানি পাহাড় থেকে বিশালাকার হয়ে এলে তাকে জলপ্রপাত বলে আর ছোট আকারে নেমে এলে তাকে ঝর্ণা বলে৷ এই ঝর্ণা ও জলপ্রপাত এগিয়ে যাবার পথে ছোট মাঝারি নিচু পাথরের গা বেয়ে আসা পানি হচ্ছে ক্যাসকেড।

বর্ষাকালে কমলদহ ঝর্ণার সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করা যায়। ক্যাসকেড গুলোতেও পানি থাকে প্রচুর৷ বর্ষায় চারিদিকে সবুজ জঙ্গলে ঘেরা পাহাড় চিড়ে প্রায় ৫০ ফুট উপর থেকে আছড়ে পড়ে পানি এই ঝর্ণায়। ২-৩ দিন ক্রমাগত বৃষ্টি হবার পর এই ট্রেইলে গেলে কমলদহ ঝর্ণার যে অসাধারণ রূপ দেখা যায় তা অন্য সময়ে গেলে দেখা যায় না।

কমলদহের আপার স্ট্রীমে গেলেই ছাগলকান্দা, রূপসী, ছুরিকাটাসহ অসংখ্য ছোট বড় ক্যাসকেডের দেখা মিলবে।

ছাগলকান্দা
ছাগলকান্দা

প্রকৃতি রং ছড়ায় সুন্দরের। সেই সৌন্দর্য যে আমাদেরকে কতটা মোহাবিষ্ট করতে পারে তা অনুভব করতে হলে যেতে হবে প্রকৃতির কাছে। মিশে যেতে হবে প্রকৃতির সাথে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও।

প্রকৃতি নানানভাবে কাছে টানে মানুষকে। কেউ ভালোবাসে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে, কেউ ভালোবাসে সমুদ্র। কারও ভালো লাগে সবুজ প্রান্তর, আর কারও নেশা শুধু পথের পর পথ পেরিয়ে যাওয়া। যদি আপনি ভ্রমণ পাগল হয়ে থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহে কমলদহ আপনার মনে প্রশান্তি এনে দিবে।

কিভাবে যাবেন


কমলদহে যেতে হলে দেশের যে কোন প্রান্ত হতে প্রথমে সীতাকুন্ডের বড়দারোগারহাট ওভার ব্রীজের সামনে এসে নামতে হবে।

নামার পর ঢাকামুখে কিছুদূর পায়ে হেঁটে গেলেই দেখবেন হাতের ডান পাশে একটা ব্রিকফিল্ড বা ইটাখোলা রয়েছে। সেই ইটাখোলার পাশ দিয়ে একটা ইটের রাস্তা গেছে। সেই রাস্তা ধররেই পাহাড়ের দিকে কিছু সময় হাঁটলেই রেললাইন দেখতে পাবেন।

রেললাইন ক্রস করে কিছুক্ষন হাঁটলে একটা ঝিরিপথ দেখা যাবে। সেই ঝিরিপথ দিয়ে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই কমলদহ ঝর্ণায় পৌঁছে যাবেন।

প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হউন। ট্রেইল পথে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না, বাংলাদেশকে ভালোবাসুন, উপভোগ করুন এর অপার সৌন্দর্য।

কমলদহ ঝর্ণা
কমলদহ ঝর্ণা, ছবিতে লেখক

লিখা ও ছবিঃ রবি চন্দ্রবিন্দু

বগালেক

বগালেক ভূমি থেকে ২২০০/২৪০০ ফুট উচুঁতে হাজার কিংবা লক্ষ বছর আগে তৈরী হওয়া প্রাকৃতিক লেক।
ভূমি থেকে এত উঁচুতে লেক তৈরী হওয়াটা খুবই অবাক করা বিষয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, লক্ষ বছর আগে মৃত আগ্নেওগিড়ির জ্বালা মুখ থেকে এই লেকের উৎপত্তি।

বগালেক
বগালেক, ছবি – আরিফ আশিক

কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীরা লেক এর তৈরী নিয়ে বলে ভিন্ন কথা। এই লেকের পাড়ে থাকতো এক ড্রাগন । ড্রাগন এলাকার গৃহপালিত পশু প্রায়ই খেয়ে ফেলতো। তাই একদিন এক পাহাড়ী কৌশলে ছাগলের মুখে টোপ দিয়ে রেখে আসে ড্রাগনের গুহার সামনে। ছাগল খেয়ে ফেলার সময় ড্রাগন আটকে যায় টোপে। আর ড্রাগনের মাথা সহ একটি অংশ টেনে বের করে আনা হয় আর এক কোপে কেটে ফেলা হয়। কিন্তু অন্য অংশটি মূহূর্তে গর্তে হারিয়ে যায়। বলা হয় যে অন্য অংশটি বের হয়ে যায় রাইখ্যাং লেক দিয়ে (যা আমাদের ট্যুরের পরবর্তী গন্তব্য)। এ জন্য বগা লেকের সাথে রাইখ্যাং লেকের মাটির হাজার ফুট নিচ দিয়ে একটি সংযোগ পথ আছে। (এ কারণেই কথাটি বলা যে, বছরের এপ্রিল মাসে বগালেক এবং ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে রাইখ্যাং লেক এর পানি একই সাথে ঘোলাটে/ লাল হয়ে যায়। কেন লাল হয় এ সম্পর্কে কারো কোন তথ্য জানা নেই)। তো পরবর্তীতে ড্রাগন দেবতা রাতে এলাকার সকলকে স্বপ্ন দেখালো এবং পরদিন পাহাড় ধ্বসে দিয়ে পুরো এলাকা মাটির নিচে ডাবিয়ে দিলো। যেখানে পরবর্তীতে সৃষ্টি এই বগালেকের।

বগালেকের গভীরতা কতটুকু এ সম্পর্কে কারো কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। কেউ বলে ১০০০ ফুট, কেউ বলে ১৫০০-২০০০ ফুটও হতে পারে। বগালেকের গভীরে ১০০-২০০ বছরের পুরোনো মাছ আছে যারা কখনই পানির উপর আসে না। Army রা একবার বরর্শী দিয়ে এবং পরে গুলি করে একটি মাছ শিকার করে যার ওজন ছিলো ৩০-৩৫ কেজি।

ছবি ও লিখাঃ আরিক আশিক

মধুখাইয়া ট্রেইল ও ঝর্ণা, সীতাকুন্ড চট্টগ্রাম

২০১৭ সালের সেপ্টেমর মাস,কুরবানী ঈদের জাস্ট পরের দিন অপু নজরুল ভাইয়ের ফোন। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলাম! ফোনে অপু ভাই বললো – ‘আসিফ ভাই! চলেন মধুখাইয়া ট্রেইলে যাই! চটপট করে গুছিয়ে নিন।‘

ঝর্ণা এবং পাহাড়ি ট্রেইলের প্রতি আগ্রহ আমার বরাবরই বেশি। চটপট ব্যাগ, ক্যামেরা গুছিয়ে চলে গেলাম একে খান বাস স্টেশন, চট্টগ্রাম! সংখ্যায় আমরা ৭ জনের গ্রুপ। সীতাকুন্ডগামী লোকাল বাসের ছাদে চেপে পৌঁছে গেলাম বারইয়াঢালা, সীতাকুন্ড! এরপর পায়ে হেঁটে কিছুদূর এগুলোই পাবেন একটি ধর্মীয় উপাসনালয়। সেখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারেন।

বারইয়াঢালা ফরেস্ট অফিসের পথ ধরে কিছুদূর হাঁটার পরই নুনাছড়া ট্রেইল।

নুনাছড়া ট্রেইল ধরে হাঁটতে হবে ঘন্টা খানেক, প্রকৃতি এখানে শীতল, শুনশান নিরবতা। সুউচ্চ পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর ঝিরির ধার ধরে প্রায় ঘন্টা দুয়েক হাঁটলে শুনতে পাবেন ঝর্ণার শব্দ। উচ্চতায় আনুমানিক ৩০ ফুট! বেশ বড় ঝর্ণা! স্হানীয়রা অনেকে মধুখাইয়া ঝর্ণা বলে একে।

পাহাড়ি পথে চলতে চলতে হাতে পেলাম মর্টারের শেলের খন্ডাংশ, সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী ব্যবহার করেছিলো। পেয়েছি বুনো হরিণের হাড়। সীতাকুন্ডের পাহাড়গুলো এখানে বেশ উঁচু, ফটিকছড়ির গহীন অরণ্যে গিয়ে এরা মিশেছে।

ছিমছাম এই ট্রেইল এতোটা জনপ্রিয় হয়নি এখোনো। পথে যেতে যেতে দেখা হবে আদিবাসী ত্রিপুরা গোষ্ঠীর মানুষদের সাথে। এরা প্রচন্ড পরিশ্রমী, পাহাড়ি বাঁশের আঁটি মাথায় বহন করে নিয়ে আসে বাজারে। একেকটা বাঁশ বিক্রী হয় ৬-৭ টাকায়। আনুমানিক ১০০ কেজি ওজনের বাঁশের ঝাঁপি তারা মাথায় বহন করে শতাধিক ফুট উচ্চতার পাহাড় বেয়ে ফটিকছড়ি থেকে এই ট্রেইল পথে নিয়ে আসে বারইয়াঢালা বাজারে।

আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী,অত্যন্ত পরিশ্রমী
আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী,অত্যন্ত পরিশ্রমী

এই পথে পাহাড়ি বাঙ্গালীরা চোলাই মদও বহন করে। আদিবাসীরা এই মদ বহন কে অসম্মানের কাজ বলে মনে করে।

তারা পরিশ্রম করে বাঁশ বহনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মধুখাইয়া ট্রেইল পার হয়ে টেরিআইলের পথে আনুমানিক আধা ঘন্টা হাঁটার পর দেখা মিলবে পাহাড়ি ছোটো দ্বিতীয় ঝর্ণার। এই ঝর্ণাটা বেশ গুছানো সিড়ির মতো। আলোর স্বল্পতার জন্য এর আপ স্ট্রিমে ওঠা সম্ভব হয়নি, সন্ধ্যা তখন ঘনিয়ে এসেছিলো। টেরিআইলের পথ ধরে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম সীতাকুন্ডের বাজারে।

সময় নিয়ে একদিনের ট্যুর দিতে পারেন – মধুখাইয়া ট্রেইলে। পাবেন নিরিবিলি পাহাড়ি পরিবেশ, ঝর্ণা দেখার প্রশান্তি।

বর্ষাকালে মধুখাইয়া ট্রেইল ফুলে ফেঁপে ওঠে। ঝর্ণাও হয়ে ওঠে জলে টইটম্বুর ।

লেখা ও ছবি : Asif Soikot (আসিফ শুভ্র)

জলময়ূরের গল্প

জলময়ূর জলাশয়ের পাখি। দেশের বড় বড় বিল-ঝিল কিংবা হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে দেখা মিলে। এক সময়ে হাওরাঞ্চলে প্রচুর জলময়ূর দেখা যেত।

হালে সেই রকম নজরে পড়ে না। শিকারিদের দৌরাত্ম্যে প্রজাতির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। প্রজাতির বৈশ্বিক বিস্তৃতি বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ চীন পর্যন্ত।

পাখিটির ইংরেজি নাম : ‘ফেজান্ট টেইল্ড জাকানা, (Pheasant-tailed jacana) বৈজ্ঞানিক নাম: Hydrophasianus Chirurgus। প্রজাতির গড় দৈর্ঘ্য লেজসহ ৪০-৫৮ সেন্টিমিটার (লেজ ২৫ সেন্টিমিটার)। এর মাথা-গলা সাদা। ঘাড় রেশমি সোনালী হলুদ।

পিঠ চকলেট পাটকিলে। ডানার পাশ ধবধবে সাদা। দেহের তুলনায় লেজ বেশ লম্বা। কাস্তের মতো বাঁকানো। পেটের নিচ কালচে। শীতে রঙ বদলায়। চকলেট পাটকিলে তখন ফিঁকে পাটকিলে বর্ণ ধারণ করে; বুকের ওপরে ‘ভি’ আকৃতির কালো নেকলেসের মত দেখায়।

আরো কিছু পরিবর্তন শীতে নজরে পড়ে। যেমন: প্রজনন ঋতুতে লেজ থাকে লম্বা কিন্তু অন্য সময়ে লেজ তুলনামূলক খাটো দেখায়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি দেখতে একই রকম। পার্থক্য শুধু আকারে। স্ত্রী পাখি পুরুষের তুলনায় খানিকটা বড়।

জলময়ূরের যৌনজীবন অন্য পাখিদের চেয়ে একটু আলাদা। বলা যায়, তেমন সুখকর নয়। প্রজনন ঋতুতে জলময়ূরী হন্যে হয়ে পুরুষ পাখিকে খুঁজতে থাকে।

এ সময় অন্য জলময়ূরীর সঙ্গে যে কোনো জলময়ূর কে ঘোরাফেরা করতে দেখলে ওদের হিংসা হয়। দুই ময়ূরীর মাঝে প্রচণ্ড ঝগড়া বাঁধে। দূর থেকে তা দাঁড়িয়ে দেখে জলময়ূর। পরিশেষে জিতে যাওয়া জলময়ূরীর সঙ্গে পুরুষ পাখির মিলন ঘটে।

ঘর বাঁধার সপ্তাহখানেক পরে জলে ভাসা লতাগুল্মের ওপর বাসা বানিয়ে জলময়ূরী ডিম পেড়ে পালিয়ে যায়। ওই এলাকা ত্যাগ করে পুনরায় অন্য পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধে (অর্থাত্ জলময়ূরীদের মাঝে বহুগামিতা লক্ষ্য করা যায়)।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট

error: Content is protected !!