Home Blog Page 3

দামতুয়া ফলস, প্রকৃতির এক বিস্ময়

মাত্র একটি দিন পৃথিবী থেকে ছুটি নিতে চেয়েছিল। ওরা ১১ জন। পৃথিবীর বাইরে কোন স্বর্গ রাজ্যে।

এটা চেম্বার, ডিউটি এবং কাজ ছাড়া নিজেদের ভাবতে না পারা ভীষণ সৌখিন ছাপোষা চিকিৎসকের স্বর্গযাত্রার(!) কাহিনী!

আমার শত জনমের ভাগ্য এই ১১ জনের একজন আমি।

হাতে যদি একটু সময় থাকে পড়ে আসতে পারেন পাগলামিতে ভরা আমাদের একটি দিনের গল্প।

ভোর চারটায় ভূমিকম্প দিয়ে বান্দরবানের আলীকদম থেকে যাত্রার শুভ সূচনা। ঘুম ঘুম ভোরে সবার প্রথম গন্তব্য ‘১৭ কিলোমিটার’।

মখমলের মতো সবুজ পাহাড়ের বুকের উপর সাপের মত প্যাঁচানো আঁকাবাঁকা পথ। তার উপর দিয়ে চাঁদের গাড়ি যখন আমাদের সবার চোখের ঘুম উড়িয়ে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলছে, তখনও মেঘের ঘুম ভাঙেনি। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে পরম নির্ভরতায় আকাশ ঘুমিয়ে আছে। সম্ভবত ভোর বেলায় ভূমিকম্পে সে কিছুটা বিরক্ত! ঘুমিয়ে ছিল ভালই ছিল। হঠাৎ জেগে উঠলো। ঘুমিয়ে থাকার জন্য বোধহয় কোন কাজ পিছিয়ে গেছে। সে কাজের চাপ সইতে না পেরে কান্নাকাটি শুরু।

পাহাড়ী পথ

আর ১ ঘন্টা পিছিয়ে পড়লাম! আমার মেডিকেলের সিনিয়র ভাই এবং সিনিয়র বিসিএস পঙ্কজ ভাই । তিনি আবহাওয়াবিদ এর ভূমিকায় চলে গেলেন এই অবস্থায় ট্রাকিং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ সেটি জাতিকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আসলেই স্যাঁতসেঁতে এবং পিছলা হয়ে যাবে খাড়া পাহাড় আমাদের প্রথম ট্রেকিং ইত্যাদি ইত্যাদি!

কিন্তু কোন লাভ হলো না। আমাদের সবার শরীরে পাগলামির যে অ্যান্টিজেন ঢুকে গেছে তার কোন অ্যান্টিবডি নেই।

বৃষ্টি শেষ হলে ট্রেকিং শুরু হল। যাত্রীদের বেশিরভাগই জীবনে এটি প্রথম ট্রেকিং। যেখানে যাওয়া হচ্ছে সেই বিষয়েও কোন খুব একটা আইডিয়া ছিল না। হাতুড়ে ডাক্তার যেমন না জেনে অবলীলায় ফোঁড়া অপারেশন করতে পারেন, তেমনি আজকের এই দল ‘হাতুড়ে ট্রেকার’।



স্বভাবতই যে সময় পৌঁছানোর তার থেকে একটু সময় বেশিই লাগলো। পৌঁছানো থেকে নিরাপদে পৌঁছনো ছিল এই হাতুড়ে ট্রেকার দের মূল লক্ষ্য।

ট্রেকিংয়ে অবলীলায় হেঁটে গেছে ডা সুদীপ্ত,ডা নীপা,ডা মুকিত। নিপা মোটামুটি দেশের সব জায়গাতেই গেছে। সম্ভবত এইমাত্র যদি নতুন কোন ঝর্ণা আবিষ্কার হয় সে ওখানেও যাবে। এটাও হতে পারে যে নিপাই কোন জায়গা আবিষ্কার করেছে। ‘তাহার বন্ধু’ সুদীপ্ত যাকে আমার খুব ঠান্ডা বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু সে খুলনার চুইঝাল। এর আগে সে মৌলভীবাজারের হামহাম গেছে। তার ভাষ্যমতে এই ট্রেকিং ওটার কাছে কিছুই না। মুকিত ভাই গেছে জাদিপাই ।

আমাদের মধ্যে সবথেকে সিনিয়র কিন্তু শিশু প্রসেনজিৎ ভাই ( শিশু ডাক্তার) যতক্ষণ পেরেছেন প্রত্যেককে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। বরগুনার mocs মেহেদী যতক্ষণ পেরেছে গানে গানে ভরিয়ে রেখেছে। যার কথা না বললেই নয় আমাদের উখিয়ার রাজকুমার লিডার অফ দা ডে ইমরান ভাই।
যখনই অভিযাত্রী দল ঝিমিয়ে বা পিছিয়ে পড়েছে তখনই তিনি গর্জে উঠেছেন তার অমর বাণী নিয়ে

Guys ! Hold your Heart…
সমগ্র যাত্রায় এই দৈব বাণী টনিকের মত কাজ করেছে!

আমি আর আলামিন ভাই বৃষ্টি জড়ানো কাদা পথে কয়েকবার ডিগবাজি খেয়েছি। আসলে আমরা কিন্তু ইচ্ছা করেই খাচ্ছিলাম। আমরা ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছিলাম আর কি!!

সম্ভবত প্রথম দিকে তিনটি পাহাড় অতঃপর কিছুটা সমতল জায়গা। তারপর একটি বেশ ভাল রকমের খাড়া পাহাড় পার হতে হয়েছিল আমাদের।এক একটা পাহাড় সম্পূর্ণটা সবুজ দিয়ে মোড়ানো তাতে দূর থেকে ছোট ছোট আদিবাসীদের ঘর।

যেন বাইরের কেউ বেশি বিরক্ত না করে তাই মেঘ তার মেঘমালা দিয়ে পাহাড়কে পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে।
বহিরাগতের অনুপ্রবেশ নিষেধ!

মনে হয় থেকে যাই এখানে সারা জীবনের জন্য…

যত গভীর মনে প্রবেশ করেছি ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঝিরির পরিমাণ। রীতিমতো সুগন্ধ সুরঙ্গ ভাব। দুপুর বারোটাতেও এতটুকু আলো কোনভাবে পৌঁছায়নি সেখানে। আমাজান জঙ্গলের মত। উপরে খাড়া পাহাড় নিচে ঝিরি।

যে পথগুলো ঝিরির মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেগুলো একই সাথে খুব আরামের ও বিপদ সংকুল। কারণ ঠান্ডা পানি যখনই পায়ে লাগে তখনই ভালো লাগে ।

হাঁটার পথে কষ্টটা ঠান্ডা পানিতে কিছুটা প্রশমিত হয়। আর বিপদ সংকুল হলো কতটা নিচে পা দিতে হবে এটা বোঝা যায় না। এক একটা পাথরের উচ্চতা এক এক রকম। লাঠি দিয়ে পথ মেপে মেপে যেতে হয়।

দামতোয়া মূল ঝরণার আগে ব্যাং ঝর্ণা বলে একটি ঝর্ণা আছে এখানে আসার পরে আমি একটু প্রাণ ফিরে পাই। এর পরের লাফাতে লাফাতে সবার প্রথমে ঝরণায় পৌঁছালাম।

সম্ভবত আমি আমার জীবনে এর বেশি জোরে হর্ষধ্বনি করিনি। বিষ্ময়ে বিমুর হতবাক হয়ে গেলাম একসাথে দুই তিনটা ঝরনা দেখে। বৃষ্টি হওয়ার দরুন পানির উচ্চতা যেমন বেড়েছে তেমনি পানির রঙেও এসেছে গাঢ়ত্ব।

সমস্ত কষ্ট ভুলে গেলাম! ভুলে গেলাম আবারও হয়তো তিন ঘন্টা যাত্রা করে ফিরে যেতে হবে! ভুলে গেলাম সময় মতো আজকেই বিয়াম এ ১০টার মধ্যে পৌঁছাতে হবে। আগামী কাল সকাল ৫টায় পিটি সেশন! ভুলে যেতে চাইলাম জীবনের সমস্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা! শুধু মনে হলো, আমাদের ১১ জনের জীবনের হয়তো একসাথে এই সময়টা আর আসবেনা।

বৃষ্টি পরবর্তী খরস্রোতা শীতল জলে ভাসিয়ে দিলাম মন পাবনের নাও। পৃথিবীর কোন শব্দ প্রযোজ্য নয় এই মুহূর্তের বর্ণনা দেবার জন্য। বিশাল জলের প্রবল স্রোতের সামনে আবারও মনে পড়ে গেল আমিত্ব কত ক্ষুদ্র একটি শব্দ।

কতক্ষণ ছিলাম এভাবে জলে ডুবে ডুবে মনে নেই। কিভাবে মনে থাকবে? সময় তো আমি আজ অনেক আগেই থামিয়ে দিয়েছি। হাতের স্মার্ট ওয়াচ বলছিল pulse কোনভাবেই ১২০ এর নিচে নয়। কিন্তু মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে অনুরণিত হচ্ছিল Its ok…

ফেরার পথে উঠতে গিয়ে ভয়ংকর muscle cramp .. প্রথমে বসে পরলেন গোপালগঞ্জের mocs সাকিব ভাই, ইমরান ভাইয়ের কিঞ্চিত স্পা তাকে দ্রুত সুস্থ করে দিলেও পরপর উইকেট পড়তে লাগলো প্রসেনজিৎ ভাই আলামিন ভাই এবং আমার। আসলে ঝর্ণায় প্রচুর আনন্দ করার পর শরীর ছেড়ে দিয়েছিল।

এদিকে আবার কেউ কাউকে না নিয়ে আগাবে না। প্রচন্ড একটা টিমওয়ার্ক কাজ করছিল আমাদের সকলের ভিতরে। জীবনে এত স্যালাইন ডায়রিয়া হলেও খাইনি। একটু সুস্থ লাগছিল। পথে পেয়েছিলাম লোকোজ বাতাবি লেবু। ৫ মিনিট অপেক্ষা করার পর আবার রওনা দিলাম।

আমাদের guide MD Nurul Islam Raju কথা না বললেই নয়। যেভাবে ও সাপোর্ট দিয়েছে পুরোটা সময়। সুন্দরবনে আমি ওর গাইড হব এই প্রমিস করে এসেছি। প্যারাসিলিং করে আমার হার্টের ব্লক ছুটে গেছিল বলে মনে হয়েছিল, ট্রাকিং করে পেরিফেরাল হার্ট অর্থাৎ পায়ের muscle এ কোন ব্লক থাকলে আজ ছুটে গেছে বলে মনে করছি।

দুর্গম এলাকায় রাখাইনদের জীবনযাত্রা, ক্ষেতে কাজ করা নারীদের কানে বিশেষ ধরনের কানের দুল, নাচান ঘরের ছোট্ট জানালায় কৌতুহলী শিশুর মুখ দেখতে দেখতে এক সময় দেখলাম চোখে আরো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

ঘোর সন্ধ্যা নেমে আসছে। হৃদয়ের গহীন থেকে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে শুরু করলাম কারণ এই পরিবেশের সাথে আমার জীবনে প্রথম পরিচয়। টান টান উত্তেজনায় হাঁটতে শুরু করলাম। পারতেই হবে যেকোনোভাবে। একদম শেষে দূরে দোকানের আলো দেখা গেল। ইমরান ভাইয়ের ভাষায় এটি লাইট অফ Hope !!

শুনলে হাস্যকর লাগতে পারে কেন যেন নিজেকে লাল আমস্ট্রন মনে হচ্ছিল!!!

বিভূতিভুষণের ‘জলে ডাঙায়’ উপন্যাসের সনদ চরিত্র মনে পরল। আমার মতো একজন ছাপোষা মানুষ যে এতোটুকু সময় পেলে ঘুমাতে ভালোবাসে সে জীবনের কোন একদিন এমন দুর্গম পর্বত বনে জঙ্গলে ঝরণা দেখার সুযোগ পাবে কে জানতো?

অনেকেই হয়তো বলবেন এতো কষ্ট করে অতো দূরে ঝরণা দেখার কি দরকার?? প্রকৃতি তার সবচেয়ে অসামান্য নৈস্বর্গিক সম্পদকে লোকচক্ষুর অন্তরালে আগলে রাখতে পছন্দ করে। প্রকৃতি কেবল যোগ্যতমদেরকেই তার এই সৌন্দয্য অবগাহন করার সুযোগ দেয় ।

The finest beauty for fittest !!

প্রায় ৭ঘন্টা (যেতে ৩ ,আসতে ৪) হাঁটার পর এমন লাইন মনে হলো! যদি সত্যি এ দুর্লভ দৃশ্য দেখতে চান তবে যাবেন না হলে বাসায় Discovery তেও অনেক দারুন দৃশ্য দেখা যায়। জীবনের কোন না কোন সময় কঠিন এর স্বাদ নিয়েও দেখা উচিত। সারা জীবন গল্প করার মত কিছু কঠিন আত্মস্থ করে রাখা উচিত।

কিছু টিপস

বন্ধুর পথে চলার জন্য বন্ধু খুব কম। অসুস্থ হলে তাকে সেখান থেকে ফেরত আনা প্রায় অপারগতার কাছাকাছি। তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শারীরিক শক্তির কাছে হার মানলেও মনের বল যেন অটুট থাকে।

দিনে দিনে ট্র্যাকিং করার চেয়ে ট্র্যাকিং করে এক রাত থেকে পরের দিন ঝরনা দেখে আবার ট্রাকিং করলে কষ্ট কম হবে। ওখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

জোঁক এখানে Normal inhabitants .. বলতে গেলে তাদের ওখানে আপনি বেড়াতে যাচ্ছেন। তারা যেন আপনাকে বেশি একটা জামাই আদর না করে তার জন্য মোজা পরে যান।

পাহাড়ের কাছে গেলে নিজে উদার হবেন । বন্ধু বাৎসল হবেন। টিম ওয়ার্কিং এর মর্মার্থ বুঝতে পারবেন।

পর্যাপ্ত শুকনো খাবার এবং পানি স্যালাইন মাস্ট মাস্ট মাস্ট।

আমরা ১১জন‌। দেশের নানা প্রান্তের । খুলনা, বরগুনা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, নারায়ণগঞ্জ। জোঁকের কামড় খাইয়া, Severe muscle cramp এর শিকার হইয়া, কাদা জলে আছাড় খাইয়া ১৭ কিলোমিটার থেকে চাঁদ দেখতে দেখতে চাঁদের গাড়িতে ফিরিয়া আসলাম!!

যা ছেড়ে আসতে পারলাম না তাহল শ্বেতশুভ্র ঝর্ণা, সবুজ পাহাড়, হলুদ প্রজাপতির স্মৃতি। এত বড় পাহাড়টা, এই ছোট্ট মনে ঢুকিয়ে না তো সম্ভব নয়। ঝর্ণার পানি এনেছিলাম স্রোত আনতে পারিনি। যে লাঠিটি ধরে পুরোটা সময় হেঁটেছি, সেই বাঁশের লাঠিটি চাঁদের গাড়ি পর্যন্ত সাথে ছিল তারপর আর মনে নেই।

যেটা বুঝলাম সৌখিন মানুষগুলোর প্রত্যেকের মধ্যে এক অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় বদ্ধ উন্মাদ বাস করে। আমরা মনের অজান্তেই আমরা এটা দমিয়ে রাখি। মাত্র একটা দিন আমরা ছুটি চেয়েছিলাম। আমরা ১১জন।

এটা সারা জীবনের জন্য শুধুমাত্র ছুটির দিন না হয়ে মে অসাধারণ এক স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে বুঝিনি। শারীরিক কষ্টটা হয়তো কয়দিনের মধ্যেই চলে যাবে কিন্তু দুচোখ ভরে যে সৌন্দর্য অবগাহন করে গেছি হয়তো কোনদিন তার ভোলা হবে না।

ভালো থেকো দামতুয়া ঝরনা !
ভালো থেকো বান্দরবান!
আবার দেখা হবে!! হবেই!!!
thanks Mumeet Sami again ..

লিখেছেনঃ Sadia Monowara

অনুভূতির বিবর্তন

স্বর্গচুত্য প্রথম মানব দম্পতির ভূপৃষ্ঠে অবতরনের সেই উষালগ্নে সৃষ্টি সুখের উচ্ছ্বাসে ভাসতে পারেনি মানব জাতি। এখনকার চাকচিক্যময় মানব সভ্যতা তখন ছিল এক বুনো সম্প্রদায়ের প্রতিচ্ছবি অস্তিত্ব বিপন্ন প্রায়। ছিল না ভাষা, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা কৌশলগত কোন জ্ঞান। পেরিয়ে গেছে শত সহস্র বছর। মানুষ গুহা থেকে পৌঁছে গেছে কম্পিউটারে, সাগরবক্ষে নির্মান করেছে আলোকময় দ্বীপমালা, মরুভূমিতে মরুদ্যান। বার্তাবাহক কবুতর জন্ম দিয়েছে পকেটবন্ধি স্মার্টফোন। ফেইসবুক, ভাইবার এর যুগে ইন্টারনেট এখন মৌলিক অধিকার।

বিবর্তনের গল্প বলছিলাম, সহজ করে বললে আমাদের টিকে থাকা, বেড়ে উঠা, এগিয়ে যাওয়ার গল্পে শুধুমাত্র দৃশ্যত বাইরের পরিবর্তনের গল্প এটি। শুধুমাত্র বললাম কারণ শুধু দৃশ্যত এসব কাঠামোই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, টিকেও থাকবে না। আপনার চিন্তা, চেতনা, দৃষ্টি, স্পর্শ, এমনকি নিঃশ্বাসের সাথে মিশে আছে অদৃশ্য আমিত্ব। আপনি তাকে ব্যক্তিত্ব, বিবেক, মমতা, ভালোবাসা, এমনকি প্রেমও ভাবতে পারেন। আমি নাম দিলাম অনুভূতি। সময়ের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিটি ধাপে সেই অনুভূতি পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন বুনো সম্প্রদায় থেকে আজকের আধুনিক মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা, শুদ্ধতার পার্থক্য দেখলেই অনুভূতির বিবর্তন বুঝা যায়।

ধর্ম আর অনুভূতি দুটো অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি বিশ্বাস করি ধর্মগ্রন্থতে কতগুলো শব্দ থাকে মাত্র। মন্দিরে থাকে ইট পাথরের দেয়াল আর সাজানো মুর্তি। নিরাকার ঈশ্বর মানুষের মনের চেয়ে মস্তিষ্কে থাকে বেশি। শৈশব, যৌবন, বার্ধক্যজীবনের প্রতিটি ধাপে আপনার মস্তিষ্ক, মনন কতটা স্নিগ্ধ , উর্বর হল সেটায় ধর্ম। ঈশ্বর মানুষের কর্মের বিচারে কর্মফল দেন (কর্মযোগ) মনের সারল্য, সততা, ভক্তিতে মুগ্ধ হয়

( ভক্তিযোগ) আপনার বিশ্লেষণ ধর্মী শুদ্ধ, সুস্থ, সুন্দর জ্ঞানে ( জ্ঞানযোগ) ঈশ্বর তার সৌন্দর্য্য দেখায়। ধর্মের আদিকথা তথা ঈশ্বর কিংবা মোক্ষ লাভের এই তিন পথের কথা শাস্ত্রেই বলা আছে।

আপনি বুঝেন কিংবা না বুঝেন, ঈশ্বর আপনাকে কর্ম, ভক্তি, আর জ্ঞান দিয়েই পরিমাপ করছে প্রতিনিয়ত। আপনার মানসিক সৌন্দর্য্যও তথা অনুভূতিগুলোও প্রভাবিত হয় এই তিনটি জিনিস ধারা ; এটায় ধর্ম।

ঈশ্বরের কাছে আপনি এতটায় ক্ষুদ্র যে আপনার জন্মপরিচয় (জাত), বংশপরিচয় ( সামাজিক অবস্থান) , কর্মপরিচয় এখানে মূল্যহীন। আপনি যদি জাত বিশ্বাস করেন, মানেন তবে আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে ঈশ্বরেরও জাত আছে। ছোট জাতের ঈশ্বর, বড় জাতের ঈশ্বর। খোলাসা করে বলছি, ধর্ম বলে ঈশ্বর আত্মারূপে সকল জীবের মধ্যে সমভাবে বিরাজমান। ধর্মগ্রন্থগুলোর কোথাও পাবেন না বড় জাতের মানুষদের মাঝে বড় মাপের ঈশ্বর বিরাজমান। কর্মের ব্যাপ্তি, ধরণ অনুযায়ী ধর্মেই জাতের কথা বলেছে। কোথাও বড়, ছোট বলা হয়নি। আপনি বুঝে কিংবা না বুঝে নিজেকে বড় জাতের প্রাণী ভেবে আত্ম অহংকারে ভুগতে পারেন। এতে ধর্ম কিংবা ঈশ্বরের কিছু আসে যায় না। হিন্দু ধর্ম এতটা হীন কিংবা ঠুনকো নয় যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করবে। সংকীণতা, আত্মগরিমা এসব আপনি সমাজ থেকেই শিখেছেন। শুরুতে সভ্যতার বিবর্তনের গল্পটা শুধুমাত্র এই জন্যই লেখা। মানব সভ্যতার বিকাশের প্রতিটি ধাপে সমাজ এমন অনেক কুসংস্কারের জন্ম দিয়েছে। আবার সেই সমাজেই সময়ের পরিবর্তনে নিজেকে শুধরে নিয়েছে। যেভাবে দাস প্রথা, সতীদাহ প্রথা বিলুপ্তি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে নিজেকেই হিন্দু ভাবতে লজ্জা হয় আমার ২০১৭ তে বাস কতগুলো মানুষ নিজেদের ধর্মের মধ্যেই ছোট বড় বিভাজন তৈরি করে ফেলেছে। যেটার ধর্মীয় কোন ভিত্তি নেই। আমি নিশ্চিত অল্পকিছু দিনের মধ্যে দাসপ্রথা, সতীদাহ প্রথার মত এই জাতপ্রথাও হাস্যকর কৌতুকে পরিনত হবে। সে আপনার ভালো লাগুক আর না লাগুক। সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের তাতে কিছুই আসে যায় না। এটায় অনুভুতির বিবর্তন। স্থান, কাল, পারিপ্বার্শিক অবস্থান আপনার মন, চিন্তা চেতনা, তথা ধর্মকে নিয়ন্ত্রন করে। প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। জাতপ্রথা উদাহরণ মাত্র।

আবারো বলছি ঈশ্বর আপনাকে কর্ম, ভক্তি, আর জ্ঞান দিয়েই পরিমাপ করছে প্রতিনিয়ত। আপনার মানসিক সৌন্দর্য্যও তথা অনুভূতিগুলোও প্রভাবিত হয় এই তিনটি জিনিস ধারা ; এটায় ধর্ম।

সবাইকে পুজোর অনেক অনেক শুভেচ্ছা। ভালো কাটুক সবার পুজো।

ক্রিসতাং, আলীকদম, বান্দরবান

পাহাড়ের চুড়ার ছবিই, কিন্তু এই চুড়াই শেষ চূড়া নয়। এতো সবে শুরু।

‘চান্দের গাড়ি’ থেকে ’২১ কিলোমিটার’- এ নেমে মাত্র মিনিট কুড়ি হাঁটার পর। এমন আরো কতো চূড়া পড়বে সামনে। উঠতে হবে আবার নামতে হবে। চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছার চিন্তা আসে না মাথায়।

মাথায় থাকে শুধু , চোখের সামনে যেটা, সেটাতেতো পৌঁছাই আগে। কয়টা উঠলেন আর নামলেন কয়টায়, তা গুণে রাখার সেন্সইতো থাকে না শেষতক!

ভ্রমণ সংগীরা
ভ্রমণ সংগীরা

তার পরও থমকে দাঁড়াতে হয় প্রতিটি চুড়ায়। কয়েক ফুট মাত্র দূর থেকেই নেমে যাওয়া ঘন সবুজের ঢাল। সামনে ভাঁজে ভাঁজে একের পর এক পাহাড়, ফাঁকে ফাঁকে ভেসে চলা মেঘের ভেলা। নয়তো দূর কোন গহীনে একাকী জুম ঘর। এতো দূর থেকেও নড়াচড়ার আভাষ পাওয়া যায় ক্যামেরা জুম করলে!

পাহাড়ের চুড়ার ছবিই, কিন্তু এই চুড়াই শেষ চূড়া নয়। এতো সবে শুরু।

ক্লান্তি অবসাদে একসময় নিঃশেষ হয়ে পড়ে সব শক্তি। তখন শুধু একটাই জানার, আর কতো? আর কয়টায় উঠতে হবে এমন? লিডার যথারীতি আশ্বস্ত করবে, এইতো শেষ।

আর মাত্র দুইটা সামনে। এই ‘দুইটা’ আর শেষ হয় না। অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে মাথায়। কিসের ছাতি আর কিসের গুমোট ভাপের সেসব ‘রেইন কোট’! এই ভিজতে পারাটাই মনে হয় শান্তির।

এর মাঝেই আহবান শুরু হবে গলা ছেড়ে, ‘আল্লাহ, তুমি রহম করো’। এমন চড়াই উৎরাই চলবে দীর্ঘ একটানা নয় ঘন্টা।
‘একটানা’ কেন? আপনি বিশ্রাম নেবেন কোথা? একটু দাঁড়ানোরও জায়গা নেই। অন্তরে সবার তখন শুধু ‘ইয়া নফসি’ ‘ইয়া নফসি’ ।

কখন মিলবে একটু বসে জিরোবার আশ্রয়! দূর থেকে শুধু গাছপালা জঙ্গলা দেখলে কি হবে হাঁটার পথে শুধু ছন জাতীয় বন। পাতায় পাতায় যার এঁকে বেঁকে নৃত্য করছে বৃষ্টিতে প্রাণ পাওয়া সব ‘চিনে’ জোঁক।

এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য
এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য

এই সফরে সবচাইতে যার উৎসাহ ডা: আসিফ , তিনিও সখ করে পিঠে করে বোঝা বয়ে নিয়ে গেছেন বহু মূল্যের অতি সখের ড্রোন, DSLR ক্যামেরা, মোবাইল।

পানিতে চুবিয়ে সবগুলোর বারোটা বাজিয়ে ফিরে এসে স্ট্যাটাস দেন, “ In between life and death ! ঝুপ বর্ষায় ভুলেও কেহ ক্রিসতং ট্রেইল দিয়া খ্যামচং / মেনিয়াং পাড়ায় যাইয়েন না । আর গেলেও বাবা মা থিকা অগ্রীম বিদায় নিয়া নিয়েন ।”

সেই তিনি আবার সব ভুলে এই ট্যুরের সূত্রে দুদিন পরেই স্ট্যাটাস দেন,

“আত্মারে পুষ্টি দেন , নিজে চাঙ্গা থাকেন। ব্যাগ আর চশমা লয়া শুধু চেম্বারে দৌঁড়ায়েন না।”

সখের সব ইন্সট্রুমেন্ট জলাঞ্জলি দিয়েও শুকুর গুজরান তিনি, অক্ষত ফিরতে পেরেছেন জান নিয়ে। পেরেশানি সব ভুলে বন্ধুদের আহবান জানান, “জীবন একটাই, দ্বিতীয় সুযোগ দেয়া হবেনা।

কাজেই সৌন্দর্য্য আহরণ আর আত্মার পুষ্টি নেবার সুযোগ হাতছাড়া করা বোকামী ……..”

ট্রেইল ডিটেইলস

ঢাকা- চকরিয়া- আলীকদম- ২১ কিলো-খেমচং পাড়া
খেমচং পাড়া- মেনিয়াং পাড়া
মেনিয়াং পাড়া- শামুক ঝিড়ি ট্রেইল- মেনকিউ পাড়া- দুসরী বাজার-আমতলী ঘাট- আলীকদম- চকরিয়া – ঢাকা ।

লেখা – Tapan Roy
ছবি – Tapan Roy, Asif soikot

মন্দির বাড়ি

“দুর্জ্জয় সমন ভয় ত্বরিবার তরে
অভয়া দুর্গা নাম রাখিলাম দ্বারে
১২৭৮ সন ”

এখনো থেকে যাওয়া অক্ষত ঘর বাড়ির মাঝে দুটি দালান আছে বসতির জন্য, একটি বড় মন্দির। আর বিচ্ছিন্ন একটু দূরে ছোট মন্দির একটা।

বসতির জন্য করা বড় দুইটি দালানের একটির দরজার উপরে স্থায়ী ভাবে খচিত উপরের কথা কটি।

ধরে নেয়া যায় সেই বৎসর ( ১২৭৮ বাংলা) অথবা তারো আগে থেকে এই বাড়িতে চলে আসছে দুর্গা পূজা। মাঝে গ্যাপ গিয়েছে এক বৎসর, ১৯৭১ সালে।

দেশ ছেড়ে না পালালে মা দুগ্গারও সাধ্য হতো না রক্ষা করা।
মহিষাসুরের চাইতেও হাজারগুণে নৃশংস ছিলো দেশীয় রাজাকার আর পাঞ্জাবী সেনারা।

‘পুরোনো’ পূজা দেখতে চান অনেকে। ‘পুরোনো পূজা’ মানে অনেক আগে থেকে চলে আসছে, এমন পারিবারিক পূজা। এই বাড়ির পূজা শুধু পুরোনোই নয়, সারা বছর ঢাকা বা গোপালগঞ্জে থেকে শুধু পূজোর কদিনের জন্য বাড়ি যান না এরা। স্থায়ীভাবেই সম্বৎসর থাকেন বাড়িতে।

“দুর্জ্জয় সমন ভয় ত্বরিবার তরে অভয়া দুর্গা নাম রাখিলাম দ্বারে ১২৭৮ সন "
“দুর্জ্জয় সমন ভয় ত্বরিবার তরে
অভয়া দুর্গা নাম রাখিলাম দ্বারে
১২৭৮ সন “

তাই ‘পুরোনো পূজা’ দেখতে আগ্রহীরা নির্দ্ধিধায় চলে যেতে পারেন এই বাড়িটিতে।
ঘন্টা খানেক যা দেখেছি এই বাড়ির লোকজন-কে, সমাদরও পাবেন ভালো, ধরে নেয়া যায়।
কর্তা – গিন্নী সবাই অতিথি বৎসল। কিছু লক্ষণ দেখেছি এর।

নিজের থেকে এরা ‘ঘোমটা’টি সরিয়ে দিয়েছেন প্রতিমার মুখ দর্শন করানোর জন্য।
সিঁড়িতে ‘লেপ্টে’ বসতে দেখে মুছে দেয়ার জন্য বাধা দিচ্ছিলেন বাড়ির বধু একজন।
বসছিলাম ছবি নেয়ার জন্য।

দোতলার রেলিং এ মেলে দেয়া ছিলো তোষক কাপড়চোপড় ।
নিজে থেকেই সরিয়ে দিয়েছেন ছবি নেয়ার সুবিধার জন্য।
তেড়ে আসেন নি – কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন বলে।

বধূ একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিগো দিদি, বলি হবে না?
বলি হবে ৮ টা!
হতেই হবে।
বাড়িতেই এতো এতো লোকজন।
পাড়া প্রতিবেশীও কি বাদ থাকবে নাকি!
তিন দিনের নিত্য প্রসাদ।
অন্তত একদিন মেঝেতে আসন বিছিয়ে দধি মাংস সহকারে অন্ন ব্যঞ্জন।

সহজলভ্য দুধের জন্য রসগোল্লার জন্য খ্যাত পুরো ফরিদপুর।
দধিতো থাকবেই।

বলি নিয়ে জানালেন, বলি হবে ৮ টা।
৭ টা পাঁঠা ১ টা মেষ।

পুরোনো সেই প্রথাটি এখনো ধরে রেখেছেন।
অতীতে মহিষ বলি দেয়া হতো কি না কে জানে!
থাকলেও সে লোপ পেয়েছে হয়তো শত শত বৎসর আগে।
হিন্দুদের মাঝে মহিষ বলিদানের প্রথা ছিলো।

কাঠমুন্ডুর দরবার স্কোয়ারে বলি দেয়া হতো – শত শত, হাজার হাজার!**
অবিশ্বাস্য বা কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে লেখার সম্ভাবনা থাকলেও এটাই ইতিহাস।
তবে এই প্রথা রহিত করেন গোর্খা শাসক পৃত্থি নারায়ণ শাহ (১৭২৩ – ১৭৭৫)।

রাজ পরিবারের গৃহদেবতা ছিলেন তেলেজু দেবী।
রাজকীয় তেলেজু মন্দির ছিলো।
যুদ্ধ জয় করে ফিরে নরবলি দিয়েছিলেন দেবীকে তুষ্ট করতে।
কিন্তু রাতে স্বপ্নে এসে অসন্তোষ প্রকাশ করেন দেবী।
সেই থেকে এই বলিদান হচ্ছে না দরবার স্কোয়ারে।

যাক, বলির কথা শুনার পর এদিক ওদিক তাকালাম, বাঁধা আছে কিনা কোথাও, ৭ পাঁঠা আর ১ মেষ।
চোখে পড়লো না।
হয়তো আনা হয়নি এখনো।

তবে হাব-ভাবে কথা বার্তায় মনে হলো, সময় পেলে মোয়া আর নাড়ু খেয়ে আসা যেতো।
গল্প জুড়তে হতো একটু সময় নিয়ে। নিজের বাড়ির পূজোর কথা, ‘৭১ থেকেই যা বন্ধ স্থায়ী ভাবে।

পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন দালানকোঠাও আছে মোটামুটি আগের মতোই, বিশাল বড় উঠোন ঘিরে সব দালান।
মন্দিরের সামনে ঢেউ টিনের চৌচালা বড় নাটমন্দির।

সামনে বিস্তৃত ঘাস বিছানো খোলা মাঠ পাড় হয়ে জঙ্গলের মতো গাছ ঘেরা বিশাল পুকুর।
ধাপে ধাপে নেমে গেছে শান বাঁধানো ঘাট।

মাছ চাষের খাবার বিষ দিয়ে কলুষিত করা পুকুর নয়, স্বচ্ছ টলটলে জলের পুকুর।
আমি নিশ্চিত, এই বাড়িতে পূজো দেখতে গেলে এই পুকুরেও নামা যাবে।
কারণ বাড়ির বাইরের লোকজনকে দেখেছি এই পুকুরে স্নান করতে।

পুকুরের ঘাটলাটার মুখের দুই পাশে দুই তুলসী বেদী, সবুজ সতেজ পাতায় ছাওয়া।
এই ঘাট পেরিয়ে ওদিকে আবার আরেক মন্দির।
এতোটা বড় নয়, তবে মৌলিকত্ব আছে নির্মান কাঠামোয়।
সেটি লক্ষী নারায়ণ মন্দির। নির্মাণ সাল ১৩৩০।
বাড়িটি নির্মাণের ৫২ বছর পরের। তাও এখন শত বছর হতে চললো প্রায়।

এই বাড়ির সবচাইতে ভালো লাগা দিকটি হচ্ছে শিশু কিশোর যুবা বৃদ্ধা নারী পুরুষ সব মিলিয়ে জমজমাট এক বাড়ি।
পূর্বপুরুষের জমিদারি বা এখনকার বিরাট এই বাড়ির ঠাটবাটের চিহ্ন নেই কারো চোখে মুখে।
নিতান্তই গ্রামের আর দশটা পরিবারের মত সাধারণ পরিবার।
না, কোন আলোকসজ্জা বা সাজ সজ্জার প্রস্তুতি চোখে পড়ে নি।

এটা এক শুভ লক্ষণ।
আশা করা যায় পূজা হবে সাত্ত্বিক মতে।
তাই, হৈ হুল্লোড় আলোর ঝলকানির উৎসব নয়, সত্যিকারের পূজো দেখতে হলে কাছাকাছি এটাই হতে পারে সর্বোত্তম destination।
নইলে হতাশ হতে হবে ‘আজাইরা কামে’ ১৬/১৮ ঘন্টা ড্রাইভের বাগেরহাটের হাকিমপুরের শিকদার বাড়ির পূজো দেখতে গেলে।

ভালো কথা, ঠিকানাটাইতো বলা হয় নি।
এটা গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের উত্তর নারায়ণপুর গ্রামে।
ভুঁইয়া বাড়ি বা মন্দির বাড়ি বললেই দেখিয়ে দেবে যে কেউ ।
পূজো দেখার সাথে বাড়তি বোনাস থাকবে ঘুরেফিরে বাড়িটি দেখা আর সাঁতার জানা থাকলে, পুকুরটিতে সাঁতার কাটা।

** The Kali Puja, which lasts for a period of ten days, commemorates the victory of the bloodthirsty Kali, the goddess of de- struction, over the demon Mahishasur, who is usually represented in the form of a buffalo, It reaches its climax in the ceremony of the blessing of the colors, when the army propitiates the goddess by the sacrifice of thousands of buffaloes, every officer being expected to furnish one or more animals, according to his rank.
THE LAST HOME OF MYSTERY By Alexander Powel , Page 199-200

লিখাঃ তপন রায়

বেহেলী আউব্বা নদী, সুনামগঞ্জ

‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’* কবিতার ‘যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়ের’ মতো হাওরে যাওয়ার বোধ হয় এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।

‘এখনই’ কারণ টান ধরেছে পানিতে।
বেশীদিন থাকবে না।
তবে পানি আছে এখনো।
ঢেউ বিহীন শান্ত স্নিগ্ধ পানি।

এই কবিতারই একটা স্তবক আছে,

“যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় । ”

দরকার কি ভালোবাসাবাসি খুনোখুনী করার?
তার চাইতে বলা যায়,

‘যদি কেউ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ভুলে যেতে চান
নৌকা নিয়ে হাওরে চলে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায় । ‘

তবে খেয়াল রাখলে ভালো, এমন বাঁশের চটির ছাদের নৌকা হলে ভেতরে উপরে পা ছড়িয়ে বসে আরাম।
নাই বা পেলেন ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা।
আরো ভালো হয় সরাসরি গাড়ি নিয়ে নৌকা ঘাটে না গেলে।
একটু গাড়ি, একটু রিকশা, একটু পায়ে হাঁটা।

বাজারের দোকানের বেঞ্চটিতে বসে এক কাপ চা খাওয়া।
আর নৌকায় বসে সেরা সব খাবার খেতে হবে, এমন সব চিন্তা মাথায় না আনা।
আপনি যাচ্ছেন হাওর দেখতে, দরকার নাই গান বাজনা, খাওয়া দাওয়ার।

কখন কোন দিকে থেকে সন্ধ্যা নেমে পড়বে দিন গড়িয়ে, মনেও আসবে না খাওয়ার কথা।
সকাল দশ ঘটিকায় নৌকায় উঠার পর তাহিরপুরের টেকেরঘাটে যেয়ে আমাদের পেটে পড়েছে শুধু জনপ্রতি একটা করে ডাব।
এই খালি পেটেই ইচ্ছেমতো সাঁতার কেটেছি পিয়াইন নদীতে।

বিশ্বাস করা না করা আপনাদের মর্জি।

*শ্রদ্ধার সাথে আন্তরিকভাবে দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি প্রিয় কবি কবি হেলাল হাফিজের।

ছবি তোলার তারিখ ও স্থান:

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ থানার বেহেলী আউব্বা নদী
ছবি তোলার তারিখ ও স্থান:
২২/০৯/২০২১, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ থানার বেহেলী আউব্বা নদীর (?) নৌকা ঘাট

লিখাঃ তপন রায়

সোনালী সূর্যদয়

সেই ২০১৫ সালের কোনো এক সকালে…

সোনালী সূর্যদয় …

এমনিতেই গতকাল রাতে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ট্রেকিং করেছি অনেকটা পথ। তাও আবার ভরা পেটে! শুতে শুতে অনেক রাত্রি হয়েছিল। পূর্বের প্ল্যান অনুযায়ী ভোর ৪.৩০ মিনিটেই উঠে পড়েছি আমি। সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলাটা একটা মহাযজ্ঞের কাজ!
যাইহোক আমরা প্রায় ৫.৪৫ মিনিটে আবার হাঁটা শুরু করলাম। একটু হাঁটতেই কেমন যেন হাপিয়ে উঠলাম। একেতো খালি পেট তার উপর রাতের ঘুমটাও ভালো হয়নি, সকালে পানি খেয়েছি শুধু! এইবারের দলে সদস্য সংখ্যা বেশী, যে যার মতো হেঁটে চলেছে। রাস্তা মোটামুটি সহজই বলা চলে। ইট বসানো সলিং রাস্তা শুধু উপরের দিকে উঠে যাওয়া এইযা! সূর্য মামা এখনো উঠেনাই, গরম সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও কাঁধের ব্যাগ ক্রমশ ভারী লাগছিলো বেশ।
দল বড় হওয়াতে বার বার থামতে হচ্ছে কারো না কারো ক্লান্তির জন্য, হাঁটার গতি অনেক মন্থর। মেজাজটা চটে যাচ্ছে! এইভাবে এগোতে থাকলে আজ সারাদিনেও টার্গেট এর আশেপাশে যাওয়া যাবেনা!
হটাৎ করেই পূর্ব আকাশে পাতা শূন্য গাছ আর পাহাড়ের ফাঁকে চোখ আটকে গেল। একি দেখছি আমি!!! এতো সুন্দর সকাল হতে পারে!!! সত্যিই কি সকালের সূর্যদয় এতো মনোমুগ্ধকর? এমনতো নয় যে আমি আগে কখনোই পূর্ব আকাশে সূর্যদয় দেখিনি!
আমি সাগরে উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে সূর্যদয় দেখেছি, নদীতেও দেখেছি, শহুরে সূর্যদয়ও দেখেছি। আমি গহীন বনেও সূর্যদয় দেখেছি, এমনকি এই পাহাড়েও সূর্যদয় দেখেছি বেশ কয়েক বার। তবে আজকের পরিবেশটা সত্যিই ভিন্ন লাগছে। কেন এতো সুন্দর লাগছে এই সূর্যদয়? মনে হচ্ছে যেন কোন চিত্রকর তার নিপুণ হাতে হরেকরকম রং এর বাহার নিয়ে আপন মনে এঁকে চলেছে এই ছবি…., মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছি।
পূর্ব আকাশে পাহাড়ের মাঝে মেঘের ফাঁক গলে একটু একটু করে সূর্য জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি। তার আলোয় আলোকিত হবে চারিদিক। সূর্যস্নানে পবিত্র হবে এই জগৎ। একটি নতুন দিনের সূচনা, একটি নতুন সূর্য, আর একটি নতুন আশা! বাস্তবতার সৌন্দর্য্য যে কল্পনার সৌন্দর্য্য কেও হার মানায় তা আমি আজ উপলব্ধি করতে পারলাম।
জানি আমি চাইলে এই সময় টাকে আমার ক্যামেরায় বন্দী করে রাখতে পারবো, তবে আমার খুবই মন চাইছে এই সময়টাতে যদি আমি নিজেই বন্দী হয়ে যেতে পারতাম!! তখন কতই না ভালো হতো! এটা ঠিক একেকজনের দেখার ভঙ্গী একেক রকম হতেই পারে! তবে আমার কাছে মনে হয়েছে এটাই লেখকের ভাষায় সেই “সোনালী সকাল”
(Golden Morning)…
লিখেছেনঃ হাদি মুন

হিজলতলী গ্রাম

হিজলতলী গ্রাম, বোর্ড বাজার, গাজীপুর থেকে।

১। আজমেরী গ্লোরি বাসে করে কোনাবাড়ি পার করে মৌচাক বাস স্ট্যান্ড। ভাড়া ২৫ টাকা।
২। রাস্তা পার করে বাজারের ভিতর দিয়ে ঐপারের রাস্তায় গিয়ে ছয় ছিটের ব্যাটারি গাড়িতে করে জামালপুর চৌরাস্তা। ভাড়া ২৫ টাকা।
৩। জামালপুর চৌরাস্তা থেকে আবার ব্যাটারি গাড়ি করে হিজলতলী বাজার পার করে হিজলতলী খাল। ভাড়া ২০ টাকা।
৪। হিজলতলী খালের পাড়েই হিজল বাগান। যায়গাটা নৈসর্গিক এবং কোলাহল মুক্ত। ভালো লাগার মতো।

সময়ঃ

যেতে আসতে ঘন্টা দুই সময় লাগে। এর সাথে যোগ হবে আপনি স্পটে যতটা সময় কাটাতে চান তা।

সুবিধা/অসুবিধাঃ

কোন সুবিধা নেই, তবে আছে অনেক অসুবিধা।
১। প্রত্যন্ত এলাকা। তাই বিকেল ৩/৪ টার মধ্যে ফিরে আসতে পারবেন এমন প্ল্যান করে যাবেন। যাদের অনেক ছবি তোলার প্ল্যান তারা ব্যাটারি গাড়ি রিজার্ভ করে যেতে পারেন তাহলে আসা যাওয়ার পথের সুন্দর সুন্দর বনগুলোতে ছবি তুলতে পারবেন৷
২। মেয়েদের নিয়ে না যাওয়াই মঙ্গল। অনেকটা ভিতরে কাঁদামাটির রাস্তা পার করে যেতে হয়। অনেক লম্বা কয়েকটা শাল বন পার করতে হয়। যার অনেক যায়গাই পুরা জনমানবহীন।
৩। বাইকারদের জন্য ট্রাভেলটা আরামের তবে অবশ্যই দুজন অথবা তিনজন যাবেন। শুকনো মৌসুমে যেতে হবে তা না হলে বাইকের চাকা কাদার মধ্যে ফাসা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
৪। যায়গাটা মৌচাক থেকে অনেক ভিতরে। অবশ্যই বিকেল ৩/৪টার মধ্যে ব্যাক করতে পারবেন এমন প্ল্যান করে যাবেন। প্রাইভেট কার নিয়ে কেউ কখনও যাওয়ার কথা চিন্তা করবেন না। গাড়ি ঢুকবে না। এবং কাদামাটির মধ্যে একবার চাকা ঢুকে গেলে আর বের করে আনার লোকও পাবেন না।
আশা করছি ট্যুরিস্ট বাড়লে রাস্তা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। ভূলেও কেউ বৃষ্টির মধ্যে যাবেন না।

লিখেছেনঃ Tonmoy Chowdhury

নির্বাসনের দিনলিপি-০১

সেন্ট মার্টিন এর একটা রিসোর্টে পড়ে আছি ৪ দিন। ঠিক পড়ে থাকাও নয়, ৫ জন মিলে উড়াধুড়া খাওয়া, আড্ডা, ঘোরাঘুরি চলতেছে।  আসতেছিলাম সলো ক্যাম্পিং এ। টেকনাফে দেখা হয়ে গেল যশোরের দুই পরিচিত ছোটভাই আর দুইজন হবু ডাক্তারের সাথে। যশোরের দুইজন সেই পিচ্চিকাল থেকে পরিচিত। একসাথে আড্ডা, ডিসি পার্কে সকালবেলা জগিং, অনেক অনেক গল্প আছে এদের সাথে। আর ডাক্তার দুইজনের সাথে সদ্য পরিচয়। টেকনাফ থেকেই বেশ হইহল্লা করে একসাথে সেন্ট মার্টিন আসা গেল, উঠলাম পশ্চিম বিচে একদম বিচ লাগোয়া একটা রিসোর্টে। 

৫ম দিন ওরা ৪ জন বিদায় নিল। এবার একটা ভালো লোকেশন খুজে নিজের ক্যাম্প পাতানোর পালা। কিন্তু না, সেটি হচ্ছেনা। টেকনাফ থেকে রওয়ানা দিয়েছে গরীবের রবিনসন ক্রুসো খ্যাত ইয়াশ আর হবু স্বাধীন নোয়াখালির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট যেআইসি (জামিল ইকরাম চৌধুরী)। রবিনসন ইয়াশ কক্সবাজার ট্রিপ শেষে টেকনাফে এসে একরাত ছিল, শাহপরীর দ্বীপে পরী খুজতে গিয়েছিল, না পেয়ে এখন সমুদ্রযাত্রা করে চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে সেন্ট মার্টিন আসতেছে। এই গরীবের সাথে আরো দুই হাতি যোগ হচ্ছে। অগত্য সেদিনটাও রিসোর্টে গ্যাট হয়ে পড়ে রইলাম। 

ইয়াশ আর জামিল চলে আসলে সেদিনটাও রিসোর্টে পড়ে রইলাম। উদ্দেশ্য একটু আইসব্রেকিং আর রেস্ট। ইয়াশের সাথে সেই ২০১৬ সালের কালাপাহাড় ট্রিপের পর দেখা। অনেক গল্প সল্প হলো, ৪ বছরের জমানো গল্প আমাদের। পরদিন সকালে নাস্তা করে আমরা পশ্চিম বিচের দিকে লোকেশন খুজতে বের হলাম। আমাদের সাথে দুইটা তাবু। মানুষ আমরা ৩ জন। টেনেটুনে হয়ে যায়। বেশ অনেকটা সময় ধরে হাটার পর আমরা একটা মনমতো জায়গা পেলাম।

পুরা উম্মুক্ত একটা নারিকেল বিথী। সামনের সমুদ্রে একটা ল্যাগুনের মত। ইউ শেপের পাথরের দেয়ালের ভেতর বেশ খানিকটা সমুদ্র, জোয়ারের সময় ও নিরাপদে দাপাদাপি করা যায়। এদিকটাতে পর্যটকের আনাগোনাও কম, জনবসতিও তেমন নাই। জায়গাটা আমাদের পছন্দ হলো। নির্বাসনের জন্য অতি উত্তম স্থান!

জায়গাটার আসল মালিক কে আমরা জানিনা, একটা মাইগ্রেটেড রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করে। তাদের ঘরবাড়ি ভিতরের দিকে। আমরা থাকব সমুদ্রের দিকে। তাদের অনুমতি নিয়ে তাবু ফেললাম। শুরু হয়ে গেল নির্বাসন জীবন। ওই পরিবারের বাচ্চাদের সাথে কর্পোরেট ডিল হলো। পারডাব ৪০ টাকা, সদ্য গাছ থেকে পেড়ে খাওয়াবে। আমরা রোজ একেকজন দুইটি করে ডাব খাব। কিচেনের দায়ীত্ব সমান ভাগ হলো।

বাজার করার দায়ীত্ব জামিলের, কাটাকাটি আর লাকড়ি জোগাড়ের দায়ীত্ব আমার, রান্নার দায়ীত্ব ইয়াশের, তবে মাছও কাটবে ইয়াশ। ৩ জনের ভেতর একমাত্র আমিই “সেই রকম চা/কফি খোর” কাজেই চায়ের দোকানের রান্না/বেচা বিক্রির দায়ীত্ব ও আমার! একটা পাথরের চুলা বানানো হলো, অনেক নারিকেল পাতা, আর ডাটার লাকড়ী জোগাড় করা হল।

ব্যাপক বাক বিতন্ডা আর আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো একেকদিন একজন করে বাজারে যাব। ক্যাম্পের সবাই একসাথে ঘুরতে যাবোনা, অন্তত একজন পাহারায় থাকব। গোসল আর খাবার পানির ব্যবস্থা হলো ওই ফ্যামিলির টিউবওয়েলে, টয়লেট ওদের প্রাগৈতিহাসিক নারকেল পাতার ট্রাট্রিখানায়। 

প্রথম দিন দুপুরেই ইয়াশ তার জাদু দেখালো। শর্টকাট রান্নায় সে করল সরিষার তেলের খিচুড়ি আর ডিম ওমলেট! জিবে জল আসা স্বাদ। সেই সকালে পরোটা ডালের নাস্তা হয়েছিল কাজেই বেশ ক্ষুধা ছিল, গপাগপ খাওয়া হয়ে গেল। এরপর শেষ দুপুরে আমি আর জামিল সমুদ্রে ঝাপ দিলাম। ইয়াশ একটা ছাতা মেলে বালিতেই ঘুমিয়ে গেল!

ঘন্টা খানেক লোনা পানিতে চুবিয়ে আমরা যখন উঠে এলাম ইয়াশ তখনো লেজি পান্ডার মতো চার হাত পা মেলে আকাশ বাতাস কাপিয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। জামিল সতর্ক করলো, ইয়াশ এভাবে কাপাইতে থাকলে বিপন্ন এই দ্বীপ যেকোন সময় সমুদ্রবক্ষে তলিয়ে যাবে। অগত্য দ্বীপ বাচানোর তাগিদেই হোক আর নিজেরা বাচার তাগিদেই হোক ইয়াশকে হাত পা ধরে ঘুম থেকে টেনে তুললাম, ইয়াশ একা একা সমুদ্রে নেমে জলজ্বীনের মতো (জলপরীর পুরুষ ভার্সন) একটু জলকেলি করে আসলো।

আমাদের সাথে দুইটা হ্যামক ছিল যেগুলা আগেই ঝুলানো হয়েছিল। লোকাল বয় রাশেদকে গাছে তুলে দিলাম ডাব পাড়তে, শেষ বিকেলে দুই হ্যামকে দুইজন আর বালিতে হাত পা ছড়িয়ে ভেজা গায়ে ডাব হাতে আমরা যখন পশ্চিমাকাশে সূর্যাস্ত দেখছি তখন আমাদের মনে হলো- জীবন সুন্দর!

সন্ধার দিকে টিউবওয়েলে গোসল দিয়ে ভদ্রলোকের পোশাক পরে আমরা দুইজন হ্যামকে ঝুলে গেলাম, একজন বসল ক্যাম্পিং টুলে। লোকাল মশারা ফিস্টের উৎস খুজে না পাওয়ায় এদিনে মশা ছিল না। সন্ধার অন্ধকারে শুরু হলো আমাদের মেইল ট্রেনের মত গতিমান আড্ডা। আড্ডার ফাকে ফাকে ছাগলের মতো মুখ না চালাইলেই নয় বিধায় একটু খেটেখুটে মুড়ি মাখানো হলো, আবার শুরু হলো আড্ডা। ইয়াশের চোখে তখন বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন, জামিল একমনে মুড়ি চিবুচ্ছে আর আমি হ্যামকে ঝুলে ইয়াশের স্বপ্নের গল্প শুনছি। সেই আড্ডার সময়ে মনে হয়েছিল- জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও আনন্দেরই, যদি আমরা সেটা চাই।

আড্ডা, হইচই, গল্পে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেলো। রাতের ডিনার মেনু স্যুপ পারহেড একগ্লাস স্যুপ। এসব স্যুপ ট্যুপ, নুডলস এসবে আমি বেশ দক্ষ। আমি স্যুপ  বানায়ে ফেললাম। ৩ জনে ৩ গ্লাস স্যুপ দিয়ে রাতের ডিনার শেষ করলাম। জি না! খেলা এখনো শেষ হয়নাই, বাকি আছে। ইয়াশের নাকি রাতে হালকা ডিনারে হবে না, গ্রেভি হেভি ডিনার ছাড়া হুজুর এক্সপ্রেসের ঘুম আসবেনা। এদিকে আমি আর জামিল কেউই আর চুলার আশেপাশে যাবোনা। কাজেই বেচারা ইয়াশ তার পেটের লবিংয়ে পড়ে বিস্কুটের দোকান এই গভীর রাতে আবার উম্মুক্ত করলো। 

এরপর আর কি? আবার ঝুলে বসে আড্ডা শুরু। এভাবেই বেজে গেল রাত প্রায় দুইটা!

এবার তো নিদ্রাপুরে যেতেই হয়। ঠিক হলো এক তাবুতে মাল পত্র সহ ঘুমাবো আমি। অন্য তাবুতে ইয়াশ আর জামিল। তবে গরমের একটু প্রকোপ থাকায় আমি একটা পাতলা কম্বল নিয়ে হ্যামকে উঠে এলাম। বাকি দুইজনে দুইটা তাবুতে ঢুকে গেলো। দুইজন তাবুর ভেতর থেকে আর আমি হ্যামক থেকেই টুকটাক গল্প শুরু করলাম। এরপর কিছুক্ষনের ভেতরেই ইয়াশের তাবু থেকে নোজ গ্রেনেড ফাটা শুরু হয়ে গেল, পুরা দ্বীপ তখন নোকিয়া ১১০০ মোবাইলের মত ভাইব্রেশন দিচ্ছে। এই শোরগোলের মধ্যে আমি আর জামিল কখন নিদ্রাপুরে রওনা দিয়েছিলাম সেটা আজ আর আমাদের কারোর ই মনে নেই। 

চলতে থাকবে…….

আমাদের দেশ, আমাদের প্রকৃতি, সমুদ্র, জঙ্গল আমাদের সম্পদ। ভ্রমণে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার জানা ও করাটা জরুরি। ভ্রমণকালীন ই শুধু নয়, সবসময়েই পরিবেশ ও প্রকৃতির যত্ন নিন। প্লাস্টিক, পলিথিন যথাযথ পরিবেশ বান্ধব উপায়ে ডাম্পিং করুন, যথাসম্ভব বর্জন করুন। পরিবেশ বাচুক, আমরাও বাচি। ভবিষ্যতের জন্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যাই।

বিঃ দ্রঃ- সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ নিয়ে “রহস্যময় ভ্রমন” নামে আরেকটা ভ্রমণ গল্প সিরিজের লাস্ট গল্পটি বাকি আছে। সেটা আর এটা পৃথক যাত্রার গল্প।

কৃতজ্ঞতাঃ নাজমুস সাকিব

জিনসিয়াম সাইতার

“জিনসিয়াম সাইতার”

রুমানাপাড়ার এক দুরন্ত কিশোরীর নাম জিনসিয়াম।
দৈনন্দিন খাবারের জন্য তরকারি সংগ্রহ করতে গিয়ে এক জলপ্রপাতের ধার ঘেঁষে যাচ্ছিলো।

হঠাৎ ই তার পা পিছলে যায়,পড়ে যায় সে এই ঝর্নার উপর থেকে। পাথরের উপর আছড়ে পড়ে তার নিথর দেহ,ছেড়ে চলে যায় দুরন্ত প্রান এই ভু-স্বর্গের মায়া ছেড়ে।

বাবা, মা, চাচা সহ অন্যান্য পাড়াবাসী খুঁজে বেড়ায় পাড়ার আশপাশ জুমখেতের এদিক-অদিক সব দিক। কিন্তু পরদিন ঝর্নার পাশে পড়ে থাকে জিনসিয়াম বমের নিষ্প্রান

শরীর, জলপ্রপাতের ধারা মিলিয়ে যায় তার দেহের সব লহু।
সেই থেকে পাড়া বাসী এই ঝর্নাকে জিনসিয়াম সাইতার বলে ডাকেন।

ঝর্ণার ধাপ তিনটি , যাওয়া যায় লুংথাউসিহ পাড়া দিয়েও। রুমানা পাড়া থেকে গেলে আপনাকে কুণ্ড এবং দ্বিতীয় ও প্রথম ধাপ দেখে পাড়ায় ফিরতে হয়। আর লুংথাউসিহ পাড়া থেকে গেলে সব ধাপ দেখে রুমানা পাড়ায় আবার ফিরে যাওয়া যায়।

জিনসিয়াম সাইতার
জিনসিয়াম সাইতার

রুমানা পাড়া মূলত বম আদিবাসীদের পাড়া। আগে এর নাম ছিল সানকুপ পাড়া, ‘সানকুপ’ নামক একজন কারবারির নামে। রুমা খালের শেষে এই পাড়াটার অবস্থান বলে এর নাম রুমানা পাড়া হয়েছে পরে । বম আদিগোষ্ঠী পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন বলে অন্যান্য বম পাড়ার মতোই রুমানা পাড়াও যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাড়া-প্রধানকে বলা হয় ‘কারবারি’। পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও আছে একটা গির্জা।

রুটঃ বান্দরবন থেকে রুমা বাজার – বগালেক – কেওক্রাডং – পাসিংপাড়া – সুংসং পাড়া – রুমানা পাড়া – জিংসিয়াম সাইতার

জিনসিয়াম সাইতার
জিনসিয়াম সাইতার

কিভাবে যাবেন :

ফকিরাপুল থেকে এস আলম, সৌদিয়াসহ আরো অনেক পরিবহনের বাসে বান্দরবান যাওয়া যায়। ভাড়া ৬২০ টাকা। বান্দরবান থেকে রুমা পর্যন্ত জিপে জনপ্রতি ১৫০ টাকা। রুমা থেকে বগা লেক পর্যন্ত রিজার্ভ চান্দের গাড়ি ভাড়া প্রায় আড়াই হাজার টাকা। এরপর বাকিটা হাঁটাপথ। রুমানা পাড়া পৌঁছতে ছয়-সাত ঘণ্টা লাগতে পারে।

কাজী হামিদুল হক, বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার গুরু

ছবিতে থাকা ডান পাশের ভদ্রলোকের নাম কাজী হামিদুল হক। তাঁকে বলা হয় বাংলাদেশের অ্যাডভেঞ্চার গুরু।
.
বিখ্যাত বাংলা চ্যানেলের আবিষ্কারক, কীর্তিমান আণ্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফার ও বরেণ্য স্কুবা ডাইভার কাজী হামিদুল হক।
.
সেই যে যৌবনে সাগর টেনেছিল কাজী হামিদুল হককে, সেই টান ছিল আমৃত্যু। দেশে ফেরার পর ছুটে যান সমুদ্রে। চষে বেড়িয়েছেন কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন এলাকার বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের এই পথে নৌকায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তাঁর মাথায় খেলা করে সাঁতারে সাগর পাড়ি দেওয়ার একটা রুট। সঙ্গে ছিলেন কামাল আনোয়ার।
.
কামাল আনোয়ার বলেছিলেন, ‘টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে ভাটার সময় সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত সাঁতরে পার হওয়া যাবে, এটা হামিদ ভাই বের করলেন। কখন কোথায় স্রোত কোন দিকে যায়, তা-ও আমরা বের করে ফেলি বিভিন্ন রঙের বোতল ভাসিয়ে। এই পথে স্রোতের দুটি ধারা আছে, এর একটা যায় আরাকানের দিকে। হামিদ ভাই সঠিক রুটটা বের করে ফেলেন।’
.
নৌকা চালিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার পরই সাঁতারের এই রুট বের করার দিকে মন দেন তিনি। ‘ওরা যেমন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়, আমরাও এমন একটা সাঁতার চালু করতে পারি।’ বলতেন কাজী হামিদুল হক।
.
২০০৬ সালে প্রথম সাঁতারের আয়োজন করা হয়। সে দলে সাঁতারু হিসেবে ছিলেন লিপটন সরকার, ফজলুল কবির ও সালমান সাইদ। দলে বয়সে সবচেয়ে ছোট সালমান সাইদ। তিনি বলেছিলেন, ‘দলে আমিই ছিলাম অনভিজ্ঞ সাঁতারু। কিন্তু হামিদ ভাই মানসিকভাবে এত শক্তি জোগাতেন যে কোনো ভয়ই লাগেনি।’
.
২০০৬ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি এই দলটি শাহপরীর দ্বীপ থেকে বঙ্গোপসাগরে ১৪ দশমিক ৪ কিলোমিটার সাঁতার কেটে পৌঁছায় সেন্ট মার্টিনে। তখনো সাঁতারের এ পথের নামকরণ হয়নি। পরে ঢাকায় কাজী হামিদুল হক এর নাম দেন বাংলা চ্যানেল।
.
২০০৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। বুড়িগঙ্গা নদী থেকে একটি নৌকা পাড়ি জমায় বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে। শুনলে অবাক লাগে কারন নৌকাটি দৈর্ঘ্যে ছিলো মাত্র ২১ ফুট আর প্রস্থে নয় ফুট। সেই নৌকায় ছিল না কোনো বাথরুম বা রান্নাঘর। স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নার ব্যবস্থা। কাজী হামিদুল হকের নেতৃত্বে এই নৌকায় অভিযাত্রী ছিলেন ১৩ জন। সে যাত্রায় অংশ নেন বাংলাদেশের পর্বতারোহী মুসা ইব্রাহীম। তাঁর কাছ থেকে জানা গিয়েছিলো সেই যাত্রার ইতিবৃত্ত ।
.
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের জাহাজ ভাঙার জায়গা থেকে একটা লাইফ বোট (বড় জাহাজের সঙ্গে এগুলো বাঁধা থাকে) কিনে আনেন। এরপর ঢাকায় নিয়ে এসে সেটায় ইঞ্জিন লাগানো হয়। নৌকাকে নদী-সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী করতে নানা কারিগরি ফলানো হয়। এসব কাজ নিজেই করেছিলেন হামিদুল হক।
.
রাতে বুড়িগঙ্গা থেকে নৌকা ছাড়ার কথা, কিন্তু যাত্রা শুরু হলো ভোরে। এই অভিযাত্রায় সে সময় অংশ নিয়েছিলেন হামিদুল হক, মুসা ইব্রাহীম, ইমরান, ফজলুল কবির, কামাল আনোয়ার, রফিক, রবিউল হুসাইন, একুশে টিভির দুই সাংবাদিক এবং আরও কয়েকজন। রুট চেনার কারণে সারেং আনা হয়েছিল সীতাকুণ্ড থেকে।
.
মুসা ইব্রাহীম বলেছিলেন, ‘ভোরে রওনা দিয়ে সেদিনই পৌঁছাই চাঁদপুরে। আমাদের হিসাব ছিল দুই দিনে সেন্ট মার্টিনে যাব। কিন্তু দেখা গেল, সন্দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছাতেই লেগে গেল পাঁচ-ছয় দিন। কারণ, নৌকার গতি ছিল খুব ধীর। সন্দ্বীপ থেকে পরের দিন যাচ্ছিলাম চট্টগ্রামের দিকে। কর্ণফুলীতে নৌকা যখন পৌঁছাল, তখন দেখি কর্ণফুলী চ্যানেল থেকে সব জাহাজ মিছিল করে গভীর সমুদ্রে যাচ্ছে। আমাদের নৌকায় জিপিএস, কম্পাস ছিল, কিন্তু রেডিও ছিল না। তাই আমরা কোনো খবরই পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি সমুদ্র পুরো উত্তাল। ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু একেকটা ঢেউ। হামিদ ভাই সবাইকে নৌকার পেছনে জড়ো হয়ে থাকতে বললেন। নিজেদের জান হাতে নিয়ে আমরা তা-ই করলাম।’
.
সমুদ্রের তাণ্ডব থামার পর কাজী হামিদুল হকের নৌকা কর্ণফুলী জেটিতে পৌঁছাল। তখন জানা গেল, সেই দিনটিতে ইন্দোনেশিয়ায় ভারত মহাসাগরে ঘটে প্রলয়ংকরী সুনামি।
.
চট্টগ্রামে গিয়ে সারেং তাঁর বাড়িতে ঘুরতে যান, কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। হামিদুল হক নিজে আবার সীতাকুণ্ডে গিয়ে আরেকজন সারেং নিয়ে আসেন। এরপর মহেশখালী হয়ে টেকনাফ, তারপর সেন্ট মার্টিনে পৌঁছায় হামিদুল হকের নৌকা। হামিদুল হক ও আরও কয়েকজন নৌকা চালিয়েই আবার ফিরে আসেন ঢাকা।
.
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে নিউইয়র্কে এক প্রবীণ স্কুবা ডাইভারের (ডুবুরি) সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিলো কাজী হামিদুল হকের। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি ডুবসাঁতারে। এরপর তাঁর আগ্রহ তৈরি হয় অতল জলের বিচিত্র-বর্ণিল জগতের প্রতি। এ সময়টাতেই জলের নিচে ছবি তোলার কৌশল শিখে ফেলেন। ডুব দেওয়া আর জলের নিচে ছবি তোলাই হয়ে ওঠে হামিদের পেশা। তিনি সাগরের ২০০ ফুট নিচ পর্যন্ত ডুব দেওয়ার জন্য লাইসেন্সধারী ছিলেন।
.
১৯৪৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আসামে জন্মগ্রহণ করা অ্যাডভেঞ্চার গুরু কাজী হামিদুল হক ২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী শেরপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে বাসে মারা যান।
**- লেখা ও ছবি (সংগৃহীত) কারো যদি জানা থাকে কমেন্ট জানান ব-দ্বীপ ক্রেডিট দিয়ে দিবে ৷
error: Content is protected !!