স্বপ্ন চূড়া আরোহনের গল্পঃ
তারিখঃ ১৪ নভেম্বর ২০২১ ইং
সময়ঃ বিকেল ৪ টা ৪০ মিনিট (সামিট পুশ থান্দুই পাড়া থেকে আগের দিন রাত ১২ টা)
প্রাপ্ত উচ্চতাঃ ৩৪৮২ ফিট (অল্টিমিটার অফলাইন এ্যাপ)
অনেক চড়াই–উৎরাই –এর পর বাংলাদেশের আনঅফিসিয়াল সর্বোচ্চ বিন্দু/সর্বোচ্চ চূড়া সাকা হাফং / ত্লাংময় / মোদক তং এর সামিট পয়েন্ট খুঁজে পাওয়ার পর অনেক জোরে একটা চিৎকার দিতে খুব ইচ্ছে করছিল কিন্তু দিতে পারিনি। তবে সামিট পয়েন্ট খুঁজে পাওয়ার পর প্রথম তোলা নির্ভেজাল ছবিটাই সেই সময়ের অনুভুতি বুঝাতে অনেকটাই যথেষ্ট ……
তখন কি যে আনন্দ লাগছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না, এমন খুশি আমি আমার জীবনে আর কখনো হয়েছি বলে মনে পরে না।
আলহামদুল্লিলাহ, মহান আল্লাহ্র অশেষ অনুগ্রহে সেদিন আমরা ফাইনালি সফল হতে পেরেছিলাম। অনেক দিনের একটা অধরা স্বপ্ন সেদিন পূরণ হয়েছিল।
২০২১ ইং সালের জানুয়ারী মাসের যোগি জোতল্যাং ট্যুরে নিজের ফিটনেসের এসিড টেস্ট সফল ভাবে উৎরানোর পর সাকার স্বপ্নটা খুব বেশি রকমে চেপে বসেছিল মনে। কিন্তু প্রথমে নিজের অসুস্থতা তারপর পারিবারিক সমস্যা আর লকডাউনের কারনে কোন ভাবেই নিজের স্বপ্নের কাছে পৌছাতে পারছিলাম না।
তাই বর্ষা শেষে বিল্লালের “সাকা” ট্যুর দেখে কোন কিছু চিন্তা না করেই তার সাথে যোগাযোগ করে ট্যুর কনফার্ম করলাম। আসলে ২০২২ এ এসে সাকা যেমন ডালভাত হয়ে গিয়েছে তখনো তেমনটা হয়ে উঠেনি।
ট্যুরের প্রথম দিন দুপুর দেড়টায় আমরা থানচি থেকে শেরকর পাড়ার উদ্দেশ্যে ট্রেক শুরু করি। বোর্ডিং পাড়া পৌছতে পৌছতে সূর্য ডুবে যায়। এরপর অন্ধকারে ট্রেক করে শেরকর পাড়া পৌছাই রাত নয়টায়। পরদিন সকালে তাজিডং ২ টা পিক সামিট করে সিমত্লাম্পিং পাড়ায় পৌছাই সকাল ১১ টায়। সেখানে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে থান্দুই পাড়ায় পৌছাই বিকেল ৫ টায়। এরপর থান্দুই পাড়া থেকে রাত ১২ টায় শুরু হয়ে ট্রিপের মেইন ট্রেকিং।
কিন্তু সামিট পুশ করার শুরুতেই দেখা গেল জিপিএস ট্রেক যে মোবাইলে ছিল সেটা কোন ভাবেই অন হচ্ছে না, তাই ট্রেইলের শুরু থেকেই পদে পদে আমরা হোচট খেয়েছি রাস্তা হারিয়েছি। রেমাক্রি খাল থেকে নেফিউ ঝিরির রাস্তা খুজে পেতেই প্রথমে হোচট খাই। তারপর সমস্যায় পরি নেফিউ ঝিরি থেকে ৩৬ কিলো উঠার রাস্তা খুজে পেতে। এর পরের সময় গুলো ছিল আরও ভয়াবহ।
নেফিউ ঝরনা পার হতে হতেই ভোরের আলো ফুটে যাওয়ায় নেফিউ পাড়া হয়ে সাকার দিকে যাওয়ার সুযোগ আর আমাদের রইল না। তাই ঝিরি দিয়ে ৩৬ কিলোর দিকে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় আমাদের হাতে আর রইল না।
এসময় বিল্লাল পাড়ার দিকে কিছুদূর একা গিয়ে রেকি করে ফিরে এসে বলল আর খুব বেশি সময় লাগবে না, আমরা এখানে আমাদের ব্যাগ রেখে যাবো এবং ফিরে এসে এখানেই সকালের নাস্তা করবো। সেই কথা মোতাবেক আমরা কয়েকটা খেজুর এবং কিসমিস মুখে দিয়ে ব্যাগ ঝিরিতে রেখেই কেবলমাত্র পানির বোতল সাথে নিয়ে রওনা দিলাম।
বর্ষা সিজনের কারনে এর আগের প্রায় ৭ মাসে এই চূড়ায় তেমন কেউ আরোহন না করায় অল্প কিছদূর উঠার পরই চূড়ায় পৌছানোর কোন ট্রেইলেরই অস্তিত্ব ছিল না।
এরই মধ্যে ৩৬ কিলো থেকে সাকায় উঠতে শুরু করার অল্প কিছু পরই টিমের একমাত্র অভিজ্ঞ ব্যক্তি বিল্লাল শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে। ঘন জজ্ঞলের মধ্যেই তার প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা হয়ে পরে, সে চোখ মেলে তাকাতেও পারছিল না।
আমাদের সাথে তখন ২ বোতল পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাই তখন রেস্ট নেওয়া ছাড়া তার আর অন্যকোন উপায় ছিল না। একদিকে চূড়ায় উঠার ট্রেইল খুঁজে না পাওয়া অন্যে দিকে টিম লিডারের এমন অসুস্থতায় আমরা ভয়ানক বিপদের মুখোমুখি হয়ে পরি।
পরে এই রকম একটা মহাপ্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার গুরু দায়িত্বটা আমি নিজ থেকেই কাধে তুলে নেই। সাপ জোঁক বিচ্ছু বা অন্য কোন বিষাক্ত/ভয়ংকর প্রাণী কোন কিছুর কথাই তখন মাথায় আনিনি। সামনে কি পরছে কিছুই পরোয়া করিনি, কোথায় পা পরছে তাও কেয়ার করিনি।
চূড়ায় উঠার রাস্তা খুঁজে না পেয়ে আমরা দুই পাহাড়ের একটা খাঁজে চলে আসি, যেই খাঁজ থেকেই মুলত নেফিউ ঝিরির শুরু। চিন্তা করলাম এই খাজ বেয়েই হয়তো আমরা উপরে উঠতে পারবো। ঝোপ–জঙ্গল, গাছ, মুলি বাঁশ যাই সামনে পরেছে হাত–পা ব্যবহার করে ভেঙ্গে কেবলই সামনে এগিয়েছি, আর পেছনে ছিল বাকি চারজন।
যেকোন উপায়ে লক্ষ্য পৌছার অন্যরকম একটা নেশা পেয়ে বসেছিল তখন আমাদেরকে। আস্তে আস্তে সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পরে। তখন আরেকটি ভয় এসে ভর করে এমন প্রতিকূল পরিবেশে অন্ধকারে কিভাবে নিচে নেমে আসবো।
অনেক কষ্টের পরে যখন চূড়ায় উঠলাম তখন শুরু হল আরেক যুদ্ধ। কোন ভাবেই সাকা সামিটের ল্যান্ডমার্ক সেই বিখ্যাত গর্ত খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমরা বিশেষ করে আমি আর বিল্লাল এদিক সেদিক তন্য তন্য করে খুজেও সেই সামিট পয়েন্ট পাচ্ছিলাম না। সামিট পয়েন্ট খুঁজতে গিয়ে আমরা চূড়ার বাশ ঝাড় তছনছ করে ফেলছি, উত্তর দক্ষিণে তিনবার এসেছি গিয়েছি। চূড়ার নিচের ক্যাম্পও দেখেছি কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সামিট পয়েন্টই খূঁজে পাইনি।
আমরা সবাই তখন চুড়ান্ত হতাশ হয়ে পরেছিলাম, ধরেই নিয়েছিলাম আমাদের ফাইনাল সামিট আর হচ্ছে না। এত কষ্ট করেও আমাদেরকে ব্যার্থতার গ্লানি নিয়ে ফেরত যেতে হবে। সূর্য ডুবতে তখন আর মাত্র বিশ মিনিট বাকি ছিল।
কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। সাথে খাবার পানি থাকলে রাতে চূড়ায় থেকে যেতাম কিন্তু সেটাও সম্ভব ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি আর বিল্লাল তখন রিজ ধরে হাটা শুরু করলাম বাকিরা একটা জায়গায় বসে ছিল। অল্প কিছুদূর হাটার পরে আমিই প্রথম গর্তটা দেখলাম, আর বিল্লালকে ডাক দিলাম।
এরপর বাকি তিনজন আসলো। সামিট পয়েন্ট দেখার পর উত্তেজনায় খুব জোরে একটা চিৎকার প্রায় দিয়ে ফেলেছিলাম কিন্তু পাশে আরাকান মামুদের আস্তানা হওয়ায় নিজেকে আটকেছিলাম।
তারপর অন্ধকারে ঘন ঝোপঝাড় অতিক্রম করে মাত্র দুইটা মোবাইলের আলো সম্বল করে আমাদের ৫ জনের নেমে আসার কথাতো রয়েছেই। ভুল অনুমানের কারনে মাত্র একটা বোতল সাথে নিয়ে বাকি সকল ব্যাগ নেফিউ ঝিরিতে রেখে যাওয়ায় পাহাড়ের উঠার সময় মাত্র এক বোতল পানি ছাড়া আর কিছুই সাথে ছিল না।
ঝিরি থেকে চূড়ায় উঠা নামার এই দীর্ঘ সময়ে আমাদেরকে খাবার এবং পানির অবর্ননীয় কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাই উপরে থাকার চিন্তা বাদ দিয়ে রাতের অন্ধকারেই এমন প্রতিকূল পথে আমাদের নেমে আসতে হয়েছে।
আমাদের খাবার আমাদের ব্যগে ছিল আর ব্যাগ ছিল ঝিরিতে। সেইসময় ব্যাগের কাছে পৌছানো আমাদের পক্ষে পুরোই অসম্ভব ছিল। তাই খাবারের জন্যে রাতে নেফিউ পাড়ায় ঢুকা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উপায় ছিল না। রাত ১১ টার পর নেফিউ পাড়ার একটা দোকানে ঢুকে আমরা রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম।
সেটা ছিল ভোরের খেজুর কিসমিস খাওয়া পরে সেদিন খাওয়া একমাত্র ভারী খাবার। সিদ্ধ ডিম আর ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে সেখানে চেয়ারে বসেই কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে রাত তিনটায় পাড়া থেকে ঝিরির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরলাম। ব্যাগের কাছে পৌছাতে পৌছাতে আবার সকাল হয়ে গেল।
তারপর ছিল আমাদের থানচি ফিরে আসার কাহিনি। শালুকিয়া পাড়ার আগে ৩৩ কিলোতে সকালের মেঘ দেখে আমরা একটু দাড়িয়েছিলাম। এমন সময় প্রাতভ্রমণে বের হওয়া বিজিবির ৩ সদস্য আমাদের দেখে ব্যাপক জেরা শুরু করে। তাদেরকে কোন ভাবে বুঝিয়ে শালুকিয়া পাড়ায় চলে আসি। সেখান থেকে কিছু হেটে কিছুদূর পানির ট্রাকে কিছুদুর চাদের গাড়িতে আমরা থানচি পৌছাই।
জিপিএস বা গাইড বা নূন্যতম একটা দা না থাকার পরও কেবলমাত্র মহান আল্লাহর কৃপা আর নিজেদের দৃঢ় মনোবলের উপর ভর করে এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ঘন ঝোপঝাড় আর জঙ্গল চিড়ে সামনে এগিয়েছি। যুদ্ধ করে সফল হয়ে নিরাপদে ফিরেও এসেছি।
সামিট পুশ থেকে চূড়ায় উঠতে সময় লেগেছে টানা ১৬ ঘন্টা আর উপরে ঘন জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ের কারনে সাকার সামিট পয়েন্ট সেই বিখ্যাত গর্ত খুঁজে পেতেই লেগেছে আরও ১ ঘন্টা।
সেই সিজনে মাত্র ৭ মাসে বিল্লাল এর পরে আরও ১১ বার সাকা গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে সেই ১২ তম বারে ২১ মে‘২২ইং তারিখে সেই স্বপ্ন চূড়ায় ২য় বারের মতো পা রেখেছি। ৩৬ কিলো থেকে চূড়ায় পৌছাতে ১ম বার যেখানে প্রায় ১১ ঘন্টা লেগেছে সেখানে ২য় বার সেই পথ পেরুতে মাত্র ৪০ মিনিট লেগেছে। এতেই বুঝা যায় সাকার রুট পরবর্তীতে কতটা সহজ হয়ে গিয়েছে। আর এখনতো রীতিমতো ডে ইভেন্ট শুরু হয়ে গেছে সাকাতে।
২য় বারে সাকার চূড়ায় যখন যাই তখন ভোরের মেঘের চমৎকার ভিউ পেয়েছিলাম কিন্তু জয়ের ফিলিং ১ম বারের তুলনায় হাজার ভাগের একভাগও অনুভূতি হয়নি।
ঘন্টার পর ঘন্টা রাতে ট্রেকিং, জিপিএস ট্রেক না থাকা, ধারণা উপর ভর করে আগানো, বারবার রাস্তা হারানো, নেফিউ ঝিরির বিশাল বিশাল সব পিচ্ছিল বোল্ডার, খাড়া পথে উঠা–নামা, জোকের অবিরাম আক্রমণ, ঘন ঝোপ–জঙ্গল, আর্মি–বিজিবি আর মামুদের সাথে লুকোচুরি খেলা, কি ছিল না আমাদের সেই ট্রেকে?
এই ট্রিপের কিছু স্মৃতি কেবলমাত্র একান্তই আমাদের পাঁচজনের হয়ে থাকবে আজীবন, হয়তো কখনোই তা কাউকেই বলা হয়ে উঠবে না, বুঝানোও যাবে না।
ঠান্ডা মাথায় ভাবলে আমাদের শেষ দিকের এক্টিভিটিগুলো পুরোই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য পাগলামী মনে হচ্ছে এখন। এটা সহজ গমনযোগ্য কোন ট্রেক হলে আমি কখনোই শেষ দিকের সেই পাগলামি গুলো করতাম না, নিশ্চিত ফিরে আসতাম।
আন্তরিক ধন্যবাদ এবং অবিরাম ভালোবাসা টিম মেটদের……
Md Billal Hossain
শাকিল চৌধুরী শুভ
Salma Patowary
Monir Hossain Sajid
মূল লেখা : কামরুল হাসান ভুঁইয়া